আমার সংসার পর্ব ৫

#আমার_সংসার
পর্ব-০৫
Sara Mehjabin

পরেরদিন ঘুম ভাঙতেই আজমী নিজেকে ফারহানের বিছানায় আবিষ্কার করে। একটা সাদা চাদর দিয়ে তার শরীর মোড়ানো। চোখ খুলতেই মনে হলো সারা শরীর যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মাথা ভার ভার লাগছে। গায়ের থেকে চাদর সরিয়ে আজমী যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না; আজমীর গায়ে কোন কপড় নেই। কাপড় নেই বলা ভুল; শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোটের ওপর শাড়িটা শুধু পেচানো আছে। কিন্তু কালকে রাতে যে শাড়ি পড়ে ছিল সেটা নয়; অন‍্য একটা শাড়ি।

কিছুক্ষণ পর ফারহান ঘরে আসল। খাবারের প্লেট নিয়ে। দেখল আজমী চাদর জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে।

“এখন কেমন লাগছে আজমী? কোনো কষ্ট নেই তো?”

আজমীর পাশে বসে কপালে হাত রাখে। প্লেট থেকে খাবার তুলে চামচ দিয়ে আজমীর মুখের সামনে ধরে।

“তোমার শরীরটা তো খারাপ। আমি তোমাকে খাইয়ে দেই।”

আজমী ধাক্কা দিয়ে ফারহানের হাত থেকে খাবার ফেলে দিল। তারপর একটানে গায়ের চাদর সরিয়ে দিল।

“কি, আমাকে এইভাবে দেখে খুব অবাক লাগছে তাই না? ভাবছেন আমার গায়ে শাড়ি কিভাবে? আপনি তো খুলে রেখেছিলেন।”

“হ‍্যা আজমী তোমার শাড়ি আমিই খুলেছি। কিন্তু আমার পুরো কথাটা তুমি শোনো‌। কালকে রাতে তোমার কি অবস্থা হয়েছিল তুমি চিন্তাও করতে
পারবে না।”

“চুপ করুন। আপনার আর মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন নেই। আপনি না বলেছিলেন শুধু আপনার ছেলের মায়ের অভাব পূরন করতে হবে। আমার কাছে আর কিচ্ছু চাইবেন না। কিন্তু আপনি ঠিকই সুযোগ নিলেন। ছিঃ আপনার জীবনে এতো ঘটনা ঘটে গেছে তাও আপনি একটুও বদলান নি।”

“তুমি নিজেকে যেই অবস্থায় দেখেছ মাথা ঠিক রাখা সম্ভব না। আমি বুঝতে পারছি আমার ওপরে অনেক রাগ হচ্ছে; ঘৃনাও হচ্ছে। কিন্তু আমার কথা শোনো..”

আজমী ফারহানকে ধাক্কা মেরে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
“আজমী দরজা খোলো। আজমী..তুমি অসুস্থ। এতক্ষণ শাওয়ারের নিচে থাকলে আরো অসুস্থ হবে। ঠান্ডা পানির কারনে তোমার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে। প্লিজ আজমী বেরিয়ে আসো।”

শাওয়ারের শব্দের মধ‍্যেও আজমীর জোরে জোরে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ফারহান অনেক্ষন দরজায় ধাক্কিয়ে দরজার বাইরে মাথা চেপে মাটিতে বসে পড়ল। আজমী তাকে ভুল বুঝছে। কাল রাতে তার কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। যা সে করেছে তা তাকে করতে হয়েছে। আজমীর জন‍্য-ই করতে বাধ‍্য হয়েছে।

কালকে রাত..

মাঝখানে প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ফারহানের। পাশে তাকিয়ে দেখে রিশান ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আজমী নেই। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খুব জোরে জোরে। ফারহান তাড়াতাড়ি রিশানের কান চেপে ধরল। বিদ্যুতের আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে খুব ভয় পেত। তারপর ঘরের দরজা-জানালাগুলো দ্রুত বন্ধ করে দিল।

আজমীকে ঘরের সব জায়গায় এমনকি বাথরুমেও পাওয়া গেল না। ব‍্যলকনিতে গিয়ে দেখল আজমী বৃষ্টির পানির মধ্যে শুয়ে আছে। পুরো শরীর ভিজে গেছে‌ পানিতে। ফারহান আজমীর কাছে মাটিতে বসে। আজমীকে অনেকবার ডাক দেয়। কিন্তু আজমী কোন উত্তর দিল না। আজমীর শরীর স্পর্শ করতেই টের পেল পাথরের মতো ঠান্ডা। আজমী মুখ হা ক‍রে টেনে টেনে শ্বাস তুলছিল আর গোঙানির মতো শব্দ করছিল।

ফারহান দ্রুত আজমীকে টেনে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। সোফায় শুইয়ে দেয়। ভেজা শাড়িটা খুলে চাদর দিয়ে আজমীর শরীর জড়িয়ে দেয়।আজমীর হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো খোলা কিন্তু কোন রেসপন্স করছে না। বারবার বুক ওঠানামা করে গোঙানির মতো শ্বাস নিচ্ছে। ফারহান আজমীর হাত-পা ঘষে গরম করার চেষ্টা করে কিন্ত কিছু হয় না। এদিকে আজমীর অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। শ্বাসকষ্টের কারনে ছটফট করছে।

“কিচ্ছু হবে না আজমী। তোমার কিচ্ছু হবে না। চিন্তা করো না। তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে

আজমীর হাতদুটো মুঠোয় ধরে ফারহান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ফারহান বুঝতে পারছে কোন কারনে আজমী ঠিকমতো অক্সিজেন নিতে পারছে না। তাই ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাই আজমীর শ্বাসকষ্ট কমাতে হলে ওকে আগে পর্যাপ্ত অক্সিজেন দিতে হবে। আর কিছু চিন্তা না করে ফারহান আজমীর ঠোঁটজোড়া নিজের মুখের ভেত‍র টেনে নিল। সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে আজমীকে অক্সিজেন দিতে থাকে। ফারহানের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে আজমী ওকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। ধীরে ধীরে আজমীর শ্বাসকষ্ট কমে যায়। কিন্তু শরীর তখনো বরফের মতো ঠান্ডা। যতক্ষণ ফারহান ওকে স্পর্শ করে থাকে ততক্ষণ একটু রেসপন্স করে; ফারহান ছেড়ে দিলেই আবার নিস্তেজ হয়ে যায়। ফারহান বুঝতে পারল তাকে কি করতে হবে।

“আমাকে ক্ষমা করে দিও আজমী। আমি জানি যা করছি তা অন‍্যায়। কিন্তু আমার কিচ্ছু করার নেই। আমার সবার আগে তুমি, তোমার জীবন। তোমাকে বাঁচাতে আমি সব ধরনের অন‍্যায়ে রাজি। আমার অন‍্যায়ের ফলাফল হিসেবে তোমার কষ্ট কমলে সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ন‍্যায়।” আজমীর কপালে চুমু খেয়ে গায়ের ওপর থেকে আলতোভাবে চাদরটা সরিয়ে দিল। তারপর আজমীর অসাড় হওয়া শরীরটাকে নিজের মধ‍্যে টেনে নিল। ফারহানের শরীরের ওমের ভেতর অল্প অল্প করে আজমীর শরীরের উষ্ণতা ফিরে এল। একসময় আজমী স্বাভাবিক হয়ে আসল। ফারহান ভেজা শাড়ি সরিয়ে তোয়ালে দিয়ে আজমীর চুলসহ শরীর মুছিয়ে আলমারি থেকে পড়ানোর জন্য নতুন শাড়ি বের করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ফারহান শাড়ি পড়াতে পারে না। তাই শাড়ি খালি কোনরকম পেচিয়ে আজমীকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সারারাত আজমীর শরীর ভীষণ খারাপ ছিল। ফারহান শেষরাত পর্যন্ত আজমীর সেবা করে। ভেবেছিল আজমী ঘুম থেকে উঠলে ওকে ধীরেসুস্থে সব বোঝাবে। কিন্তু আজমী আগেই ওকে ভুল বুঝল। এখন হয়তো আজমী আরো বেশি ঘৃণা করবে ওকে।

“পাপা পাপা কি ভাবত? আমলা বেরু বেরু (বেড়াতে) যাব না?”

রিশান ফারহানের গেন্জির কোনা ধরে টানছে‌। রিশানের কথায় ফারহানের ধ‍্যান ভঙ্গ হল। রিশান আবারও বলল, কি হলো বলো? যাব না? আচ্ছা মাম্মা কোতায় পাপা?

রিশানের কথায় মনে পড়ল আজকে আজমীদের বাসায় যাওয়ার কথা। আজমীর ঐ অবস্থায় ফারহান ভুলেই গিয়েছিল। যাক নিজের বাসায় গিয়ে আজমী যদি একটু স্বাভাবিক হয়! তাছাড়া রিশান তো আজমীদের বাসায় যাওয়ার জন্য কালকে থেকে রেডি হয়ে আছে।

বাসায় যাওয়ার পর আজমীর মুডটা একটু ঠিক হলো। বাড়ির সবাই খুব খুশি আজমীকে দেখে।
রিশানো আনন্দেই আছে। আজমীর ভাই হৃদয়ের ছেলেমেয়ের সাথে খেলাধুলা করছে‌; আশেপাশের বাসা থেকেও অনেক বাচ্চারা এসেছে। বয়স কম হলেও রিশান খুব মিশুক স্বভাবের; অল্প সময়েই সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। শুধু বাচ্চারা নয়, আজমীদের বাসার সবাই রিশানকে ভালবেসে ফেলেছে। শুধু আজমীর মা নাজমা বেগম ফিরতি অনুষ্ঠানে রিশানকে আনা পছন্দ করলেন না।

“হ‍্যা রে আজমী তুই গাধা নাকি রে? বিয়ের পর প্রথমবার বাবার বাড়ি আসলি..সাথে ঐ বাচ্চা কেন? এমনিতে তোর শশুরবাড়িতে এতো লোক সেইখানে জামাইয়ের সাথে আলাদা সময় কাটাতে পারস না। বাপের বাড়ি আসছিস..ইচ্ছামতো জামাই নিয়ে ঘুরবি, জামাইয়ের কাছাকাছি যাবি এভাবেই না জামাইয়ের মনে জায়গা হবে! তা বাদ দিয়ে মানুষের বাচ্চা কোলে নিয়ে চলে আসছিস‌। বাচ্চাটা তো একটা সেকেন্ড তোকে ছাড়ে না। জামাইয়ের সাথে আলাদা সময় কাটাবি কখন? তোকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে তাই কি তোর কাজ শুধু বাচ্চা পালা? তোর কোন শখ আহ্লাদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাই?”

“না নাই। আমার এতো শখ আহ্লাদ জাগে না। আর তোমার জামাইয়ের সাথে আমার আলাদা সময়ের কোন দরকার নেই। বরং সে আমার থেকে দূরে থাকাই ভালো। আর সারাক্ষন মানুষের বাচ্চা মানুষের বাচ্চা বন্ধ করো। আমি কোনো মানুষের বাচ্চা পালছি না। আমার নিজের বাচ্চাকে মানুষ করছি।”

এছাড়া বাড়িতে আজমীর সারাদিন ভালোই কাটল। রিশানকে নিয়ে আনন্দেই আছে ও। আজমীরা আসার পরেরদিন আজমীর দুই বান্ধবী ফারিহা ও সারা আসল। আজমীর সাথে দেখা করতে।

সারা বলল, আজমী আমরা কিন্ত দেখা করতে আসি নাই। আসছি তোকে নিয়ে যেতে। আজকে আমাদের বাসায় তোদের দাওয়াত। চল্।

বলেই আজমীর হাত ধরে টান দিল।

আজমী বলল, আরে না না আমি কিভাবে যাব? আমি গেলে রিশানকে কে দেখবে?

ফারিহা বলল, আমাদের কে ছাগল ভাবিস তুই? তুই যে এখন মা হয়েছিস সেটা আমরা জানি না। আরে তোকে তো দাওয়াত দেওয়ার মেইন কারন এই মিষ্টি বাবুটাকে ধরে নিয়ে যাওয়া‌।

রিশানের গালগুলো টান দিল।।

এমন সময় নাজমা বেগম সেখানে উপস্থিত হলেন, না না এই ভরদুপুরের রোদের মধ্যে ছোট মানুষ ওকে বের করা দরকার নাই‌। আজমী তুই যা জামাইকে সাথে নিয়া ঘুরে আয়। রিশানকে নিয়া পরে আবার যাইস।

আজমী বলল, তাহলে থাক রে। আমরা কালকে বিকালে যাবো নি।

নাজমা বেগম বললেন, ওমা..মেয়েগুলো দাওয়াত দিতে এসেছে না যাওয়াটা খারাপ দেখায় না? ওদের বাসায়-ও নিশ্চয়ই আয়োজন করছে তোদের জন্য। এখন তোরা না গেলে ওদের বাসার লোকজন কি মনে করবে। যা তো..জামাইকে নিয়ে যা। রিশানকে হৃদয়ের বাসায় দিয়ে আসব নে। পোলাপানের সাথে খেলাধুলা করবে।

অবশেষে মায়ের জোরাজুরিতে আর সারাদের মন খারাপ হবে চিন্তা করে রিশানকে বাসায় রেখে যেতে রাজি হলো। এমনকি ফারহান-ও বলল। যদিও আজমীর মন সায় দিচ্ছিল না।রিশানের ওপর কি যে মায়া লেগেছে..একটা মুহুর্ত-ও ওকে না দেখে থাকতে পারে না। নিজের ছেলে তাও ফারহানের কোন টেনশন হচ্ছে না; কিন্তু রিশানকে রেখে আসার পর থেকে আজমীর বুক ধ্বুকপুক করছে।

সারাদের বাসা থেকে আসার পর ফারহান আর আজমী দেখল বাসার দরজা খোলা রয়েছে। আজমীর মা নিজের রুমে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। রিশান কোথাও নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here