আমার সংসার পর্ব ৬

আমার সংসার
পর্ব-০৬
Sara Mehjabin

ফারহান আর আজমী বাসায় ফিরে রিশানকে কোথাও পেল না। দুইজনে মিলে সম্পূর্ণ বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজল; কোথাও রিশান নেই। আজমী চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। ওইটুকু একটা বাচ্চা, একা কোথায় যাবে?

এইদিকে আজমীর মা তখনো নিজের রুমে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আজমী তার মায়ের গায়ে ধাক্কা দিতে লাগল,
“এই আম্মা রিশান কৈ? আম্মা উঠো…রিশানকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তোমাকে বলছিলাম ওকে দেখে রাখতে। ও কৈ গেছে? এই আম্মা উঠো।”

আজমীর মা ঘুমের মধ্য আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললেন, “এই সমস্যা কি তোর আজমী? ঘুমের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করছিস? শান্তিতে কি একটু ঘুমাইতেও দিবি না। চোখটা লেগে আসছিল..কাচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি।”

“রিশানকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তোমার ঘুম জরুরি হয়ে গেল! বাসার দরজা খোলা কেন? রিশানকে কোথাও পাচ্ছি না। ও কোথায় গেছে? তুমি কি করছিলা? তোমাকে না বলে গেছিলাম ওকে দেখে রাখো!”

“কি জানি ও কৈ গেছে। দুপুরে খাওয়ার পর চোখটা লেগে আসছিল। দরজাটা আটকাতে ভুলে গেছিলাম। দরজা খোলা পেয়ে বের হয়ে গেছে। আমি কি করব।”

“বাহ্, দারুণ কথাটা বললে। আমি তো রিশানকে রেখে যেতে চাই নাই। তুমিই বললে তুমি ওকে দেখবে। তাই ওকে রেখে গেলাম আর তুমি বাসার দরজা খোলা রেখে নিজে ঘুমিয়ে পড়লা। তোমার কাছে রিশানকে রাখাই আমার ভুল হয়েছে।”

আজমী কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়েছে।

“হোয়াট? এতোটা কেয়ারলেস আপনি কিভাবে হতে পারেন? একটা কথা মনে রাখবেন আমার ছেলেকে পাওয়া গেলে তো ভালো; কিন্তু যদি আমার ছেলের একবিন্দু আচড়-ও লাগে আপনি আমার ভয়ংকর রূপ দেখবেন। আপনার যে আমি কি অবস্থা করব আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। আজমীর মা বলে ছাড় পাবেন না। আমার ছেলে আমার কাছে পুরো দুনিয়া, আমার সবকিছু। ওর জন্য আমি সব করতে পারি।”

ফারহানের কথা শুই এইবার আজমীর মা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। সত্যি তার অসাবধানতার জন‍্য-ই রিশান হারিয়েছে। রিশানকে যদি সত্যি আর পাওয়া না যায়? ফারহান নিশ্চিত থানা-পুলিশ করবে। আজমীর মায়ের খুব ভয় হচ্ছে না জানি তিনি ফেঁসে যান।

রিশানের জন্য আজমীর কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ার অবস্থা। আজমীর অবস্থা দেখে ফারহান নিজেকে শক্ত করে। আজমীর মাথায় হাত রেখে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। ফারহানের স্পর্শ পেয়ে আজমী আরো জোরে কেঁদে দেয়,
“আমার ভুলের কারণে সব হলো। আমি কেন রিশানকে রেখে গেলাম। ও কতবার বলেছিল আমাদের সাথে যাবে।”

“থাক আজমী কান্না করো না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমাদের এখন রিশানকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে। আমার মনে হয় রিশান তো অনেক চঞ্চল। আশেপাশের কোন বাসায় খেলার জন‍্য চলে গিয়েছে। তুমি একটু তোমাদের আশেপাশের বাসাগুলোতে যাও। আমার মনে হয় রিশানকে ওখানেই পাওয়া যাবে। কান্নাকাটি করো না। রিশানের কিচ্ছু হবে না। ওকে আমরা খুঁজে পাবো। কোনো ভয় নেই।”

আজমী হঠাৎ ফারহানের হাত চেপে দরল, আমার রিশানকে এনে দিন। প্লিজ ওকে আমার কাছে এনে দিন। কোন ক্ষতি হয় নি তো আমার বাচ্চাটার?”

“না কিচ্ছু হয় নি। আমাদের ছেলের কিচ্ছু হবে না। আর আমি রিশানকে ফিরিয়ে আনব যেখান থেকে পারি।” আজমীর গালে হাত রেখে ফারহান কথাগুলো বলছিল। এরইমধ‍্যে আজমীর গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। ফারহান নিজের হাতে তা মুছে দিতে নিলে আজমী ফারহানকে সরিয়ে দ্রুত আচল দিয়ে চোখ মুছে বেরিয়ে যায়।

আজমীর বাবা নামাজে গিয়েছিলেন। বাসায় এসে এসব ঘটনা শুনে স্ত্রীর উপর প্রচণ্ড রেগে বকাবকি করেন। আজমীর মা অন‍্যসময় হলে আজমীর বাবাকে ধুয়ে দিতেন। এখন পুলিশের ভয়ে চুপ আছেন।

ফারহান এবং আজমীর বাবা ঠিক করলেন থানায় যেতে হবে। মিসি‌‌ং ডায়েরি করানোর জন্য। তখনই পিছনের দরজা দিয়ে রিশান ঢুকল। হাতে একগাদা চিপস চকলেট বিভিন্ন রঙিন কালারের বেলুন অন‍্যহাতে একটা চকলেট কোন আইসক্রিম চেটে চেটে খাচ্ছে। যার ফলে ফরসা মুখের চারিদিকে চকলেটের দাড়ি তৈরি হয়ে গেছে।

ফারহানকে দেখে রিশান ‘পাপা’ ডেকে চিৎকার করে ওঠে। তারপর দৌড়ে গিয়ে ফারহানকে জড়িয়ে ধরে। ফারহান যেন ভাবতেই পারছে না রিশান তার সামনে। ও একদম ঠিক আছে। এটা ভাবতেই রিশানকে বুকের সাথে মিশিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। রিশানকে হারানোর ভয়টা এখনো ভুলতে পারছে না। আজমীর বাবাও এসে রিশানকে আদর করে দিলেন‌।

“পাপা কি হয়েতে? তুমি কাদত কেন? ডোন্ত ক্লাই (ক্রাই)।” হাত দিয়ে ফারহানের চোখের পানি গালে মুছিয়ে দিয়ে।

“তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে আব্বু? আমরা কেউ তোমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর এগুলো এত জিনিস কে দিল তোমায় বাবা?”

“একটা আন্টি দিয়েছে। আমি রাস্তায় বল খেলছিলাম। আমাকে কোলে করে নিয়ে গেল। আন্টিটা অনেক ভালো জানো পাপা। আমার সঙ্গে অনেক খেলল। অনেক গল্প বলল। আমাকে নিয়ে ঘুরতে গেল। তারপর এতোগুলো চকলেট কিনে দিল। আমি আন্টিটাকে আমাদের বাসায় আসতে বলেছি।”

“কিহ্..একটা অচেনা মানুষের সাথে তুমি এতক্ষণ ছিলে? দিস ইজ ভেরি ব‍্যাড বাবা..পাপা না বলেছে অচেনা অজানা মানুষ রাস্তায় কিছু দিলে নেবে না।”

“তুমি তো পতা লোকদের কাছ থেকে নিতে না কলেছ‍। আন্টিতা তো ভালো‌। অনেক ভালো।”

“আচ্ছা তুমি আন্টিটাকে দেখেছ?”

রিশান দুইপাশে মাথা নাড়ল। “না, আন্টিতা বোলকা পলেছিল। কালো লঙের (রঙের)।”

“ওরে আমার সোনার টুকরা, আমার কলিজার টুকরা তুই ফিরে এসেছিস? তোকে ছাড়া ঘরটা পুরো ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছিল। আয় বুকে আয়। হায় হায় রে কৈ চলে গিয়েছিলি তুই?” আজমীর মা রিশানকে কোলে তুলে গালে চুমু দিতেই রিশান বলল, তোমার লজ্জা করে না একটা মহিলা মানুষ একটা ছেলে মানুষকে চুম্মা দিচ্ছ? আর মাম্মা বাইরে যাওয়ার পরে তুমি না বললে আমি একটা বান্দর, একটা শয়তানের জাহাজ, এখন বলছ আমি সোনার টুকরা, কলিজার টুকরা। আমি আসলে কি? আমি কনফিউজ হয়ে যাচ্ছি। পাপা তুমি বলো তো আমি কি– বান্দর, শয়তানের জাহাজ, নাকি সোনার টুকরা নাকি কলিজার টুকরা। একটা মানুষ একসাথে এতকিছু কিভাবে হয়?”

আজমীর বাবা বললেন, কিহ্? তুমি ওকে এইসব বলেছ? একটা ছোট বাচ্চাকে এসব বাজে কথা বলতে তোমার লজ্জা করল না?
তারপর রিশানকে বললেন, খিদা লাগছে ভাই? কিছু খেয়েছ?

রিশান বলল, হুম খেয়েছি তো। ওর কাছে (আজমীর মাকে হাত দিয়ে দেখিয়ে) কেক চেয়েছিলাম। ও বলল কেক খাওয়া ভালো না। কেক খাইতে হয় না। তারপর মাটির মধ্যে মুড়ি ফেলে বলল নে এগুলা টুকায়া টুকায়া খা। (ঠিক আজমীর মায়ের মতোন ভঙ্গি করে বলল)।

ফারহান অবাক হয়ে আজমীর মায়ের দিকে তাকাল। একটা মানুষের মানসিকতা এতো নিচ হতে পারে। তাও আজমীর মতো মেয়ের মা।

ফারহান: আপনার এতো বড় সাহস আপনি আমার ছেলের সঙ্গে এইসব করেছেন? কোন সাহসে এগুলো করেছেন বলুন‌। আপনার কি মনে হয়েছে এইসব শোনার পর আমি আপনাকে ছেড়ে দিব। চাইল্ড এ্যাবিউসের কেস করব আপনার বিরুদ্ধে।

আজমীর বাবা: ছিঃ নাজমা ছিঃ মেয়ে মেয়ের জামাই ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে দুইদিনের জন্য থাকতে আসছে। তোমার মেয়ে যেখানে বাচ্চাটাকে মেনে নিয়েছে সেখানে তোমার সমস্যা কিসের? নতুন জামাইয়ের সামনে আমার মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলে। আমি আর কোনদিন আজমীর সামনে মুখ দেখাতে পারব না। বাবা, তুমি কিছু মনে করো না। আমি জানতাম না আমার স্ত্রী এতো নিচ হতে পারে,,,,তাহলে আমি রিশানের সাথেই থাকতাম‌। বাবা আমি জানি নিজের সন্তানের সঙ্গে কেউ দুর্ব‍্যবহার করলে অনেক কষ্ট হয়। তবুও আমি তোমার সামনে হাতজোড় করছি..তুমি আমাকে মাফ করে দিও। তোমার বাচ্চা তার নানারবাড়ি এসে কোনো যত্ন-ই পায় নি।”

আজমীর বাবা ফারহানের সামনে হাতজোড় করেন। ফারহান তার হাত ধরে বলল, আপনি কেন ক্ষমা চাচ্ছেন বাবা? আপনার তো কোন দোষ নেই‌। আমি আপনার ছেলের মতো। প্লিজ আমার সামনে হাতজোড় করবেন না। কিন্তু এই বাড়িতে এটাই আমার শেষ আসা। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে আর কখনো আপনাদের বাড়িতে আসব না। হ‍্যা, আপনারা আজমীর বাবা-মা, ওর আপনাদের কথা মনে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। আমি ওকে আসতে বাধা দিব না। আপনাদের মেয়ে সবসময় আপনাদের কাছে আসবে‌। কিন্তু একটা কথা আপনার স্ত্রী যেন কোনদিন আমার বাসায় না আসে। আজমী ফিরে আসলেই আমরা রওনা দিচ্ছি। এই বাড়িতে আমি আর এক সেকেন্ড-ও থাকব না।”

এলাকার প্রায় সবগুলো বাড়ি খুঁজেও আজমী রিশানকে কোথাও পায় নি। ভয়ে-চিন্তায় আধমরা হয়ে গেছে আজমী‌। দৌড়াদৌড়ি করার কারনে প্রচুর ক্লান্ত-ও। রাস্তায় যাকে পাচ্ছে মোবাইলে রিশানের ছবি দেখিয়ে জিগ্যেস করছে ওকে দেখেছে কিনা। কেউ কিছুই বলতে পারছে না। হঠাৎ একটা লোক নিজে থেকেই এসে বলল, আপা কাউকে খুঁজছেন?

আজমী অস্থিরভাবে বলল, জ্বি ভাই..ছবির বাচ্চাটা দেখছেন.. আমার ছেলে। খুঁজে পাচ্ছি না।”

“সর্বনাশ! বাচ্চাটাকে দেখেছি জঙ্গলের দিকে গেছে তাড়াতাড়ি যান। আমিও সাথে যাচ্ছি। আসেন।”

আজমীদের এলাকাটা একটু গ্রাম দিকে। বাড়িঘরের পরেই একটা নদী। তারপাশে ঘন জঙ্গল। আজমী দৌড়ে দৌড়ে জঙ্গলের পথে যেতে লাগল। পেছনে লোকটা। জঙ্গলের গভীরে ঢুকেই লোকটা পিছন থেকে আজমীর হাতে একটা ইনজেকশন দিল। আজমী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ে।

“কাজ হয়ে গেছে বস। মেয়েটা অজ্ঞান‌।”

কিছুক্ষনের মধ্যেই সেখানে একটা কালো গাড়ি আসে। গাড়ি থেকে কালো হুডি পড়া একটা লোক নেমে আজমীর মাটিতে পড়ে থাকা দেহ কোলে তুলে। আজমীকে পেছনের সিটে লম্বালম্বি ভাবে শুইয়ে দেয়। এরপর লোকটার দিকে একটা টাকার মোটা বান্ডিল ছুঁড়ে গাড়ি চালিয়ে নিমেষেই উধাও হয়ে গেল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here