#আমার_সংসার
পর্ব-১০
Sara Mehjabin
একা রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে আজমী অর ফারহান। আজমীর খুবই অসস্তি হচ্ছে। ও এর আগে কখনো এরকম অচেনা অজানা মানুষের সাথে একসাথে কোথাও যায় নি। বুঝতে পারছে না লোকটাকে বিশ্বাস করা ঠিক কিনা। আজকালকার যুগে স্বার্থ ছাড়া কেউ সাহায্য করে না। লোকটার অন্য উদ্দেশ্য নেই তো? বাসায় নেওয়ার কথা বলে যদি অন্য কোথাও নিয়ে যায়? কিন্তু এই মুহুর্তে আজমীর কোন উপায় নেই। এখানের রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। মোবাইল ফোন-ও নেই যে বাসায় ফোন করবে। তাই ফারহানের পিছু পিছু যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেইদিকেই যেতে থাকল।
ফারহান আজমীকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিল। আজমীর বাবা মেয়েকে দেখেই বুকে নিয়ে কেঁদে ফেললেন। চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন তারা। ধরেই নিয়েছিলেন অচেনা রাস্তায় আজমী বোধহয় হারিয়েই গেছে। ফারহানের মুখে সমস্ত ঘটনা শোনার পর আজমীর বাবা ফারহানের প্রতি কৃতজ্ঞতার কোন ভাষা খুঁজে পেলেন না। ফারহান কিছুতেই বসতে চাচ্ছিল না কিন্তু আজমীর বাবার জোরাজুরিতে বসতে বাধ্য হলো। আজমীর বাবা তো ফারহানকে নিয়ে কি করবেন ওকে কিভাবে আপ্যায়ন করবেন এসব নিয়ে একদম অস্থির হয়ে গেলেন। পারলে ফারহানকে মাথায় তোলেন এমন অবস্থা। আজমীদের বাসা থেকে রাতের খাবার খাইয়ে ফারহানকে ছাড়া হলো।
সেদিন ফারহান চলে যাওয়ার পরে আজমী তাদের ড্রয়িংরুমের সোফার নিচে একটা কাগজ খুঁজে পায়। কাগজটা খুলে দেখে- সেখানে একটা নাম্বার লেখা আর উপরে লেখা “আমার ফোন নাম্বার। কল করো প্লিজ। তুমি কল করলে খুব ভালো লাগবে।” আজমী কাগজ হাতে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। সারারাত তার আর ঘুম হলো না। ফারহান তার ভাবনার মাঝে বারবার চলে আসছিল। সারাটারাত সে ফারহানকে নিয়ে ভেবেই কাটিয়ে দিল।
পরেরদিন কলেজের গেটের সামনে ফারহানকে দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল আজমী। ফারহান এদিকে ঐদিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছিল। আজমীকে দেখে বলল, কালকে ফোন করতে বলেছিলাম? করলে না যে?-
আজমী উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি আমার কলেজ চিনলেন কিভাবে?
ফারহান হেসে বলল, ভয় পেয়েছ নাকি? ভাবছ পেছন পেছন তোমাকে ফলো করেছি। হা হা হা। তোমার বাবাই কালকে বলেছিল তুমি এই কলেজে পড়ো।
“ওহ্”
“তো কল দিলে না কেন? আমার একটারাতের ঘুম পুরো নষ্ট করলে।”
“মানে?” আজমী অবাক হয়ে তাকায়।
“মানে হচ্ছে আমি ম্যাডামের কলের অপেক্ষায় সারারাত জেগে ছিলাম।”
“স্যরি। আমার আসলে কোন ফোন নেই। কিন্তু আপনি আমার ফোনের জন্য জেগে ছিলেন কেন?”
ফারহান সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, যদি তোমার ফোন থাকে আমাকে কল করবে? চলো।
বলেই আজমীকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কিছুই বলে না। এদিকে আজমী যে জিগ্যেস করবে বেচারির সেই অবস্থাই নেই। এটা তার জীবনে প্রথম পুরুষের ছোঁয়া। বাবার পরে এই প্রথম কোন পুরুষ তার হাত ধরল। আজমীর বুকের ভেতর ধ্বুকপুক করছিল। নড়াচড়া বা কথা বলার কোন শক্তিই খুঁজে পাচ্ছিল না।
ফারহান আজমীকে একটা ফোনসেট কিনে দিয়ে বলল এটা রাখো। ঠিক রাত বারোটায় তোমার জন্য অপেক্ষা করব। যদি ইচ্ছা হয় ফোন করো। না ইচ্ছা হলে করো না। তোমার সাথে হয়তো কখনো দেখা হবে না। বাট ফোনটা রাখো। হয়তো অন্য কারো সাথে কথা বলার জন্য কাজে লাগবে।।
তারপর আরেক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল। আজমীর সেই সারাটাদিন প্রচণ্ড অস্থির কাটে। বাসায় ঢুকে ফোনটা তার পারসোনাল ড্রয়ারে তালা দিয়ে লুকিয়ে ফেলে। ফোন করবে কি করবে না এই ভাবতে ভাবতে এগারোটা বেজে যায়। রাত বারোটা। ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে আজমী। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজ দেখে নাম্বারটা ডায়াল করে। একবার রিং হতে না হতেই ফোন ধরল। যেন সে ফোন কানেই বসেছিল। অল্পসময়ে ফারহানের সাথে কথা বলাটা আজমীর দৈনিক রুটিনে পরিনত হলো। প্রতিদিন প্রায় সারারাত ওদের কথা হতো। কথা বলতে বলতে এমন অবস্থা যে দুইজন দুইজনের কাছে কিছু লুকোতে পারত না। অপরজনের কাছে না বললে শান্তি পেত না। আজমীর জীবনে ফারহান সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠল। আজমীর জন্য কলেজ গেটে অপেক্ষা করত ফারহান। তারপর আজমীকে বাড়ির গলি পর্যন্ত পৌঁছে দিত। মাঝে মাঝে ক্লাস বাদ দিয়ে দুইজন একত্রে রিকশায় ঘুরত। মেঘলা বিকেলের ঝড়ো হাওয়ায় হুডখোলা রিকশায় ফারহানের হাত ধরে ঘোরা, একপ্লেটে ফুচকা-চটপটি ভাগ করা; আজমীকে সারপ্রাইজ দিতে কলেজে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে দুজনে মেলায় যাওয়া; দামের কারণে আজমীর রেখে দেওয়া চূড়ি, কানের দুল আজমীকে কিনে পরিয়ে দেওয়া; কখনো কখনো শাড়ি পড়ার বায়না ধরা, বৃষ্টির দিনে এটছাতায় ভীষণ কাছাকাছি আসা দুজনের, আজমীর ঠোঁটে ফারহানের প্রথম স্পর্শ, ছোট ছোট মান-অভিমান, ঝগড়া, আবার ভালবাসা- আজমীর পরীক্ষার আগের দিন সারারাত ভিডিও কলে থেকে আজমীর সঙ্গে রাত জাগা, আজমী ঘুমিয়ে পড়ার পর ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, ফারহানের ভোরের ক্লাস এ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন এর ডেট মনে করিয়ে দেওয়া, দিনগুলো যেন খুব দ্রুত কেটে গেল। হয়তো ভালো সময় মানুষের জীবনে বেশিক্ষণ থাকে না।।
আজমী একদিন বাসায় হাতেনাতে ধরা পড়ল।।আজমীর ফোন কেড়ে নেওয়া হলো। কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ফারহান আজমীর যোগাযোগ বন্ধ হলো না। আজমীর বেস্ট ফ্রেন্ড আনিকা। যেমন সুন্দরী দেখতে, তেমন তার বুদ্ধি। কলেজের অনেক ছেলেই আনিকার প্রেমে পাগল। কিন্তু আনিকা প্রেম টেম পছন্দ করে না। খুব ভালো মেয়ে আনিকা। আনিকার ফোনে ফরহান রেগুলার ফোন দিত। আজমীর খোঁজ-খবর নিত আনিকার ফোনের মাধ্যমে। আজমীর থেকে আনিকার সাথেই কথাবার্তা বেশি হতো। এমনকি ওরা একসাথে ঘুরতে গেলেও সাথে আনিকা যেত। ফারহানের সাথে আনিকার সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। শালী হিসেবে সারাক্ষণ-ই ফারহানের পিছনে লাগত আনীকা। ফারহানো খুব মজা পেত আনিকার দুষ্টামিগুলোয়। ধীরে ধীরে বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়াল যেন আজমীই কেউ না; ফারহান ও আনিকা দুইজন দুইজনকে নিয়ে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে ফারহান কেমন যেন বদলাতে লাগল। আজমীর সঙ্গে কথা বলত কম, সময় তো দিতেই চাইত না। আজমী ফোন করলেও ধরত না। ধরলেও “ব্যস্ত পরে কথা বলো” এইটুকু বলেই শেষ। আজমী সব সমস্যা আনিকাকে খুলে বলল। আনিকা বলল “আরে গাধী ভাইয়ার এক্সাম চলছে। হুদাই সন্দেহ করিস না তো। এইজন্যই তোদের মতো মেয়েদের সবাই ফেলে চলে যায়। তোরা আসলেই রিডিকিউলাস।” আনিকার কথাগুলো যেন আজমীর বুকে গিয়ে গিঁথল। সে কি সত্যিই বিরক্তিকর? আনিকার মতো সুন্দর করে সাজতে জানে না- কারো সাথে সহজ হতে পারে না, কথায় কথায় হাসাতে পারে না, পাল্লা দিয়ে কথার লড়াই-ও করতে পারে না। তার সাথে থাকার কোন মজা নেই। সে প্রচুর ব্যাকডেটেড- বয়ফ্রেন্ড হয়েও ফারহানকে সে হাত ছাড়া শরীরের কোথাও ছুঁতে দেয় না। আর আনিকা বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডের কাঁধে মাথা রাখে ফারহানের গাল ধরে টেপাটেপি করে। এইসব আজমীর একদম পছন্দ ছিল না। কিন্তু ও ভাবত আনিকা আর ফারহান ভাইবোনের মত। আনিকাকে ও নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করে। আর ফারহান তো ওর জীবন। ওদেরকে সে ভুল বুঝতে পারে না।
প্রায় তিন মাস ফারহানের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। ফারহানের যে নাম্বারটি আজমীর কাছে ছিল সেটায় কল করে বোঝা গেল ফারহান সিম চেন্জ করেছে। আজমীর কোন সোশ্যাল সাইট নেই যে যোগাযোগ করবে। ভয়ে আজমীর বুক দুরুদুরু করছে। যে ফারহান একটা বেলা তার সাথে কথা না বলে থাকতে পারত না সে কিভাবে মাসের পর মাস তার সঙ্গে কথা না বলে রয়েছে। ফারহানের কোন বিপদ হয় নি তো? আজমী আর চিন্তা নিতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে ফারহানের দেওয়া ঠিকানামতো ফারহানের বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ফারহানদের বাসায় তখন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে। আনিকা ও ফারহানের।
চলবে