আলো আঁধারের লুকোচুরি পর্ব -০১

সাদা রঙের গাড়ি দুটো শো শো করে এসে ধুলোবালি ছড়িয়ে থামলো একেবারে ইরফানদের আড্ডা স্থলে। চোখ পিটপিট করে তাকালো ইরফান। মনে মনে শক্তপোক্ত গা’লি দেওয়ার জন্য মাত্রই মুখ খুলতে চেয়েছিলো। কিন্তু সামনে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেলো। সিগারেটটা হাতে চেপে নজর তীক্ষ্ণ করলো। দ্বিতীয় গাড়ি থেকে হাতে বন্দুক চেপে কতগুলো পালোয়ান ছেলেপুলে নামলো। এগিয়ে এসে সামনের গাড়িটার দরজা খুলে দিলো।

সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা পরিহিত একটা পুরুষ ধীরপায়ে নেমে এলো। নেমে সে খানিক সময় দাঁড়ালো। গাড়ির ভেতর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই একটা মেয়েলি হাত স্পর্শ করলো। শাড়ির কুচি ধরে যে মেয়েটি বাইরে বেরিয়ে এলো তাকে দেখে ইরফানের মাথা চক্কর মেরে উঠেছে। আরে, এতো ওর এক্স গার্লফ্রেন্ড রুহানি! এই গরীবের মেয়েটা এত দামী গাড়িতে কি করছে? রুহানি ইরফানকে দেখে মলিন হাসলো। পাঞ্জাবি পরিহিত ছেলেটা রুহানিকে হাতের ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে মোবাইল নিয়ে সরে দাঁড়ালো। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে রুহানি। ইরফানের চোখে তখনো বিস্ময়! সিগারেটের আগুন হাতে লাগায় ধ্যান ফিরলো। তা দূরে ছুঁড়ে মেরে ইরফান অপ্রস্তুত গলায় বললো,

‘তুমি এই সাজসজ্জায়?’

রুহানির ঠোঁট জুড়ে মলিন হাসির বিচরণ।
‘কেন অবাক হয়েছো?’

‘ছেলেটা কে?’

রুহানি একবার পেছন ফিরে সুঠাম দেহের পুরুষটাকে দেখে নিলো। চোখ ফিরিয়ে উত্তর দিলো,

‘আমার হবু বর।’

‘মানে, কিভাবে কি?’

‘তুমি যাকে অবহেলা করে ছুঁড়ে ফেলে দিবে, অন্য কেউ তাকে যত্ন করে বুকে টেনে নিবে। এটাই ধরণীর নিয়ম।’

ইরফানের বন্ধু বান্ধব সবাই বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না। ঝলমলে শাড়িতে আজ রুহানিকে অপ্সরাদের থেকে কম লাগছে না। কানে, গলায় ম্যাচিং করা জুয়েলারি। হাতে চিকন গাছি সাদা পাথরের চুড়ি। মুখে খাপেখাপ মেকআপ। মেয়েটা কি হুট করে আজ ভীষণ সুন্দর হয়ে গেলো নাকি? কালচে শ্যামলা গায়ের রংটা এতো উজ্জ্বল হলো কি করে? ইরফানের চিন্তায় বাঁধা পরলো রুহানি একটা ইনভিটেশন কার্ড এগিয়ে দেওয়ায়।

‘দুই সপ্তাহ পর আমার বিয়ে। আশা করছি তুমি যাবে।’

ইরফান সন্দিহান চোখে প্রশ্ন করলো,
‘কে এই ছেলেটা?’

‘চিনতে পারোনি? আমি ভেবেছি চিনতে পারবে। জেলার ১ আসনের তরুণ মন্ত্রী….

ইরফান রুহানির মুখের কথা কেড়ে নিলো।
‘ইয়াসফি?’

রুহানি ছোট করে উত্তর দিলো,
‘হু!’

ইরফানের চোখ এবার কোটর থেকে বের হয়ে যাবে। কি বলে মেয়েটা? মন্ত্রীর বউ হচ্ছে? ইরফান নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে। সাথে থাকা ইরফানের বন্ধু আবির বললো,

‘দোস্ত, আমি যা শুনছি তুই কি তা শুনছিস?’

আরেক বন্ধু মিলন থামিয়ে দিলো,
‘চুপ কর শালা!’

ততক্ষণে ইয়াসফি মোবাইল কল শেষ করে এগিয়ে এসেছে। গরমে তার সাদা পাঞ্জাবি ভিজে জবজবে হয়ে আছে। উপরের পেস্ট কালারের কটি থাকায় তেমন বোঝা যাচ্ছে না। চুলগুলো এলোমেলো করে কপালে ফেলা। হাতে দামী ব্রান্ডের ঘড়ি। বাবরি চুল হওয়ায় চোখের সামনে লেপ্টে আছে। তার মধ্যে চোখে সানগ্লাস। রাতের বেলা নিশ্চয়ই কেউ সানগ্লাস পরে না। কিন্তু নিজেকে আড়াল করতে ইয়াসফি পরেছে। মুখে কালো মাস্ক। এগিয়ে এসে ইরফানের সাথে করমর্দন করলো।

‘আমার পরিচয়টা নিশ্চয়ই রুহানি দিয়ে দিয়েছে। তবুও বলছি আমি ইয়াসফি মাহবুব। রাস্তাঘাটে তো ব্যানার,পোস্টার বহু দেখেছেন। তাই পুনরায় পরিচয় দিলাম না। আমার বউয়ের ভয়ংকর এক ইচ্ছে জেগেছে। নিজ হাতে আমাদের বিয়ের কার্ড আপনাকে দিবে। আমি বললাম তুমি দিয়ে এসো সময় করে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা! আমাকে ছাড়া আসবেই না। বলে একসাথে গিয়ে দিয়ে আসবো। নয়তো বিশ্বাস করবে না। আমি মন্ত্রী মানুষ। আমার কি এসবে সময় আছে? তবুও বউয়ের মন রক্ষার্থে এতো প্রোটেকশন, লুকিয়ে চুরিয়ে, গার্ড নিয়ে আসতেই হলো। একটামাত্র বউ বলে কথা!’

ইরফান অবিশ্বাস্য চোখে ইয়াসফির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার সামনে বর্তমান যুবকদের আইডল ইয়াসফি মাহবুব দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে আড়ালে ইরফানের বন্ধু রোহিত মোবাইল বের করে ফেসবুক লাইভে চলে গেলো। তার বর্তমান কনটেন্টগুলো ভালো হচ্ছে না। এখন লাইভে মন্ত্রীকে দেখালে পাবলিক ভালোই গিলবে। তার পেজের ফ্যান, ফলোয়ার, ভিউস হুরহুর করে উপরে উঠবে। তাকে উপরে উঠতে কে ঠেকায়? উপরে বড় বড় করে ক্যাপশন লিখে দিলো, ‘দেখুন জেলা ১ আসনের মন্ত্রী ইয়াসফি মাহবুব কিভাবে লুকিয়ে হবু স্ত্রীর এক্সকে বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছে!’ এর থেকে বড় টপিক এই মুহুর্তে কিছু হতেই পারে না। রোহিতের মোবাইলটাকে এমনভাবে রাখলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে।

রুহানি নিষ্পলক দৃষ্টিতে ইরফানের দিকে তাকিয়ে। ইয়াসফি গলা ঝেড়ে নিলো।

‘সেদিন ধামরাইতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে গলা দেবে গেছে। গলার স্বরটা ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছে। (একটু থেমে) বিয়েটা একদম ঘরোয়া ভাবে করতে চাইছি বুঝলেন ইরফান। কিন্তু বউয়ের আবদার আপনাকে দাওয়াত দিতে হবে। আলাদা করে ইনভিটেশন কার্ড তৈরি করেছে সে। তাই বাধ্য হয়ে এলাম। বুঝেনই তো রাজনীতি করি। আমার কারণে যাতে রুহের কোন নিরাপত্তা নষ্ট না হয় তাই এই প্রন্থা অবলম্বন করলাম। আপনি আসলে আমরা অনেক খুশি হবো। বেশি সময় থাকতে পারবো না। আসি তাহলো। চলো রুহ!’

সোডিয়াম বাতির স্পষ্ট আলোয় ইরফান দেখলো, ইয়াসফি রুহানির হাত টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রুহানি তখনো পেছন ফিরে ইরফানকে দেখতে মগ্ন। মানুষটা কখনো তাকে বুঝলো না! দীর্ঘশ্বাস টেনে ইয়াসফির পিছু পিছু চললো। ইয়াসফি রুহানিকে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে উঠলো,

‘সব ভুলে যাও।’

রুহানি নিজের মনকে শক্ত করলো। হ্যাঁ, তাকে সব ভুলে যেতে হবে। ইয়াসফি গাড়িতে উঠতেই শা করে গাড়ি দুটো ছুট লাগালো। ইরফান রাগে সামনের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঘুষি মেরে বসলো। তার ভীষণ হিংসে হচ্ছে। সাথে রুহানি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলার জন্য ভয়াবহ আফসোস। এর জন্য তো রুহানি এসেছিলো তাকে দাওয়াত করতে। যাতে সে দেখতে পায় তাকে ছাড়া কতটা ভালো আছে। হঠাৎ করে সবকিছু কেমন জানি বিস্বাদ হয়ে গেলো ইরফানের কাছে৷ ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। এতদিন পর উপলব্ধি করতে পালো সে আসলেই একটা দামী জিনিস হারিয়ে ফেলেছে।

ওমর দারজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। কখন মিটিং শেষ হবে আল্লাহ মালুম। পাশের চেয়ারে বসে মোবাইল অন করলো। এখন সে ফেসবুকে গিয়ে ভিডিও দেখবে। এতে যদি সময় কাটে৷ কিন্তু ভিডিও অপশনে গিয়েই তার চোখ ছানাবড়া। সদ্য ছাব্বিশ মিনিট আগে একটা ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। যেটা তে ক্যাপশন দেওয়া ‘দেখুন জেলা ১ আসনের মন্ত্রী ইয়াসফি মাহবুব কিভাবে লুকিয়ে হবু স্ত্রীর এক্সকে বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছে!’ একেবারে সস্তা ক্যাপশন। তাও পাবলিক ভালো গিলছে। ছাব্বিশ মিনিটে ৫৮৭ কে ভিউস। এক মিলিয়ন হতে বেশি সময় নিবে না৷ কমেন্ট ১৮ কে। এর মধ্যে মেয়েদের কমেন্ট বেশি। হার্ট ভাঙা ইমোজি দিয়ে পুরো কমেন্ট বক্স ভরপুর।

ভিডিও অন করে ওমর নিজেও কনফিউশানে পরে গেলো। কারণ স্ক্রিনে যেই ছেলেটা দেখা যাচ্ছে তা হুবহু ইয়াসফির মতো দেখতে। গেটআপ তেমন নিয়েছে। দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো ওমর। ঐ তো ইয়াসফি গম্ভীর মুখে বাকি দুই আসনের এমপির সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মত্ত। গত দুই ঘন্টা যাবত রুমে বসে আলোচনা চালিয়ে গেছে। এক মিনিটের জন্য রুম থেকে বেরোয়নি। বেরুলে তাকে টপকে বেরুতো৷ তাহলে ছেলেটা কে? শত্রুপক্ষের কাজ নয়তো? ইয়াসফির চরিত্রে দাগ লাগাতে নতুন কোন ট্রিকস কাজে লাগাচ্ছে? না বিষয়টা ইয়াসফিকে জানাতেই হচ্ছে। দরজার হাতল টেনে মাথাটুকু ভেতরে ঢুকিয়ে উঁকি দিলো ওমর।

‘ইয়াসফি ভাই!’

অপরপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। ওমর আবারো ডাকলো। ইয়াসফি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওমরের দিকে তাকালো।

‘ওমর আমি জরুরি মিটিং-এ আছি। এখন বিরক্ত করো না।’

‘ভাই, আমার কথাটাও জরুরি।’

‘অপেক্ষা করো আসছি।’

ওমর মাথা চুলকালো। বোকা ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি কি এক ঘন্টা আগে বাইরে গিয়েছিলেন?’

ওমরের প্রশ্নে ইয়াসফির মুখের আদল বদলে গেলো। দাঁত দাঁত চেপে কটমট চাহনিতে তাকালো।

‘আমি কি স্পাইডার ম্যান? দেয়াল বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে যাবো৷ রুমের একটাই দরজা। বের হলে তুমি দেখতে না? আর ফিরতে হলেও তোমার সামনে দিয়ে ফিরতে হতো। অদৃশ্য হয়ে এখানে আসার ক্ষমতা আমার নেই। ফারদার উল্টোপাল্টা কথা বলে মুড খারাপ করবে না। এখন যাও। আমি ব্যস্ত আছি।’

ইয়াসফি মুহুর্তে নিজের রাগী লুক পাল্টে মনোযোগ সহকারে তার আলোচনায় ফিরলো। ওমর আশাহত হয়ে ফিরে এলো। এখন দুনিয়া উল্টে গেলেও ইয়াসফিকে বের করা যাবে না। ওমর পুনরায় ভিডিও ক্লিপ ওন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আরম্ভ করলো। এতো মিল কি করে হতে পারে? গতবারের সমাবেশে তো ইয়াসফি এই গেটআপ নিয়ে গিয়েছিলো। রাস্তায় ছেলেপেলেরা দেখলে হৈ হুল্লোড় করে ঝামেলা পাকাবে বলে মাস্ক পরে, বাবরি চুলগুলো এলোমেলো করে, চোখে রোদচশমা পরে হাজির হয়েছিলো। একেবারে অবিকল সেরকম গেটআপ। তাই বলে হাটাচলা, হাত নাড়িয়ে কথা বলার ধরনও একরকম হবে? অবিশ্বাস্য!

#চলবে

#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_01
#Writer_NOVA

চারিদিকে রাজনৈতিক নেতাদের গল্প দেখে আমারো একটু লিখতে মন চাইলো🤧। দুই মাস পর লিখলাম। একটু রেসপন্স করবেন প্লিজ🥹।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here