আমার মনকাননে ভ্রমর তুমি পর্ব -০৯ ও শেষ

#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

দোলানায় দোল খাচ্ছে হিমাল। হেমসিনী কি করবে বুঝতে পারছেনা, মাহাতিবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার অস্বস্তি লাগছে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে সে এমন ভাব করছে যেন সে কোন কাজে ব্যস্ত আছে।

” এভাবে কোন কারণ ছাড়া মোবাইলটাকে গুঁতাগুঁতি করে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? এতো মোবাইল চালালে তো চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। সামনে যে অন্য একটা মানুষও আছে সেদিকে আপনার একটুও খেয়াল নেই হেমসিনী। বড় বাজে কাজ করেছেন আপনি।”

হেমসিনী প্রতিউওরে কিছু বললোনা। শুধু একপলক মাহাতিবকে দিকে আবারো ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।

” হেমসিনী আমি আপনার সাথে কথা বলছি। দয়া করে আমার দিকে তাকান।” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে কথাটি বললো মাহাতিব। হেমসিনী ফোন বন্ধ করে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো। হেমসিনীর চাহনি দেখে মাহাতিবের গম্ভীরভাব মূহুর্তেই উবে গেলো। ভেবেছিলো গম্ভীরভাবে কিছু কথা বলবে কিন্তু তা আর পারলোনা।

” হেমসিনী কেন আপনি আমাকে এড়িয়ে চলেন? আমি কি দেখতে খারাপ কিংবা আমার মধ্যে কি কোন বাজে স্বভাব আছে? আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কি খারাপ? উওর দিন হেমসিনী।” বেশ হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বললো মাহাতিব।

” না আপনার কিংবা আপনার পরিবারের মধ্যে কোন সমস্যা নেই।”

” তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমি আর পারছিনা। ধৈর্য্যেরও যে একটা সীমা থাকে। আপনি কি বুঝতে পারেন না নাকি বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে যাচ্ছেন? আমি যে হেমসিনীকে চিনি তিনি তো এতোটা বোকা নন আর না এতোটাই অবুঝ যে সামনের ব্যক্তির মনের কথা কিছুই বুঝতে পারবেন না।”

” আমি বুঝতে পারলেও তাতে কিছু যাই আসেনা মাহাতিব। আমি আগেও বলেছি, আবারো বলছি আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলুন মাহাতিব। আমাদের দু’জনের পথ সম্পূর্ণ আলাদা, যা কখনোই এক হবেনা। আপনি হাজার চাইলেও দু’টো পথকে এক করতে পারবেন না। আমি আপনাকে নয় বরঞ্চ আপনার পেশাকে ঘৃ’ণা করি। আশা করছি আর কখনোই আমাকে এই বিষয় কোনরূপ প্রশ্ন করবেন না।”

বিপরীতে মাহাতিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেলো হেমসিনী। হিমালকেও সে নিলোনা। হেমসিনী যে চলে গিয়েছে সেদিকে মাহাতিবের মনোযোগ নেই, সে পুনরায় হেমসিনীর বলা কথাগুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে।
.
.

এক সপ্তাহ চলে গিয়েছে। সেইদিনের পর থেকে হেমসিনীর সাথে মাহাতিবের কোন রকমের যোগাযোগ হয়নি। হেমসিনী নিজে থেকে ভুলেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি, এতে মাহাতিবের বেশ মন খারাপ হয়েছিলো। তবে সেও কোনরূপ যোগাযোগ করতে পারেনি, সময়ের কারণে তা সম্ভব হয়নি। আর মাত্র দু’দিন তারপরেই ভোট, যা নিয়ে মাহাতিব এখন অনেক ব্যস্ত।

চিন্তিত এবং ক্লান্ত শরীর নিয়ে চেয়ারে বসলো মাহাতিব। ড্রয়ার থেকে ফাইল নেওয়ার সময় একটা সিগারেটের প্যাকেট চোখে পড়লো তার। মাহাতিব বেশ খানিকটা সময় সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো, অতঃপর তা হাতে তুলে নিলো। চেয়ারে হেলাম দিয়ে একদৃষ্টিতে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

একসময় সে সিগারেট খেতো, বিশেষ করে যখন অনেক চিন্তিত থাকতো তখন। যা একদিন হেমসিনী দেখে ফেলেছিলো। সেদিনের বলা হেমসিনীর কথা আজো তার মনে আছে।

” আপনি নাকি সমাজসেবা করে থাকে? ক্যান্সারের রোগীদের জন্য নাকি হসপিটাল খোলার চিন্তাভাবনা করছেন। তা নিজের করা সেই হসপিটালে প্রথম রোগী হিসেবে কি আপনি ভর্তি হবে?”

আচমকা হেমসিনীর আগমন এবং কথা শুনে ভড়কে গেলো মাহাতিব৷ সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো।

” আপনার কথা আমি বুঝতে পারিনি।”

” ছোট বাচ্চা আপনি যে বুঝতে পারেননি? জানেন না সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক? এদিকে ক্যান্সারের রোগীদের জন্য হসপিটাল খুলছেন অন্যদিনে তিনি নিজেই সিগারেট খেয়ে থাকেন। কত সুন্দর বিষয়টা। এনারা নাকি আবার সমাজসেবা করবেন। যারা নিজেই ঠিক নেই তারা অন্যের জন্যই বা কি করবে।” কথাটি বলে হেমসিনী চলেই যাচ্ছিলো তবে মাহাতিবের প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো।

” আপনি বুঝি এসব পছন্দ করেন না?”

” না, মোটেও না। না সিগারেট পছন্দ করি আর না সিগারেট খাওয়া মানুষদের।”

ব্যস এই কথাটি শোনার পর থেকে মাহাতিব এখন পর্যন্ত আর কোন সিগারেট খাইনি। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হতো, অস্বস্তি লাগতো তবে হেমসিনীর জন্য সে তার এই বাজে অভ্যাসটা ত্যাগ করেছে।

পুরনো কথা ভেবে অধরের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠলো মাহাতিবের।

” হেমসিনী আপনি বুঝতে পারলেন না আমাকে। এতোদিন অপেক্ষায় রেখেছিলেন, এখনো আপনার অপেক্ষায় আছি। আমার এই অপেক্ষার প্রহর কি শেষ হবেনা? হেমসিনী নামক ভ্রমরটি কি আমার মনকাননে তৈরিকৃত ভালোবাসার বাগানটির সৌন্দর্য, তাতে বেড়ে উঠা ফুলের মিষ্টতা আধো কি কখনো গ্রহণ করবে?”
.
.

সকাল থেকে পুরো শহরজুড়ে একটা মিশ্রভাব বিরাজমান। এদিকে কেউ খুশি, অন্যদিকে কেউ আহত আবার অবশেষে কেউ নিজেদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করছে।

এতোদিন প্রতিক্ষার পর অবশেষে আজ ভোট সম্পন্ন হয়েছে। মানুষের ভালোবাসায় বিপুল পরিমাণ ভোটে মাহাতিবের জয় হয়েছে। এতে তাদের দলের সবাই খুব খুশি। সব জায়গায় খবরটা প্রচলিত হচ্ছে তবে তার সাথে আরো নতুন খবর প্রচারণা করা হচ্ছে। ফলাফল প্রকাশ করার কিছু মূহুর্তে পরেই সবাই জেনে যাই প্রণয় শিকদারের নকল ঔষধের ব্যবসার কথা। সেইসাথে তার দলের ছেলেরা মাহাতিব এবং তার দলের ছেলেদের উপর হামলা করে বসেছে। সব মিলিয়ে শহরে এখন একটা শোরগোল চলছে।

মাহাতিব হসপিটালে আছে শুনে হেমসিনী কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো তবে তা প্রকাশ করলোনা। দুপুরের দিকে তারা সবাই মিলে হসপিটালে গেলো মাহাতিবকে দেখতে।

মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ, মুখেও ছোট ব্যান্ডেজ করা মাহাতিবকে দেখে হেমসিনীর ভিষণ মায়া হলো।

” কেমন আছো মাহাতিব?” আকবর আহমেদ প্রশ্ন করলেন।

” জ্বি দাদু আমি ঠিক আছে। এগুলো তো নতুন কিছু নয়। বাবা তুমি ওনাদের জন্য কিছুর ব্যবস্থা করো। কত দূর থেকে এসেছেন ওনারা আমাকে দেখতে।”

” এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের কিছু লাগবেনা।”

” তা বললে কিভাবে হয় স্যার? আপনি আসুন আমার সাথে। আজ আমাদের জন্য এতো বড় খুশির দিন, আপনাদের সাথে তা ভাগ করে নিতে না পারলে খুশিটাই বৃথা হয়ে যাবে।”

শান্ত হোসেন আকবর আহমেদকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। হেমসিনীর বাবা-মা আগে থেকেই বাইরে মাহাতিবের মায়ের সাথে ছিলেন। হেমসিনী বের হওয়ার জন্য পা বাড়াবে তবে মাহাতিবের ডাকে থেমে গেলো।

” আপনি বড্ড পাষণ হেমসিনী। এতোদিন চলে গেলো একটিবারের জন্যও আমার খোঁজ নিলেন না, নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেননি আপনি। আমি এতোটাই খারাপ? আপনার কাছে কি আমার একটুও মূল্য নেই? এমনকি এখন আমি হসপিটালে আছি, একটিও জিজ্ঞেস করলেন না আমি ঠিক আছি কিনা। আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে বুঝি আপনার খুব ভালো লাগে?” ব্যথিত কন্ঠে বললো মাহাতিব। এতোদিন পর প্রিয় মানুষটিকে দেখে সে নিজেকে সামলাতে পারেনি।

” মাহাতিব আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম আপনি আর আমি কখনোই একি পথে হাঁটতে পারবোনা। আমি আপনার সাথে নিজে জড়াতে চাইনা। আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন তবে আমি চাইনা আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক তৈরি হোক।”

” আপনাকে আমাকে পছন্দ করেন না হেমসিনী? এতোগুলা দিনে কি একটুও মায়া জন্ম নেইনি আমার জন্য?”

” না নেইনি। করিনা আমি আপনাকে পছন্দ, আমার জীবনে আপনার কোন মূল্য নেই।” দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো হেমসিনী।

” হেমসিনী আমি আপনাকে পছন্দ করিনা ভালোবাসি। পছন্দ থেকে ভালোবাসা শব্দটার ওজন বেশি। এই শব্দটা সবার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাইনা। আমার মুখশ্রী থেকে পরিবারের পরে ভালোবাসা নামক মূল্যবান শব্দটা শুধু আপনার জন্যই উচ্চারিত হবে হেমসিনী, শুধু আপনার জন্য।”
.
.

” আমাকে এভাবে আলাদা রুমে নিয়ে এসেছো কেন শান্ত? গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে? ছেলের জন্য চিন্তিত তুমি?”

” না স্যার ভোট বিষয়ক কিছু নয়। আসলে ব্যপারটা পারিবারিক।” কিছুটা ইতস্তত হয়ে বললেন শান্ত হোসেন।

ছাত্রের মুখশ্রী দেখে আকবর আহমেদ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

” শান্ত কোন সমস্যা?”

” আসলে স্যার আপনি তো জানেন বাবা আপনাকে ভাই এবং শিক্ষক হিসেবে কতটা পছন্দ এবং শ্রদ্ধা করতেন। আপনাদের সম্পর্কটাও বেশ ভালো ছিলো। বাবা চেয়েছিলেন আপনার সাথে যেন আমাদের একটা স্থায়ী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।”

” শান্ত তুমি কি বলতে চাইলো আমি বুঝতে পারছিনা। জড়তা ছাড়িয়ে কথাটি বলো তুমি।”

” স্যার আমি চাইছিলাম মাহাতিবের সাথে আপনার নাতনী হেমসিনীর বিয়ে দিয়ে দু’পরিবারের মধ্যে সম্পর্কটা জোরালো ভাবে স্থায়ী করতে।”

শান্ত হোসেনের কাছে এধরণের কথা শুনে আকবর আহমেদের মুখশ্রী চুপসে গেলো। বেশ খানিকটা গম্ভীরভাব ছেঁয়ে গেলো ওনার মুখশ্রীতে।

” শান্ত তুমি, তোমার পরিবর্তন, মাহাতিব সবাই বেশ ভালো। আমি তোমাদের সবাইকে বেশ স্নেহ করি। মাহাতিবও পাত্র হিসেবে সুপাত্র তবে তুমি তো জানো আমার বড় ছেলের সাথে কি হয়েছে। এখন আমি করি করে নিজের নাতনীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মধ্যে ঠেলে দি, তুমিই বলো?”

” কিন্তু স্যার মাহাতিব তো সেরকম নয়। আপনি তো জানেন মাহাতিব কতটা সৎ এবং বিচক্ষণ প্রকৃতির। আপনার বড় ছেলের সাথে মাহাতিবের কোন রূপ মিল নেই।”

আকবর আহমেদ কিছু সময় ভাবলেন। তারপর ধীরেসুস্থে বললেন,

” ঠিক আছে আমি তোমার কথাটা ভেবে দেখবো। তবে সবটা নির্ভর করে হেমসিনীর উপর। তার মতামতের উপর ভিত্তি করেই আমি আমার উওর জানাবো।”

হসপিটালে বা বাসায় ফিরে আকবর আহমেদ বিয়ের ব্যপারে কাউকে কিছু জানাননি। রাতে খাবার পর্ব শেষ হলে হিমালকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে বসলেন তিনি এবং বিষয়টা জানালেন। তবে অন্য কেউ কিছু বলবে তার আগেই হেমসিনী দ্বিমত করে বসলো।

” আমি কখনোই ওনাকে বিয়ে করবোনা। তোমরা আমাকে যদি সামান্য বেতনের কোন লোকের সাথেও বিয়ে দাও তাও আমি হাসিমুখে মেনে নেবো তবে উনি নয়।”

” কিন্তু কেন হেমসিনী? মাহাতিবের মধ্যে খারাপ কি আছে?”

” বাবা ওনার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। খারাপ হচ্ছে ওনার পেশা, উনি যে পথে হাঁটছেন সেটা। রাজনীতি হচ্ছে একটা বিষাক্ত সাপ। যেকোন সময় ছোবল মেরে জীবন শেষ করে দিতে পারে। ঘৃণা করি আমি রাজনীতিকে। এই রাজনীতির কবলে পড়ে চাচ্চু খারাপ পথে পা বাড়িয়েছে। মনুষ্যত্ব হারিয়ে অমানুষে পরিণত হয়েছিলো। চাচির জীবনটা ন’র’ক করে দিয়ে চলে গিয়েছে। ভুলে গিয়েছো তোমরা চাচু চাচির সাথে কি কি করেছে? কত জঘন্য জঘন্য কাজ করেছে? শেষ পর্যন্ত ওই রাজনীতির কারণেই ওনার মৃ’ত্যু হলো। ম’রে তো নিজে বেঁচে গিয়েছে কিন্তু চাচিকে মৃ’ত্যু যন্ত্রণায় রেখে গিয়েছে। আমি চাইনা আমার জীবনটাও চাচির মতো হোক। আমি রাজনীতির সাথে যুক্ত কোন মানুষের সাথে কোনরূপ সম্পর্ক গড়তে চাইনা। তোমরা ওনাদের কথাগুলো পরিষ্কারভাবে বলে দিও।”

হেমসিনী বেশ রে’গে রুমে চলে গেলো। সৃষ্টি আহমেদ শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে কান্না করছেন। পুরনো ক্ষতগুলো এখন আবারো তাঁজা হয়ে উঠেছে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

” বাবা, আমার জীবন তো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করবেন না।”
.
.

বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে আকবর আহমেদ শান্ত হোসেনকে হেমসিনীর সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। যা মাহাতিব জানার পর ভিষণ কষ্ট পেয়েছে।

স্ক্রিনে মাহাতিবের নাম দেখে হেমসিনী ভেবেছিলো রিসিভ করবে না তবে তা হলোনা।

” কি করলে আপনি এই প্রস্তাবে রাজি হবেন?”

রিসিভ করার পরেই এধরণের প্রশ্ন শুনে হেমসিনী খানিকটা বিব্রত হলো।

” আপনি কিসের কথা বলছেন?”

” বিয়ের কথা। আমি এখন এতোসব প্রেম, ভালোবাসা চাইছিনা। সোজা বিবাহের কাজ সম্পন্ন করতে চাইছি, বাকিসব তার পরে দেখা যাবে। এবার বলুন কি করলে আপনি এই প্রস্তাবে রাজি হবেন? একটা বাড়ি কিনে দিলে নাকি নিজের কিডনি কাউকে দান করে দিলে?”

” আপনি কি সিরিয়াস? দেখুন মাহাতিব বিয়ে কিন্তু কোন মজার জিনিস নয়। খুবই সেনসেটিভ এবং পবিত্র একটা বিষয়। তাই যা বলবেন একটু চিন্তা ভাবনা করে বলবেন।”

” হেমসিনী আমি সিরিয়াস। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই, একদম মন থেকে। আপনি বলুন কি করলে আপনি রাজি হবেন?”

” রাজনীতি ছাড়তে পারবেন?”

” কি?” হেমসিনীর কথা শুনে মাহাতিব অনেকখানি অবাক হয়েছে। হেমসিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

” আপনি হয়তো সব জানেন কেন আমি না করেছি। আপনি যদি সত্যিই আমাকে চান তাহলে আপনাকে রাজনীতি ছাড়তে হবে।”

” আপনি কি আমাকে পদ ত্যাগ করতে বলছেন?”

” যদি ভেবে থাকেন আমি পদ ত্যাগ করতে বলছি তাহলে তাই। যতদিন আপনার সাথে রাজনীতি জড়িয়ে থাকবে ততদিন আমি আপনার জীবনে আসবোনা। যদি রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে আমাকে কখনোই পাবেন না। আমি আপনাকে জোড় করছিনা। আমার থেকেও ভালো অপশন আছে আপনার কাছে। আপনি রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে সেরকম কাউকে খুঁজে নিতে পারেন। তবে আমার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাইলে আপনাকে যেকোন একটা পথ বেঁছে নিতে হবে।”

হেমসিনীর কথা শুনে মাহাতিব এতোটাই শকে চলে গিয়েছে যে উওরে বলার জন্য কিছু খুঁজে পেলেনা সে।

সে এখন কি করবে? ভালোবাসার মানুষটাকে বেঁছে নেবে নাকি এতোদিনের পরিশ্রম, এতোটা পথ পেরিয়ে যে সাফল্যের দেখা পেয়েছে তা বেঁছে নেবো? একটা বেঁছে নিলে যে তাকে আরেকটা হারাতে হবে।
.
.

৫ বছর পর,

আবারো নতুন এমপির জন্য নিবার্চন হলো। মাহাতিবের দলের লোকেরা বেশ চিন্তিত এবার, এমনকি মাহাতিবও বেশখানিকটা চিন্তিত। সবাই পায়চারি করছে। কিছুসময় পর একটা ছেলে দৌড়ে তাদের কাছে এলো, প্রচুর হাঁপাচ্ছে সে। তার অবস্থা দেখে সবার চিন্তা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে।

” ভাই….” ছেলেটা এতোটাই হাঁপাচ্ছে যে ঠিকমতো কথা বলতে পারছেনা। মাহাতিব দ্রুত তাকে পানি খেতে দিয়ে শান্ত হতে বললো। ছেলেটা একটু স্বাভাবিক হলে মাহাতিব বিদ্যুৎ এর গতিতে তাকে প্রশ্ন করতে লাগলো।

” সায়ান নির্বাচনের খবর বলো?”

” ভাই আপনি জিতে গিয়েছেন, আমরা জিতে গিয়েছি। মুকিত ভাই নির্বাচনে জয়ী হয়েছে।”

সায়ানের থেকে প্রতাশিত কথাটি শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো মাহাতিব। মুকিত তো আবেগী হয়ে মাহাতিবকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।

” আরে আরে নতুন এমপি মশাই, আপনি আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলে কিভাবে হবে?”

” ভাই আপনি কোন সাধারণ মানুষ না। আজ আমি যা তা মোটেও আমার প্রাপ্য নয়। এসব কিছুই তো আপনার হওয়ার কথা। মানুষ আপনার উপর ভরসা করে আমাকে ভোট দিয়েছে। আমি তো এই পদের যোগ্য নয়। আপনার দয়ায় আমি এতো বড় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি।”

মুকিতের হাতে হাত রেখে মাহাতিব বললো,

” মুকিত তুমি জয়ী হয়েছো তাতে আমি অনেক খুশী। আমার একটুও আফসোস নেই যে আমি ভোটে না দাঁড়িয়ে তোমাকে দাঁড় করিয়েছি। আমি আফসোস করবো তখন যখন তুমি মানুষের জন্য কাজ না করে নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করবে। তবে আমি আশা করবো তুমি এরকমটা করবো না। তোমার কারণে আমার সম্মান ক্ষুণ্ণ হবেনা বরং তা আরো বৃদ্ধি পাবে।”

” ভাই আপনি যে ভরসা করে এতো বড় একটা দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও তা সঠিকভাবে পালন করবো।”
.
.

পড়ন্ত বিকেল, নদীর পাড়ে বেঞ্জে বসে বই পড়ছে হেমসিনী। পাশে কারো উপস্থিত বুঝতে পেরেছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। হেমসিনীকে তাকাতে দেখে মুচকি হাসলো মাহাতিব। হেমসিনী একবার মাহাতিবকে সম্পূর্ণভাবে পরখ করে দেখলো। গুণে গুণে ঠিক চার বছর পর আবারো তাদের এতো কাছাকাছিভাবে দেখা হলো। এবার প্রথমে হেমসিনীই কথোপকথন শুরু করলো,

” এবার ভোটে দাঁড়ালেন না যে? নিজে না দাঁড়িয়ে মুকিত ভাইকে দাঁড় করালেন।”

” এক রমণীর প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি তাই কি আর করার।” প্রথম কথাটা মাহাতিব একটু মজা করে বললেও এবার সিরিয়াস হয়ে বললো,

” পথ তো আমার কাছে একটাই ছিলো। হয় রাজনীতি না হয় প্রিয় মানুষ৷ দু’টোই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমি না আপনার জন্য রাজনীতি ছাড়তে পারতাম, না রাজনীতির জন্য আপনাকে। তাই ৫ বছর নিজের শখটা পূরণ করে এবার নিজের আসল ঠিকানায় ফিরে এলাম।”

একটা বই হেমসিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে মাহাতিব বললো,

” হেমসিনী আপনি কি আমার মনকাননে ভ্রমর হয়ে উড়ে বেড়াবেন? আমার মনকাননে থাকা ভালোবাসা মিশ্রিত ফুল থেকে কি আপনি প্রেমটুকু গ্রহণ করবেন? দয়া করে এবার আর ফিরিয়ে দেবেন না।”

হেমসিনী বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ বসে রইলো। প্রেয়সীর র্নিলিপ্ততা দেখে মাহাতিব বেশ কষ্ট পেলো। সে বইটি সরিয়ে নিতে যাবে তখনই হেমসিনী তা ছিনিয়ে নিলো।

” আপনি এবার যেতে পারেন তবে বইটা আমি নিয়ে যাবো।”

বইটা হেমসিনী নিয়েছে দেখে মাহাতিবের মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো।

” তার মানে আপনি রাজি?”

” কে বলেছে আমি রাজি? আমার তো বইটা পছন্দ হয়েছে, আপনাকে আমার কোন কালকেই পছন্দ ছিলোনা। যান যান নিজের কাজে যান।” বলেই বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলো হেমসিনী। তবে বইয়ের দিকে তাকিয়ে সে মিটমিট করে হাসছে। যা মোটেও মাহাতিবের চোখ এড়িয়ে গেলোনা। প্রেয়সীর মুখে হাসি দেখে মাহাতিব অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতোবছর, এতোটা সময় অপেক্ষা করার পর অবশেষে সে তার প্রেয়সীর মন জয় করতে পেরেছে। পেরেছে তার মনে জায়গা করে নিতে।

দু’জনেই মনে মনে বললো,

” হেমসিনী আপনি হচ্ছেন সেই ভ্রমরটা যাকে দূর থেকে আলাদা করা যাই। আপনার জন্য আমি প্রতিদিন আমার মনকাননে থাকা প্রেমপুষ্পটাকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি। ভালোবাসি হেমসিনী। তবে আপনি এখনো নিষ্ঠুর রয়ে গেলেন। একবারো নিজের মনের ভাবটা মুখে প্রকাশ করলেন না। তবে আমি অপেক্ষা করবো আপনার মুখ থেকে শোনার জন্য।” — মাহাতিব।

” আমি প্রথমে আশা করিনি আপনি এতো বড় একটা পদক্ষেপ নিতে পারেন। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো যেকোন একটা ত্যাগ করবেন। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো মাঝপথেই পদত্যাগ করবেন নয়তো বা আমাকেই ভুলে যাবেন। কিন্তু আপনি এতোটাই বুদ্ধিমান যে দু’টোই আপনি অর্জন করেছেন। নিজের প্রতি, নিজের ভালোবাসার প্রতি আপনার এতো বিশ্বাস দেখে আমি কি করে শক্ত থাকতে পারি? মাহাতিব আপনি পেরেছেন, হেমসিনী নামক রমণীর পাথর হৃদয়ে প্রেমপুষ্প সৃষ্টি করতে। আপনি জিতে গিয়েছেন মাহাতিব তবে আমি হেরে যাইনি। আমি হেরেও জিতে গিয়েছি।” —- হেমসিনী

_________________ সমাপ্ত ____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here