আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ১২, ১৩
.
গ্রামে হাসপাতালের জন্য কাজ শুরু করতে পারছিলাম না কিছুতেই। যতবার চেষ্টা করেছি, মতি কাকা এসে বাঁধা দিয়েছেন। শুনতে পেয়েছিলাম গ্রামে হাসপাতাল নির্মানের জন্য সরকার অনুদান দিয়েছিল। কিন্তু সেই অনুদানের টাকা হাসপাতাল নির্মানের কাজে লাগেনি। রাঘব-বোয়াল, চুনোপুঁটি সবাই আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। প্রহরের চিন্তা বাড়তে লাগল। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মনি মা ও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন।
স্বাস্থ্য দফতরে আমাদের ফাইল যাচ্ছিল না। সনদ দিচ্ছিল না কিছুতেই। গ্রামের পরিচিত কিছু মুখ আশার আলো হিসেবে আর এক বছর অপেক্ষা করতে বলতো। আর এক বছর পর নির্বাচন ছিল। মতি কাকার জেতার চান্স কম ছিল। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম….. কঠিন অপেক্ষা।
প্রথম বিবাহ বার্ষিকী নিকটে ছিল। কিন্তু আমাদের মন ভালো ছিল না। কোন কিছুতে শান্তি পাচ্ছিলাম না। হাসপাতাল শুধু যে আমার আব্বার নামে করা হচ্ছিল তা নয়। আমি আমার শ্বশুর মশাইয়ের নামও সংযুক্ত করে ছিলাম তাতে।
” কাজি আমির উদ্দিন হাসপাতাল”…..
.
এই এতো চিন্তার আর অশান্তির মাঝে আমাদের জীবনে নতুন মানুষের আগমন ঘটে।
চিন্তাশীল রাজ্য সজ্জিত হয়ে উঠে খুশির বর্ণিল সাজে। মনি মা, প্রহর, আত্মীয়স্বজন সবাই মেতে উঠে আনন্দে। মনে হচ্ছিল, রুক্ষ মরুভূমিতে আমাদের অনাগত সন্তান পরিতৃপ্তির বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে।
ভাবতেই ভালো লাগছিল আমাদের বাড়িতে কেউ গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়াবে, আধো আধো বুলিতে কথা বলবে, ছোট ছোট হাত দিয়ে গাল ছুঁয়ে দিবে। জীবনের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা অনুভব করছিলাম।
মাঝে মাঝে তো এমনও হয়েছে আমি পেটে হাত দিয়ে আমার ভিতরে বেড়ে ওঠা অংশের সাথে কথা বলতে বলতে দুপুর পার করে দিয়েছি।
অবশ্য মনি মা, প্রহর এরা দুজনেই আমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে ছিল প্রচুর কনসার্ন। আমি কী খাচ্ছি, কখন ঘুমাচ্ছি, কতক্ষণ পড়বো, কতক্ষণ টিভি দেখবো এসব নিয়ে দুজন মিলে রুটিন তৈরি করে ফেলেছিল।
এমন কী প্রহর বাজার থেকে বই কিনে নিয়ে এসেছিল।
“How to be a good father…”
মাঝে মধ্যে এসব অসহ্য লাগতো। আবার মাঝে মধ্যে ভালো লাগতো… ভীষণ ভালো লাগতো।
প্রহরের কাণ্ডকারখানা দেখে হাসি পেত। বলতাম,
-” এভাবে ভালো বাবা হওয়া যায় না। এটা ন্যাচারাল।”
-” আরে আগে কখনো বাবা হয়েছি নাকি? এই প্রথম। ভয় লাগছে। আমি ভালো বাবা হতে পারবো তো?”
-” কেন পারবে না?
হুমায়ূন আহমেদ স্যার বলে গিয়েছেন – পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ রয়েছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।
বাবা হওয়া অনেক সৌভাগ্যের জানো? তুমি তোমার সন্তানের প্রথম আশ্রয়কেন্দ্র হবা। তোমার সন্তান তোমাকে সুপারম্যানের সাথে তুলনা করবে। তুমি হবা ওর চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্র।”
-” উইশ বক্স?”
-” জি হ্যাঁ।”
-” তাহলে তুমিও একটা উইশ করে ফেলো। দেখি পূরণ করতে পারি কী না।”
-” কেক খেতে ইচ্ছে করছে। রেড ভেলভেট। ”
-” জো হুকুম উড বি মাদার। আমি করে নিয়ে আসছি।”
-” এই রাত দুটোয় তুমি সত্যি কেক বানাবে?”
-” তোমার জন্য না। আমার বাবুর জন্য। আমি ওর উইশ বক্স না? ”
.
প্রেগন্যান্সির সময়টা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। খেতে পারতাম না কিছু। কয়েকটা মাছ যেমন – পাঙাশ, কৈ, সিলভার কাপ, মৃঘেল, পুঁটি দেখলেই বমি চলে আসতো। মনি মা ছোট মুরগির পাতলা ঝোল করে দিত, তাই খেতাম। মাঝে মাঝে ভাত খেতে পারতাম না। প্রহর স্যুপ বানিয়ে জোর করে খাওয়াত। দুধ, ডিম খাবো না খাবো না বললেও আমাকে জোর করে খাওয়ানো হতো। পাঁচ মিনিট পর আবার বমি করে ফেলতাম। প্রহর বাসায় থাকলে তখন মনি মা কে বলতো,
-” মা পনেরো মিনিট পর আরেকটা দেশী মুরগীর ডিম ওকে সিদ্ধ করে দিবা।”
এই কথা শুনে আমি আবার বমি করতে দৌড় দিতাম। ওরা মজা পাচ্ছিল আমার অবস্থা দেখে। একটু অতিরিক্ত ঢং করতাম। এই যেমন,
-” মনি মা বাবু বলছে সে আর খেতে পারছে না।”
-” ওহ, তাইলে তুই খা।”
-” আরে বাবুর পেট আর আমার পেট তো এক।”
-” তাইলে বাবু বললো খেতে পারছে না অথচ তুই তো একবারও বললি না -মনি মা আমি খেতে পারছি না।”
নিজের কথায় তখন নিজেই ফেঁসে যেতাম।
.
পড়ায় যাতে পিছিয়ে না পড়ি সেজন্য প্রহর আমাকে নোট বানিয়ে দিত। আমি শুয়ে বসে সেগুলোই পড়তাম। মনে মনে তখন বলতাম,
এমন আরামের জীবন পেলে প্রতি বছর একটা করে বাচ্চা নেওয়া যায়।
কিন্তু যখন খারাপ লাগত, বমি বমি ভাব হতো তখন মনে হতো মা হওয়া সত্যি অনেক বিশাল ব্যাপার।
আমার মতো প্রহরও মাঝে মাঝে আমার পেটে হাত দিয়ে বাবুর সাথে কথা বলতো। আমি প্রায় দুপুরেই ঘুমাতাম। ফলাফলে রাতে আর ঘুম আসতো না। তখন সারাদিন রুগী দেখে ক্লান্ত হওয়া প্রহর ক্লান্তির ছিটেফোঁটাকে বিদায় জানিয়ে সারা রাত আমার সাথে বসে থাকত। অর্ধ খোলা বারান্দায় বসে দুজনে গল্প করতে করতে রাত পাড় করতাম। কখনো কখনো এমনও হয়েছে আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোরে যখন চোখ খুলেছি তখন ও মিষ্টি হেসে বলে উঠত,
-” শুভ সকাল ঘুম পরী। আপনার জন্য চমৎকার একটি সকাল অপেক্ষা করছে আজ। সামনে তাকান..”
ধরণীর বুক চিড়ে লাল উদীয়মান সূর্য আকাশে উঁকি দিয়ে সারাপাশ আলোকিত করে তুলত। হালকা নীল আকাশ লাল সোনালি আভায় নব রূপ ধারণ করত। আমি প্রহরের কাঁধে মাথা রেখে ওর হাত জড়িয়ে নতুন দিনের সূচনা করতাম।
.
আমার ডেলিভারির দিন আমার চেয়ে বেশি টেনশনে ছিল প্রহর। স্ট্রেচারে করে আমাকে যখন ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন প্রহর আমার হাত ধরে ছিল। ও আমাকে সান্ত্বনা দিবে কী বরং উল্টো আমাকেই ওকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছিল।
প্রচণ্ড ব্যাথা সত্ত্বেও ওর একহাত আমি দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,
-” চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এ এতো চিন ন্তা কর ছো কে ন? আমি আ ছি না?”
ডেলিভারির সময় প্রায় সব গর্ভবতী মায়েদের মানসিক অবস্থা একরকম থাকে। অনেকেই মনে করে সে হয়ত আর বেঁচে ফিরতে পারবে না। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। ভয় হচ্ছিল খুব। নিজেকে নিয়ে…. নিজের অনাগত সন্তানকে নিয়ে।
.
ছোট পিহুকে যখন প্রহর প্রথম আমার কোলে দেয়, মনে হচ্ছিল এক টুকরো সুখ কেউ আমার থলিতে ভরে দিয়েছিল। বুকের সাথের জড়িয়ে ধরেছিলাম মেয়েটাকে। অন্তরে শান্তির কোমল হাওয়া বয়ে গিয়েছিল।
“পিহু” নামটা মনি মা’র দেওয়া। প্রহরের মেয়ে পিহু। বাবার আদরের ধন। ছোট পিহু সারাদিন ঘুমাত। আর খালি রাত জাগত। প্রহরও মেয়ের সাথে রাত জাগত। মেয়ের সাথে গল্প করত। যদি বলতাম,
-” তুমি ঘুমাও প্রহর। সকালে চেম্বারে যেতে হবে। ডিউটি আছে। আমি দেখছি পিহুকে।”
প্রহর তখন গাল ফুলিয়ে বলতো,
-” তুমি তোমার বেলায় ঠিক আমার সময় আদায় করে নিয়েছ। তোমার সাথে রাত জাগতাম না? আমার পিচ্চি প্রিন্সেস কিছু বলতে পারে না বলে তুমি ওকে ওর আদর থেকে বঞ্চিত করতে পার না। হিংসুটে মহিলা।”
আসলেই পিহু ওর বাবার প্রিন্সেস। ওর ছোট থেকে বড় হওয়া সব ছবি, ভিডিও প্রহর যত্ন করে রেখেছে। ওইটুকু পিচ্চি বাচ্চার আগে পিছে দৌড়াত ক্যামেরা নিয়ে। বাইরে গেলে বাপ-মেয়ে একই রঙের জামা পড়তো। পিহুর সব মুমেন্ট ক্যাপচার করার জন্য প্রহর সব সময় হাতে ক্যামেরা রাখত। আমি হাসতাম ওর কাণ্ড দেখে।
.
পিহুর জন্মের ছয়মাসের মাথায় গ্রামে হাসপাতাল নির্মানের কাজ শুরু হয়। প্রহর শার্টের কলার নাচিয়ে তখন বলেছিল,
-” দেখলা অতিথি, আমার মেয়ে হলো আমার জন্য লাকি চার্ম।”
পিহু বাবা বলতে অজ্ঞান ছিল। প্রহর বাসায় না থাকলে ও সারাক্ষণ ওর বাবাকে খুঁজত। আর ওর বাবা যখন বাসায় ফিরত, হাসি যেত না ওর ঠোঁট থেকে। প্রহর আমার মেয়ের দুনিয়া। এমনকি পিহু প্রথমে “মা” না বলে বলেছিল “বা বা”।
প্রহর সেদিন খুশিতে কেঁদে ফেলেছিল।
.
মনি মা, প্রহরের প্রচেষ্টায় আমি ইন্টার্নি শেষ করি। এতো কিছুর পরও যে নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে পারব তা কখনোই ভাবিনি। মনি মা বলতেন,
-” অতিথি আমি নিজের জন্য লড়াই করতে পারিনি। আমি নিজে পিছিয়ে পড়েছি। তবে তোর জন্য আমি শেষ পর্যন্ত লড়বো।”
মনি মা, প্রহর, পিহুকে নিয়ে আমার চলমান জীবন ছিল স্বপ্নে মোড়া এক শহর…..আনন্দ, ভালোবাসা ও খুশির শহর।
ভয় লাগত, আমার মতো অনাথের জীবনে এতো সুখ সইবে তো। মাঝে মধ্যে যে অতিরিক্ত সুখেও মন কু ডাকে।
.
৩০ শে ডিসেম্বর,
পিহুর পঞ্চম জন্মদিন ছিল সেদিন।
দেখতে দেখতেই বাচ্চারা বড় হয়ে উঠে। আমরা বাবা-মা ‘রা ভাবি “ইশ! আমার মেয়েটা খুব দ্রুতই বড় হয়ে উঠছে।”
বাড়িতে সেদিন একটি ছোট খাটো আয়োজন করা হয়।
ছোট পিহুর সাথে প্রহরও বাচ্চা হয়ে উঠেছিল যেন। সকাল থেকে হইচই করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিল দুজন। কেক কাটা, আতশবাজি, স্নো স্প্রে, আর অসংখ্য আলোকসজ্জা দেখে মনে হচ্ছিল কোন মন্ত্রী- মিনিস্টারের বিয়ে। এই আয়োজনের মূল কারণ ছিল আমাদের কলিজার টুকরা আর দুই দিন পর স্কুলে যাওয়া শুরু করবে।
এতো উল্লাসের ভিড়ে আমার চোখ বারবার প্রহরের দিকে চলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ও অসুস্থ; অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু মানুষের মাঝে আমি ওর সাথে কথা বলতে পারছিলাম না।
.
সব কিছু গুছিয়ে উঠতে উঠতে রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল সেদিন। ঘরে এসে দেখি প্রহর ওয়াশরুমে বমি করছিল। ধীরে ধীরে যখন ওকে বিছানায় শুইয়ে দেই তখন ও খিচুনি দিয়ে উঠছিল।
বিগত কয়েকদিন ধরেই আমি ওর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম। ও আমাকে কখনোই কিছু বলতো না। ডাক্তার হয়েও নিজের প্রতি ও খুব যত্নহীন ছিল। গ্রামের চেম্বার, বাড়ি আর পিহুকে সামলাতে যেয়ে আমি প্রহরের দিকে নজর দিতে পারছিলাম না। মেডিকেল সেক্টরে থাকায় ওর সিনটমগুলো দেখে ভয় পাচ্ছিলাম খুব। জোর করে ওকে দিয়ে পরের দিন ওর হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। প্রতি সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার ও গ্রামে রুগী দেখত বিকাল ৫টা থেকে। পরের দিন বৃহস্পতিবার ছিল। আমি গ্রামে ফোন দিয়ে বলে দেই আমরা কেউ আসতে পারবো না।
পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।
ডা. এনামুল হুডা
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
নিউরো সার্জারি বিভাগ।
উনি টেস্ট দেন। সিটিস্ক্যান, এম.আর.আই, ব্লাডটেস্ট…..
আমি শুধু মনে মনে দোয়া পড়ছিলাম। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল ভয়ে।
.
জানুয়ারির এক তারিখ পিহুর স্কুলের প্রথম দিন। স্কুলে সেদিন বই উৎসব। প্রহর আমার সাথে রাগারাগি করে পিহুকে নিয়ে স্কুলে যায়। আমি মানা করি শতবার। ওকে বের হতে দিতে চাচ্ছিলাম না আমি। এমনিতেই অসুস্থ মানুষ।
সকাল এগারোটার দিকে কুরিয়ার আসে প্রহরের নামে। ওর টেস্টের রিপোর্ট। পিহুকে নিয়ে প্রহর তখনো বাসায় ফিরেনি। রিপোর্টে লিখা ছিল,
প্রহরর ব্রেইন টিউমার হয়েছে।
বিনাইন টিউমার নয়। খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ক্যান্সারের ব্রেইন টিউমার (মেলিগন্যান্ট টিউমার)।
.
চলবে….
(