আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -৩৬

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(36)

বেশ কয়েকদিন ধরে উশখুশ করে অবশেষে আজ বেরিয়েছে। না জানা পর্যন্ত কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা অরুনিকা। আদাভানের ভুল বোঝা মেনে নিতে পারছেনা। অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সহ্য করার নয়। পথভ্রষ্ট হওয়া অরুনিকাকে এখন কাব্যই একমাত্র সঠিক পথ বলে দিতে পারবে।

কাব্যকে না জানিয়েই এসেছে অরুনিকা। কাব্যকে চমকে দিতে গিয়ে যে নিজেই জীবনের সবচেয়ে বড়ো চমক খেয়ে বসবে ভাবেনি অরুনিকা।

“ঠিকই বলেছো তুমি। বর্ষা কতো বোকা ছিলো, নাহলে এতো সহজে আমাদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলতনা। আহা, কি বিশ্বাস করতো আমাকে। হা হা হা।”

“সম্পত্তির জন্য খুব সুন্দর করে ভালোবাসার নাটক করে যাই আমি বর্ষার সাথে। প্রথম দিকে তো পাত্তাই দিতনা, আমিও ভাবতাম একসময় দুর্বল হয়ে পড়বে ঠিকই। তাই আরোও বেশি করে কেয়ার দেখাতে থাকি। কিন্তু ওই বর্ষা তো ভালোবাসতো আদাভানকে। ক্লাসমেট হওয়ায় বেশিরভাগ সময় কাটাতো ওই আদাভানের সাথে, এদিকে নিজের প্ল্যান সফল হচ্ছিলনা দেখে আমি পাগলপ্রায়।”

মেইন ডোর খোলা থাকায় খুব সহজে ভেতরে প্রবেশ করে কাব্যের রুমের দিকে এগোতেই কারোর কথা শুনে থেমে যায় অরুনিকা। খালামণির রুম থেকে আসা শব্দে সেদিকে এগোতেই শুনতে পায় কাব্য কারোর সাথে কথা বলছে ফোনে। ডাকতে যাবে এমন সময় কথাগুলো শুনে থমকে যায় অরুনিকা। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় যেনো।

“আদাভান তো কখনো বর্ষাকে ভালোই বাসেনি। বেষ্ট ফ্রেন্ডের থেকে বেশি কিছু মনেই করতোনা। এদিকে বর্ষার প্রপোজাল পেয়ে আদাভান বেষ্ট ফ্রেন্ডকে কিভাবে বোঝাবে বুঝতে না পেরে কলেজ ছেড়ে দেয়, সাথে এই শহর থেকেও অনেক দূরে চলে যায়। আর সেই সময় আমি হয় বর্ষার সাহারা। কান্নার জন্য এগিয়ে দি নিজের কাঁধ। আসতে আসতে জেনে নিই আদাভান সম্পর্কে সবকিছু। তারপরেই চালি মোক্ষম চাল, আদাভানের আইডি খুঁজে সেখান থেকে কিছু পিক নিয়ে নতুন আইডি খুলি। সেটা দিয়ে রিকোয়েস্ট দিয় বর্ষাকে আর বলি এটা নতুন আইডি। বর্ষাও সহজ মনে বিশ্বাস করে নেয় আমার কথা। এদিকে আদাভান বর্ষার পাগলামি দেখে নিজে থেকে সরে যায়, ফোন নম্বর বদলে ফেলে সাথে যোগাযোগও বন্ধ করে দেয় একেবারেই। কোথাও থেকে যোগাযোগের রাস্তা খুলে রাখেনা।”

কাব্য থামতেই ওপাশের মানুষটা কিছু বলে উঠলো যা অরুনিকা অব্দি পৌঁছালো না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অরুনিকা বাকি সবটা জানার জন্য। মুখ চেপে ধরে কান্না করে যাচ্ছে অনবরত।

“আদাভান সেজে বর্ষার সাথে প্রেমের নাটক শুরু করলাম। অনেকবার কলে কথা বলতে চাইতো কিন্তু আমি কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে কথা ঘুরিয়ে দিতাম। তবে মানতে হবে বর্ষা আদাভানের প্রেমে একেবারে পাগল ছিলো। এরকম প্রেমে পাগল মেয়ে আমি দেখিনি। আমিও মনে মনে ভাবতে থাকলাম এর পরে কি করা যায়। তারপর তুমি বললে আসল কাজের কথা। প্রথমে তো অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম, যদি কাজ না করে কোনোভাবে তাহলে আমাদের সব শেষ হয়ে যেত। বর্ষা সব জেনে যেতো। ফুলপ্রুভ আরোও একটা ব্যাকআপ প্ল্যান বানালাম। অনেকবার আকারে ইঙ্গিতে ওর সাইন নেওয়ার চেষ্টা করেছি, এমনকি বিয়ের নাম করে রেজিষ্ট্রি অফিসে নিয়ে গিয়ে প্রপার্টি পেপারে সাইন করিয়ে ওখানেই শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এসবে বাদ সাধলো ওই বুড়ো, বর্ষার বাপ। বয়স হয়েছে এখন তো মরার বয়স হয়েছে অথচ না মরে আমাদের প্ল্যানে বাধা দিয়ে দিল। যেদিন লুকিয়ে বিয়ে করার কথা ছিল সেদিনই ওই বুড়োর মিনি স্ট্রোক হওয়ার ছিলো। বর্ষাকে তারপর কিছুদিন এসব ব্যাপারে আর কিছুই বলা গেলোনা। বাপভক্ত মেয়ে কিনা!”

এসব শুনে অরুনিকার দাড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ে। একের পর এক ধাক্কায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ। আপন মানুষগুলোর এমন বহুরূপী আচরণে ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। কাব্যের করা কাজে পাথরে পরিণত হয়েছে। প্রতিটা শব্দ এক একটা তীরের মতো বিধছে বুকে। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে এই মানুষটাকে সে এত স্নেহ করতো, নিজের ভাইয়ের জায়গায় বসিয়েছিল। পরিবারের সবাই নিজের ছেলের মতো আগলে রাখে সবসময়, অথচ তারা জানেই না দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে। ক্লান্ত শরীরটাকে দেওয়ালে ঠেকিয়ে রেখেছিলো এতক্ষন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দেহের ভার রাখা দায় হয়ে পড়ছে অরুনিকার কাছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে অরুনিকা। কান্নায় ভারী হাওয়া বুকে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গাটাও যেনো অবশিষ্ট নেই। শ্বাসনালীতেও যেনো কান্নার ভীড় জমিয়েছে।
______________

নূরকে নিয়ে নতুন এক বাড়িতে উঠেছে আদিল। তাদের স্বপ্নের বাড়ি। নূরের পছন্দমতো সাজিয়েছে আদিল এই বাড়িটাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশে শুয়ে থাকা রমণীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিল। প্রেগন্যান্সির পর মেয়েটা আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেছে। হালকা হেঁসে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই ঘুম ভেংগে যায় নূরের। ঘুমঘুম চোখে তাকায় আদিলের দিকে। নূরের দিকে আরও খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

“গুড মর্নিং জান।”

“গুড মর্নিং। কখন উঠেছেন আপনি?”

“এইতো মাত্র উঠে আমার বউটাকে দেখছিলাম।”

“আজকাল কি আমার রুপ উতলে পড়ছে নাকি? সবসময় কেমন তাকিয়ে থাকেন।”

“হু পড়ছে তো। দিন দিন আরো গোলুমোলু আর কিউট হচ্ছো। দেখলেই মনে হয় একটু কামড়ে দিয়।”

“ছিঃ অসভ্য হচ্ছেন দিন দিন”

“বেশি সভ্য হলে এইযে এ আসতনা।”

আদিলকে একদৃষ্টিতে পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেদিকে তাকায় নূর। ঘুমের কারণে পেটের কাছের অংশের শাড়িটা সরে গিয়ে উন্মুক্ত। তারাহুরো করে শাড়ী দিয়ে পেট ঢেকে নেয় নূর। নূরের কর্মকাণ্ডে আদিলকে বেশ জোরে হেঁসে উঠতে দেখে ভেবাচেকা খেয়ে যায় নূর। নূরকে দুইহাতে টেনে কোলের উপর বসিয়ে আদিল ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

“আরো কিছু দেখার বাকি আছে বুঝি জান?”

লজ্জায় রাঙ্গা চেহারা লুকাতে আদিলের বুকে মুখ গুঁজলো নূর।

“শুনুন আমার কিন্তু একটা ছেলে চাই। ঠিক আপনার মতো। বেবি আদিল।”

“হুশ আমি বেবি নূর আনবো দেখো।”

“নাহ নাহ কোনোভাবেই নাহ। আর কোনো নূরের জন্ম যেনো না হয় এই পৃথিবীতে। একদম এসব কথা বলবেন না আপনি।”

“শান্ত হও নূর। আমি আমার নূরের নূরানী চেহারায় বেবি নূর চাই। যার জন্য আসবে এক আদিল। সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আগলে নেবে, দুঃখগুলোকে সুখ করে ফিরিয়ে দেবে তার জীবনে।”

“সত্যি আমি অনেক লাকি আপনাকে পেয়ে। আমার মত পরিবার হয়তো অনেকে পায় তবে আপনার মতো স্বামী সবার জীবনে থাকেনা। প্রত্যেকটা সময় ঢাল হয়ে থেকেছেন। আচ্ছা, আমি যদি বেবিকে পৃথিবীতে আনতে গিয়ে মারা যাই আপনি কি আর একটা বিয়ে করবেন?”

” নূর”

“বলুন না। পেপারে তো দেখি কতো মানুষ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। আমিও যদি চলে যায় না ফেরার দেশে তবে একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নেবেন। আমার বাবুকে শুধু একটু আগলে রাখিয়েন, আমার আর কিছুই চাইনা।”

“নূর প্লিজ লক্ষিটি চুপ করো। কেনো জেনে বুঝে কষ্ট দিচ্ছ আমাকে? তোমার এই কথাগুলো কি পরিমাণ আঘাত করছে আমাকে বুঝছোনা? দেখো আমার মুখের দিকে, তাকাও, দেখতে পারছো কতোটা পুড়ছি আমি? আমার সন্তান চাইনা নূর। আমি শুধু তোমাকে চাই।”

“আমার আমিটা আর আমি নেই হয়ে গেছো তুমি।
আমার আমিতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে তুমি।”

“দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়ে আমার তুমি চাই, শুধুই তুমি। তোমার এক অংশ আমি কাওকে দিতে পারবনা। আমার একটা সেকেন্ডের ভাবনায় থাকার অধিকারও আমার নূরপাখি ছাড়া আর কারোর নেই। কারোর নাহ। তুমিই ছিলে, তুমিই আছো, আর তুমিই থাকবে। ফর এভার অ্যান্ড এভার।”

“এই তাকান এদিকে। তাকাতে বলছি কিন্তু। পাগল হয়ে গেছেন? আদিল! আপনি কাঁদছেন?”

“বাইরে সবার কাছে অতীব কঠোর মানুষটাকে মোমের মতো নরম করে দিয়েছো তুমি নূর। এতোটা দুর্বল তো আমি কোনোকালেই ছিলাম না। কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমি বরাবরই দুর্বল। বড্ড দুর্বল।”

আদিলের কোলের মধ্যে আরো জড়োসড়ো হয়ে নূর ডানহাতে স্পর্শ করলো আদিলের গাল। হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে আবেগী কণ্ঠে বলে উঠলো,

“মিষ্টার রাগীর মন যে এতো কোমল আগে জানতাম না তো!”

“হুহ না জানলে নাই। মজা করছো করো যাও।”

“হা হা হা।”

“তবেরে দাড়াও হচ্ছে তোমার।”

খুনসুঁটিতে মেতে উঠলো আদিল আর নূর। সেদিন অনেক বোঝানোর পরও নূরের একটা কথাও শোনেনি আদিল। বরং ওই বাড়িতে যাওয়ার কথা বললেই ভীষণ রেগে যায়। নূরও অপেক্ষায় আছে সময়ের সাথে রাগগুলো কমে যাওয়ার। মায়ের প্রতি বেশিদিন রাগ করে আদিল থাকতে পারবেনা সে জানে, তাই কিছুটা সময় নিজেদের মতো কাটাবার তাগিদে এসব নিয়ে আর জোর করেনা।

চলবে?
#Fiza_Siddique

এক পর্বে সব রহস্য দেওয়া সম্ভব হলোনা। পরের পর্বে উন্মোচন হবে পুরো রহস্য। আপনাদের মতামত দিয়ে পাশে থাকবেন। সাথে নতুন গল্পের প্রতিও একটু ভালোবাসা দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here