আমার মনকাননে ভ্রমর তুমি পর্ব -০৬+৭

#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

হেমসিনী মাহাতিবকে ফিরে যেতে বললেও সে গেলোনা। হেমসিনীর থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে তার পেছন পেছন ভার্সিটি পর্যন্ত গেলো। নিজ দায়িত্বে তাকে সাবধানে পৌঁছে দিয়ে সে বাড়িতে ফিরে এসেছে।

সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই আচমকা মাহাতিবকে কেউ জড়িয়ে ধরলো। আচমকিক কাজে ভড়কে গেলো মাহাতিব। রমণীটি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো। কিছুক্ষণ সেভাবে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো সে, পরমুহূর্তে হালকা করে রমণীর মাথা হাত বুলিয়ে দিলো।

” কখন এসেছো দিভাই?”

” তুই এতো কেয়ারলেস কেন ভাই? তোর দুলাভাই থেকে খবরটা শোনার পর থেকে জানিস আমি কতটা ভ’য় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুই কেন এপথে পা বাড়িয়েছিস আনদ্রে? তুই জানিস না এসব কত বি’পদ’জনক? কপালের জোড়ে কাল বেশি কিছু হয়নি কিন্তু পরবর্তীতে যে আরো বড় কিছু হবে না তার কি কেন নিশ্চয়তা আছে?”

মেয়ের সাথে সঙ্গ দিলেন সুমাইয়া নাসরিন। তিনিও কাঁদতে কাঁদতে ইশারায় বললেন,

” ওকে একটু বোঝা সাইরা। কতবার বলেছি এসবে জড়িয়ে যাসনা, বড় বিপদ এপথে৷ খুবই কুৎসিত রাজনীতি বিষয়টা। মানুষকে প’শু বানাতে সময় নেই না, ভালো মানুষদের বি’প’দ লেগে থাকে সবসময়। সাইরা ওকে বোঝা, এখনো সময় আছে যেন বেরিয়ে আসে।”

মাহাতিব বোনকে ছেড়ে মাকে আগলে ধরলো। চেয়ার টেনে ওখানে বসালো, হাঁটু গেড়ে বসলো মাহাতিব।

” মা এই পথ থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়, চাইলেও এখন পারা যাবেনা। বাবা তো তোমাকে বুঝিয়েছে৷ একটু বোঝার চেষ্টা কারো। সামনে ভোট, এখন পিছিয়ে এলে জনগণ ভাববে আমরা ভ’য়ে পিছিয়ে গিয়েছি। বিপক্ষ দল জিতে যাবে, পরবর্তীতে তারা আমাদের ক্ষতি করার জন্য অনেক বড় সুযোগ পেয়ে যাবে। আর তাদের সেই সুযোগটাই আমি দিতে চাইনা। ভয় পেওনা মা, সবঠিক হবে।”

.
.

বিকেল বেলায় ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামে ফিরে এসেছেন হেমসিনীর বাবা আমজাদ সাহেব। প্রীতি আহমদের আজ সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো বিধায় বেশ অনেক পদের রান্না করেছেন। স্বামী, ছেলে-মেয়ে এবং জা’ কে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও খেতে বসে পড়লেন।

বেশ কিছুসময় পর আমজাদ সাহেব গলা খাকড়িয়ে বললেন,

” ভাবী, আপনার শরীর ঠিক আছে? কোন কিছু প্রয়োজন আপনার?”

সৃষ্টি আহমেদ প্লেটের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন,

” না ভাই, আমার কিছু লাগবে না।”

” আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না। আপনার কি খাবার পছন্দ হয়নি? আপনি কি অন্যকিছু খেতে চান? ইচ্ছে হলে বলুন, আমি এবং প্রীতি তৈরি করে দিচ্ছি।”

” না ভাই তার প্রয়োজন নেই। খাবার যথেষ্ট ভালো হয়েছে, তুমি তো জানো প্রীতির রান্নার হাত ভালো।”

” তাহলে না খেয়ে মন ম’রা হয়ে রয়েছেন কেন? এভাবে নিজের প্রতি অবহেলা করলে কি করে হবে? নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে, অন্যকেউ তো আপনার খেয়াল সঠিকভাবে রাখতে পারবেনা।”

” কথায় আছে ‘ সুখে থাকলে ভুতে কি’লা’ই ‘ বর্তমানে ওনার অবস্থাও সেরকম। বাপের বাড়িতে নিজের যত্ন নিতো না বলে আমরা ওনাকে এখানে নিয়ে এসে সেবাশুশ্রূষা করছি আর উনি দেবদাসী হয়ে থাকেন সবসময়। যে নিজের যত্ন নেই না তাকে আমরা হাজার সেবা করলেও কি আধো কিছু হবে?”

জায়ের কথা শুনে সৃষ্টি আহমেদ টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন।

” প্রীতি শান্ত হও তুমি। তুমি তো জানো ভাবীর অবস্থা, তার এই আচরণটা কি স্বাভাবিক নয়?”

” স্বাভাবিক আমিও জানি কিন্তু আর কতদিন? কমদিন তো হলোনা। তাকে এভাবে দেখলে আমাদেরও যে খারাপ লাগে। কার জন্য সে মন মরা হয়ে থাকে? তুমি ভালো মতোই জানো কেন আমি তাকে মনখারাপ হয়ে বসে থাকলে বকাবকি করি।”

” ঠিক হয়ে যাবে। ভাবী আবারো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, তুমি চিন্তা করোনা।”

হেমসিনী চুপচাপ খাবার খেয়ে যাচ্ছে। ছোট হিমাল খাবারের পাশাপাশি উৎসুক নয়নে বড়দের কথাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে।
.
.

বিকেলে নিজের ঘরে বসে গিটার প্র্যাকটিস করছিলো হেমসিনী। কিছুদিন পর তাদের ভার্সিটিতে ৫০ বছর উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে তারা কয়েকজন মিলে গান পরিবেশন করবে সেইসাথে হেমসিনী এবং অন্য একজন মেয়ে গিটার বাজাবে।

হেমসিনী মনোযোগ দিয়ে প্র্যাকটিস করছিলো, অন্যদিকে তার ফোন বেজে চলেছে। সে শুনতে পেলেও তৎক্ষনাৎ উঠে গেলোনা। পুরোটা শেষ করে তবেই ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনে বাংলায় গোটা গোটা অক্ষরে “মাহাতিব” নামটি ভেসে উঠছে।

” এই লোকটা কবে আমার পিছু ছাড়বে? প্রতিদিন হুটহাট ওনার ফোন না দিলে কি পেটের ভাত হজম হয়না? রাত নেই দিন নেই যখন খুশি ফোনের উপর ফোন দিয়ে থাকেন৷ আর সহ্য করা যাচ্ছেনা, এবার একটু কঠিন ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন। তবে যদি একটু দূরে সরে যান।” খানিকটা রাগ এবং বিরক্ত নিয়ে নিজেই বললো হেমসিনী।

” আপনার গিটার বাজানো খুবই মনোমুগ্ধকর। কবে আপনি আমার কাছে আসবেন হেম? অপেক্ষায় আছি সেইদিনের যখন আপনি আমার সামনে বসে গিটার বাজাবেন, সাথে আপনার সুরেলা কন্ঠে কোন গান শোনার সৌভাগ্য হবে আমার। হেম গাইবেন আপনি গান? রাখবেন তো আমার আবদার? নাকি বরাবরের মতোই ফিরিয়ে দেবেন?”

হেমসিনী ভেবেছিলো ফোন রিসিভ করেই মাহাতিবকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে কিন্তু মাহাতিবের ব্যথাকাতুর কন্ঠ শুনে সে কিছু বলতে পারলোনা৷ রাগীভাবটা মূহুর্তেই উবে গেলো, গম্ভীরভাব ছেঁয়ে গেলো তার মুখমন্ডলে।

” আপনি কি করে জানলেন আমি এখন কি করছি?”

” তোমার গিটারে শব্দ রাস্তার প্রতিটি মানুষ শুনতে পাচ্ছে, তাহলে আমি কিভাবে বাদ যাবো?”

মাহাতিবের কথা শুনে হেমসিনীর বুঝতে বাকি নেই মাহাতিব তার বাড়ির সামনেই আছে।

” আপনি আবারো আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সবসময় দাঁড়িয়ে থাকলে যে-কেউ তা লক্ষ্য করবে। বাবা-মা অন্যের মুখ থেকে জানতে পারলে কি হবে চিন্তা করেছেন?”

” কি হবে? সিনেমার মতো আমার সাথে জোড় করে বিয়ে করিয়ে দেবে বুঝি? তাহলে তো ভালোই হবে, আমাকে আর এতো কষ্ট করে এক মানবীর পাথরের তৈরি হৃদয়ে ফুল ফোটাতে হবেনা।”

” বড্ড বা’জে কথা বলেন আপনি। এই বিকেল বেলা কাজকর্ম ফেলে কেন দাঁড়িয়ে আছেন তা বলুন।”

” একটু বারান্দায় আসবেন? আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি, রাতে ফেরা হবেনা। আপনাকে না দেখলে আমার দিন সার্থক হয়না। রাতে যেহেতু আপনাকে দেখা হবেনা তাই এখনই তা পুষিয়ে নেবো। দয়া করে একটি বার বারান্দায় আসুন৷ প্রমিজ আজ আর বিরক্ত করবোনা।”

হেমসিনী জানে এখন সে বারান্দায় না গেলে মাহাতিবও সরবেনা। তাই কথা না বাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তায় একটি সাদা রঙের গাড়ির দেখতে পেলো সে, হেমসিনী জানে মাহাতিব কাঁচ উঠানো গাড়ির ভিতর থেকেই তাকে দেখছে।

” এবার আমার কাজ আরো ভালোভাবে সম্পন্ন হবে। সাবধানে থাকবেন হেমসিনী, নিজেকে কখনো একা মনে করবেন না। সবসময় মনে রাখবেন আপনার আশেপাশে একজন আ়ছে, যে আপনার জন্য নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবেনা।”

” কোন মুভি থেকে তুলে এনেছেন লাইনগুলো?”

ফোনের অপর পাশ থেকে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শুনতে পেলো হেমসিনী।

” আমার মনের মুভি থেকে। দেখবেন মুভিটা? আপনার জন্য একদম বিনামূল্যে দেখার সুযোগ আছে।”

” আর কখনো ফোন করে বলবেন না আমাকে বারান্দায় আসার জন্য। বললেও আমি আসবোনা। এবার আমার বাড়ির সামনে থেকে যান।”

আবারো হেসে উঠলো মাহাতিব।

” যতদিন বেঁ’চে থাকবো ততদিন আপনার কাছে আমার আবদার শেষ হবেনা হেমসিনী। আর আপনাকে আমার ছোট ছোট সব আবদার পূরণ করতে হবে, আমি জানি আপনি করবেন। থাকতে মূল্য দিতে হয় হেমসিনী। আজ আমি আছি, কাল নাও থাকতে পারি। তখন কে আবদার করবে? তাই যতদিন আছি আবদার করা বন্ধ করবোনা। ভালো থাকবেন হেম।”

লাইন ডিসকাউন্ট হওয়ার সাথে সাথে মাহাতিবের গাড়িটাও মূহুর্তেই উধাও হয়ে গেলো। হেমসিনী স্থির হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। অজানা কারণে তার অদ্ভুত অনূভুতি হচ্ছে তবে সেটা সুখকর নয়।

চলবে…….#আমার_মনকাননে_ভ্রমর_তুমি
#পর্বঃ০৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

সকাল থেকে পুরো শহরজুড়ে একটি চাঞ্চল্যকর এবং ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজমান। প্রায় প্রতিটি ঘর, অফিস, দোকান-পাট সবখানে জনগণ টিভির সামনে বসে আছে। প্রতিটি টিভিতে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে একটি মাত্র খবরই প্রচলিত হচ্ছে।

শহরের একটি বেসরকারী হসপিটাল থেকে নকল ঔষধ এবং ভেজাল ঔষধ উদ্ধার করা হয়েছে। সকল সাংবাদিকরা ভীড় করেছে সেই হসপিটালের সামনে এবং জনগণ ভীড় করেছে টিভির সামনে।

হেমসিনী এবং তার পুরো পরিবার চিন্তিত অবস্থায় বসে আছে টিভির সামনে। আমজাদ আহমেদ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছেন। এই হসপিটালের কিছুটা দূরেই ওনার স্ত্রীর কর্মস্থল।

” এভাবে হা করে টিভির সামনে বসে না থেকে খেতে এসো৷ তোমাদের অফিস, ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে না হলেও আমাকে দুপুরে হসপিটালে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে আমার একটা কাজ কামাও, আমাকে আবার দুপুরে জন্য রান্না করতে হবে।”

প্রীতি আহমেদের ব্যস্তময় কন্ঠ শুনে সবাই দ্রুত টিভির সামনে থেকে উঠে খেতে বসে পড়লো। তবে টিভি তখনো চলছে।

” শোন তুমি না হয় কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে নাও।”

” ছুটি কেন নেবো? কোথাও যাবে নাকি?”

” না আমার জন্য বলছিনা। এখন যা পরিস্থিতি, তুমি বরং কয়েকদিন হসপিটালে না গিয়ে ঘরেই থাকো।”

নিজের প্লেটে রুটি তুলে নিয়ে চেয়ারে বসলেন প্রীতি আহমেদ৷ অল্প খেয়ে তিনি উওর দিলেন,

” যাবো না কেন? আমাদের হসপিটালে কিছু হয়েছে বা আমি কিছু করেছি? করিনি তো? তাহলে কেন শুধু শুধু ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকবো?”

” তাহলে আমিই ঘরে থাকি। তোমাকে না হয় এ কয়েকদিন আমিই পৌঁছে দেবো।”

” তার দরকার নেই। তুমি শুধু শুধু বেশি চিন্তা করছো।”

আমজাদ সাহেব বুঝতে পারলেন প্রীতি আহমেদকে এখন আর বলেও কোন লাভ হবেনা।

” আচ্ছা তাহলে এ কয়েকদিন হেঁটে যেওনা। রিকশা নিয়ে আসা-যাওয়া করো। আমি এর বেশি কিছু শুনতে চাইনা। তুমি যদি এটাও না শোন তাহলে আমিই তোমাকে পৌঁছে দেবো।”
……..

” ভাই কাজটা করলেন আপনি। সব বুদ্ধি খাটিয়ে, সময় দিয়ে বিষয়টা সমাধান করলেন আপনি। কিন্তু সব কৃতিত্ব নিয়ে যাচ্ছে পুলিশরা। কেন ভাই? আপনি তাদের সুযোগ কেন করে দিয়েছেন? আপনি যদি এখনো বলেন তাহলে আমরা এখুনি সাংবাদিকদের প্রমাণ সহ বলতে পারবো যে এই নকল ঔষধ হাতেনাতে ধরতে পেরেছে শুধু আপনার কারণে।”

” না মুকিত তোমরা এরকম কিছু করবেনা। আমি কিন্তু আগেই বারণ করে দিয়েছিলাম। আমার অগোচরেও করার চেষ্টা করবেনা।”

” কিন্তু কেন ভাই? এই খবরটা মিডিয়া, জনগণ জানতে পারলে তো আমাদেরই লাভ। সামনে ভোট, এটা একটা সুর্বণ সুযোগ আমাদের জন্য। এতে করে আমরা আরো মানুষের মন জয় করতে পারবো, এর ফলে আমরা আরো বেশি ভোট পাবো।”

” মুকিত আমি কোন কিছুই নিজ স্বার্থের জন্য করিনা, আমার বাবাও তা করেননি। আমরা কাজ করি সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য। সবাই যদি নিজের কথাই চিন্তা করে তাহলে সবার স্বার্থের কবলে পড়ে এই নিরিহ মানুষগুলো কষ্টে ভুগবে। যা আমি চাইনা। আমি নিঃস্বার্থ ভাবে, আড়ালে থেকে আমার কাজ করে যাবো। আর কেউ জানুক বা না জানুক, উপরে একজন আছেন। তিনি সবকিছু দেখছেন। আমি ভোটের যোগ্য হলে জনগণ মন থেকে এমনিতেই দেবে। এর জন্য সবার চোখে মহান হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা।”

মাহাতিবের কথন শুনে মুকিতের হৃদয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো।

” মানুষটা সাধারণ জনগণের কথা কত চিন্তা করে। রাত নেই, দিন নেই শুধু মানুষের জন্য কাজ করে যাই, একদম বড় স্যারের মতো।” মনে মনে বললো মুকিত।

.
.

সকাল থেকে হেমসিনীদের বাড়িতে ব্যস্তময় একটা পরিবেশ বিদ্যামান রয়েছে। বর্তমানে বাড়ির মানুষরা আরো অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

হেমসিনীর দাদা বহুমাস পর আবারো তাদের বাড়িতে এসেছেন৷ তিনি দু’তিন বছর পর পর একবার আসেন। প্রীতি এবং সৃষ্টি আহমেদ দু’জনে শশুরের সাথে কুশলাদি করে রান্নাঘরে চলে গিয়েছেন। হিমাল বহুদিন পর দাদাকে পেয়ে ওনার সাথে বসে আছে। আজ যেন সে পণ করেছে শত বকা খেলেও সে সরবেনা।

সৃষ্টি আহমেদ শশুড়ের জন্য শরবত এবং কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এলো।

” এই নিন বাবা, ঠান্ডা শরবতটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।”

বউয়ের হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা একবারেই খেয়ে নিলেন আকবর আহমেদ।

” কেমন আছো বড় বউমা? শরীর ভালো আছে তো? ছোট বউদের সাথে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো? সমস্যা হলে বলো, আমি না হয় যাওয়ার সময় তোমাকেও সাথে নিয়ে যাবো।”

” না না বাবা, কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমি এখানে বেশ ভালো আছি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনি বরং খাবারগুলো খান, আমি রান্নাঘর থেকে আসছি।”

আকবর আহমেদ বুঝতে পারলেন উনার বড় বউ কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এখান থেকে চলে গিয়েছেন।

” আচ্ছা হিমাল দাদু ভাই তোমার বাবা-মা কি তোমার চাচীকে বকাবকি করে?”

” না তো। তবে জানো দাদু চাচী মাঝে মাঝে কান্না করেন। তখন মা খুব রে’গে যাই। আচ্ছা দাদু চাচী কেন লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করেন?”

নাতীর কথা শুনে আকবর আহমেদের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। তিনি হিমালকে কি উওর দেবেন তা বুঝতে না পেরে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললেন।

হেমসিনী মা এবং চাচীর কাজে সাহায্য করছে। অনেক্ক্ষণ যাবৎ তার ফোর বেজে চললেও সে কাজ ফেলে যাচ্ছেনা। একবার ফোনের শব্দ বিরক্ত হয়ে প্রীতি আহমেদ বললেন,

” কে ফোন করেছে দেখো হেমসিনী। অনেক্ক্ষণ ধরে বেজে চলেছে।”

” থাক মা আমি পরে দেখে নেবো।”

” ফোন না দেখলে বুঝবে কিভাবে কে ফোন করেছে? হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে। তাই এতোবার ফোন করছে। যাও ফোনটা রিসিভ করো। এতোবার ফোন করার পরেও না ধরাটা একধরনের অভদ্রতা।”

হেমসিনী আর মায়ের উপরে কথা বলতে পারলোনা। হাতটা ধুয়ে দৌড়ে রুমে এলো।

ফোন এখনো অনবরত বেজে চলেছে। এতোবার ফোন পেয়ে এবার হেমসিনীরও একটু চিন্তা হতে লাগলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো আননোন নম্বর থেকে তাকে ফোন করা হচ্ছে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে তার।

” হ্যালো। কে বলছেন?”

” হেম।”

কন্ঠস্বর শুনে হেমসিনীর বুক ধক করে উঠলো। দ্রুত কানের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে নম্বরটা আবারো চেক করে দেখলো। না এটা আননোন নম্বর তাহলে সে মাহাতিবের কন্ঠ কি করে শুনতে পেলো? হেমসিনী ভাবনায় পড়ে গেলো সে কি ভুল শুনেছে?

” মাহাতিব? মাহাতিব এটা কি আপনি বলছেন?”

” মাত্র দু’দিন কথা হয়নি এর মাঝেই আমার কন্ঠস্বরও ভুলে গেলেন হেমসিনী।” তার কন্ঠস্বরে স্পষ্ট মন খারাপের রেশ পেলো হেমসিনী তবে সে তা আমলে নিলোনা।

” এটাতো আপনার নম্বর নেই মাহাতিব। এটা কার নম্বর?”

” মুকিতের। আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক ব্যস্ত আছি, নতুন ফোন কিনে যে সেটাপ করবো তারও সময় হচ্ছেনা। কেমন আছেন আপনি? মনে আছে মাহাতিব নামক অবহেলিত ব্যক্তিটিকে?”

” আপনি এতোবার ফোন কেন দিয়েছেন বলুন তো? এতোবার ফোনের শব্দ শুনে মা পর্যন্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো।”

” আপনি ফোন ধরছিলেন না। চিন্তা হচ্ছিলো আপনার জন্য তাই দিয়েছিলাম।”

” আর কখনো এতোবার দেবেন না। না জানি বাড়ির সবাই কি ভাবছে এখন।”

” নিষ্টুর মানবী আপনি।”

” জানি আমি। এবার বলুন কেন এতোবার ফোন দিয়েছেন?”

” আপনার কথা মনে পড়ছিলো।”

” এই কারণে লাগাতার এতোবার আপনি ফোন দিয়েছেন! এই সামান্য কারণে!”

মাহাতিব পরবর্তীতে কিছু বলবে তার আগেই কেউ তাকে ডেকে উঠলো। ফোন কাটার আগে সে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,

” কাউকে মন থেকে চাইলে এই কারণটা আপনার কাছে সামান্য মনে হতোনা হেমসিনী। কিন্তু আপনি তো পাথর মনের মানবী। তাই এই কথাটার মর্ম আপনি বুঝতে পারেননি। তবে আমি অপেক্ষায় থাকবো সেইদিনের যখন আপনি কথাটা অনুভব করতে পারবেন। সাবধানে থাকবেন হেম।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here