আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -৩৫

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(35)

হসপিটালে অ্যাডমিট করা হয়েছে আদিলকে। ডক্টর চেকআপ করছে। এদিকে কান্না করতে করতে নূর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় পাশের কেবিনে শিফট করা হয় তাকে। হসপিটাল করিডোরে পায়চারী করছেন আদিলের আব্বু। স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে শান্তনা দেন।

টেনশনে নখ কামড়ে নূরের কেবিনের দিকে তাকায় হিয়া। ডক্টরকে বেরিয়ে আসতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় সবাই।

“কংগ্রাচুলেশন উনি মা হতে চলেছেন।”

খুশির খবরেও খুশী হতে পারছেনা কেউ। আদিলের কি অবস্থা কেউ এখনো জানেনা। হঠাৎ করেই কোথা থেকে কি হয়ে গেল কারোরই মাথায় আসছেনা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলেন আদিলের কেবিনের দিকে তাকিয়ে।

ভোর রাতের দিকে মাত্র দুচোখে বন্ধ করেছিলো হিয়া হঠাৎ করে ডক্টরের কথা শুনে এগিয়ে গেলো সেদিকে।

“আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছেন উনি। বিষ শরীরে অনেকটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। আর একটু দেরি হলে ওনাকে বাঁচানো যেতনা। আমাদের হাতে সময় কম দেখে আমরা অপারেশন শুরু করে দিয়, কিন্তু এটা পুলিশ কেস। আপনাদের পুলিশকে ইনফর্ম করা উচিত।”

“বিষ? এসব কি বলছেন? বিষ কিভাবে?”

“জ্বী ওনার শরীরে বেশ কড়া ডোজের বিষ পাওয়া গেছে”

কথাটা শুনেই থমকে গেল সবাই। বিষ! কিন্তু বিষ কিভাবে এলো আদিলের শরীরে? তবুও আদিল যে এখন বিপদমুক্ত এটা ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই।

হসপিটাল বেডে শুয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে আদিল নূরের দিকে। বর্তমানে কেবিনে দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। আদিলের সাথে দেখা করে একে একে সবাই বাড়ি ফিরে গেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। যেতে না চাইলেও নূর জোর করেই পাঠিয়েছে তাদেরকে। এখন নিজের সিদ্ধান্তের উপর আফসোস হচ্ছে নূরের। একা পেয়ে যেভাবে তাকিয়ে আছে আদিল ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা নূরের। আদিলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতেই,

“এদিকে তাকাও”

রাশভারী কন্ঠে বলা আদিলের কথায় কেঁপে ওঠে নূর। ভয়ে ভয়ে তাকায় আদিলের দিকে।

“কিভাবে হলো?”

“ককককি?”

“বুঝতে পারছনা কিসের কথা বলছি? কনসিভ কিভাবে করলে?”

“আআসলে আমি মেডিসিন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম ”

“আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করনি একবারও? কি ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি?”

“আপনাকে বললে কখনোই রাজি হতেন না, তাই আপনাকে বলিনি। সারাদিন বাড়িতে একা থাকি আমি, আম্মু তো নিজের মতো ব্যাস্ত থাকেন। তাই আরকি।”

“একদম মেরে গাল লাল করে দেবো, বেয়াদব মেয়ে। আমার কাছে মিথ্যে বলা! আমি কি জানিনা তুমি ফুফির কথায় বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছ।”

আদিলের ধমকে কেঁপে উঠলো নূর। জলে টইটুম্বুর করা চোখের দিকে তাকিয়ে আর রাগ করে থাকতে পারলোনা আদিল। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো নূরকে।

“দেখি কাছে এসো।”

“ননননা থাক”

“আসতে বলছি কিন্তু।”

ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায় নূর আদিলের দিকে। কাছাকছি আসতেই আদিল হেচকা টানে বুকের উপর নিয়ে আসে নূরকে।

“আই অ্যাম সরি নুরপাখি।”

আদিলের এমন আদুরে কণ্ঠ শুনে বুকে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে নূর। নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আপনি জানেন কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কাল রাতে যখন আপনি ওরকম করছিলেন আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছিলো। কিন্তু খাবারে বিষ কিভাবে এলো বুঝতে পারছিনা।”

“সেটা পরে ভাবা যাবে। আগে তাকাও তো দেখি আমার দিকে। কেঁদে কেটে কি অবস্থা করেছে।”

“নুরপখি!”

“হু”

“ভুল বুঝনা আমায় প্লিজ। তুমি নিজেই এখনো ছোটো আছো। একটা বাচ্চা আর একটা বাচ্চাকে সামলাবে কিভাবে শুনি? আমি তোমার কথা ভেবেই এতদিন কোনরকম প্ল্যান করিনি। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি আমাকে আমার জীবনের সবথেকে বড়ো গিফ্ট দিয়েছো। এজন্য বোধহয় মরতে গিয়েও বেঁচে ফিরেছি। আমি অনেক খুশি নূর।”

নূরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাখা আদিলের বন্ধ চোখের পাতা থেকে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো নূরের বাহুতে। সবটা বুঝে প্রশান্তির হাসি হাসলো নূর।

আজ দুদিন পর বাড়ী ফিরে আদিলকে লাগেজ গুছাতে দেখে অবাক হয়ে যায় নূর। কোনোকিছুর উত্তর না দিয়ে দুটো লাগেজে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নূরের হাত ধরে নীচে নেমে আসতেই মুখোমুখি হয় আদিলের আম্মু।

“কোথায় যাচ্ছো তোমরা এভাবে কাউকে কিছু না বলে? মাত্র তো হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরলে আদিল, যেখানে যাওয়ার কিছুদিন পর নাহয় যেও।”

“আমরা একেবারের জন্য এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এবার তুমি নিজের পছন্দের মানুষজনকে এই বাড়ীতে এনে রাখতে পারো, আর কেউ বাঁধা দেবেনা। যে পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলে সেই পথের কাটা সরিয়ে ফেললাম। ভালো থেকো।”

“এসব কি বলছিস বাবা। আদিলের বাবা এসে দেখে যাও কি বলছে আদিল।”

আদিলের কথায় চমকে ওঠে নূর। আদিল যে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি সে। আদিলকে কিছু বলতে গেলেই চোখ পাকিয়ে তাকায় আদিল। ভয়ে মাথা নিচু করে নেয় নূর।

“আমার ভাবতেও অবাক লাগছে তুমি আমার মা। যে কিনা অন্য এক জনের কথায় একটা নিরীহ মেয়েকে মেরে ফেলতে চায়। সেদিন যদি নূরের পায়েসের বাটি থেকে আমি পায়েসটা না খেতাম তাহলে আজ এই অঘটন নূরের সাথে ঘটতো। আমার অনাগত সন্তান জন্মের আগেই শিকার হতো এক ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার। নূর আমার কাছে কি সেটা বিয়ের এত বছরেও বোঝনি তুমি? বলো বোঝনি? তবে কেনো সবসময় ফুফির কথা শুনে নূরকে যা তা শোনাতে? ওর যদি কিছু হয়ে যায় তোমার এই ছেলেকে বাঁচাতে পারতেনা। এরকম একটা বাড়িতে আমি কখনও আমার স্ত্রী, সন্তানকে নিরাপদে রেখে যেতে পারবনা। যেখানে আপন মানুষগুলোই মুখোশ পরে থাকে। চলো নূর।”

নূরের হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে যায় আদিল। আদিলের মায়ের বলার মত কিছুই ছিলনা। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে দেখতে লাগলেন তার ভরা সংসার শুন্য হতে।

____________

“এই সময়ে কেনো এলি তুই বলতো? যেখানে নিজেও জানিনা আমার ভবিষ্যৎ কি, সেখানে তোকে কিভাবে জন্ম দেবো আমি। তোর মা যে বড্ড অভাগা সোনা।”

ডান হাতে পেটের মাঝবরাবর স্পর্শ করে অভিযোগের গল্প জুড়েছে অরুনিকা।

পরেরদিনই হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে দেয় আদাভানকে। হাঁটা চলা করতে পারলেও হাতে আর মাথায় বেশ জখম হয়েছে। সেই ঘটনার পর আদাভান অরুনিকার সাথে একটা কথাও বলেনি। চাপা অভিমান জমে আছে অরুনিকার প্রতি।

সুপের বাটি নিয়ে রুমে ঢুকতেই আদাভানকে খালি গায়ে শার্ট পরার চেষ্টা করতে দেখে বেশ লজ্জায় পড়ে যায় অরুনিকা। আড়চোখে তাকাতেই দেখলো হাতের ব্যাথার জন্য কোনোভাবেই পরতে পারছেনা আদাভান শার্টটা। সুপের বাটিটা পাশে টেবিলে রেখে আস্তে করে শার্টটা পরাতে যায় অরুনিকা।

“লাগবেনা আমার। আমি পারবো।”

” হুম। এতক্ষন কতো পারলেন দেখলামই তো।”

অরুনিকাকে মুচকি হাসতে দেখে আরো রেগে যায় আদাভান।

“আর ইউ কিডিং উইথ মি?”

“একদমই না। আমি কেনো মজা করতে যাবো আপনার সাথে। আমি তো শুধু আমার বরকে সাহায্য করছি।”

“দূরে যাও আমার থেকে। একদম কাছে আসার চেষ্টা করবেনা।”

“আপনার পায়ে তো ব্যাথা নেই, তবে কোলে বসেছি সমস্যা কি? আমার তো আমার বরের কোলে বসতে দারুন লাগে।”

“অরু”

” উফ দেখুন আমি আপনার একদম কাছে, খুউউউব কাছে বসে আছি। এতো জোরে চিল্লাচ্ছেন কেনো।”

আদাভান চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে নিজেদের চার ঠোঁট এক করে দেয় অরুনিকা। ছোটো ছোটো আদরে ভরিয়ে দেয় আদাভানকে। বেশ কিছুক্ষন পরে আদাভানকে ছেড়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

“এতো বাহানা করার কি আছে, আপনারই বউ তো। যখন ইচ্ছে মিষ্টি খেতে পারেন। এর জন্য নিজেকে তিতা করলা প্রমাণ করার দরকার নেই।”

বাটির সুপটুকু আদাভানকে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন বক্স থেকে ওষুধ বের করে খাইয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় অরুনিকা সেগুলো কিচেনে রেখে আসতে।

“আমি জানি প্রাণপাখি তুমি এগুলোর সম্পর্কে কিছু জানতেনা। তোমার অগোচরে গেম সাজিয়েছে মাষ্টার মাইন্ড। যদিও সেদিন কিছুক্ষনের জন্য ভুল বুঝেছিলাম আমি তোমাকে। আমি শুধু তোমাকে বোঝাতে চাই, ভালোবাসার মানুষের অবহেলা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক। তবে চিন্তা করোনা তোমার মত একা ছেড়ে যাবনা আমি। সারাক্ষণ পাশে পাশে ঢাল হয়ে থাকবো তোমার। কারণ আমার সবকিছু শুধু তোমাকে ঘিরে। আজ থেকে নয় বহু বছর আগে থেকে।”

সকাল সকাল ফোনের রিংটোন ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে বাম হাতে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে অরুনিকা। ওপাশের মানুষটার কথা শুনে সব ঘুম উবে যায় অরুনিকার।

“আম্মু, কি বলছো তুমি? খালামণি!”

আর কিছুই বলতে পারলোনা অরুনিকা। বিশাল এক ধাক্কা পেয়ে শকের মধ্যে থাকা অরুনিকাকে একহাতে জড়িয়ে নেয় আদাভান। আদুরে কন্ঠে বলে,

“কি হয়েছে প্রাণপাখি? কে ফোন করেছিলো?”

“খালামনি! খালামণি আর নেই। খালামণি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আদাভান।”

চলবে?
#Fiza Siddique

পরের পর্বে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিরাট চমক। সবাইকে অনুরোধ একটু বেশি বেশী করে কমেন্ট আর রিয়েক্ট দেবেন আইডি আর পেজে। দুটোতেই রিচ কমে গেছে অনেক🥲

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here