#আমার_সংসার
পর্ব-১২
Sara mehjabin
আচমকা আজমীর চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়। বসা থেকে সে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়। খুব কঠিন গলায় বলে, “আমি আমার ব্যক্তিগত কথা কাউকে বলি না। আপনাকেও বলতাম না। আপনি বলতে বাধ্য করেছেন তাই বলতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আমাকে আর কিছু জিগ্যেস করবেন না।”
“কাউকে ব্যক্তিগত কথা শেয়ার না করা কোন সমস্যা নয় আজমী। মানুষের জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর মুহুর্তগুলো কখন হালকা হয় জানো যখন সে তার কষ্টের সময়ের অনুভূতি কারো কাছে খুলে বলে। একদম খুলে প্রকাশ করে। আজমী আমি বুঝতে পারছি তোমার আঘাতটা অনেক বড়। কিন্তু আঘাত যতোই বড় হোক সেটা ভোলা যায়; যদি তুমি তার থেকে দূরে থাকো। কিন্তু তুমি তবুও সেই মানুষটার সঙ্গে রয়েছ। কেন রয়েছ? আর যে’ই মানুষটা একদিন তোমাকে পুরোপুরি খেলনা বানিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল তাকে তুমি পরে বিয়েই বা করলে কেন? এক বছর ধরে তুমি তার সঙ্গে সংসার করছ; কিন্তু কেন?”
“আমি আপনার সঙ্গে এতো কথা বলতে চাই না। যা বলেছি তাও বলতাম না। আপনি বাধ্য করেছেন বলতে।”
“বাধ্য করেছি কারন আমি চাই তুমি ভালো থাকো। তোমার জীবনের কালো অধ্যায়টা ছাড়িয়ে নতুন জীবনে পা রাখো। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই আজমী। তুমি বোঝো না?”
রিফানের দিকে তাকিয়ে আজমী শান্ত দৃষ্টির ভরসা জাগানো দুটি চোখ দেখতে পেল। যে চোখ ভালবাসায় পূর্ন। কিন্তু আজমী এই চোখকে এখন সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না।
“না আমি বুঝি না। আর বুঝতেও চাই না। আপনি এমন কাউকে খুঁজে নিন যে বুঝতে চায় কিংবা আপনাকে বুঝতে পারে।”
আজমীর হাত ধরে টেনে ওকে নিজের দিকে ঘোরায়। একদম বুকের কাছে টেনে নেয়। ছোট্ট ঘরটার টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে। তারমধ্যে রিফান আজমীর দুইগালে হাত রেখে ওকে খুব কাছে টেনে নেয়। আজমী খুব চেষ্টা করতে থাকে নিজেকে ছাড়ানোর। কিন্তু রিফানের শক্ত বাহুডোরের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে না। রিফান আজমীর মুখের কাছে মুখ এনে বলে, “কিন্তু আমি তো তোমাকে বুঝতে চাই।”
“ঠাস”
রিফানকে সশব্দে থাপ্পড় মেরেছে আজমী। “লজ্জা করে না একটা বিবাহিত মেয়েকে এসব কথা বলতে?”
“বিবাহিত! যার স্বামীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক-ই নেই সেখানে বিবাহিত কিভাবে হলে?”
“চুপ করুন। আপনাকে এত কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে আমার থেকে দূরে থাকবেন নাহয় আমি স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবো। আমার সেই যোগ্যতা আছে অন্য জায়গায় চাকরি করার।”
আজমী উঠে দাঁড়িয়ে যেতে নিলেই প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাত হয়। এতক্ষণ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। বজ্রপাতের শব্দটা হওয়ার পরপর বৃষ্টি জোরে পড়তে লাগল। জোরে জোরে বৃষ্টি পড়তে দেখে আজমী কেমন যেন থমকে গেল। ওর হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। বৃষ্টির শব্দ আরেকটু জোরে হতেই আজমী “নাআআ” চিৎকার করে দুইহাতে কান চেপে ধরে। আজমীর এই অবস্থা দেখে রিফান তাড়াতাড়ি ওর কাছে যায়। ওকে ধরার জন্য হাত এগোতে আজমী নিজে থেকেই রিফানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। শক্তভাবে রিফানকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। যেন নিজের জমানো রাগ-কষ্ট ভয় সব কান্নার সঙ্গে বের করে দিচ্ছে। রিফান হাতটা তোলে ধীরে ধীরে আজমীর মাথায় রাখে। আলতোভাবে মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
“কি হয়েছে আজমী? দ্যাখো আমি তোমার সামনে। এত ভয় কেন পাচ্ছ?”
আজমী চেহারায় কেমন অসহায় ছাপ। সে রিফানের বুকের সঙ্গে নিজেকে আরো শক্তভাবে মিশিয়ে নেয়, “সেদিনো এরকমই বৃষ্টি ছিল। না, এর চেয়েও জোরে বৃষ্টি পড়ছিল আনিকাদের গায়ে হলুদের দিন। বৃষ্টির মধ্যে ওরা আমাকে বের করে দেয়। আমার তখন পৃথিবীর কোন খেয়াল নেই। আসলে ফারহানকে নিয়ে অনেক আবেগ ছিল তো; পায়ের নিচে যেন মাটি নেই এরকম মনে হচ্ছিল। আকাশ কালো করে মেঘ হয়েছিল। একটু পর পর জোরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছিল। রাস্তাঘাটে একটা মানুষ-ও ছিল না। তারমধ্যে আমি নেশাগ্রস্তের মতো হেঁটে যাচ্ছিলাম। কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি কিছুই খেয়াল করছিলাম না শুধুই হাঁটছিলাম আর মাথায় শুধু বাজছিল ফারহানের বলা কথাগুলো। ঠিকই করে ফেললাম এই জীবন আর রাখব না। হঠাৎ করে কেউ একজন আমাকে হাতে ধরে টান দেয়। আমি কিছুই বলি না। দেখি ওরা একজন নয় চার-পাঁচজন। তাও কোন প্রতিবাদ করি না। ওরা দেখে ভেবেছিল আমার মাথা ঠিক নেই। ওরা আমাকে একটা বদ্ধ ঘরে নিয়ে যায়। টানা দুই ঘন্টা ধর্ষন করে। এই কষ্টটা কাউকে বোঝানোর মতো নয়। ঐ সময়ে আমার ওপরে কি হয়েছিল আমিই জানি। আমি ওখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। পরেরদিন সকালে কিছু লোক আমাকে ঐখান থেকে হাসপাতালে নেয়। আমার ধর্ষিতা হওয়ার খবর কেউ জানতে বাকি থাকে না। আমার বাবা-মার সব মান-সম্মান আমার কারনে শেষ হয়ে যায়। আমার কারণে তারা এই সমাজে সবার থেকে আলাদা হয়ে যান। আপনি জিগ্যেস করেছিলেন না আমি কেন এতবছর পরে আবার ঐ লোকটাকে বিয়ে করলাম। কারন আমি তাকে চিনতেই পারি নি। ঐ ঘটনায় আমি প্রচণ্ড শক পেয়েছিলাম। আমার স্মৃতি থেকে অনেক কিছুই মুছে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে ফারহানের কোন ঘটনা আমার মনে পড়ত না। এরকম আরো অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারতাম না। আসলে ঐ সময় আমি মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়ি। মানে কয়েকবছরের জন্য আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায়। সেইসময়-ই ফারহানের সব স্মৃতি ভুলে যাই আমি। আমার বাবা-মা সেইসময়গুলো কতটা কষ্টে পার করেছেন আমি জানি না। তবে পৃথিবীতে ঐ দুজন মানুষ কখনো আমাকে ফেলে দেন নি। বিশেষ করে আমার বাবা। একবছর পর আমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। নিজের মতো পড়াশোনা করি। চাকরিবাকরি শুরু করি। আমার বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। আমার কোন দোষ না থাকলেও সব পাত্রপক্ষ আমাকে রিজেক্ট করে দিচ্ছে। যেহেতু আমি অতীতের ঘটনা কিছুই মনে রাখি নি তাই বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। আমার মনে হয় নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন রহস্য আছে। বাবা আমার কাছে কিছুতেই এসব বলতে চায় নি। যাতে আমি দ্বিতীয়বার কোন শক না পাই। কিন্তু আমার জিদের কাছে হার মানতে হয়। বাবার মুখে সবকিছু শোনার পরেও আমি ভেঙে পড়ি না। কারণ এখন আর আমি আগের মতো নই। অনেক শক্ত হয়ে গেছি। এজন্যই ফারহানকে দেখে আমি চিনতে পারি নি। ওরা যখন দেখতে এসেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায় আমি একেবারে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মতো একটা মেয়েকে সব জেনেও বাড়ির বৌ করতে চাইছে ভেবে সত্যি অবাক হই। তখন তো আর জানতাম না এর পেছনে এত বড় সত্যি লুকিয়ে আছে। বাসর রাতে ফারহান যখন আমাকে আনিকার ছবি দেখায় তখন সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।”
“তারপরেও তুমি এক বছর ঐ লোকের সঙ্গে সংসার করছ? কেন করছ? দ্যাখো আজমী আমি আর কোনভাবেই ঐ লোকের সঙ্গে তোমাকে থাকতে দেব না। তোমার বাবা-মা’র সঙ্গে আমি কথা বলব। ওনাদের সব জানাব। তোমাকে ঐ লোকের থেকে মুক্তি নিতেই হবে। আমি তার সাথে তোমাকে থাকতে দেব না। সেটা তুমি চাও বা না চাও।”
“আমি না চাইলে আমাকে আমার সংসার থেকে কেউ বের করতে পারবে না। কথাটা মনে রাখবেন আর আমার ব্যক্থিগত বিষয়ে আপনার ভাবার দরকার নেই।”
বলেই আজমী বৃষ্টির মধ্যেই ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেল।
গত এক বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। আজমী ফারহানের সংসারে রিশানকে দেখাশোনার পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। কারন নিজের পায়ে না দাড়ালে ওকে ফারহানের ওপর নির্ভর করতে হবে যা সম্ভব নয় কোনমতেই। এরমধ্যে একদিন পেপারে একটা বিজ্ঞাপন দিল। শহরের একটা বিখ্যাত প্রাইভেট স্কুলের জন্য টিচার লাগবে। স্কুলটা শুধুমাত্র এতিম বাচ্চাদের জন্য। শহরের একটা ধনী পরিবার স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্কুলের সব খরচ , টিচারদের বেতন ঐ পরিবারের লোকেরাই দেয়। এই পরিবারেরই ছেলে রিফান। আজমী দেখল বেতন খুব ভালো। তাছাড়া পড়ানোর কাজ আর বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে আজমীর খুব ভালো লাগে। তাই আজমী চাকরিটা জয়েন করেই ফেলল। স্কুলে আজমী খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রিফান তখন মাত্র লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছে। একদিন স্কুল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে এসে সবার মুখে স্কুলের একজন টিচারের খুবই প্রশংসা শুনতে পায়। স্কুলের সবদিক নাকি সেই নিজের দায়িত্বে সামাল দেয়। মাত্র কয়েকমাসে স্কুলের সব বাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় ম্যাডামে পরিনত হয়েছে। আজমীর কাজের প্রশংসায় রিফান তখনই আজমীর সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু আজমীকে ডিরেক্টর চেম্বারে দেখা করার জন্য ডেকে আনার পর যা ঘটে তার জন্য কেউ মোটেও প্রস্তত ছিল না। আজমী “ঠাস” করে রিফানের গালে থাপ্পড় মারে। পুরো স্কুল কমিটি বোর্ডের মাথায় হাত। আজমী এতো ভালো একটা মেয়ে; ওর চাকরিটা বোধহয় আর থাকবে না।
“ছোটলোক ইতর আপনি এখানে কি করছেন? আমাকে ফলো করতে করতে স্কুলে হাজির হয়েছেন? অসভ্য কোথাকার!”
চলবে