আমার হৃদয়ে সে পর্ব -৩৮

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৮

তারপর হৃদয়ের পর আমিও ভেতরে এলাম।ঘুরে দরজাটা বন্ধ করতে বাবার রুম থেকে লাবণ্যের হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।বুঝলাম লাবণ্য বাবার কাছে।সেদিকে আর না মনোযোগ দিয়ে শান্ত পায়ে টেবিলের কাছে গেলাম।হৃদয়ের জন্যে খাবার বাড়তে থাকলাম।খাবার বাড়া শেষ হলে গলার আওয়াজ হালকা উঁচু করে হৃদয়কে ডাকলাম,

“খাবার বাড়া শেষ!”

এমন সময় লাবণ্য কেঁদে উঠে।আমি বাবার রুমের দিকে তাকাই।বাবা লাবণ্যের কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে যান,
“আহা দাদু আপু, কাঁদে না।আম্মু কাজ করতেছে এখন।আম্মু কাজ শেষ করে তারপর তোমাকে নিয়ে যাবে।একদম কাঁদে না দাদু আপু।”

কিন্তু না লাবণ্য যেন আরো কেঁদে চলছে।বাবা ওকে থামাতে পারছে না কিছুতে।আমি এবার বাবার রুমের দিকে গেলাম।দরজার সামনে বাবা আমাকে দেখতে পেয়ে বলে উঠেন,
“বাইরে থেকে তোমার আওয়াজ পেয়ে কেঁদে উঠেছে।শত হোক মা ত!যাও দাদু আপু তোমার মা এসেছে।মার কোলে যাও।”

আমি লাবণ্যকে হাত বাড়িয়ে নিলাম না।ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।আজ এতটা মাস পর এই প্রথম আমার শ্বশুর নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলছেন!যিনি কখনো আমাকে বউ হিসেবে মেনে নিবেন না বলেছেন!আমার মা-বাবার সাথে আরো কত কি কথা বলেছেন!আমাকেও আরো কত কি বলেছেন!আর সেই তিনি!?এতক্ষণে আমার ক্ষেত্রে অনেকে হলে খুশিতে লাফ দিয়ে উঠতো।কিন্তু আমি তা পারলাম না।কথা তো দূরে থাক।নড়তেও পারলাম না!আসলে আমি অবাক!চরম মাত্রায় অবাক।কেঁদে দিতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে!খুব কেঁদে ইচ্ছে করছে!ভাবনার মাঝে লাবণ্য আমার পায়ের তলায় এসে দাঁড়ায়।আর কাঁদতে থাকে ওকে কোলে তুলে নিতে।

“বউ মা,লাবণ্যকে কোলে তুলে নাও!”

বাবার কিছুটা উঁচু গলার আওয়াজে টনক নড়ে উঠে আমার।চোখের উপর আলতো হাত রেখে নিজেকে ধাতস্ততা করে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুঁটিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিই।

“লাবণ্যকে একা ছাড়বে না।রুম থেকে কিছুর আওয়াজ শুনতে পেয়ে বাইরে এসে দেখি লাবণ্য ডাইনিং চেয়ার নিয়ে ধপাধপি করতেছে।আল্লাহ নাহ করুক, ছোট্ট মানুষ যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতো?একা আর ছাড়বে না।আর ছাড়লেও আমাদের সজাগ করে ছাড়বে!ঠিক আছে?”
“জ্বী,বাবা।”
“যাও।”

লাবণ্যকে নিয়ে পেছন ঘুরতে মুখে আনমনা একটা হাসি ফুঁটে উঠলো।হাসিটা খুশির!ডাইনিং এ হৃদয় এতক্ষণে খেতে বসেছে।ওকে দেখে ওর একদম পাশের চেয়ারটায় লাবণ্যকে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসি।বলে উঠি,
“শুনছেন?বাবা আমার সাথে কথা বলেছে আজ। তাও নিজ থেকে?!”

হৃদয় হেসে উঠলো।খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে উঠলো।ওর হাসিতে মনে হলো বাবা এরকম কিছুই করবেন!আমি ভ্রুর যুগল তীব্র কুঁচকে ফেলি,
“হাসলেন যে?এটা কি হাসির কথা?”

হৃদয় বললো,
“ইদানীং বাবার এই মতিগতি আমিও খুব খেয়াল করেছি।যতটুকু বুঝলাম উনি আমাদের সবার সাথে আবার একত্রিত হতে চান!হয়তো নিজের ভুল বুঝেছে বউ!তোমাকে বুঝেছে।আর সবথেকে বড়কথা আমাদের এই ছোট্ট পাখিটার জন্যে সব ভুলে গেছে!তোমাকে আমি প্রথমেই বললাম বাবার রাগ বেশিদিন থাকবে না।পৃথিবীর কোনো পিতামাতাই তার সন্তানদের উপর বেশিদিন রাগ করে থাকতে পারে না!”
“বুঝছি।আর হ্যাঁ, আমি অনেক খুশি!”

৬২.
এক সপ্তাহ না যেতেই এই বাড়ির সব পরিবর্তন হয়ে গেলো!পরিবর্তনটা বাবাকে নিয়ে।বাবা আমাদের সবার সাথে কথা বলছেন এখন!আলহামদুলিল্লাহ!কথা বলার পেছনে অবশ্যি অনেক শ্রম ছিল।সেদিন যে বাবা আমার সাথে নিজ থেকে কথা বললেন না?তারপর থেকে আমিও বাবার সাথে কথা বলা শুরু করে দিয়েছি।একদম সহজ-সরল ভাবে কথা শুরু করে দিয়েছি।সকালের ব্রেকফাস্ট, দুপুরের লাঞ্চ,রাতের খাবারের সময় আমি বাবাকে রুম থেকে ডেকে এনে ডাইনিং এ বসিয়েছি।প্রথমত বসতে চাননি।অনেক আকুতি মিনতির পর বসাতে পেরেছি।তার সাথে হাসনা, মা এবং হৃদয় কেও বসিয়েছি খেতে।লক্ষ্য এই খাবারের সুবাদে সবাইকে এক করবো!পেরেছিও।যখন সবাই বসতো একে অন্যকে টেনে মশকরা কথা শুরু করতাম।বাবার বিশেষণ টানতাম।মার বিশেষণ টানতাম।এমনকি হৃদয়েরও!আর হাসনার তেমন টানতাম না।ওর আর কি টানবো।ও উনাকে একবার “আব্বু” বললেই ব্যাস্।হুরমুর অভিমান ভেঙ্গে যাবে পিতা-মেয়ের মাঝে।পিতা-মেয়ের মাঝে অভিমান তেমন থাকেও না।এই যেমন আমার আমার বাবার প্রতি থেকে পরে সব রাগ,অভিমান উবে গেলো!?তবে, হৃদয় এবং মার অভিমান ভাঙ্গাতে একটু বেগ পেতে হয়েছে। পিছিয়ে যাই নি।যতটা সম্ভব তাদের সবাইকে এক প্রসঙ্গে এনেছি!সবার এখন মেলবন্ধন এবং কথাবার্তা আমার হৃদয়কে পরিতৃপ্ততা দিয়েছে।
আমি ভীষণ খুশি!তবে বাবার কাছে মনে আমার এখনো একটা প্রশ্ন থেকে গেলো।প্রশ্নটা হলো- বাবা কি লাবণ্যের মুখের দিকে চেয়ে আমাকে জোরপূর্বক উনার বউ হিসেবে মেনে নিয়েছে?নাকি আমার গুণে আমাকে উনার বউমা হিসেবে উনার মনের সব রাগ,অভিমান,কষ্ট ভেঙ্গেছে?সুযোগ পেলে বাবাকে একদিন এই প্রশ্নটা করে বসবো।এখন সুযোগটার অপেক্ষায়…

৬৩.
মনটা এখন হালকা।চারপাশটাও বেশ সতেজ, শান্ত এবং প্রাণবন্ত।ভাবলাম এমন একটা পরিবেশের মাঝে বাইরে কোথাও একটু বেড়িয়ে আসা যাক।ঠিক করলাম আমাদের বাড়িতে যাবো।আর সেখানে গিয়ে খালামণি,খালু,ফাহিমকে কল করে নিয়ে আসবো।অনেকদিন হয়েছে উনাদের দেখি নি।সেই যে হাসপাতালে লাবণ্যকে শেষবার দেখতে এসেছিলেন সবাই তারপর আর কারো সাথে দেখা হয়নি।আমার পরিবারের,আত্মীয় কারোই হৃদয়দের বাড়িতেও আর আসা হয়নি আমার শ্বশুরের সেইদিনের কথার পর থেকে।রাতে ঘুমতে গেলে হৃদয়কে বাড়িতে বেড়িয়ে আসার ব্যাপারটা বলি।হৃদয় ঝট করে রাজি হয়ে যায়।

তার পরদিন সকালে হৃদয় এবং আমি লাবণ্যকে নিয়ে রওনা করি।রিক্সা চলার মাঝপথে হৃদয় রিক্সা থামিয়ে দেয়।বলে,

“পারিসা?কিছু কেনাকাটা করবো।আমরা এখানে নামি।”

আমি বুঝলাম না হৃদয় কি কেনাকাটা করবে!বা কেনাকাটার কথা রাতেও কিছু বলে নি।বুঝতে না পেরে আবার হৃদয়ের দিকে প্রশ্নাতীত চোখে তাকালাম।সে ব্যস্ত হয়ে বলে,
“আহা,নামো ত!”

নেমে গেলাম।হৃদয় রিকসাওয়ালাকে তার ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে বিদেয় করলো।তারপর আমরা একটা বড় শপিং মলের সামনে এলাম।
“জামাকাপড় কিনবেন?”
“হুম!”
“কারজন্যে?”
“আমার শ্বশুরবাড়ির লোকদের জন্যে।”
“উনাদের হঠাৎ জামাকাপড়?…. এরকম কিছু কাল রাত তো বল”
“আহা চুপ করো।শান্তশিষ্টের মতন ভেতরে এসে চয়েজ করে দাও ত?”

আর কিছু বললাম না।চুপ হয়ে গেলাম।এই ছেলেটাকে না আসলে বোঝা দায়।হুটহাট কি করে আমিও নিজেও বুঝি না।শুধু জানে আমাকে “বিস্ময় করতে!”শপিংমলের ভেতরে ঢুকলাম।জামাকাপড় দেখতে থাকলাম এক এক করে।যেমন- শাড়ি,পাঞ্জাবি, প্যান্ট,লুঙ্গি, শার্ট ইত্যাদি।লাবণ্যটাও মাঝে মাঝে জামাকাপড় দেখাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলে!এটা ধরতে কাঁদে ওটা ধরতে কাঁদে।ওর জন্যে ঠিকমতন দেখতেই পারি না।ওর এরকম বিরক্তি করা দেখে সেলসম্যান বলেন,

” ম্যাম,বাবুকে এখানে বসান।ওর যত ইচ্ছে সব কাপড় ধরুক!ধরে আনন্দ করুক।ছোট্ট মানুষ ত..!”
বলে হাসলো সেলম্যান।
হৃদয় বলে,
“দরকার নাই।সব অগোছালো করে ফেলবে।
লাবণ্যকে আমার কোলে দাও পারিসা।”
লাবন্যকে হৃদয়ের কোলে তুলে দিলাম।আর আমি জামাকাপড় চুজি করতে মনোযোগ দিলাম।তবে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে পেছনে এক নারীর উঁচু স্বরের কন্ঠে!

“তোমার কোনো কমনসেন্সের আছে, অভি?তোমার কি ধারণা নেই আমি পঁচিশ হাজারের নিচে শাড়ি কিনি না!তারপরও কেনো বারবার বলছো দশ হাজারের ভেতর শাড়ি দেখতে?”
“দশ হাজারের ভেতর তো খারাপ শাড়ি পাবে না তুমি,স্নিগ্ধা!!”
“দশ হাজারের ভেতর কারা পড়ে জানো ত তুমি!আমি কি খেত যে পড়বো?”
“কিন্তু..!”
“দ্যাখো অভি,মানুষদের সামনে তোমার এরকম ছোটলোকি একদম মানায় না!কারণ ভুলে যেও না আমার নিজেরও যে একটা সম্মান আছে!”

কথাগুলো শোনার পর পুরুষানালী কণ্ঠস্বর আমার খুবই পরিচিত মনে হলো!আর মোয়েটির কন্ঠস্বরটাও খুব বেশি পরিচিত না হলেও অনেকটা অনুধাবন করে ফেলেছি সেই কে হবে?ভেতরটা মুচড়ে উঠলো ভীষণ!মাথাটা শূন্য হয়ে গেলো মুহূর্তে।তবে তাকালাম না সেদিকে!জামাকাপড়ের দিকে আবার মনোযোগ বাড়ালাম। পাশ থেকে আবারো ঝাঁঝ এবং ক্ষিপ্র গলার স্বর এলো স্নিগ্ধার,

“সেলসম্যান?পঁচিশ হাজারের মধ্যে যেই শাড়িটা ওটা দিন আমাকে!”
“স্নিগ্ধা এই মুহূর্তে আমার কাছে এতটাকা নেই!”
“ভিক্ষা করে দিবা প্রয়োজনে!ভিক্ষা!বুঝতে পেরেছো?”
“স্নিগ্ধা..!”

বলে খুব জোরে মেয়েটির গালে চড় পড়লো। হয়তো অভিই দিয়েছে।আমি এবার না চাইতেও তাকালাম পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে।অভি এবং তার বউ বসা আমাদের থেকে দেড় হাতের মতন দূরে হবে।তবে দোকান একই। অভি আমাদের খেয়াল করে নি।অভি তার রাগ মাখা মুখ নিয়ে বলে উঠলো তার স্ত্রীকে,
“এতটা নীচে নামতে পারো তুমি,ছিঃ!ছিঃ!”

বলে আর দাঁড়ালো না অভি।হন্তদন্ত পায়ে স্নিগ্ধাকে রেখে চলে গেলো!স্নিগ্ধা গালে হাত দিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো।তবে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমাটা বেশিক্ষণ থাকলো না স্নিগ্ধার।চোখের অগোচরে তার আমার দিকে তার চোখ পড়লো!আমাকে দেখে সে কিছুটা চমকে যাওয়ার মতন হয়ে গেলো।গাল থেকে তরহর হাত নামিয়ে নিল!আর চোখমুখ শক্ত করে ব্যাগ টা হাতে তুলে নিয়ে সামনে থেকে সোঁজা চলে গেলো!আমার মাঝে কোনোরকম ভাবান্তর এলো না।তবে আফসোসের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শুধু,
“মনের মতন বউ পেয়ে এখনো অসুখী?!”

চলবে…

(গল্পটা শেষ হতে আরো দুই পর্বের মতন লাগবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here