আসক্তি ২ পর্ব ২৪+২৫+২৬

#আসক্তি২
পর্বঃ২৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ পিটপিট করে তাকায় পাখি।চোখের নজর পড়ে সোজা ঘরের ছাদের দিকে।আধখোলা চোখে ভ্রুকুচকে সেদিকে চেয়ে থাকে।
“আমার ঘরের ডিজাইন তো এটা না!”,ভাবতে গায়ের উপর লাল রঙ্গের ব্ল্যাঙ্কেটটা নজরে আসে।দ্বিতীয় দফা অবাক হয় সে।ঝিমঝিম করা মাথাটা দু হাতে চেপে ধরে, উঠে বসার চেষ্টা করে পাখি।মাথায় যেন জগতের ভর সব এক করে দেয়া হয়েছে।খুব আস্তে ধীরে উঠে বসতেই নজর পড়ে তার ঠিক সোজা সামনে বসা মানুষটার উপর।চট করে চোখ বড় বড় করে ফেলে পাখি।সন্দিহান চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে,”ইনি আমার ঘরে এতো সকালে মানে!”

শান নির্বকার চিত্তে চেয়ে আছে পাখির দিকে। পাখি সেদিকে দুএকবার চেয়ে নজর সরিয়ে চারপাশে তাকায়। আর তখনি চক্ষুছানাবড়া পাখির।
“এটা তো ওনার ঘর!আমি!আমি এখানে মানে!কি হচ্ছে এসব?”
ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে হরবরিয়ে উঠতে যাবে তার আগেই নিজের দিকে নজর পড়ে।
“এটা কি?”
ভাবতেই কয়েক দফা চোখের পলক ফেলে পাখি।নিজের গায়ে লম্বা টি-শার্ট দেখে বেশ চমকে যায় সে।ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে নগ্ন পায়ের সাথে পা ঘষা লাগতেই বুঝতে পারে পরনে কিছু নেই।নিশ্চিত হতে সন্তর্পনে হাত দিয়ে পা স্পর্শ করে চমকে ওঠে।বুঝতে পারে সত্যিই তার পরনে কিছু নেই।কাচুমাচু মুখে আবারও সামনে তাকায় পাখি।

শান কোন কথা না বলে চেয়েই আছে সামনে।শানের দিকে তাকাতেই যেন লজ্জায় মরি মরি অবস্থা হয়।নজর নামিয়ে ভাবতে থাকে, “আচ্ছা কাল কি হয়েছিলো?আমি এ ঘরে?ড্রেস চেঞ্জ্ড! ”
পাংশুর মতো মুখটা করে পূনরায় ভাবে,”কাল তো পার্টি করলাম।তারপর তো হিটলার আমায় শাসাল।তারপর? তারপর কি হলো? ”
দাঁতে নখ খুটতে খুটতে ভেবে চলেছে পাখি। হঠাৎ ভাবনার উদয় হয়,”আমি তো বাজে জিনিসের বোতল টা শেষ করলাম!তারমানে কী? আমি মাতলামো করেছিলাম খুব!তাই বলে এ ঘরে কেন আমি?আর আমার ড্রেস কোথায়?আর কে করলো এসব?”
ভাবতেই মুখটা থমথমে হয়ে ওঠে পাখির।সিরিয়াস ভাবটা মুখে ফুটে ওঠে।
কিছু একটা বলার জন্যে উদ্যত হতেই শান সোজা উঠে দাঁড়ায়।পাখিকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না।

“যা বাবাহ,কিছু বলতেও দিলো না!”,বিড়বিড় করে উঠতে গিয়ে পরে যায় আরেক বিপত্তিতে।পা তো পুরো ফাঁকা।তবুও শানের অনুপস্থিতে সাবধানে উঠে দাঁড়ায় পাখি।কোনকিছুই তার মাথায় খেলছে না কাল কি থেকে কি হয়েছে!মনের মাঝে অজানা আশঙ্কা বিরাজমান।
দাঁড়িয়ে শার্টের নিচ টা টানতে টানতেই শান তোয়ালে হাতে মুখ মুছে বের হয়।শানের হঠাৎ আগমনে ধপ করে বিছানায় বসে পরে পাখি।ব্ল্যাঙ্কেট টা পায়ে জড়িয়ে বলে, “আমার কিছু কথা আছে”
শান কোন প্রতিউত্তর না করে ভেজা তোয়ালে টা পাখির মুখের উপর ছুড়ে মারে আলগোছে।বেশ অবাক হয় পাখি।মুখ থেকে তোয়ালে সরাতে সরাতে বলে,”এটা কি হলো?”
তবুও শান কোন উত্তর করে না।কাবার্ড খুলতেই পাখি আবার বলে,”কি হলো কথা কেন বলছেন না?আমি কিছু জানতে চাইছি তো!”

শান একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে পাখির সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “বলো কি বলবা?”
“আমি এখানে কেন?আমার ড্রেস কোথায়?কে চেঞ্জ করেছে?কি হয়েছিলো কাল রাতে”,বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে পাখি।শান আরেকটু এগিয়ে বলে,”প্রথমত তুমি কাল ড্রিংকস করেছো।দ্বিতীয়ত তোমার ড্রেস চেঞ্জ করা হয়েছে।কে করেছে সেটা না হয়, না জানলে!আর কাল রাতে কি হয়েছে বা কি করেছো তা না হয় রিমাইন্ড করে দেখো।হুমমম?”
শানের এমন হেয়ালিময় কথায় রাগ উঠে যায় পাখির।সে এই মূহূর্তে বাজে কোন কিছুই ভাবতে রাজি না।
ঝনঝনে গলায় অগ্নিশর্মা হয়ে বলে,”সোজাসুজি বলুন।এতো প্যাচানোর কি দরকার?”

শান একদম কাছাকাছি এসে নিজের গলার নিচে আঙ্গুল তাক করে বলে,”সি!কি করেছ।এরপরেও সবটা বলব আমি? ওকে ফাইন। বুঝতে পেরেছি তুমি আমার মুখে শুনতে চাও।তাহলে শোন ‘কাল রাতে তুমি ড্রিংক করেছো।আচ্ছা যাই হোক, তারপর তুমি আমার ঘরে ঢুকেছো।দরজা লক করেছো।দেখো এখনো লক করা”
দরজার দিকে ইশরা করে বলে শান।এরপর আবার বলতে শুরু করে,”এরপর তুমি ঝাপিয়ে পরলে আমার উপর।বাব্বাহ, তুমি যে এতো এডভান্স আমি ভাবতেও পারি নি।”
শানের কথায় চোখ মুখ কুচকে ওঠে পাখির।আপনাআপনি মুখে হাত চলে যায়।নজর এদিক সেদিক করে লজ্জা লুকাবার বৃথা চেষ্টা করে।শান সেদিকে চেয়ে আবার বলে,”এই দেখো ঠোঁটের কি অবস্থা করেছো,আবার গলায় কামড়ও দিয়েছো।তারপর তো…….”
“স্টপ দিজ”,দুহাতে কান চেপে ধরে বলে পাখি।চোখ বন্ধ করে রেখে বলে,”এসব কিচ্ছু হয় নি কাল।”
“আরে এসব হবে কেন!এসবের থেকে বড় কিছু হয়েছে কাল।তুমিই নিজে থেকে করেছো।আর আমি কি!আমি তো ছেলে মানুষ, না! কী করে নিজেকে…?.”

“একদম মিথ্যে বলবেন না। এসব কিছু না”,চোখে টলমলে জল নিয়ে নাকোচ করে পাখি।জলের গভীরতা এতো বেশি যেন পলক ফেললেই টুপ করে গাল বেয়ে পড়ে যাবে।কিছুক্ষন ভেবে পাখি আবার বল,”আপনি আমায় ঘরে কেন নিয়ে গেলেন না?”
শান ডেভিল হেসে বলে,”এতো সুন্দর একটা মূহূর্ত যে পুরুষ নষ্ট করতে পারে সে তো পুরুষ না মহাপুরুষ।আমি আবার সাধারন মানুষ”
শানের কথা শেষ হতেই দুহাতে কলার চেপে ধরে পাখি।ছলছলে চোখে বলে,”ঐ অবস্থার সুযোগ নিতে বাঁধলো না কাওয়ার্ড কোথাকার।”
বলেই কলার ছেড়ে দুহাতে মুখ চেপে কান্না করে পাখি।শান ওর দিকে কিছুক্ষন চেয়ে বলে,”আমরা আমরাই তো।এতো ঢং করার কি আছে!আর তুমি তো চাওই আমি তোমার কাছে আসি, আদোর করি।তাহলে এতো ভাব নিচ্ছো যে আজ!আমি না তোমার বর!”
চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে শান।পাখি তখনো দুহাতে মুখ চেপে অনবরত কেঁদেই চলেছে।

মাথা তুলে ঘৃনাভরা চোখে বলে,”এমন টা না করলেও পারতেন!আপনি এতো নিচ, ছিহহ!”
“যা বাবাহ্,কি করলাম! যা করার তুমিই তো করেছো”,অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে শান।এরপর গলা ঝেড়ে বলে,”যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।এখন থেকে আমার ঘরে থাকবা তো নাকি!ড্রেস সব নিয়ে এসে কাবার্ডের ঐ বাম পাশে রাখবে।আমি একটু বাগানে হাঁটতে যাব।উফ!একটু ফ্রেশ এয়ারের প্রয়োজন”
এরপর পাখির কোন কথার সুযোগ না দিয়ে আবারও ওয়াশরুমে চলে যায় শান।
এদিকে অনবরত কেঁদেই চলছে পাখি।উপচে পরা কান্না এসে ভর করছে যেন।যতো চোখ মুছে নিচ্ছে ততোই কান্না আসছে তার।কিছুক্ষন পর শান ওয়াশরুম থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে আগা-গোড়া দেখে নেয়।এরপর কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

শানের যাওয়ার দিকে চেয়ে পাখি ভাবে,”আমি তো এরকম টা চাই নি।হ্যা আমি তাকে ভালোবাসি। তাই বলে এভাবে….উনিও কী করে এমনটা করলেন!উনি তো স্বাভাবিক ছিলেন!চাইলেই তো পারতেন সবটা আটকাতে!”
থমথমে মুখে পা টিপে টিপে পাখি ঘর ছেড়ে বের হয়।এরপর নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।ইনায়াহ্ তখনো ঘুমাচ্ছে।মাথার পাশে বসে পাখি আবারও গতরাতের কথা ভাবতে থাকে।কিন্তু ফলাফল শূন্য।সবটাই আবছা মনে পড়ছে তার।দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে পাখি।

🌸🌸
সকাল থেকে রাহেলার মুখটা থমথমে দেখায়।কারোর সাথে কোন কথা বলছে না।শান বেশ কয়েকবার ডেকেও সাড়া পায় নি।নিজের মতো কাজ করে চলেছে।শান রাহেলার অবস্থা বুঝে বার কয়েক প্রশ্নও করেছে।কিন্তু শানের দিকে না তাকিয়েই রাহেলা জবাব দিয়েছিলো,”কিছু হয় নি”

ভোরবেলা থেকে একটি বারের জন্যেও পাখি ঘর থেকে বের হয় নি।লজ্জায়, ঘৃনায় শানের সামনে পরা তো দূরের কথা।শানের নাস্তা করার একদম শেষে গিয়ে ইনায়াহ’কে নাস্তা করিয়েছে।রাহেলার এমন খাপছাড়া ভাব পাখির নজরও এড়ায় নি।কাটাকাটা স্বরে কয়েকবার প্রশ্ন করেছে কিন্তু কোন জবাব মেলে নি।অবাক হয় পাখি।
“আজ একবার খেতেও বলল না চাচি!”,আনমনে ভেবে মনটা খারাপ হয়ে আসে পাখির।
কোন কথা না বলে অতিরিক্ত খাবার সমেত এঁটো প্লেট গুলো তুলে নিয়ে রান্নাঘরে যায় রাহেলা।

ইনায়াহ’কে খাইয়ে আবার দ্রুত উপরে চলে যায় পাখি।কারণ সে চায় না কোনভাবে শানের সাথে দেখা হয়ে যাক।

শুক্রবার হওয়ায় হসপিটালের নামগন্ধ নেই শানের।ড্রয়িংরুমে বসে কোলের উপর ল্যাপটপটা রেখে কিছু একটা করছে সে।
ইনায়াহ্ জিদ করছে এই ভর দুপুরে পাস্তা খাবে সে।অগত্যা পাখিকে নিচে নামতে হয়।ইনায়াহ্ পাখির হাত ছেড়ে শানের কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে কোলে গিয়ে বসে।এই সুযোগে পাখি দ্রুত পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।রাহেলা তখনো রান্না ঘরে দুপুরের খাবারের আয়োজন করছে।

“তোমার গলায় ওটা কিসের বাইট সান সাইন? “,অবাক হয়ে প্রশ্ন ছোড়ে ইনায়াহ্।পা থেমে যায় পাখির।বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে দ্বিগুন।রান্নাঘরের দিকে চোখ ফেলে বুঝতে পারে রাহেলা ড্রয়িংরুমে তাকিয়ে আছে শানের উত্তরের অপেক্ষায়।
“ককই মাম”,দাগটা টি-শার্টে লুকাতে লুকাতে বলে শান।ইনায়াহ্ আঙ্গুলটা সেদিকে নিয়ে গিয়ে বলে,”এই যে, এই তো। দেখ,কতোগুলো দাঁতের দাগ। কালো হয়ে গেছে তো!”
“ককিছু না মা”,এরপর পাখির দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাদের বাড়িতে একটা গড়িলা আছে। সে হয়ত কামড়েছে”

শানের কথায় চোখ মুখ কুচকে আসে পাখির।কোন প্রকার টু শব্দটি না করে রান্না ঘরে চলে যায় পাখি।
ঢুকতে না ঢুকতেই হাতে প্রচন্ড টান পরে ।আহ্ শব্দ করে তাকায় সামনে।
“এদিকে আসো”,রাহেলা হাত টেনে রান্নাঘরের একদম কোনায় নিয়ে যায় পাখিকে।লজ্জিত আর চিন্তিত চিত্তে বলে,”এসব কি পাখি?আমি কিন্তু অবুঝ না।তোমরা কী করে পারলে বিয়ে ছাড়াই এমন একটা জঘন্য কাজ করতে!”
কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে রাহেলা আবার বলে,”তাহলে আশপাশের লোক যা বলতো সবই ঠিক!তোমাদের বলা হয়েছিলো তোমরা বিয়ে করে নাও।তা করলে না অথচ…. ছিহ ছিহ ছিহ। এতো নোংড়ামি!”,
পাখি অসহায় চোখে রাহেলার দিকে তাকিয়ে থাকে।তার কাছে কোন জবাব থাকে না এই মূহূর্তে রাহেলাকে দেয়ার মতো।

“শান না হয় ছেলে মানুষ। তারা তো ছোঁকছোঁক করবেই। যদিও শান এরকম ছেলে নয়।কিন্তু তুমি!তুমি তো নিজেকে সংযত রাখতে পারতে!”,ঝনঝনে গলায় বলে রাহেলা।পাখি লজ্জায় কেঁদে ফেলে কিন্তু কিছুই বলার থাকে না।সত্যিই তো ব্যপার টা কতোটা লজ্জার ব্যপার!না পারছে বিয়ের কথাটা খুলে বলতে না পারছে কাল রাতের কথাটা বলতে।পাখির নিরুত্তর চাহনী দেখে রাহেলা বলে,”কাল রাতে আমি সব দেখেছি। তুমি নিজেই শানের ঘরে ঢুকেছো।তারপর দরজা লক করেছো।আর ভোরবেলা শানের শার্ট গায়ে ঐ ঘর থেকে বের হয়েছো।এরপরেও আর কি বাকি থাকে বোঝার?”
পাখি নিজের স্বপক্ষে বলে,”চাচি আমায় ভুল ভাবছো।দেখার মাঝেও কিছু ভুল……. ”
“পাখি”,কটকটে দৃষ্টিতে রেগে তাকায় রাহেলা।
মাথা নিচু করে নেয় পাখি।

🌸🌸
সারাদিন আর একটি বারের জন্যেও পাখি ঘরের চৌকাঠ মারায় নি।কার সামনে যাবে সে!রাহেলা বেগমের সাথে কথা তো দূরের কথা চোখ তুলে তাকানোর মতো নির্লজ্জতা পাখির হচ্ছে না।আর শানের সামনে তো যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছে না পাখি।
“বিকেল হয়ে গেলো ইনায়াহ্’র জন্যে হালকা নাস্তা তৈরী করতে হবে। এবার তো নিচে যেতেই হবে।কিন্তু…কিন্তু যাব কোন লজ্জায় যদি উনি বসে থাকে ড্রয়িংরুমে?বা চাচি যদি রান্না ঘরে থাকে!ছিহহ কি বিদঘুটে একটা কান্ড হলো কাল।কি করে করলাম
এসব? আমার তো মাথাতেই আসছে না।”,পাখি ঘরে একা একা বিড়বিড় করছে আর মেঝেতে পায়চারী করছে।মনটা বিষিয়ে উঠছে কাল রাতের কথা ভাবলেই।

“উহুহম উহুহম”,দরজায় কারো গলার শব্দে সেদিকে তাকায় পাখি।
“কি ব্যপার, আজ একবারো সামনে এলে না?কথা বলছো না?বউ বউ করে অধিকার ফলাচ্ছো না…কাহিনী কি বলতো?আজ তো আরো বেশি আমার কাছে কাছে থাকার কথা। কিন্তু তুমি তো……”বলেই পাখির দিকে তাকায় শান।অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাখি।
নিজের হাসিটাকে কৌশলে দাবিয়ে রেখে শান বলে,”এতো রেগে যাওয়ার কি আছে বউ?খুব চাপে ছিলাম সারাদিন।তাই তোমার কাছে আসতে পারি নি।চলো চলো আমার ঘরে চলো।মিস করছি তোমায়”
বলতে বলতে পাখির একদম কাছে চলে আসে শান।হাত টা ধরে টেনে নিয়ে যেতেই ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় পাখি।ঘর কাপানো চিল্লানিতে বলে ওঠে,”লজ্জা করলো না আপনার?কোন সাহসে আমার অবচেতনের সুযোগ নিলেন?নিজেকে কি একটুও সংযত রাখতে পারলেন না?”
বলতে বলতে রাগে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পরে পাখির।শান সেদিকে শান্তস্বরে চেয়ে বলে,”শান্ত হও।বসো”
“আমায় হুটহাট জড়িয়ে ধরা,আর পাঁচটা দম্পতির মতো স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা এসবই তো তুমি চেয়েছিলে।তাহলে আজ…… “,স্বগতোক্তি করে বলে শান।
“চুপ করুন আপনি।আমি সবটা চেয়েছিলাম ভালোবেসে ; এভাবে নয়।আপনি জানেন রাহেলা চাচি সবটা দেখে ফেলেছে?আর আজ আমায়…..,”বাকি কথা শেষ করতে পারে না পাখি।লজ্জায় কেঁদে ফেলে।

শান চোখ ছোট ছোট করে পাখির দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে,”তাহলে এই কারণে চাচির ব্যবহার আজ ব্যাতিক্রম! ”

পাখির ফোন স্ক্রীনের ক্ষীন আলোটা বার বার জ্বলছে আর নিভছে ; যেটা শানের চোখ এড়ায় না।
স্বাভাবিক স্বরে বলে,”তোমার ফোনে কল এসছে ”
পাখি শানের দিকে তাকিয়ে ফোনের দিকে এগিয়ে যায।সত্যিই ফোন এসেছে।রাখি ফোন করেছে।
চোখ মুখ মুছে ফোন রিসিভ করে পাখি।
“হ্যালো”
“কিরে থাকিস কই, ফোন টা থাকে কই তোর?”,কপোট রেগে বলে রাখি।
পাখি প্রশ্ন গুলো এড়িয়ে শানের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার নাক মুছে বলে,”কি বলবি, বল!”
শান মুচকি হেসে ঘরের বাহিরে চলে যায়।
“আরেহহ, কাল রাতে কতোবার ফোন করলাম ধরলি না। আজ সকালে তোর খোঁজ নিতে ফোন করলাম যে সুস্থ আছিস কিনা তাও ধরলি না;কাল ওতো অসুস্থ্য দেখলাম।পরে ডাক্তারকে ফোন করে তোর খোঁজ নিতে হলো।আচ্ছা ফোন কেন ব্যবহার করে মা…..”
“আমি পুরোপুরি সুস্থ এখন। আর কিছু বলবি?”,রাখিকে কথার মাঝে থামিয়ে বলে পাখি।চিন্তিত কন্ঠে রাখি প্রশ্ন করে,”গলাটা এমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা লাগছে তোর! কি হয়েছে রে?
“কিছু না। ওয়েট!এক মিনিট…..আমার কি হয়েছিলো?কিসের অসুস্থতা? আর তুই যখন গেলি তখন তো আমি সবটাই জানি। তাহলে?”
“কেন, তোর কিছু মনে নাই?”, উৎকণ্ঠিতা রাখি প্রশ্ন করে।
“নাতো! আমার জানা টা খুব জরুরী রাখি।আর তুই….. ”

“ও মুন সাইন ক্ষিদে লেগেছে তো।কিছু করো নি?”,ইনায়াহ্ ক্লান্ত শরীরে দৌড়ে এসে বলে পাখিকে।
খেলতে খেলতে মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে ইনায়াহ্’র।বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে পাখির।ইনায়াহর মুখটায় হাত বুলিয়ে বলে,”এই তো মা করব এখন।কথাটা শেষ করে নিই?দাঁড়াও একটু”
বলেই পূনরায় রাখিকে বলে,”হ্যা বল ”
“ডাক্তারও তোকে কিছু বলে নি?আমি ফিরে আসার পর তোকে মনে হয় একশ বারের মতো ফোন দেই যাতে ওই বোতল না খাইস।তুই ফোনই ধরলি না।তারপর আমি আবারও তোর ওখানে যাই।গিয়ে দেখি তুই কাম সাবার করে ফেলছিস।যা হবার তাই হয়েছে। আর রাতে কোন ঘরে ছিলি এটা দেখেও কি কিছু মনে পড়ছে না তোর?”,প্রশ্ন করে রাখি।

রাখির কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে পাখি।এখন আর বোঝার অপেক্ষা রাখে না কাল রাতে সত্যিই সে মাতলামো করেছে শানের সাথে।নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃনা লাগছে পাখির।
“ও মুন সাইন… “,ইনায়াহ্’র করূনস্বরে ডাকটা কানে আসতেই পাখি হুশ ফিরে রাখিকে বলে, “পরে কথা হবে ”
ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখে পাখি।এরপর নিচু হয়ে ইনায়াহ্’কে বলে,”মা, তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি নুডলস করে দিচ্ছি”
“না।নুডলস খাবো না।অন্য কিছু করে দাও”,একরোখা জবাব দেয় ইনায়াহ্।
পাখি অসহায় হয়ে বলে,”আজকে খাও না মা। অন্যকিছু করতে মন চাচ্ছে না”
মলিন মুখে ঠোঁট উল্টিয়ে চেয়ে থাকে ইনায়াহ্।সঙ্গে সঙ্গে পাখি হেসে বলে, “এক্ষুনি করে আনছি তোমার ফেভারিট পাকোড়া। চলবে?”
“দৌঁড়াবে”,পাখির গলা জড়িয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে ইনায়াহ্।

🌸🌸

সকাল হতে হতেই ইনায়াহ্কে তৈরী করে দেয় পাখি।এরপর নিজে তৈরী হয়ে নেয়।নিচে এসে ডায়নিং এ শানকে পায় না পাখি।হাফ ছেড়ে বাঁচে এবার।হাতে হাতে খাবার ডায়নিং সাজাতে সাহায্য করে রাহেলাকে।রাহেলা থমথমে গলায় বলে,”খেতে বসো।আমি দিচ্ছি”
পাখি রিনরিনে স্বরে বলে,”কথা বলবে না চাচি আমার সাথে?”
রাহেলা পাখির কথাকে এড়িয়ে বলে, “একটা কথা বলি মা?এরকম নোংড়া সম্পর্ক গুলোতে সবসময় মেয়েদেরই দোষ হয়।তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো।তাই অনুরোধ করব যেভাবেই হোক শানকে বিয়ের জন্যে বলো।আমিও বোঝাব।”
এরপর স্বগতোক্তি করে রাহেলা বলে,”নয়ত এ বাড়ি ছাড়তে আমরা বাধ্য হবো”

পাখি আর কোন কথা বলতে পারে না।ক্ষিদের চোটে শরীরে কথা বলার মতো শক্তি নেই।তাই দ্বিতীয়বার কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও কিছু বলে না পাখি।গিয়ে ডায়নিং এ।এদিক ওদিক শানকে দেখে নিয়ে দ্রুত নাস্তাটা সেড়ে নেয়।এরপর ইনায়াহ্’কে নিয়ে চলে যায় স্কুলে।
আর উপর থেকে সবটা দেখে মুচকি হাসে শান।

স্কুলে ঢুকেই রাখির সাথে দেখা হয়ে যায় পাখির।
“না জানি কাল কতো কি করেছি? এবার সবটা নিয়ে খিল্লি করবে নিশ্চই”,ভাবতে ভাবতে আড়চোখে রাখির দিকে চেয়ে অন্যদিকে চলে যায় পাখি।
রাখি ডাকতে ডাকতে একদম পাখির কাছাকাছি চলে আসে।জোড় করে থামায় পাখিকে।
“কি রে কতোক্ষন ধরে ডাকছি। শুনছিস না যে?”
“এমনি।কিছু বলবি?”
“এমন করছিস কেন?কালকের ঘটনা নিয়ে মন খারাপ?আমি চেয়েছিলাম তোকে সামান্য একটু খাওয়াবো। পরে মনে নেই আর। আর তুই পরে সবটা খেয়ে নিবি কে জানতো……”,মিনমিনে স্বরে বলে রাখি।
পাখি ওকে এড়িয়ে বলে,”আচ্ছা বাদ দে ও টপিক।ভালো লাগছে না আমার।”
পাখির খাপছাড়া ভাব দেখে রাখি আর কিছু বলার সুযোগ পায় না।
মাথা এলিয়ে আস্তে করে বলে,”আচ্ছা।চল ভিতরে চল”
#আসক্তি২
পর্বঃ২৫ (বোনাস)
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

স্কুলের ক্লাসগুলো কোনমতে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসে পাখি।এসেই ড্রয়িং রুমে শানকে দেখে। দু’জন ভদ্রলোক সহ সেন্টার টেবিলে রাখা পেপার টার উপর কিছু একটা লিখছে শান।তাদের দিকে এক নজর দেখে পাখি ইনায়াহ্’র হাত ধরে উপরে চলে যায়।শান সেদিকে একবার চেয়ে মুচকি হেসে আনমনে বলে,”তোমায় সোজা পথে আনার জন্যেই সারারাত বসে বসে এই উপায় বের করেছি সেদিন।দেখো কেমন নাজেহাল করেছি তোমার অবস্থা!এখন কই গেলো আমার কাছে আসার চেষ্টা?”
“কি ব্যপার শান বাবু,কি অবস্থা? মেয়েটা এখনো তোমার সাথে থাকে,দেখছি!”,পাশে বসা সোহেলের কথায় ভাবনা ভাঙ্গে শানের।সন্দিহান চোখে চেয়ে বলে,”তো?”
“না মানে, ভালোই তো চলছে তাহলে।তা আমাদেরকেও একটু সুযোগ দেবে না?”,বেশ নোংড়া চাহনীতে বলে সোহেল।

শান আর কোন কথা না বলে সোজা উঠে দাঁড়ায়। দুহাতে কলার চেপে ধরে টেনে তোলে সোহেলকে।উপস্থিত বাকিজন হতভম্ব হয়ে যায় শানের আচরনে।শানের গতিবিধি বুঝে উঠে দ্রুত ধরে ফেলে শানের হাত।
“ছাড়ো মিহির ভাই।ওর এতো বড় সাহস হয় কী করে এতো নোংড়া একটা কথা বলার?জিহ্ব টেনে ছিড়ে ফেলব একদম”,রাগে গজরাতে গজরাতে বলে শান।
মিহির পিছন থেকে জাপটে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে শানকে।
“এতো উত্তেজিত হয়ো না শান।একটু শান্ত হও”
“কিসের শান্ত হবো?ও কতো বড় ইঙ্গিত করেছে তোমার ধারনা আছে?চিপ, লো মাইন্ডেড কোথাকার…..এই আউট..আউট ফ্রম মাই হাউজ..রাইট নাও”,রাগে চিল্লিয়ে বলে শান।চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে শানের।ইতোমধ্যে পাখি উপর থেকে সব দেখছে।রাহেলা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে।চিন্তিত মুখে আনমনে বলে,”কবে শেষ হবে এসব? জনে জনে কতোজনের মুখ আটকাবে শানবাবা!”

“ব্যপার টা মোটেও ভালো করলে না শান।শেয়ার ক্যান্সেল। মাইন্ড ইট।আর ভুল তো কিছুই বলি নি আমি।চাইলে আমরাও মোটা অঙ্কের এমাউন্ট দেব।তোমার এতো জ্বলুনির কি আছে?”,কটাক্ষ করে বলে সোহেল।
ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি শেয়ার বিজনেসেও শানের বিচরন।আর সেই শেয়ারে অংশীদার হিসেবে যুক্ত হয়েছে সোহেল আর মিহির।
সোহেলের আবার এমন নোংড়া কথায় শান নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারে না।সেন্টার টেবিলের সেন্টারে রাখা ফুলের টব টা সোহেলের দিকে তাক করে ডান পায়ে এক লাত্থি মারে।অসতর্ক হলেই আজ কিছু একটা ঘটে যেত।সোহেল তৎক্ষনাৎ সরে যায় অন্যপাশে।
“মিহির ভাই ওকে চলে যেতে বলো।”,মুখ ঘুরিয়ে বলে শান।শানের এমন কান্ডে দ্রুত নিচে নেমে আসে পাখি।অপরাধীর ন্যায় দূরে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না।উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে শান টেবিলের উপর রাখা প্রত্যেকটা কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বলে,”এটারই ভয় দেখাচ্ছিলি তো!যা আমিই ক্যান্সেল করলাম”

মিহির আর কোন কথা না বলে সোহেলকে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায়।চাপা রাগ দেখিয়ে বলে,”অন্যের ব্যপারে নাক না গলালে চলে না তাই না?চরিত্রটা কি কোনদিনও ঠিক হবে না?নিজের মতো মনে করো সবাইকে?”

শান দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।পিছনের সোফায় বসে পাখির দিকে একবার তাকায়।উঠে গিয়ে দাঁড়ায় সোজা পাখির সামনে।কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,”এসবই চেয়েছিলে না?দেখো, হচ্ছে।এসব চাইছো বলেই তো সিলেটের ওতো সহায় সম্পদ ছেড়ে আমার সাথে চলে আসলে,তাই না?”
শান উঠে সোজা হয়ে বলে,”আমার বদনাম করছো সাথে তোমার নিজেরও বদনাম হচ্ছে”
বলার পর পরই পাখি মাথা তুলে তাকায়।ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে বলে, “যে পুরুষ নিজের বউকে প্রকাশ্যে আনতে পারে না ;সে কাপুরুষ।তার চুড়ি পরে বসে থাকা উচিত।আর আমি যাবো না, যাবো না, যাবো না। ”
বলেই ছলছলে চোখে উপরে চলে যায় পাখি।

“কী করে বোঝাই তোমায় পাখি আমার”,চোখ মুখ কুচকে ভাবে শান।

🌸🌸

সে রাতে না খেয়েই ঘুমায় পাখি।রাতের গভীরতা একটু বাড়তেই শান উঠে চলে যায় পাখির ঘরে।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে শান।ইনায়াহ’কে জড়িয়ে রেখে বাচ্চাদের মতো মলিন মুখে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে পাখি।খুব সন্তর্পনে, শব্দহীন পদধ্বনিতে শান সেদিকে এগিয়ে যায় ।পাখির পিছনে বেশ খানিক টা ফাঁকা জায়গা খালি পরে থাকে।মুচকি হেসে শান সেদিকে এগিয়ে সাবধানে বসে পরে।এরপর কাত হয়ে থাকা পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।ধীরেধীরে হাতের স্পর্শ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে যায়।তবুও ঘুম ভাঙ্গে না পাখির।শানের ঠোঁট অনেক টা প্রসস্ত হয় হাসিতে।
“এতো গাঢ় ঘুম তোমার,যে প্রতি রাতে এভাবেই তোমার কাছে আসি অথচ তুমি বুঝতেই পারো না”,
হাসি টা অবিচল রেখে কপালে একটা চুমু দেয় শান।
চুমুর স্পর্শে ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ চলে আসে ঘুমন্ত পাখির।শান নির্বকার মনে সেদিকে চেয়ে থাকে।

পাখি একটু নড়েচড়ে শানের দিকে কাত ফিরতেই মেঝেতে সাবধানে বসে পরে শান।কিছুক্ষন কোন প্রকার নড়াচাড়া ছাড়াই ঠাঁয় বসে পাখির গতিবিধি পরোখ করার চেষ্টা করে।পাখির নিঃশ্বাস ভারি হতেই শান হাফ ছেড়ে বাঁচে।বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”আজ তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে ”
সে রাতের কথা মনে তুলে মুচকি হেসে শান আবার ফিসফিস করে,”তুমি যে এতো ভীতু আর অবিশ্বাসী ভাবা যায়!গুড নাইট জান পাখি”

কথা শেষে শান উঠে চলে যেতেই ইনায়াহ্’র কথায় থমকে যায়।
“সান সাইন, তুমি কি করছিলে এখানে?”,ঘুম জড়ানো কন্ঠে টেনে টেনে বলে ইনায়াহ্।
শান পরে যায় মহা বিপদে।দুটো শুকনো ঢোক গিলে তড়িৎগতিতে পাখির দিকে তাকায়।দেখে পাখি এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।আটকে রাখা নিঃশ্বাস টা ছেড়ে শান লম্বায় পা ফেলে দু কদম এগিয়ে আসে ইনায়াহ্’র পাশে।আতঙ্কিত চোখে শান প্রশ্ন করে,”তুমি এখনও ঘুমাও নি মাম?”
“হ্যা, ঘুমিয়েছি তো। তুমি আসলে বলে…..”
“হিসসসস,আস্তে মা আস্তে কথা বলো প্লিজ”,হাতের ইশারায় বলে শান।
“আমি তো ঘুমিয়ে গেছি।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি কেউ একজন মুন সাইনকে কি যেন করছে।পরে দেখি তুমি। কি করছিলে তুমি মুন সাইনকে বলো।তুমি আবার ঝগড়া করেছো, না?”,ঘুমকে একপাশে ঝেড়ে বিছানায় শক্ত হয়ে বসে বলে ইনায়াহ্।

ইনায়াহ্’র কথা শুনে শানের ডান হাত আপনাআপনি কপালে চলে যায়।হাঁটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসে ইনায়াহ্’র পায়ের কাছে মাথা দেয়।চোখ বন্ধ করে ভাবে,”আর রক্ষা নেই তোর শান।যা হবার হয়ে গেছে।এবার পরিস্থিতি সামলাবি কী করে?”
“তারমানে তুমিই প্রতিদিন আসো।আর আমি চোখ মুছে তাকাতেই চলে যাও”,কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে প্রশ্ন ছোড়ে ইনায়াহ্।শান এবার আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।গা হাত পা কাঁপা শুরু হয়। কি বলবে বুঝতে পারছে না শান।তবে যে করেই হোক ইনায়াহ্’র কাছে কোন ভাবেই বোঝানো যাবে না সবটা
ঢোক গিলে বলে,”এসব কি বলছো মা?আআমি কেন…..!”
“একদম মিথ্যে বলবা না। আমি দেখছি তোমার মতো একটা মানুষ আসে আবার কিছুক্ষন পর চলে যায়।সকাল সকাল হতে হতে সবটা ভুলে যাই আমি
মুন সাইনকে আর বলতে পারি না।বলো কেন আসো তুমি?”,শেষের কথাটা বেশ গোয়েন্দা চিত্তে বলে ইনায়াহ্।

“ওকে আমরা আস্তে কথা বলি কেমন!শুনো, আমি দেখতে আসি তোমাকে বুঝেছ মা।দেখতে আসি তুমি ঘুমাইছো কিনা!”,বলেই ইনায়াহ্’র মুখের দিকে তাকায় শান।মুখ দেখে মনে হচ্ছে মিথ্যেটা ইনায়াহ্’র হজম হয়েছে। তাই আরেকটু এগিয়ে শান বলে,”কি বলোতো মা, তোমার মুন সাইন এসছে থেকে আমায় সময় দিচ্ছো না।তোমায় মিস করি তো।তাই লুকিয়ে তোমায় দেখতে আসি।”
ইনায়াহ্ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,”কিন্তু তুমি যে মুন সাইনের দিকে যাও। কি যেন করে আবার চলে যাও”
শান হরবরিয়ে বলে, “ও কিছু না এমনিই আরকি।চকোলেট খাবে মা?”
খুশিতে গদগদ হয়ে ইনায়াহ্ বলে,”হ্যা হ্যা ”
“ওকে কাল অনেক গুলো চকোলেট দেব।বাট প্রমিজ করো তোমার মুন সাইনকে কিছু বলবা না”
কিছু একটা ভেবে ঠোঁট উল্টিয়ে ইনায়াহ্ বলে,”ওকে”

অনিচ্ছাসত্বেও হেসে শান ইনায়াহ্’কে বুকে জড়িয়ে নেয়।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “সরি মা।সত্যিটা জানলে তুমি তোমার মুন সাইনকে বলবা। যেটা আমি চাই না”

বেরিয়ে যায় শান।রাহিলা সিঁড়িতে উঠে সবটা দেখে মুখে আঁচল ঠেকায়।অবাক হয়ে ভাবে, “এতোটা অধঃপতন শানবাবার!”

🌸🌸

প্রতিদিনের ন্যায় আজও ইনায়াহ্’কে সাথে করে স্কুলে যায় পাখি।স্কুল শেষে ফিরে আসে। তবে আগেকার মতো শানের সামনে যায় না বললেই চলে। রাহেলাও প্রয়োজনের বাহিরে টু শব্দটিও করে না।অসহায় মুখে পাখি সারাটা দিন ঘরবন্দি পাখির মতো শুয়ে বসে কাটায়।

সন্ধ্যেবেলায় শান দরজায় এসে ডাকে ইনায়াহ্’কে।তখন ইনায়াহ্ পাখির কাছে পড়তে ব্যস্ত।ইনায়াহ্ অনুমতির অপেক্ষায় তাকায় পাখির দিকে। একবার শানের দিকে তাকিয়ে পাখি চোখ সরিয়ে মুচকি হেসে বলে,”যাও।পাঁচ মিনিট টাইম।তাড়াতাড়ি চলে আসবে। কেমন!”
“আচ্ছা”

কিছুক্ষন পর ইনায়াহ্ কতোকগুলো চকোলেট সমেত ঘরে ঢোকে।পাখি ভ্রু কুচকে বলে, “এতো চকোলেটস!”
“হুমমমম।সান সাইন দিলো।”
“কেন? তিনি কি জানে না এতো চকোলেটস বাচ্চাদের জন্যে কতোটা ক্ষতিকারক?”,কথাটা ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে পাখি।
ইনায়াহ্ পাংশুটে মুখে বলে,”সান সাইন প্রতিদিন রাতে তোমার ঘরে আসে।তোমার দিকে গিয়ে কি যেন করে। আমি ভালো করে তাকাতেই চলে যায়”
অবাক চোখে চেয়ে থাকে পাখি।অস্ফুটস্বরে বলে,”তারপর?”
অবুঝ মন একে একে কাল রাতের সব কথা জানায় ইনায়াহ্।
পাখির অবাক হয়ে ঠাঁয় বসে ইনায়াহ্’র কথাগুলো শুনে যায়।

🌸🌸
রাতে না ঘুমিয়ে পাখি আজ অপেক্ষা করছে শানের লুকিয়ে আগমনের।
“আজ আপনাকে বলতেই হবে এতো লুকোচুরির কী কারণ”,ভাবতেই চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে পাখির।কিছুক্ষন পর তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে ১.২০ মিনিট।আর চোখ দুটো খুলে রাখতে পারছে না পাখি।
” শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করি”,ভাবতেই গা এলিয়ে দেয় বিছানায়।কতোক্ষন থাকতেই রাজ্যের ঘুম এসে জমা হয় চোখের পাতায়।এক ঘুমে সকাল হয়ে যায় পাখির।
“এই হাড়িপাতিল, হাড়িপাতিল “,হাড়িপাতিল ওয়ালার করা কড়া ডাকে ঘুমে ভাঙ্গে পাখির।জোড়পূর্বক চোখ খুলে দেখে ৭.৩০ বাজে।
হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভাঙ্গে পাখি।তখনি মনে হয় কাল রাতের কথা।নিজের ব্যর্থতায় মুখটা চুপসে যায়।

আজও স্কুলের জন্যে চলে যায় পাখি।আধাবেলা স্কুল শেষে বাড়ি ফেরে। কিন্তু কোথাও ইনায়াহ্’র বলা কথাগুলো ভুলতে পারছে না পাখি।বার বার মনে হয়,”কেন লুকিয়ে আসে উনি!কী সে কারণ?জানতে তো আমায় হবেই।”

আজ দুপুর বেলাতেই শান চলে আসে বাড়িতে।শরীরটা বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। নিজের ঘরে গিয়ে গোসল সেরে লম্বা ঘুম দেয় শান।

বিকেল গড়াতেই ইনায়াহ্’র জন্যে হালকা নাস্তা বানিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢোকে পাখি।ফ্যানের নিচে রেখে ঠান্ডা হতে দেয় সেগুলো।ইনায়াহ্ পাশে বসে অপেক্ষা করছে খাবার ঠান্ডা হওয়ার আশায়।রাহেলা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বসে ইনায়াহ্’র পাশে।

“কই শান”,বলতে বলতে বাড়িতে ঢোকে কয়েকজন পুরুষ-মহিলা।পাখিসহ রাহেলা বেগম তাকায় সেদিকে।মহিলাদের দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না এনারা সেদিনের ভদ্র মহিলারা।যারা পাখিকে নিয়ে ভালো মন্দ বলে গিয়েছিল।রাহেলা তাদের দেখে চিন্তিত মুখ বিড়বিড় করে,”এবার সবটা শেষ”

আগত সবাই গিয়ে দাঁড়ায় ড্রয়িংরুমে।তন্মধ্যে পাখির দিকে নোংড়া দৃষ্টিতে তাকায় কয়েকজন মানুষ।পাখি বেশ বুঝতে পারে এবার বদনামের আর কিছুই বাকি নেই।শুকনো মুখে তাদের দিকে তাকায়।
“কি নোংড়া মেয়েরা বাবা”
“শুনলাম না, ওরে রেখে আসলো!”
“আরে আবার নিয়ে আসছে।”
“বোঝ না এ যুগের ছেলে মেয়েদের মতিগতি!”
“কত্তোবড় সাহস ভাবুন ভাবি।আমরা না করা সত্বেও আবার নির্লজ্জের মতো একসাথে থাকছে’
সবাই একে অপরকে টিপ্পনী কেটে পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলছে।

রাহেলা এগিয়ে গিয়ে বলে, “চেয়ারম্যান সাহেব, আসুন না বসুন এদিকে”
হাত উচিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,”শানকে ডাকো ”
“শানবাবার তো শরীর ভালো না, ঘুমিয়েছে”,কাপা কাপা গলায় বলে রাহেলা।
পাশ থেকে একজন বয়স্ক গোছের লোক বলে ওঠেন,”অবৈধ কাজ করলে কারোরই শরীর সুস্থ থাকে না।কি বলো? ”
“আরে সব দোষ এই বে* মেয়ের।ও যদি এখনি চলে যায় সব ঠিক হয়ে যাবে।নোংড়া, বেজন্মা মেয়ে কোথাকার”
কথাটা শুনে পাখির কান গরম হয়ে আসে।
“শেষমেশ এতোটা নীচে নামতে হলো!”,আনমনে ভাবতেই পাখির সারা শরীর অবশ হয়ে আসে যেন।
রাহেলার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় পাখি।রাহেলা করূন চোখে সেদিকে চেয়ে উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশ্যে বলে,”এভাবে মেয়েটাকে হেনস্থা না করে শান বাবার থেকে সবটা শুনে একটা ব্যবস্থা করলে হয় না আপা”

“আর কতো ব্যবস্থা করবে শান?শানের ব্যবস্থা তো দেখলামই।পূনরায় বাড়িতে পতিতা এনে বিবাহ ছাড়াই সংসার করছে”
“ওর ব্যপারে আর একটাও বাজে কথা বললে একজনকেও এখান থেকে সুস্থ হাত পায়ে বাড়ি ফিরতে দেবো না।জবান চিরতরে বন্ধ করে দেব।”,রাগে গর্জন করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে শান।উপস্থিত সবাই একপ্রকার ক্ষিপ্ত হয় শানের প্রতি।

ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হয় না পাখির।হাত পা যেন কনকনে শীতের মতো কাপঁছে।অসাড় হয়ে পরছে পাখির শরীর।শান দ্রুত এগিয়ে এসে একহাতে পাখিকে জড়িয়ে বলে,”ও বউ হয় আমার।”
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায় শানের কথায়।ক্ষিপ্ত অনুভূতি এবার আশ্চর্যে পরিনত হয়।রাহেলাও অবাক হয়ে যায় শানের কথায়।

কান্নাটা যেন গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে পাখির।অবাক বিষ্ময়ে মাথা তুলে তাকায় শানের দিকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে শান পাখির দিকে চেয়ে বলে,”কান খুলে শুনে রাখো ও আমার বউ।হ্যা ঠিকই শুনছো সবাই।আমার বিয়ে করা বউ ও।দেশের পূর্ণ আইন মেনে বিয়ে হয়েছে আমাদের।”
মাঝখান থেকে কেউ একজন গলা উচিয়ে বলে, “তুমি বললে আর আমরা মানলাম তাই না,এতো বোকা ভাবো আমাদের”
“চাচি পাখিকে ধরো একটু “,দাঁতে দাঁত পিষে বলে শান।এরপর দৌঁড়ো উঠে যায় উপরে।কাগজ পাতির ভাঁজ থেকে যত্ন করে রাখা রেজিস্ট্রির কাগজ টা সাবধানে বের করে আনে শান।নিচে নেমে ছুড়ে মারে উপস্থিত লোকদের দিকে।আঙ্গুল উচিয়ে শান বলে,”আমি এখন এই মূহূর্তে আপনাদের নামে মানহানির মামলা করব চেয়ারম্যান চাচা।পারলে আটকায়েন”

কাগজে চোখ বুলিয়ে সবার মুখ চুপসে যায়।চেয়ারম্যানের কাছে কাগজ টা দেয়া হলে তিনিও চোখ বুলিয়ে নেন।ভেজা বিড়ালের মতো চুপসে গিয়ে বলেন, “দেখো বাবা আমাদের তো জানা কথা নয় তোমাদের মাঝে কি সম্পর্ক।আগে থেকে ব্যপারটা জানানো উচিত ছিলো।”
“আপনারা জানানোর সুযোগ দিয়েছেন আমায়?আগে বলেছেন সহ্য করেছি।আর না।আমার ওয়াইফকে যা নয় তাই বলেছেন।ঠিক করেছেন কি?”
“মাথা ঠান্ডা করো বাবা।যেহেতু সবটা মিটে গেলো তাই কেস ফেসে যাও না।তুমি ডাক্তার মানুষ। ফেসলস হয়ে গেলে ব্যপার টা কেমন না?আর আমারও সামনে ইলেকশন”

শান নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে, “এখন থেকে কারো ব্যপারে না জেনে কোন রকম মন্তব্য করবেন না।আর আপনারা।আপনারা মেয়ে হয়ে কী করে অপর একটা মেয়েকে এতোকিছু বলতে পারেন। বাঁধে না একটুও!”
“আমরা বুঝতে পারি নি বাবা”

এরপর আরো কিছু কথা শুনিয়ে দেয় শান।যে যার মতো চলে যায় বাড়ি থেকে।

🌸🌸
এতোক্ষন রাহেলার বুকে মুখ লুকিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে একদৃষ্টে চেয়েছিলো পাখি।সবাই চলে যাওয়ার সাথে সাথে পাখি এলোমেলো পায়ে অনুভূতিহীন মনে দ্রুত চলে যায় নিজের ঘরে।ইনায়াহ্ ভয়ার্ত চোখে পাখিকে অনুসরন করে চলে যায় ওর সাথে।ইনায়াহ্’কে ঘরে টেনে নিয়ে দরজা লক করে দেয় পাখি।বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে ।ইনায়াহ্ও কান্নারত অবস্থায় পাখির মাথা বুলাতেই পাখি মাথা তুলো ইনায়াহ্’কে জড়িয়ে হুহুস্বরে কেঁদে ফেলে।যে কান্নার শব্দ নিচ থেকে রাহেলার অন্তরকে নাড়িয়ে দেয়।নিজেকে অপরাধী মনে হয় রাহেলার।শান হতভম্ব বনে যায় ঘটনার আকষ্মিকতায়।পাখির কান্নার করূনস্বর টা এবার আর শানকে নিজের মাঝে থাকতে দেয় না।

রাহেলা ক্রুর চোখে শানের দিকে চেয়ে বলে,”বিয়ে করেছো অথচ মেয়েটাকে কতো নিচে নামিয়েছো। ছিহ শানবাবা।এতোটা নিচ তুমি ভাবতেও পারছি না।আর আমিও না জেনে মেয়েটাকে কতো কথাই না বলে ফেললাম”,
আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে রাহেলা।শান সেদিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে যায় উপরে।পাখির দরজায় কড়া নাড়ে শান।শান্তস্বরে বলে, “পাখি, দরজাটা খোল”
শানের কথায় কান্না থেমে যায় পাখির।রাগে ফোঁস ফোঁস করে চিল্লিয়ে বলে,”আর কি বাকি আছে?আর কতো অপমান বাকি আছে?শেষ পর্যন্ত পতিতা,বে*……!”
শান বুঝতে পেরেছে পরিস্থিতি কতোটা ঘোলা হয়ে গেছে।উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

ইনায়াহ্’কে খাইয়ে ঘুমিয় দেয় পাখি
🌸🌸

রাত গভীর হলে শান নিজের ঘর থেকে বের হয়।আজ কিছুতেই দুচোখে ঘুম আসছে না তার।প্রতিদিনকার ন্যায় আজও পাখির ঘরে ঢোকে শান।
নির্ঘুম চোখে পাখি ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।দরজা খোলার শব্দে ফট করে চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমের ভান করে।চোখ পিটপিটিয়ে বোঝার চেষ্টা করে শান কী করে।

এদিকে শান আজ আর ভয়ে ভয়ে না বেশ সাবলিল ভাবে পাখির দিকে এগিয়ে যায়।মাথার কাছে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরে মেঝেতে।স্বাভাবিকভাবেই পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় শান।সবটাই পরোখ করে পাখি।ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় তা আর চোখে পড়ে না শানের।এরপর চোখের কোণা দুটো মুছে পাখির কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দেয়।এবার আর চোখ আধখোলা রাখতে পারে না পাখি।অজানা ভালো লাগায় চোখ বুজে নেয় সে।
শান মাথা তুলে বলে,”আই’ম সরি জান।আমার জন্যে তোমায় কতোটা বদনাম সহ্য করতে হচ্ছে!আমার কী’ই বা করার আছে বলো তো। আমি কী করে আমার ঘৃন্য অতীতের সাথে তোমায় জড়াবো। কী করেই বা অক্ষম ভবিষ্যতের মায়ায় তোমায় মেশাব?তাই তো তোমার থেকে দূরে দূরে থাকি।আর তুমি উঠে পরে লেগেছ আমাদের সম্পর্কটা ঠিক করতে।আর তোমার এই পাগলামি দূর করতেই সে রাতে তোমার ড্রাংক হওয়ার সুযোগে একটা মিথ্যে বাহানা তৈরী করেছি।আর যেটা কাজেও দিয়েছে।ভালো তুমি একা না আমিও বাসতে পারি জানপাখি”

শান উঠে আবারও পাখির কপালে চুমু দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,”আই লাভ ইউ ”
ফট করে চোখ খোলে পাখি।দুহাতে চেপে ধরে মাথায় রাখা শানের হাতটা।অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, “এভাবে রাতের আঁধারে কারা সত্যি কথা বলে জানেন? যারা অপরাধী;আলোতে যাদের ভয়।আপনি কোন অপরাধে অপরাধী আজ আমি জানতে চাই।আপনাকে আজ বলতেই হবে সবটা।না হলে ফল এতোটা খারাপ হবে যে সারাজীবন পস্তাবেন।বলুন কেন এতো লুকোচুরি? কেন এতো ভালোবেসে আমায় দূরে সরানো?কেন রাতের আঁধারে আমার কাছে আসা?আর সে রাতে আপনার সাথে করা সমস্ত ঘটনা আজ আমি জানতে চাই।আমার এতো কেন’র উত্তর না নিয়ে আমি ছাড়ছি আপনাকে”
#আসক্তি২
পর্বঃ২৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

ভালোবাসা গোপন রাখার জিনিস নয়
ঠিকই সেটা নির্দিষ্ট মানুষের সামনেই প্রকাশ পায়, নির্দিষ্ট সময় পরে।নিজেকে যতো কঠিন করেই উপস্থাপন করা হোক না কেন ভালোবাসা তো ভালোবাসাই।একদিন ঠিকই নিজের রূপে ফিরে আসে।
পাখির দুইহাতে চেপে ধরা নিজের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করেই চলেছে শান।ফলাফল! শূন্য।কপোট রাগ দেখিয়েও কোন কাজ হয় না শানের।পাখি হাত চেপে রেখে কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শানের দিকে।দুহাত চেপে রেখেই খুব সাবধানে বিছানা ছাড়ে পাখি।হাতে ঢিলে পাওয়ায় শান চলে যেতেই দুই হাত দুইদিকে সোজা করে পাখি সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“আজ যদি সবটা না জানতে পারছি, তো আমার নামও পাখি না।দরকার পরলে নিজেকে শেষ করে দিবো;বলে রাখলাম”,বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে পাখি।শান পাখির দিকে এগিয়ে চুলগুলো ডান হাতে কানের পিঠে গুঁজে মুচকি হেসে বলে,”নেক্সট টাইম এই শব্দগুলো বলো না কেমন!”,
চুপসে যায় পাখি।কারণ হাস্যোজ্বল আর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেও কথাটার ঘনত্ব বেশ গাঢ় ছিলো।শুকনো দুটো ঢোক গিলে বলে,”তাতে আপনার কি?”
শান কোন কথা না বলে ডান হাত বাড়িয়ে পাখির বাম হাতটা টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে বলে,”যখন জানতেই পারছো আমি ভালোবাসি তোমায় তখন এভাব পরীক্ষা নিও না। হুমম?আর আমার ভালোবাসার গভীরত্ব মাপতে এসো না তলিয়ে যাবে”
শানের বুকে মুখ গুঁজেই পাখি অস্ফুটস্বরে বলে,”আমি সবটা জানতে চাই।”

পাখির কথার কোন প্রতিউত্তর না করে হাত টেনে নিয়ে যায় ঘরের বাহিরে।
“কোথায় নিচ্ছেন আমায়”,হকচকিয়ে বলে পাখি।
ঠোঁটে সামান্য হাসি এলিয়ে শান জবাব দেয়,”ভয় হচ্ছে?”
যে হাসি পাখির দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়।শানের জবাবে নিজের সব বুলি যেন ফুরিয়ে যায়।হেঁটে চলে যায় সামনে তার ভালোবাসার মানুষটিকে অনুসরন করে।

ছাদের একদম মাঝ বরাবর এনে দাঁড় করায় পাখিকে।চারিদিকে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে পাখি।কতো শত দালান মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে নির্দ্বিধায়। কোথাও ক্ষীন আলো জ্বলছে, কোথাও নিশুতি।পাখির শানের দিকে তাকিয়ে দেখে দূর আকাশের জ্বলজ্বল করা তারাটার দিকে তাকিয়ে আছে।হাতদুটো বিজ্ঞের মতো পিছনে একটার সাথে আরেকটা আটকানো।খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে তারাটা।

পাখি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেসা করে, “কি হলো এখানে কেন আনলেন?”
কোন জবাব দেয় না শান।ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।পরিবর্তন শুধু এটুকুই হয়, দৃষ্টিটা তারা থেকে সরিয়ে সামনে ফাঁকা যায়গায় নিবদ্ধ হয়।শানের বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটা ডোবা মতোন কিছু হবে।তার ওপাড়ে আবারও বড় বড় দালানের সাড়ি।সেদিকেই অপলক চোখে চেয়ে আছে শান।পাখি আরেকটু কাছে এসে বলে,”বলবেন?”
“সে রাতে তুমি জোড় করে আমার ঘরে ঢুকেছো।আমার সাথে আমার বিছনায় থাকতে চেয়েছ”,পাখিকে অবাক করে দিয়ে বলতে শুরু করে শান।কিন্তু শানের একেকটা কথা ভীষণ লজ্জাজনক লাগছে পাখির কাছে।লজ্জার কাঁটা গুলো শরীরে ফুটছে এদিক সেদিক।অবনত মস্তিস্কে পাখি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।

শান পিছন ফিরে আবার বলে,”মজার ব্যপার কি জানো, আমায় জোড় করে কিসও করেছিলে তুমিই।”
ফট করে চোখ দুটো বুজে নেয় পাখি।এ লজ্জার থেকে কথা না শোনাই ভালো ছিলো।হরবরিয়ে বলে,”আমার আর শুনতে হবে না।আপনি নিজের কথা বলুন”
মুচকি হেসে শান বলে,”শুনতে যখন চেয়েছো তখন তো আমি আর ছাড়ছি না পাখি”
শান আবার বলতে শুরু করে,”তোমার অবস্থা এতোটাই বেগতিক হয়েছিলো যে আমার নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়েছিলো।খুব সাবধানে কৌশলে আমার গলায় সাপের মতো পেঁচিয়ে রাখা তোমার হাত দুটো সরিয়ে দিয়ে উঠি।তখন তুমি প্রকৃত নেশাখোরদের মতো কান্ড শুরু করলে।কি করব বুঝতে পারছিলাম না।দ্রুত নিচে চলে গেলাম ফ্রিজ থেকে লেবু কেটে একগ্লাস পানি সমেত তোমার সামনে রাখলাম।তুমি সেটা স্বাবাবিকভাবে খাওয়ার মতো কোন অবস্থায় ছিলে না।বাধ্য হয়ে আমিই খাইয়ে দেই তোমায় আর তুমি রাগে পানিটা না খেয়ে কামড় বসিয়ে দাও আমার গলায়।পাখি তোমার সেদিন এতোটাই খারাপ আর শোচনীয় অবস্থা ছিলো, চাইলেই তোমার সবটা তোমার অবচেতনায় নিয়ে নিতে পারতাম।গলায় করা তোমার স্পর্শ গুলো অন্য এক নেশার জন্ম দিচ্ছিলো আমার মাঝে”

এবার পাখি আর ঠিক থাকতে পারে না। দুহাতে কান চেপে অনুরোধ করে, “আমি আর শুনতে চাই না প্লিজ।এসব!আমি?ছিহহ”
ছিহ ছিৎকারে বিড়বিড় করে পাখি।শান হেসে দিয়ে বলে,”এতো লজ্জা পেতে হবে না।বাকিটা শুনো তারপর না হয় নিজেকে গালি দিও”
শান উল্টোদিকে ফিরে বলে,”তোমার নেশা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এক প্রকার জোড় করেই লেবু পানিটা খাওয়াতে হয়।আর তারপর বিঁধিবাম!
কিছুক্ষন পর গলগল করে বমি করে দিলে আমার গায়ের উপর।যার কিছুটা তোমার শরীরেও লেগেছিলো।মাথা পুরো হ্যাং হয়ে গেলো আমার, এতোসব সামলাবো কি করে!দরজা খুলে চাচিকে ডাকতে যাব তখন রাখি আসে।তোমায় নাকি শ’খানিক কল দিয়েছিলো তুমি ধরো নাই।পরে বাধ্য হয়ে বাসা থেকে আবার ব্যাক করে।অবশ্য আমার জন্যে উপকারই হয়েছিলো।ওকে টেনে নিয়ে আসলাম আমার ঘরে।রাগ দেখিয়ে বলেছিলাম ‘দেখো তো এসব কি?’রাখি আমার কথার মানে বুঝতে পেরেছিলো।অপরাধিনীর মতো মাথা নিচু করে ছিলো।আমিও তেমন কিছু বললাম না।পরে ওর সহযোগীতায় তোমার ড্রেস চেঞ্জ করানো হয়।”

এতোক্ষনে লজ্জা ভুলে যায় পাখি।মাথা তুলে তাকিয়ে বলে,”তখন কোথায় ছিলেন আপনি?”
“বাহিরে”,এক শব্দে জবাব দেয় শান।
“তোমার ড্রেস খুঁজতে যেতে অনেকটা সময়ের দরকার ছিলো কিন্তু তুমি তো শরীরে একটা ড্রেসও রাখতে চাচ্ছিলে না।অগত্যা আমার একটা শার্ট বের করে রাখিকে দেই যাতে কোণমতে সেটা তোমার গায়ে জড়ায়।রাখি তোমায় একদম চেঞ্জ করে দিয়ে বাড়ি চলে যায়।আর তুমি বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলে।আমি পাতলা ব্ল্যাঙ্কেট টা তোমার কোমড় অবধি জড়িয়ে আমি পাশের ঘরে চলে আসি ঘুমানোর জন্যে।কিছুক্ষন পর হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় কারো গোঙ্গানিতে।দ্রুত উঠে এসে দেখি তুমি গোঙ্গাচ্ছো।গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোমার।দ্রুত মোটা ব্ল্যাঙ্কেট বের করে গায়ে জড়িয়ে দেই।মাথায় পানি ঢালি পর পর কয়েক বালতি।এসব করতে করতে রাতের শেষাংশ শুরু হয়। তখন তোমার জ্বরটাও কিছুটা কমে আসে।সামনের সোফায় বসে তোমার জাগনা হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম।আর মনে মনে একটা ডিসিশন নিলাম তোমাকে একটা আতঙ্কিত সকাল উপহার দিবো।যেটা তোমার পাগলামি গুলো বন্ধ করবে চিরতরে আর সেই ভাবনা থেকেই তোমায় মিথ্যে বলা। এটা বোঝানো যে আমাদের মাঝে সবটা হয়ে গেছে।বাট অনেস্টলি, তোমার ঐ চুমু আর লাভ বাইট ছাড়া কিছুই হয় নি”,
শেষের কথাটা বেশ রসিকতার স্বরে বলে শান।

শানের প্রতি যেন ভালোবাসাটা আরো দ্বিগুন বেড়ে যায় এই ফাঁকা অম্বরের শামিয়ানার নিচে।অজানা ভালো লাগায় ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসে ফুটে ওঠে পাখির।

“নিজের ভালো লাগার কাছে প্রশ্নগুলোকে তো দাফন করলে চলবে না! আজ তো আমায় জানতেই হবে সবটা”,ভাবতেই পাখির হাসিটা মিলিয়ে যায় ঠোঁট থেকে।এরপর ঝনঝনে গলায় বলে,”সেসব না হয় বুঝলাম কিন্তু আপনার জীবনে এমন কি আছে যার জন্যে আমায় দূরে রাখছেন!এটা আমার জানতেই হবে।”
“জানতেই হবে?”,হেসে বলে শান।
“হ্যা হ্যা জানতেই হবে।”,একরোখা জবাব দিয়ে বুকের কাছে দুহাত গুঁজে পাখি শানের জবাবের প্রত্যাশা করে

“আমার জীবনে সব থেকে ভালোবাসার মানুষ ছিলো আমার জন্মদাত্রী ;আমার মা।মাকে ছাড়া একটা পা চলার সামর্থ্য আমার ছিলো না।তবে আমি বাবাকেও প্রচন্ড ভালোবাসতাম।এতো ভালোবাসার সেই মা যদি ১৬ বছর বয়সি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে ও সাত বছর বয়সি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকে রেখে নিজের সুখের আশায় পুরোনো প্রেমিকের হাত ধরে পাড়ি জমাতে পারে বিদেশের মাটিতে, সে মা’কে আর যাই হোক কখনো ক্ষমা করা যায় না পাখি।

পুরো নারী জাতটার প্রতিচ্ছবি ছিলো আমার মা।আর তাকে ঘৃনা করা মানেই সমস্ত নারীর প্রতি বিশ্বাস, ভরসা,ভালোবাসা,সম্মান সবটাই উঠে যাওয়া।”,এটুকু বলেই থেমে যায় শান।গলাটা যেন কাঁপছে তার।সাথে সারা শরীর।অবাক হয়ে যায় পাখি। এসে শানের বাম বাহুতে হাত রাখে।নজর এদিক সেদিক করে শান জবাব দেয়,”আই’ম ওকে”

এরপর শান বলতে থাকে,”আমার বয়স যখন ষোল, তখন মা চলে যায়।আমার তখন মাধ্যমিক এক্সামের ফর্ম ফিলআপ হয়ে গেছে।বাবা নাকি অনেক কেঁদেছিলো মা কোন কথা শোনে নি।নিজের সুখের আশায় চলে গেছিলো।তখন আমাদের অবস্থা হয়ত এতোটা স্বচ্ছল ছিলো না তবে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আমরা ছিলাম।তখন থেকেই রাহেলা চাচি আমাদের বাড়িতে আমাদের দেখাশোনা করত।ঠিক কাজের লোক নয় কিন্তু পরিবারেরই একজন ছিলো।আর আব্দুল্লাহ্ চাচা বাবার ব্যবসায় দেখাশোনা করত। সংসারে টাকার সংকট কখনোই ছিলো না। বাবা যথা সাধ্য চেষ্টা করত আমাদের ভালো রাখতে।কিন্তু মা’র লোভী মন ভরাতে আমার অসহায় বাবার সামর্থ্য ছিলো না।

একদিন দুপুর বেলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বাবা কাঁদছে। পাশে সাত বছরের ছোট বোন টিনাও বসে কাঁদছে মায়ের ছবি বুকে জড়িয়ে।আমি অজানা ভয়ের আশঙ্কায় এগিয়ে যেতেই বাবা আমায় জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।
‘তোর মা নাই রে বাবা,আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।আমায় শর্মিলাকে এনে দে শান।তোর মাকে এনে দে’বলেই হুহু স্বরে কেঁদেছিলো বাবা।কতোটা ভালোবাসলে পালিয়ে যাওয়া বউয়ের জন্যে এভাবে কাঁদতে পারে কেউ আমার জানা ছিলো না।আমিও পাথর বনে গেলাম। কতোটুকুই বা বয়স তখন।ধরে নিলাম মা আমাদের ছেড়ে পরজগৎে পাড়ি জমিয়েছে।কিছুক্ষন পরে জানতে পারি মা পালিয়েছে।লজ্জায় ঘৃনায় মরে যেতে ইচ্ছে করেছিলো।একে একে চারিদিকে ছড়িয়ে গেলো কথাটা।গ্রামে থাকাটা দূর্ভিষহ হয়ে উঠলো।বিষিয়ে উঠল চারিপাশ।স্কুলে যেতে পারতাম না সবাই খিল্লি করত।লজ্জায় কয়েকবার সুইসাইডের চেষ্টাও করেছি।কিন্তু বাবা আর টিনার কথা ভেবে কিছুই করতে পারি নি আমি।আর কিছু দিন পর মাধ্যমিক পরীক্ষা। অথচ মাথায় তখন সারাদিন মায়ের স্মৃতি মনে উঠত।পড়া মাথায় রাখতে পারলাম না।ছোটবোন টা মায়ের কষ্টে শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেলো।ছোট কাকা আমেরিকা থাকত পুরো পরিবার সহ।তিনি এসে টিনাকে নিয়ে যায়

বাবাও মায়ের শোকে নেশা করে রাত বিরেতে বাড়ি ফিরত।খুব কষ্টে পরিক্ষা দিলাম।রেজাল্ট খুব একটা খারাপ হয় নি।অথচ আমি জিপিএ ৫ এর স্টুডেন্ট।পুরো গোছানো জীবনটাই মায়ের একটা সিদ্ধান্তে এলোমেলো হয়ে যায়।আস্তে আস্তে ঘৃনা জন্মালো শর্মিলা নামের ঐ মহিলার উপর।সাথে পুরো নারী সমাজের উপর।এরপর গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম ঢাকার এই অজানা শহরে।যেখানে কেউ কাউকে চেনে না, জানে না।খুব আনন্দ না হলেও মায়ের জন্যে হওয়া বদনাম গুলো থেকে বেঁচে গেলাম।

আমাদের সাথে আব্দুল্লাহ্ চাচাও তার পরিবার সহ চলে এলো ঢাকায়।অজানা কোন এক কারণে রাহেলা চাচি আমায় ছাড়লেন না।অনেক বার বলেছিলাম আমি একা থাকতে পারব, উনি কথা শুনে নি।
ঢাকায় এসে বাবার ব্যবসার সাথে যুক্ত হলাম।স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়ার; বাবারও তাই।পড়াশুনার প্রতি তখন কোন ইচ্ছেই ছিলো না।তবুও রিস্ক নিলাম।খুব কষ্টে উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার প্রস্তুতি নিলাম।পড়াশুনায় মন দিলাম।ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় স্যারদের নজরে এসে গেলাম তাড়াতাড়ি।গ্রামের ছোট ব্যবসাটা এখানে বেশ পাকাপোক্ত ভাবেই দাঁড় করালো বাবা।তারপর আর আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি একে একে বাড়ি হলো,গাড়ি হলো অথচ তবুও বাবা কোথাও না কোথাও মায়ের শোক কাটিয়ে উঠত পারত না।মাসের বেশীরভাগ সময় ব্যবসায়ের কাজে শহরের বাহিরে থাকতে বাবা। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট অনেক ভালো হয়।তখন ভীষণ খুশি হয় বাবা।ভর্তি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে ভর্তি হলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে ।শুরু হলো আমার স্বপ্নের পথে এক পা বাড়ানো।”

আর রাহেলা চাচি দেখাশোনা করলেন আমার।আব্দুল্লাহ্ চাচাকে বাড়ির কেয়ার টেকার হিসেবে রাখলেন বাবা।রাহেলা চাচির সাথে মায়ের বরাবরই যোগাযোগ হতো বাবার অগোচরেই।যেটা আমি বুঝতে পারতাম কিন্তু কখনো বাবাকে বলি নি।ঢামেকে ভর্তি হওয়ার পর মা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিলো আমার সাথে যোগাযোগ করার। আমি করি নি। ভালো যে একেবারে বাসি না তা নয়।তবে ভালোবাসাটা ঘৃনার কাছে বড্ডো তুচ্ছ। তুমিই বলো, যে মা’র কারণে আমার ফেরেসতার মতো বাবাকে দিনের পর দিন কষ্ট করতে দেখেছি।নেশা করে পরে থাকতে দেখেছি,যে মায়ের কারনে এতো বদনাম এতো লাঞ্ছনা সহ্য করেছি সে মা কে কী করে মেনে নিই!আমার বাবা ঐ মহিলাকে অনেক ভালোবাসতো।মজার ব্যপার কি জানো পাখি?

“কী?”
“তোমার ঠোঁটের নিচে যেখানে একটা কালো তিল ঠিক সেইম জায়গায় মায়েরও একটা বড় তিল ছিলো।যেটা মায়ের সৌন্দর্য অনেক গুন বাড়িয়ে তুলত।আর আমার সবথেকে পছন্দ ছিলো মায়ের ঐ তিলটা।”

শান কিছুক্ষন থেমে বলে,”বলো এবার।কোন মেয়েকে আদৌ বিশ্বাস করা সম্ভব?যেখানে নিজের মা সন্তানের বিশ্বাস ভেঙ্গে দেয়!জানো আমার বাবা কতো কষ্ট করে দিন কাটাতেন!মা কে প্রচন্ড মিস করতেন।

“কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব”,ছলছলে চোখে প্রশ্ন করে পাখি।
শান পাখির দিকে চেয়ে বলে,”করো”
“ইনায়াহ্’কে নিতে যে ভদ্র মহিলা এসেছিলেন তিনিই কি……..”,পাখির আধা কথায় শান ঘুরে তাকায় পাখির দিকে।কথা থেমে যায় পাখির।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান জবাব দেয়,”হ্যা,তিনিই সেই”

পাখি কিছুক্ষন সময়ের জন্যে কিছু একটা ভেবে বলে,”রাগ করবেন না একটা কথা বলি।তাকে দেখে আমার একটুও মনে হয় নি তিনি এরকম কোন কাজ করতে পারেন।বেশ ভদ্র, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর ভাবগাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ মনে হয়েছিলো।”
“হাহাহা…বাহির দেখেই যদি সবটা বোঝা যেত তবে মুখোস বলতে কোন কথা থাকত না পাখি”,কটাক্ষ করে হেসে বলে শান।

“এটা না হয় মেয়েদেরকে ঘৃনা করার প্রথম কারণ, দ্বিতীয় কারণ কি?”,থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here