আমার মনকাননে ভ্রমর তুমি পর্ব -০১

” আমাদের দলের ছেলেদের মে’রে’ছেন কেন হেমসিনী?”

” আপনি কি আমার উপর নজর রাখছেন মাহাতিব?”

হেমসিনীর প্রশ্ন শুনে হালকা হাসলো মাহাতিব।

” জ্বি না তবে খবর ঠিকই চলে আসে। এবার কারণটা বলবেন?”

” তারা বা’জে ব্যবহার করেছিলো।”

হেমসিনীর কথা শুনে মাহাতিব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর দিকে তাকালো।

” আপনার সাথে বা’জে ব্যবহার করেছে তারা?” একদম শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো সে।

” না, অন্য একটি মেয়ের সাথে বা’জে ব্যবহার করেছিলো। মেয়েটা কিছু বলতে পারেনি তাই আমিই কাজটা করেছি। এখন কি এরজন্য আমাকে শা’স্তি পেতে হবে?”

দু’কদম এগিয়ে এলো মাহাতিব। খানিকটা ঝুঁকে বললো, ” জ্বি অবশ্যই পেতে হবে।”

” জানতাম। ক্ষমতার অ’পব্য’বহার সবাই করে থাকে, আপনি কেন বাদ পড়বেন। বলুন আপনার দলের বা’জে ছেলেদের মা’রার জন্য আমাকে আপনি কি শা’স্তি দেবেন?” কিছুটা বিদ্রুপ করে বললো হেমসিনী আর তা বুঝতে পেরে মাহাতিব পুনরায় পিছিয়ে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

” শা’স্তিটা আপাতত জমা রইলো, পরবর্তীতে আমার মন চাইলে হিসেব মিটিয়ে ফেলবো।”

উওর শুনে খানিকটা বিরক্ত হলো হেমসিনী। কাঁধে থাকা ব্যাগটা ঠিক করে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সে তবে মাহাতিব হাত বাঁড়িয়ে পথ আটকে ফেললো।

” আমি পৌঁছে দেবো?”

” ধন্যবাদ তার দরকার নেই। আমি সবার কাছ থেকে সাহায্য নেই না৷ আমার যেতে হবে, হাতটা সরালে ভালো হতো।”

হেমসিনীর শেষোক্ত কথাটি শুনে মাহাতিব চোখ নামিয়ে হাতটা গুটিয়ে নিলো। হেমসিনী খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থেমে গেলো। তার থেমে যাওয়া দেখে মাহাতিবের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো।

” নিজের জন্য না হোক অন্তত আপনার বাবার সম্মানের কথা ভেবে হলেও এধরণের কাউকে দলে রাখবেন না। না হলে কেউ আর আপনাদের উপর আস্থা রাখতে পারবেনা। ” র’ক্ষই ভ’ক্ষ” আশা করছি কথাটা আপনার ক্ষেত্রে আমরা পাবোনা। আপনার বাবার উপর জনগণ যে বিশ্বাসটা করেছে, আশা করছি আপনি সেটা ভাঙবেন না এমপি পুত্র আনদ্রে মাহাতিব।”

কথা শেষ করেই দ্রুত স্থানটি ত্যাগ করলো হেমসিনী। খানিকটা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলো তারা, না হলে কেউ দেখলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো দু’জনকেই৷ হয়তো টিভির হেডলাইন হতে বেশিক্ষণ সময় লাগতো না।

হেমসিনী চলে যেতে মুকিত এগিয়ে এলো।

” ভাই আমাদের যেতে হবে। দলের সবাই চলে এসেছে, আপনার অপেক্ষা করছে।”

” মুকিত হেমসিনী যাদের মে’রে’ছে তাদের ট্রিটমেন্ট করাও। এখানের সবচেয়ে ভালো হসপিটালে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করো এবং তা এখুনি।”

মুকিত অবাক চোখে তাকিয়ে ফোনে নম্বর টাইপ করলো।

” আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে না থেকে ফোন করো মুকিত।”

হসপিটালে ফোন করে সবকিছু বুঝিয়ে বললো তাদের। ফোন রেখে সে কিছু বলবে তার আগেই মাহাতিব বললো,

” চলো আমাদের দেরি হয়ে যাবে।”

খানিকটা আড়ালে রাখা গাড়ি মূল রাস্তা এলে মাহাতিব তাতে চড়ে বসলো৷ হাতে থাকা ঘড়ির দিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে কিছু ভাবলো সে।

” মুকিত ছেলেগুলোকে কাল ঠিক এই সময়ে আমার সামনে চাই। একদম ১০ টা বেজে ৪৫ মিনিটে, এক মিনিটও দেরি হলে তোমার ক’পা’লে দুঃখ আছে।”

মাহাতিবের কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো মুকিত। সে হালকা ঘাড় গুড়িয়ে দেখলো মাহাতিব কানে ব্লুটুথ হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে আছে, তা দেখে সে আরো একবার ঢোক গিললো। মাহাতিব মানুষটা কম রা’গে, সবার সাথে শান্ত ভাবে কথা বলতে পছন্দ করে সে। তবে মাঝে মাঝে মাহাতিবের এই শান্ত রূপটাকেই বেশি ভ’য় পাই মুকিত। এই যেমন এখনও ভ’য়ে তার বুকটা ঢিপঢিপ করছে।

” না জানি কোন বে’য়া’দব ছেলেপেলে এধরণের কাজ করেছে। কলি’জায় কত সাহস! না জানি ভাই তাদের সাথে কি করেন। মনে হয়না জ্যা’ন্ত ছাড়বেনা, তার উপর হেমসিনী জড়িয়ে পড়েছে এখানে।”
.
.

নিজের ব্যাগ এবং ছোট ভাইয়ের স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো হেমসিনী। ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও সে আলো জ্বালানোনা। চুপচাপ গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে রইলো। নিস্তব্ধ পরিবেশে কয়েক সেকেন্ড এর জন্য ক্ষীণ একটি শব্দ শোনা গেলো। হাতে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালো হেমসিনী।

” একা বারান্দায় মন খা’রা’প করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন হেমসিনী? ঘুমিয়ে পড়ুন, ভোরে উঠতে হবে তো।”

বার্তাটি পড়ে হেমসিনী বুঝতে পারলো এটি আর কেউ নয় মাহাতিবই পাঠিয়েছে। সে আশেপাশে দেখলো তবে অন্ধকারের কারণে স্পষ্ট কিছুই দেখতে পেলোনা।

” এতো অন্ধকার বারান্দায় উনি কিভাবে বুঝলেন আমি দাঁড়িয়ে আছি?” হালকা শব্দ করে বললো হেমসিনী। কয়েক সেকেন্ড পরেই আবারো মাহাতিবের বার্তা এলো।

” আপনি কি ভেবেছিলেন হেমসিনী অন্ধকারের মধ্যে আমি আপনাকে খুঁজে পাবোনা? সব পরিস্থিতিতে আপনাকে খুঁজে বের করার শক্তি আছে আমার। ঘরে যান, হিমাল একা আছে। দরজা-জানালা ভালো মতো বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ুন। একদম নিশ্চিতে শান্তির ঘুম দেবেন, কোন ক্ষ’তি হবেনা আপনাদের। শুভ রাত্রি হেমসিনী।”

হেমসিনী সময় অপচয় না করেই মাহাতিবকে ফোন করলো এবং তা সাথে সাথেই রিসিভ করা হলো। তবে অপর পাশ থেকে কেউ কিছু বললোনা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হেমসিনী গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

” আপনি আমাকে নজরে নজরে রেখেছেন কেন মাহাতিব? আপনি কি করে বুঝতে পারলেন আমি বারান্দায় আছি?”

” কিছু কিছু জিনিসকে নজরে রাখতে হয়, যেন সেটা সুরক্ষিত থাকে। এতো প্রশ্ন না করে ঘুমিয়ে পড়ুন, সময় হলে আসল উওর পেয়ে যাবেন।”

বিরক্ত হয়ে হেমসিনী ফোন কেটে দেবে তবে মাহাতিব দ্রুততার সাথে বাঁধা দিলো।

” এই শুনুন।”

” বলুন কি বলবেন?”

” খেয়েছেন?”

” হুম, এবার রাখবো?”

” হেমসিনী আপনি কিন্তু বড়দের সম্মান করতে ভু’লে গিয়েছেন।”

” জ্বি? আমি বড়দের সম্মান করি না?”

” না করেন তবে এখন ভু’লে গিয়েছেন। আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি আপনি খেয়েছেন কিনা কিন্তু আপনি তো জিজ্ঞেস করলেন না।” অভিমানী কন্ঠে বললো মাহাতিব।

মাহাতিবের কথা শুনে হেমসিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

” ভালো থাকবেন, শুভ রাত্রি।”

মাহাতিব বুঝতে পারার আগেই হেমসিনী ফোন কেটে দিয়ে ভেতরে চলে গেলো।

কল কেটে যেতেই মাহাতিব হেমসিনীর বারান্দায় তাকালো। ততক্ষণে সে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এ কপাল ঠেকালো মাহাতিব, বড্ড ক্লান্ত লাগছে থাকে।

” আপনি বড় কঠিন হৃদয়ের মানবী হেমসিনী। নারীদের মন হয় নরম ঠিক শুভ্র তুলোর মতো কিন্তু আপনার হৃদয় তো কঠিন, একদম পাথরের মতো। পা’ষা’ণ মানবী হেমসিনী।” বিরবির করে হেমসিনীর বিরুদ্ধে অ’ভিযো’গ তুললো মাহাতিব।
.
.

সব দরজা-জানালা বন্ধ করে ভাইয়ের পাশে এসে শুয়ে পড়লো হেমসিনী৷ মাথার উপর ঘুরতে থাকা পাখাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।

বাড়িতে বর্তমানে শুধু সে এবং তার ছোট ভাই হিমাল আছে, এটা হেমসিনীর কাছে নতুন নয়। সে ছোটবেলা থেকেই এরকম থেকে এসেছে। তার বাবা একজন ব্যবসায়ী, উনি প্রায় সময় কাজের সূত্রের ভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ান। তার মাও একজন চাকরিজীবি, তিনি একটি হসপিটালে নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন। বর্তমানে হেমসিনীর মা হসপিটালে, কাল সকালে তিনি ফিরে আসবেন এবং বাবা অন্য জেলায়৷ ছোট থেকেই সে বাবা-মাকে খুব একটা পাইনি, দিনের বেশির ভাগ সময়ই সে মামা-মামীর কাছে থেকেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড একা লাগে তার। নিজের অনুভূতি চেপে রাখতে রাখতে নিজেকে এখন অনুভূতি শূণ্য মনে হয় হেমসিনীর।এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।

তবে বেশি সময় স্থায়ী হলো না তার ঘুম। ঘুমের মাঝেই হালকা হালকা কেঁপে উঠছে হেমসিনী। চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়েছে পড়তে লাগলো। তার ফুঁপানি শুনে হিমাল জেগে গেলো। বোনের অবস্থা দেখে কিছুটা ঘা’ব’ড়ে গেলো সে।

” আপু উঠো, আপু।”

কিছুক্ষণ ধাক্কা দেওয়ার পরে হেমসিনীর ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভেঙে যেতেই বুঝতে পারলো সে আবারো ঘুমের ঘোরে কান্না করেছে। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো সে। চোখে লেগে থাকা জলটুকু সযত্নে মুছে নিলো হেমসিনী। হিমালকে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে দিলো। কাঁথাটা গায়ে টেনে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

” ঘুমিয়ে পড় ভাই। অনেক রাত হয়েছে।”

হিমাল কথার বিপরীতে কোন প্রশ্ন করলোনা। এটা এখন তার কাছে নতুন কিছু নয়৷ হেমসিনীর ক্ষেত্রে প্রায় সে এই বিষয়টা দেখতে পাই।

চলবে…….

#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here