আলো আঁধারের লুকোচুরি পর্ব -০৯

#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_09
#Writer_NOVA

ইয়াসফি চোখ দুটো খুশিতে টলমল করে উঠলো। বরফের মতো ঠান্ডা গালে হাত রেখে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

‘আমার স্লিপিং বিউটি!’

প্রতিবারের মতো এবারো ইয়াসফির চোখের ভ্রম হলো। মেয়েটার চোখের পাতা নেচে উঠলো। ইয়াসফির মনে হলো ধীরে ধীরে চোখ খুলে মেয়েটা তাকালো। করুন গলায় বললো,

‘আমাকে মুক্তি দাও মাহ…….

পুরো কথা মেয়েটাকে বলতে দিলো না। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ফিসফিস করে উঠলো ইয়াসফি।

‘হুশ! চুপ করো। তোমাকে প্রাণভরে দেখতে দাও দেখি।’

মেয়েটা কেমন নিথর হয়ে গেলো। সে যেনো আল্লাহর কাছে নিজের মুক্তির প্রার্থনা করছে। মেয়েটার কথা বলা, তাকানো, আল্লাহর কাছে আর্জি জানানো সবই ইয়াসফির কল্পনা। লাশের পক্ষে আদৌও কি তা সম্ভব?

অপু হেলেদুলে রুমের ভেতরে ঢুকলো। ঢুকতে না ঢুকতেই দাঁতে কামড় দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। কি ঠান্ডা! এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা দায়। সারা গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে সামনে এগুলো। ইয়াসফি একা একা লাশের সাথে বিরবির করছে। ইয়াসফিকে দেখে অপুর একটা গানের কথা মনে পরছে। ঐ যে ঐ গানটা আছে না,

‘মইরা গেলে কানবা ঠিকই
বাঁইচা থাকতে বুঝলা না
হাতের ধন ঠেললা পায়ে
আপন মানুষ খুজলা না।’

বেঁচে থাকতে মূল্য দেয়নি এখন মরে যাওয়ার পর পাগলামি করে। আচ্ছা কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কি ভালোবাসার মানুষকে এভাবে রেখে কষ্ট দেয়? অপুর মাঝে মধ্যে মনে হয় ইয়াসফি ভয়ানক মানসিক রোগ আছে। যদি না থাকতো তাহলে এতদিন লাশ সংরক্ষণ করে রাখতো না।

‘এই মেয়ে চোখ খুলো না। আমি তোমার সব কথা শুনবো। একবার ফিরে আসো।’

অসহায় গলায় ইয়াসফি বলে উঠলো। অপু ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে মিনমিন করে বললো,

‘ভাই, একটা মৃত মানুষকে আর কতদিন এভাবে রেখে কষ্ট দিবেন? আমি বলি কি এবার তাকে দাফন দিয়ে দেন।’

ইয়াসফি চোখ লাল করে অপুর দিকে তাকালো। মেয়েটার গাল ছেড়ে হুট করে অপুর গলা চেপে ধরে ভাঙা গলায় বললো,

‘আমার থেকে মুক্তি ওর মিলবে না। আমাকে একা করে যাওয়ার শাস্তি ওকে পেতেই হবে।’

অপু চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। মনে হচ্ছে সে এখন লাশ হয়ে যাবে। চোখ উল্টে প্রাণ বায়ু বোধহয় বের হলো। ইয়াসফি ছেড়ে দিলো। অপু গলা ধরে খুকখুক করে কেশে উঠলো। এক মুহুর্তে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে এসেছে। ইয়াসফি আবারো মেয়েটার লাশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। বিরবির করে কথা বলছে। অপু এবার নিশ্চিত হয়ে গেলো ইয়াসফিকে দেখতে স্বাভাবিক মনে হলেও এর ভয়াবহ মানসিক রোগ আছে।

কড়াইয়ে তেল দিয়ে চাপিং বোর্ডে পেঁয়াজ কুচি করতে লেগে পরলো। ফ্রীজ থেকে কাঁচা মরিচ বের করে সেগুলো কুচি করে নিলো। গতকালকের ভাত আছে সেগুলো দিয়ে পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে ডিম ফাটিয়ে ফ্রাইড রাইস বানিয়ে ফেলবে। গরীবের ফ্রাইড রাইস! শব্দটা উচ্চারণ করে মনে মনে হাসলো রুহানি। হাত চালিয়ে কাঁচা মরিচ কুচি করলো। এক হাতে কাজ করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। দরজা দিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখলো মাসুম খাটে বসে মন দিয়ে গেমস খেলছে। ছেলেটা গেমসে আসক্ত। গেমস পেলে দুনিয়া ভুলে যায়। তেল গরম হতেই সেখানে পেঁয়াজ, মরিচ কুচি ছেড়ে দিলো। হালকা বাদামি রং আসতেই ডিম ফাটিয়ে দিলো। হালকা ভাজা ভাজা হয়ে গেলে ভাত দিয়ে তিন মিনিট নাড়িয়ে চুলা বন্ধ করলো। মিটসেফ থেকে প্লেট নিতে নিতে জোরে গলা হাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মাসুম, আরো কিছু খাবি?’

মাসুম মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়ে উচ্চস্বরে বললো,

‘তুই বানালে অবশ্যই খাবো।’

‘এ্যাহ শখ কত! মন চাইলে নিজে বানিয়ে খা। আমি আর কিছু করতে পারবো না।’

‘জিজ্ঞেস করে অপমান করলি?’

রুহানি রিনরিনে সুরে হেসে উঠলো। দুটো প্লেটে খাবার নিয়ে বেডরুমে হাজির হলো।

‘নে ধর, আজকের জন্য এতটুকুই।’

একবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার রুহানির দিকে তাকালো মাসুম। মুখ ভোঁতা করে বললো,

‘হ্যাঁ, রে রুহানি! এতদিন পর তোর বাসায় এলাম। এই খাবার খাওয়াবি?’

রুহানি এক লোকমা মুখে পুরে আস্তেধীরে চিবিয়ে নিলো। এরপর মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,

‘এক হাতে যে এতটুকু রান্না করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ বল। তোর জন্য ব্যান্ডেজটাও খুলতে পারি না। এক হাত দিয়ে কি কাজ করা যায়?’

মাসুম ভ্রু নাচিয়ে দাঁত কেলালো। অতঃপর মোবাইল রেখে খাবারের ওপর হামলে পরলো। খুদা লেগেছে এখন একটা কিছু পেলেই হলো। রুহানি খাবার শেষ করে বেসিনে প্লেট ধুয়ে যথাস্থানে রেখে দিলো। ঠিক তখুনি কোলিং বেল বেজে উঠলো।

‘এতোরাতে কে এলো?’

নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো। চেচিয়ে মাসুমকে দরজা খুলতে বললো। কিন্তু মাসুমের হেলদোল নেই। সে কানে ইয়ারফোন গুঁজে মুভি দেখতে বসেছে। অগত্যা রুহানিকে দরজা খুলতে হলো। দরজা খুলে অপর পাশের ব্যক্তিটাকে দেখে রুহানির বুকটা ধ্বক করে উঠলো। অবিশ্বাস্য নজর! চোখ কচলে, নিজেকে চিমটি কেটে পরীক্ষা করে নিলো। সে ভুল দেখছে না তো? দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কাঁপা কাঁপা হাতে রুহানির গালে হাত রাখতেই রুহানি নিশ্চিত হলো সে স্বপ্ন দেখছে না। কতদিন পর দেখা! চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। আজ কান্নারা বাধ মানবে না। মানাতে চাইলোও না। চোখের পানি ছেড়ে তার বুকে আছড়ে পরলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, শব্দ করে কেঁদে উঠলো।

শুভা খান গুণগুণ করে একঘেয়ে সুরে কাঁদছে। কান্নার তোর বাড়া বৈ কমেনি। রায়হান খান রকিং চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে রেখেছেন। এক পলক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার চোখ দুটো বেইমান হয়ে গেছে। পানি পরতেই চায় না। তার স্ত্রী এর জন্য তাকে পাষাণ উপাধি দিয়েছে। রায়হান খানের মনে হচ্ছে আসলেই সে পাষাণ। নয়তো আদরের মেয়ে হারিয়ে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে পারতো না। শুভা খান হঠাৎ করে উঠে বসলো। চোখ দুটো আঁচলে মুছতে মুছতে অনুরোধী গলায় বললো,

‘তুমি আরেকবার যাও না ওর কাছে।’

রায়হান খানের চোখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। মুখটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। মাথা নিচু করে নজর দিলো টাইলসের দিকে। শুভা খান মুহুর্তে আঙ্গারের মতো জ্বলে উঠলেন।

‘ওর সমস্যা কি? আমার মৃত মেয়েটাকে কেন নিজের কাছে রেখে দিয়েছে? বেঁচে থাকতে তো ওকে ভালোবাসে কম কষ্ট পায়নি। এখন মরে গিয়েও কি শান্তি পাবে না? সারাজীবন কি ঐ বরফে মোড়া থাকবে? কবরের মাটি কি ওর ভাগ্যে জুটবে না? কেমন বাবা তুমি? নিজের মেয়েটা মরে যাওয়ার পরও কবরে শোয়াতে পারোনি।তুমি বাবা নামে কলঙ্ক।’

শুভা খানের একেকটা কথা রায়হান খানের বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হলো। আসলেই তো সে বাবা নামে কলঙ্ক। নয়তো মাস খানিক আগে মারা যাওয়া মেয়েটাকে আজও কবর দিতে কেন পরলো না? টাকা-পয়সা, ক্ষমতার কাছে আজ সব অসহায়। শুভা খান কাদতে কাদতে হাত তুলে আল্লাহর দরবারে আর্জি জানালো।

‘আল্লাহ একটু রহম করো। আমার মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না। এবার ঐ জালিমের হাত থেকে রক্ষা করো। ওকে কবরে জায়গা করে দাও। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মেয়ে হারিয়ে যতটা না কষ্ট পাচ্ছি তার থেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে আমার মেয়ে মাস ধরে মারা গিয়েও এখনও কবর পায়নি, জানাজার নামাজ পায়নি। কতটা আজাব হচ্ছে ওর। তুমি একটা পথ দেখাও। ওর সকল গুনাহ মাফ করে কবর, জানাজার নামাজ পেতে সাহায্য করো। তোমার তো বান্দাকে সাহায্য করতে কোন উছিলা লাগে না। আল্লাহ আমার মেয়েটাকে ক্ষমা করে দাও।’

শুভা খান ডুকরে কেঁদে উঠলো। মায়ের এমন মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক কান্নায় আল্লাহ কি দয়ালু হবেন না? অবশ্যই হবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম করুনাময় ও অসীম দয়ালু।

রায়হান খান দেয়ালে টানানো হাস্যজ্জল মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, না এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মেয়ের লাশ দাফন করতে হলেও তাকে আবারো তার মুখোমুখি হতে হবে। এর জন্য সে হাজার তোপের মুখে পরতেও রাজী। মেয়েটা তো কবরের মাটি, জানাজার নামাজ পাবে।

ক্লান্ত পায়ে বাসার ভেতরে ঢুকতেই সোফায় কাউকে বসে থাকতে দেখলো ইয়াসফি। চোখ দুটো সরু হয়ে কপাল কুঁচকে গেলো। ওমরকে ডাকতে নিয়েও ডাকলো না। হেলতে দুলতে সামনে এগিয়ে গেলো। সোফায় বসে থাকা লোকটা ইয়াসফিকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। এগিয়ে এসে ইয়াসফির সাথে কোলাকুলি করলো। পিঠে দরাম করে এক ঘুষি মেরে বললো,

‘একদমই ভুলে গেছিস। বন্ধু-বান্ধবের খবর রাখার কোন প্রয়োজন নেই। বড় মন্ত্রী হয়ে গেছিস এখন বন্ধুর খবর রেখে কি হবে?’

ইয়াসফি এক নজরে সামনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসছে। ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে উচ্চ স্বরে হেসে বললো,

‘আরে আমি নিহান, তোর বাল্যকালের বন্ধু। দেখেছিস, তুই ঠিক আমায় ভুলে গেছিস।’

ইয়াসফি সূক্ষ্ম চোখে আপাদমস্তক নিহানকে দেখে নিলো। অতঃপর আচানক উচ্চস্বরে হেসে নিহানকে আরেকবার জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে চাপর মেরে বললো,

‘কি কেমন দিলাম?’

নিহান বুকে হাত দিয়ে বড় করে দম ছাড়লো।
‘বাঁচালি ভাই। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুই আমাকে চিনবি না।’

‘ধূর, কি যে বলিস! তোকে চিনবো না তা কি হয়?’

‘মন্ত্রী সাহেব, কতশত মানুষ এখন তার। আমাদের মনে রাখার সময় আছে নাকি?’

নিহানের অভিমানী গলা শোনা গেলো। ইয়াসফি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিজে সোফায় বসে নিহানের হাত টেনে বসিয়ে বললো,

‘রাগ করিস না। কত ব্যস্ত থাকা হয়। কারো সাথে কোন যোগাযোগ করা হয় না। কেমন আছিস তাই বল।’

দুই বন্ধু সুখ দুঃখের আলাপ জুড়ে দিলো। কতদিন পর দেখা। ততক্ষণে ওমর ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। দুজনের কথার মাঝে এসে দাঁড়ালো।

‘কিছু বলবে ওমর?’

‘হ্যাঁ, ভাই। এবার একটা গৃহ পরিচারিকা রাখেন। আমি তো ভালো রান্না করতে পারি না। কত আর বাইরের খাবার আনা যায়।’

ইয়াসফি কিছু সময় ভেবে বললো,
‘হুম বিষয়টা আমিও ভেবেছি। তুমি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ খবর নিয়ে একজন নিয়োগ দাও। আমার এতো সময় নেই।’

নিহান ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘গৃহ পরিচারিকার কি দরকার? এবার একটা বিয়ে করে নে। দেশে যখন এসেছি বন্ধুর বিয়ে খেয়ে যাই।’

ইয়াসফি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘তা আপাতত সম্ভব নয় রে বন্ধু।’

ইয়সসফির গম্ভীর আওয়াজ শুনে নিহান কথা বাড়ালো না। একসাথে খাবার খেয়ে বিশ্রাম করে নিহান চলে গেলো। ইয়াসফি থাকার জন্য জোর করেছিলো। নিহানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় সে থাকলো না।

ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিতেই দেখে অনেকগুলো মিসড কল উঠে আছে। মামা কল করেছিলো। ইয়াসফি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে কল ব্যক করলো।

‘কিরে ভাগ্নে কোথায় ছিলি? কতখন ধরে কল দিয়ে যাচ্ছি তোর কোন রেসপন্স নেই।’

‘এই তো ওয়াসরুমে ছিলাম মামা।’

‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে? কোন ঝামেলা-টামেলা হচ্ছে না তো আবার? কোন সমস্যা হলে আমায় জানাস।’

‘না, তেমন কোন সমস্যা নেই। বুঝলে মামা, আজকে নিহান এসেছিলো। রাতে একসাথে খাবার খেলো। জোর করেছিলাম থাকার জন্য কিন্তু থাকলো না।’

আজিম সারোয়ার গলার স্বরে বিস্ময় টেনে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কে এসেছিলো?’

‘নিহান! আমার ছোটবেলার বন্ধু।’

‘কি যা-তা বলিস! নিহান কোথা থেকে আসবে? ও তো গত দুই মাস আগে লিভার ক্যান্সারে মারা গেছে।

#চলবে

নায়ক-নায়িকা কে এখন বলবো না। পড়তে থাকেন জেনে যাবেন। আপনাদের মাথা আউলাইতে না পারলে কিসের থ্রিলার গল্প লিখলাম😁?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here