আমার হৃদয়ে সে পর্ব -৩৪

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৪

হৃদয়ের বাবা বাসায় খাচ্ছেন না!শাশুড়ী মা জিজ্ঞেস করলে বলেন বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন।আমিও খাবার নিয়ে গেলে একই কথা বলেন।এইরকম আজ তিনদিন ধরে করে আসছেন।হৃদয়কে ব্যাপারটা গতকাল বলি।সে চুপ করে থাকে।কিছু বলে না।এই ব্যাপারটায় কেনজানি নিজেকে আরো নিঃসঙ্গতা লাগছে।আমার কারণে এই পরিবারের আজ এই হাল।হৃদয়ের সাথে আমার বিয়ে না হলে কখনো এরকম হতো না।পরিবারের প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের সাথে সুসম্পর্কের বন্ধন থাকতো।হাসিখুশি দিন যেত।আমি আসাতে পরিবারটা কেমন হয়ে গেলো!মাঝে মাঝে হৃদয়কে কথাগুলো বলতে চাই।তবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস পাই না।

শাশুড়ী মা দেড় ঘন্টা হবে রান্না চড়িয়েছেন।আমি কাঁচামরিচ, পেয়াজ, ধনেপাতা কুটেছি।আজ মা ইলিশ মাছের ডিম রান্না করবে।হৃদয় গতরাতে বাজার থেকে অনেক বড় বড় কয়েকটা ইলিশ কিনে এনেছে।সেগুলোর ডিম মা হৃদয়ের জন্যে আলাদা রান্না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।হৃদয়ের নাকি ইলিশ মাছের ডিম ভুনা বেশ পছন্দের খাবার!আমি মাকে সবগুলো পেয়াজ কুচি, কাঁচামরিচ কুচি এবং ধনে কুচি এগিয়ে দিই।মা তা হাতে নেন।বলেন,

“বউমা?তোমার শ্বশুর রুমে আছে কিনা দেখো ত গিয়ে একটু?”

আমি মাথা নেড়ে উনার রুমের সামনে এলাম।দরজা হালকা একটু ফাঁক করে ভেতরে তাকালাম।উনি পূর্বদিকের জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছেন।কিছুক্ষণ আগে হয়তো বাইরে এসে রুমে ঢুকেছেন।দরজার ফাঁক মিলিয়ে মার ফিরে এলাম।বললাম,

“হ্যাঁ মা আছে।”

মা চুপ করে রইলেন।আর থেকে থেকে কড়াইয়ের মশলা নাড়তে থাকলেন।উনার মশলা নাড়ার স্থবির মুখটার দিকে হঠাৎ আমার চোখ আঁটকে যায়।উনি যেন কেঁদে ফেলবেন এখন এরকম!আমি এক কদম এগিয়ে পেছন থেকে মার কাঁধ চেপে ধরলাম।বললাম,

“মা মন খারাপ আপনার?”

মার উত্তর এলো না।আবার জিজ্ঞেস করলাম।এবার হালকা অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠলেন।
” মা কি হয়েছে বলেন?”

দুই তিন সেকেন্ডস লাগলো নিজেকে ধাতস্থতা করতে।তারপর কড়াইয়ে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
“জানো?তোমার শ্বশুরের ইলিশ মাছের ভুনা খুব পছন্দ?যেদিন শুনবে ইলিশ মাছ ভুনা রান্না হবে সেদিন সকালের নাস্তা শেষ করে আর অন্যকিছু মুখে নেবেন না।দুপুরের খাবারের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকবেন।।অন্য হালকা কিছু মুখে নিতেন না এই কারণে পেট খালি থাকলে ইলিশের ডিম ভুনাটা মনভরে খেতে পারবেন।”

বলে শাশুড়ী মা হাসলেন।মেকি হাসি!হাসিটার পেছনে লুকিয়ে আছে একবুক কষ্ট!আজ ইলিশ মাছের ভুনা রান্না হবে।হয়তো তা উনার স্বামীর মুখে যাবে না আজ!আমি মাথা নুইয়ে চুপ করে থাকলাম।কিছু বলতে পারলাম না।মা এবার বললেন,

“তোমার আর থেকে কাজ নেই।সব রান্না ত শেষ।তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।আর পারলে রুনুকে পাঠিয়ে দিও।”
“জ্বী, আচ্ছা।”

৫৩.
দুপুরের দিকে আমি মাকে কিছু না বলে কিচেন থেকে বাটি ভরে ইলিশ মাছের ডিমের ভুনা নিই।সাথে তিন চামচ ভাত।বাটি এবং ভাতের প্লেট নিয়ে বাবার রুমে ঢুকি।উনি ফতোয়া পড়তেছেন।কোথাও যাওয়ার উদগ্রীব।হয়তো বাইরে খেতে যাবেন এখন তাই ফতোয়াটা পড়ে নিচ্ছেন।আমি পেছন থেকে বললাম,

“বাবা?”

না তাকিয়েই বলে উঠেন,
“আমার রুমে কেনো!”
“বাবা আপনার জন্যে মা আজ নিজহাতে ইলিশ মাছের ডিম ভুনা রান্না করেছে।আজ দয়া করে বাইরে খাবেন না বাবা।”

উনি আমার কথা যেন শুনলেন না।বাটন ফোনটা হাতে নিয়ে নিলেন।আমি আবার বললাম,
“বাবা আমি যদি আপনার মেয়ে হতাম আপনি কি আমার সাথে এভাবে রাগ করে থাকতে পারতেন?বাবা আমার জায়গায় আপনার মেয়ের যদি এরকম হত তখন তাকে আপনার কেমন অনুভব হত?মেনে নিতে পারতেন মেয়ের কষ্ট!পারতেন না!বাবা আমরা ডিভোর্সি বলে আমাদের কি মূল্য নেই?আমাদের সত্যিই মূল্য নেই!”

উনি চুপ করে রইলেন।আগের জায়গায় স্থবির দাঁড়িয়ে থাকলেন।বললাম,
“বাবা সমস্যা নেই।আপনি আমাদের সবার সাথে রাগ করুন বা কথা না বলুন।তবে আজ একটা আবদার আপনাকে রাখতে হবে।আপনি এই খাবারটা খাবেন।আমাকে রিক্ত হাতে ফিরিয়ে দেবেন না!নাহলে আমি খুব কষ্ট পাবো বাবা!খুব কষ্ট পাবো!রেখে গেলাম।খেয়ে নিবেন।”

বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।চোখের কোণের পানি মুছলাম।ডাইনিং এ আসতে দেখি হৃদয় সদরে ঢুকলো সবে।হাতে ব্যাগ।ব্যাগের ভেতর এক্সাম পেপার।হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।তাল মিলিয়ে সে মৃদু হাসলো।ঠোঁট চওড়া হলো না।রুমে ঢুকে গেলো।শাশুড়ী মা সম্ভবত শুনেছেন হৃদয় যে ফিরেছে কলেজ থেকে।তাই রুম থেকে বেরুলেন।বললেন,

“বউ মা?তুমি খাবার রেডি করো সবার জন্য।আমি নামাজ শেষ করে আসতেছি।”

বলে আবার রুমের ভেতর ঢুকে গেলেন।আমি মাথা নেড়ে এক এক করে সবার জন্যে খাবার বাড়লাম।আর ফিরে ফিরে বাবার রুমের দিকে তাকালাম।উনি বের হচ্ছেন কি না রুম থেকে!কিন্তু না! বের হতে দেখছি না।আল্লাহ যেন বের না হোন।আমার দেওয়া আবদারটা যেন রাখেন।!হৃদয় এসে বসলো।হাসনা এসে বসলো।তার একটু পর মা।হৃদয় এবং হাসিনার প্লেটে ইলিশ মাছের ডিম ভুনা দেওয়ার পর মায়ের প্লেটে দিতে গেলে বাঁধ সাঁধে।হাত উঁচিয়ে নাকচ করে বসেন,

“বউ মা,আমি খাবো না।সবজি দাও।”

হৃদয় বলে উঠে,
“শুধু সবজি দিয়ে খাবে তুমি?ভুনা খেলে কি সমস্যা?”
“আমার ভালো লাগছে না ওটা আজ।অন্যদিন খাবো।”
“মা আমি শেখ করে…!”

হৃদয়কে পুরো কথা শেষ করতে দিলেন না!বলে উঠলেন,
“বউ মা!তুমি সবজি দাও তো আমাকে!”

বাধ্য হয়ে দিয়ে দিলাম।আমি বুঝেছি মা কেনো খাবে না।বাবা খাবে না তাই।হৃদয়ও বুঝেছে ব্যাপারটা। তাই আর বাড়াবাড়ি করে নি সে।সে জানে মাকে যতই বলবে খেতে মাকে খাওয়াতে পারবেই না।সন্ধে নেমে এলেও রাজি করাতে পারবে না।মা যেটার জেদ ধরেন একবার সেটাই করেন।আমি এ বাসায় আজ পনেরো দিনের মতন হবে এসেছি।এই পনেরো দিনে মাকে অনেক বুঝেছি।যদিও ঠান্ডা,শীতল,মায়াবী।তবে ক্ষেত্রবিশেষে জেদটা একটু বেশিই!এমন সময় বাবার রুম থেকে বের হবার শব্দ শুনি।উনি আমাদের পাশ কাটিয়ে যেতে হাসনা বলে উঠে,

“বাবা কোথায় যাও?”
“বাইরে!”

হাসনার জবাব দিয়েছেন এখন!বেশ অবাক হলাম আমি!বাবা ত আমার সাথে,হাসনার সাথে, মার সাথে এবং হৃদয়ের সাথে কথা বলেন নি এই পনেরো দিনের ভেতর একবারও! আজ হাসনা জিজ্ঞেস করা মাত্রই জবাব দিলেন!মানে কী?বাবা কি আমার দেওয়া খাবার গুলো খেয়েছেন?ভেবেই দেরী করলাম না। দৌড়ে দরজা ঠেলে উনার রুমে ঢুকলাম।রুমে ঢুকে হতবাক।সাথে তো নাচ দিতে ইচ্ছে করতেছে এখন।হ্যাঁ,উনি খেয়েছেন!যাক তাহলে মাকে ত এখন বলা যাবে।তখন বলিনি এই কারণে উনি যদি খাবারটা না খেলেন বা ফিরিয়ে দিলেন।তখনতো মা আরো কষ্ট পেতেন।এমনকি আজ খেতেন ই না।তরহর করে প্লেট এবং বাটি হাতে তুলে নিলাম।ডাইনিং এ যেয়ে প্লেট এবং বাটী হাত থেকে টেবিলের উপর রাখলাম।মা,হৃদয় এবং হাসনা খেয়াল করলেন সেগুলো যে আমি বাবার থেকে এনেছি।মা ভ্রুর যুগল কুঁচকালেন।উৎফুল্লতা স্বরে বললাম,

“মা বাবাকে আমি ইলিশ মাছের ডিম ভুনাটা দিয়েছি।সাথে ভাত।বাবা খেয়েছেন!”
“কি!”
“জ্বী,মা!”
“সত্যি বলছো?”
“এই যে দেখুন?”

মা অবাক চোখে তাকিয়ে হেসে দিলো।পূর্ণতায় ভরা যেন সেই হাসি!হৃদয়ও বেশ অবাক হলো।পরে সেও হেসে উঠলো।হৃদয়ের হাসিটা যেন এতদিনের বন্ধ হয়ে শ্বাসটা এবার যেনো কিছুটা ছাড়া পাওয়ার মতন এমন দেখালো!তাহলে সেও মার মতন বাবাকে নিয়ে মনে মনে ভীষণ কষ্ট ফিল করতো যা আমাকে বুঝতে দেয় নি?

৫৪.
খাবার শেষ করে রুমে ঢুকতেই হৃদয় কোথা থেকে এসে হঠাৎ দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো!আমি ভ্রু যুগল হালকা উঁচু করে অবাক চোখে তাকালাম তার দিকে।রিসার্চ করতে থাকলাম এই ছেলেটা কোথা থেকে এসে হুট করে দরজাটা বন্ধ করলো?তখন তো খাওয়া শেষ করে বললো ঘুমিয়ে পড়বে।ভীষণ ক্লান্ত।কিন্তু এসে তো বিছানায় দেখলাম না।বা দরজার সামনেও না।এমনকি বেলকনিতে না।তাহলে কি দরজার পেছনে লুকিয়ে থেকেছিলো?তবে কেন?আর দরজাই বা এভাবে বন্ধ করলো কেন?ভাবনার মাঝেই সে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।গভীর মনোযোগে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।আমি আরো অবাক হলাম!আর চুপ থাকলাম না।বললাম,
“ব্যাপার কি?আপনি না ঘুমাবেন বলে তখন তাড়াতাড়ি চলে এলেন?আর এখন এসব কি?”
“এসব অনেক কিছু!ঘুমাবো।তবে একা না!”
“মানে?”

আমার কাঁধে এবার আলতো হাত রাখলো হৃদয়!আমাকে তার দিকে চাপিয়ে নিয়ে বলে উঠলো,

“বিছানায় তোমাকে নিয়ে শুবো।কারণ আমার একটা বেবী চাই!”
“হোয়াট!”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here