আসক্তি ২ পর্ব ২৭+২৮+২৯

#আসক্তি২
পর্বঃ২৭
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

পাখির করা দ্বিতীয় প্রশ্নে দুনিয়া থেমে যায় শানের।নজর সরিয়ে বলে,”এটা না জানলেও চলবে”
হনহন করে চলে আসতেই পাখি ছাদের দরজার কাছে চলে এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।রাগত স্বরে বলে,”এটা জানা আরো বেশী জরুরী আমার”

শান বুঝতে পারে পাখি সবটা জেনে তবেই ক্ষান্ত হবে।ঠোঁট দুটো গোল করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তুমি খুব জেদি পাখি”
“তাই যদি হয়, তবে তাইই।এবার বলুন”,শানের চোখে চোখ রেখে বলে পাখি।

“ঢামেকে ভর্তি হওয়ার পর বেশ ভালোই চলছিলো সবকিছু।মেয়ে বন্ধুদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম।কেমন যেন ওদের দিকে তাকালেই ঘৃনা চলে আসত আপনাআপনি।শুধু পড়তাম আর পড়তাম।ভালো রেজাল্ট করাই ছিলো আমার মূল উদ্দেশ্য।দেখতে দেখতে কেটে যায় তিনটা বছর।তিন ইয়ারেই কলেজ টপার।বেশ নাম ছড়িয়ে পরল চারদিকে।ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় জুনিয়র অনেকেই শর্ট নোট চাইত।ঐ যে বললাম বরাবরই মেয়েদের এড়িয়ে চলতাম।তাই মেয়েদের নোট গুলো অন্য ফ্রেন্ডদের দিয়ে পাঠাতাম।এভাবেই নোটের বদৌলতে পরিচয় হয় নীরা নামোক এক জুনিয়রের সাথে।ও তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ত।ছোট ছোট বিভিন্ন নোটসের জন্যে আমার কাছে আসত।আমি এড়িয়ে চলতাম।খোঁজ নিয়ে জানতে পারি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কোন কলেজ থেকে পাশ করে মেধার জোড়ে আর লোকের সহযোগীতায় ঢামেকে চাঞ্ছ পায়।এ ও জানতে পারি মেয়েটা অনেক বেশি অসহায় আর গরীব।সব শোনার পর ওর প্রতি কেমন যেন মায়া হলো খুব।ওকে বিনামূল্য এক ঘন্টা করে পড়ানো শুরু করলাম ;কলেজ শেষে।

এভাবে চলে গেলো ছয়টা মাস। বুঝতে পারলাম পড়ার থেকে ওর আমার প্রতি মনোযোগ অনেক বেশি।তাই পড়ানো বন্ধ করলাম।তবে ওকে সুযোগ দিলাম অন্য টিচারের কাছে পড়ো। বেতন আমি দিবো।ও সেদিন অনেক কান্নাকাটি করে বলেছিল ‘শান ভাই আমি আপনাকে ভালোবাসি’
থমকে গেছিলাম সেদিন।রাগে ওর গালে চর বসিয়েছিলাম।সেদিনের পর জানতে পারি নীরা গ্রামে চলে গেছে।মেস ভাড়া পুষিয়ে দিয়ে;ব্যাগপত্র সমেত।বুঝতে পারলাম সেদিনের ঘটনাটা একটু বেশি হয়ে গেছে।নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হলো।আমার জন্যে মেধাবী একটা মেয়ে পড়াশুনা বন্ধ করবে!
ওর নম্বরে ফোন করলাম।ফোন বন্ধ ছিলো। ঠিকানা নিয়ে গ্রামে গেলাম।এতো গরীব অবস্থা ওর যে, মাথা তুলে ঘরে ঢোকার সামর্থ্য ছিলো না আমার।মাথা গিয়ে ঠেকত মরিচা ধরা ভাঙ্গা টিনের উপর।গিয়ে জানতে পারি ওর পরিবার আর পড়াতে পারবেন না।বিয়ে দিবেন ওর।বেশ অবাক হয়েছিলাম।পরে নিজ দায়িত্বে ওকে আবার নিয়ে আসি।ততোদিনেও ওর প্রতি আমার কোন ফিলিংস ছিলো না।

কলেজ হোস্টেলে সিট নিয়ে দেই।পড়াশুনা বাবদ সমস্ত খরচ আমি চালাতাম।এভাবে সব মিলিয়ে কেটে গেলে বাকি ছয় মাস।এর মাঝে ও কোনদিনও আর ভালোবাসার কথা জাহির করে নি।কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম দিনে দিনে কতোটা এডিক্টেড হয়ে যাচ্ছিলাম ওর প্রতি।নতুন করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো নীরাকে।আমার চতুর্থ বর্ষের প্রথম এক্সামের শেষে আমি ওকে প্রোপোজ করি।ও কোন কথা ছাড়াই কেঁদে ফেলেছিলো।কান্না টার মাঝে কোন ছলনা ছিলো না।খুব গভীর আর পিওর লাভ ফিলিংস খুঁজে পেয়েছিলাম।এরপর আস্তে আস্তে সমস্ত পরীক্ষা দিলাম।রেজাল্টও পেলাম চতুর্থ বর্ষের।এবার আর টপার হতে পারলাম না।কারণ আমার নিজের পড়াশুনার থেকে ওর পড়াশুনার প্রতি আমার কেয়ার ছিলো অনেক বেশি।নীরা ওর ব্যচে অনেক ভালো রেজাল্ট করল।রেজাল্টের দিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিলো আমায়।রেজাল্ট শীট হাতে বলেছিল’সব তোমার জন্যে শান’
আমার টপার থেকে তৃতীয় স্থানে আসা রেজাল্ট ওকে জানিয়ে ওর খুশির মূহূর্তটা নষ্ট করতে চাই নি।ওর খুশিতে খুশি হয়েছিলাম।”

“আর শুনব না আমি”,কাটকাট গলায় বলে পাখি।শান নিজের হাসিটাকে দাবিয়ে রেখে বলে,”শুনতে হবে তো।তুমি তো শোনার জন্যে ব্যস্ত।”পাখির হাতটা চেপে ধরে বলে শান।

শান আবার বলতে শুরু করে, “নীরা আর আমার সম্পর্কটা অনেক বেশিই ভালো চলছিলো।লং ড্রাইভে যাওয়া, স্ট্রিট ফুডে দশ পাঁচ টাকা খরচ করা এসবই ছিলো আমাদের প্ল্যানিং।আস্তে আস্তে আমার পঞ্চম বর্ষের দিন ঘনিয়ে আসছিলো।আর কেমন যেন অজানা ভয় মনে জেঁকে বসল।কলেজ ছেড়ে যেতে হবে ইন্টার্ণির জন্যে।নীরাকে ছেড়ে থাকতে হবে।এসব ভয় পেতাম খুব।কিন্তু দিনে দিনে নীরার আচরনে অনেক পরিবর্তন চলে আসে।তার আর স্ট্রিটের দশ পাঁচ টাকার ফুডে পোষায় না,লং ড্রাইভে বাইকে না ;কারে যেতে চায়।আমি অবশ্য ব্যপার গুলো তেমন আমলে নিতাম না।কারণ ওকে ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়ানো,কারে লং ড্রাইভ যাওয়া,দামি দামি পোশাক, কসমেটিক্স দেয়া আমার কাছে কোন ব্যপারই ছিলো না।তো বাবাকে বলে নতুন একটা গাড়ি নিলাম।বাবা আমার কোন চাওয়াই অপূর্ণ রাখত না।কথামতো বাজারের নতুন মডেলের কার কিনে দিলো।মন্দ না সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো।চোখের পলকে আমার ফাইনাল এক্সাম এসে এলো।আর নীরার দ্বিতীয় বর্ষ।পরীক্ষা দিলাম এবার আর রেজাল্টের হেরফের হলো না।অনেক ভালো ফলাফলে মেডিকেল ফাইনালে পাশ করলাম।সময় এবার কলেজ ছাড়ার,ইন্টার্ণি দিয়ে প্রোফেশনে ঢোকার।

মন না চাইলেো কলেজ ছাড়তে হলো।কলেজে থাকাকালীন নীরার সমস্ত আপডেট সংগ্রহের জন্যে ওরই ব্যচের দুজন ভালো ছেলেকে ঠিক করলাম।যাতে নীরার কোনরকম কোন অসুবিধা না হয়।এদিকে আমার ইন্টার্ণশিপ চলছিলো কোন বান্দরবানের কোন এক প্রত্যন্ত হাসপাতালে।দিনে দিনে বুঝতে পারি নীরার সাথে আমার অদৃশ্য এক দূরত্বের তৈরী হচ্ছে।আমার সারাদিনের ইন্টার্ণ শেষ করে ওকে একটু ফোন করলে বিজি দেখাত।নেটওয়ার্কের সমস্যায় পাহাড়ের চূড়ায় বসে ফোন দিতাম ওকে কিন্তু বিজি পেতাম।ঐ ছেলে দুটোর থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি নীরা কোন এক সিনিওরের সাথে ইদানিং বেশি মিশতেছে।ব্যপারটা আমার মোটেও ভালো লাগল না ইন্টার্ণ ছেড়ে আসতে মন চাইছিলো।বাধ্য হয়ে ওকে বিয়ের জন্যে বললাম।কিন্তু ও টোট্যালি নাকোচ করে বলল’শান আমি ডক্টর হতে চাই।আমার গরীব বাবা মায়ের মুখটা উজ্জ্বল করতে চাই।তুমি যেমন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছো আমিও তেমনটা চাই।তারপর না হয় বিয়ের ব্যপারে আগাব’

আমিও আর জোড় করি নি নীরাকে।কারণ ওকে ডাক্তার বানাব বলেই ওর বাড়ি থেকে রিস্ক নিয়ে এনেছিলাম।এভাবে দিন যতো যাচ্ছিলো নীরার আচরন ততোই বাড়ছিলো।দামি দামি জামা কাপড়ের কথা বলত আমায়।যখন বলতাম কে দিয়েছে?তখন বলত ওর নাকি কোন বান্ধবী অনেক বড়লোক সে দিয়েছে।ওর দামি জুতা,ব্যাগ,জামাকাপড় বা বিলাসবহুল জীবন যাপন আমায় ভাবনায় ফেলে।প্রশ্ন করেও মনযুৎ কোন জবাব পেতাম না।কেটে গেলো একটি বছর।আমি ইন্টার্ণশিপ শেষ করলাম;ভালো রেজাল্ট নিয়ে।ততোদিনে নীরা আর আগের নীরা নেই।কেমন যেন খাপছাড়া স্বভাবের হয়ে গেলো।তবে ডিরেক্ট বলতোও না যে ও ব্রেকআপ চায়।ডিপ্রেশনে আমি দিন কাটানো শুরু করলাম।নিজেকে ধাতস্ত করলাম পেশায় নিযুক্ত হওয়ার জন্যে।হয়েও গেলাম।তবুও ডিপ্রেশন কাটলো না।এদিকে নীরাকে অঢেল টাকা পয়সা ঢালতে শুরু করলাম।তবুও দিনশেষে নীরার মন পাওয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।

এর মাঝে ঘটল আরেক বিপত্তি।ছোট কাকার একটাই মাত্র ছেলে ছিলো, রনি। তাই টিনাকে নিজের সন্তানের থেকে কম কিছু দেখত না কাকি।বরং রনির থেকে অনেক আদর করত। আমরা ঢাকায় সেটেল হওয়ার পর অনেক ডেকেছিলাম কিন্তু টিনা আসে নি।কলেজে পড়াকালীন নাকি ডেভিড নামের খ্রিষ্টান ধর্মীয় আমেরিকান ছেলের সাথে প্রেম হয় টিনার।কোনভাবে ব্যপার টা কাকার কানে আসতেই কাকা এক কথায় নাকোচ করে দেয়।বাধ্য হয়ে টিনা আর ডেভিড গোপনে বিয়ে করে নেয়।কাকা আমাদের এসব কিছুই জানায় নি ;লজ্জায়।পরবর্তীতে টিনা যখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট তখন ব্যপারটা ডেভিডের পরিবারে জানালে তারা কোনভাবেই মানতে চায় না ।এরপর ডেভিড সহ টিনা আলাদা সংসার পাতে।টিনা যেদিন লেবার পেইনে হসপিটালে কাতরায় সেদিন ডেভিড ডিউটিরত ছিলো একটা ফুড ফ্যাক্টরিতে। আগুন লেগে দশজন ওয়ার্কার মারা যায়।তাদের মাঝে ডেভিডও ছিলো একজন।হাসপাতাল থেকে কাকাকে কল করা হলে কাকা গিয়ে টিনার অপারেশনের সমস্ত ব্যবস্থা করেন।কিছু ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনের জন্যেই সেই বাচ্চার এপিলেপসি রোগ হয়।ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম দেয় আমাদের টিনা।আর সেই সন্তান আর কেউই না।আমাদের ইনায়াহ্ পাখি”

বলেই থেমে যায় শান।পাখিকে প্রশ্ন করে,”ইনায়াহ্’কে কি আর পাঁচটা দেশীয় বাচ্চার মতো মনে হয়? “,
পাখি বিড়বিড় করে বলে,”প্রথম দিন তো বিদেশীর বাচ্চাই মনে হয়েছিলো”
শান মুচকি হেসে বলে,”হ্যা ”
“তারপর কি হলো?”
“তারপর আর কি।ব্যপার টা কাকা কোনভাবেই মানতে পারলেন না।বাধ্য হয়ে সমস্ত ঘটনা আমাদের খুলে বললেন।আর টিনাকে এককালীন দেশে আমাদের কাছে পাঠালেন সদ্য জন্মানো সন্তান সহ।বাবাও কোনভাবে ইনায়াহ’কে মানতে পারলেন না।বলতেন খ্রিষ্টানের বিদেশি বাচ্চার কোন ঠাঁই আমি দিবো না।অনেক করে আমি বাবাকে সবটা বোঝালে সব বুঝে বাবা টিনাকে বাড়িতে রাখে তবে টিনার সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না।এক বাড়িতে থেকেও দুজনার মাঝে দেয়াল উঠে যায়।যেটা আমি চাইলেও ভাঙ্গতে পারছিলাম না।টিনাকে দেখাশোনা করার জন্যে পার্মানেন্ট একজন লোক লাগত।কিন্তু সেরকম কাউকেই পেলাম না।অগত্যা শর্মিলা বেগম নিজের কাছে নিয়ে গেলেন টিনাকে।ওহহহ হ্যা, আরেকটা কথা বলা হয় নি। আমরা ঢাকায় শিফট হওয়ার কয়েকমাস পর শর্মিলা বেগম তার সো কল্ড হাজব্যান্ড সহ আমাদের পাশের এলাকায় চলে আসে।আর বাবার বেশিরভাগ সময় শহরের বাহিরে থাকার কারণ মূলত এটাই ছিলো।

ইনায়াহ্ যখন ছয় মাস বয়স তখন আমি একপ্রকার জোড় করে ওকে আমার কাছে আনি।টিনার কিছু শারীরিক প্রবলেম ছিলো যা দিনকে দিনকে বেড়েই চলছিলো।আমি রাহেলা চাচি সমেত ইনায়াহ্’র দেখাশোনা শুরু করি।মাঝে মাঝে ঐ বাড়িতেও গিয়ে থাকত টিনা।কিছুদিন পর বুঝতে পারি টিনা বাবাকে আর পছন্দ করছেন না।আমায় বার বার বলত আমি যেন মায়ের সাথে যোগাযোগ করি কিন্তু আমি করি নি।কারণ টিনা জানে না আমি জানি উনি কতোটা জঘন্য মানুষ। টিনার বাবাকে এতোটা ঘৃনা করার কারণ বুঝতে পারছিলাম না।বাবা বাধ্য হয়ে আলাদা বাড়ি কিনে নেয়।আর সেখানেই থাকতে শুরু করে;আমাদেরকে এ বাড়ি ছেড়ে দিয়ে।টিনাকে আমরা কেউ টু শব্দটি করতাম না কারণ, টিনার হার্টে জন্মগত সমস্যা ছিলো।

এতোসবের মাঝে আমি অনেক বেশিই ব্যস্ত হয়ে পরি। ফলে নীরার সাথে দৈনিক এক থেকে দুইবার কথা বলার সুযোগ হতো।তাতেও নীরার ইচ্ছে থাকত না কথা বলার।পড়াশুনার অযুহাতে আমায় এড়িয়ে চলত।এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সময়।আর দিনে দিনে টিনার শরীরের অবনতি হচ্ছিলো।এক পর্যায়ে ইনায়াহ্ যখন আঠার মাসের বাচ্চা তখন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ইনায়াহ্’কে এতিম করে চলে যায় টিনা।নিজেকে এতো বেশি একা মনে হলো বলার বাহিরে।নীরার হাতে পায়ে ধরে একটু সময় ভিক্ষে চাইতাম।কিন্তু নীরার অন্তর গলত না।

সেদিন রাহেলা চাচি ইনায়াহ্’কে ও বাড়ি নিয়ে যায়।আর আমিও সুযোগটাকে কাজে লাগালাম। সময় বের করে নীরাকে নিয়ে গেলাম লং ড্রাইভে ঢাকার অদূরে।শুধু এটা জানতে যে ও কি চায়!ও সোজাসুজি বলেছিলো ‘আমি তোমাকেই চাই শান।আর তো মাত্র একটা ইয়ার।তারপর ইন্টার্ণ। তারপর প্রোফেশন।আমি না হয় প্রোফেশনে ঢোকার আগেই বিয়েই টা সেড়ে ফেলব। হ্যাপি!’
সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলাম বলার মতো না।খুশিতে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে ফিরে আসছি বাড়ির পথে।হঠাৎ কিভাবে যেন গাড়ি ব্রেইক ফেইল করল।গাড়ির গতিবিধি বুঝে নীরার পাশের দরজাটা খুলে রাস্তার পাশে নিরাপদ জায়গায় ওকে ধাক্কা মেরে ফেলি।তৎক্ষনাৎ আমি আমার পাশের দরজা খুলে লাফ দেয়ার আগেই বড় একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়ি সমেত পরে গেলাম রাস্তার ভাঙ্গা খাঁদে।

ছোটখাটো না বেশ বড় এক্সিডেন্ট হয়।আর অপারেশনটাও বেশ ক্রিটিক্যাল হয়।জ্ঞান ফিরে বুঝতে পারি আমি হসপিটালের বেডে শোয়া।পাশেই বাবা, রাহেলা চাচি আর আব্দুল্লাহ্ চাচা ;কোলে ইনায়াহ্।চারপাশে তাকিয়ে বলেছিলাম ‘নীরা কোথায় বাবা?’
বাবা তখন সবে প্রথম আমার মুখে নীরার নাম শোনে।বেশ থমকে গিয়ে বলেছিল’একটা মেয়ে নাকি তোমায় হসপিটালে আনে আর তারপর আমাদের খবর দেয়া হয়।কিন্তু মেয়েটার আর কোন খোঁজ তো পাই নি আমি ‘
বেশ চিন্তায় পরে যাই।দ্রুত বাবার থেকে ফোন নিয়ে কল করি নীরার কাছে ;ফোন বন্ধ।হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা স্যারের কাছে ফোন করলে স্যার জানায় নীরা নাকি কালকে বন্ধুরা মিলে সাজেক ঘুরতে যায়।মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে আমার।আমায় এতো অসুস্থ্য রেখে নীরা কী করে সাজেকে যেতে পারল?আর এতো টাকাই বা কে দিলো?
এসব ভাবতে ভাবতে পুরো দিন চলে গেলো তবু নীরার কোন খোঁজ হলো না।

সাত দিন পর হসপিটাল থেকে রিলিজ হলে আমি বাড়ি চলে আসি।রাহেলা চাচি প্রত্যেকটা সময় আমার সাথে ছিলো।তার সহযোগীতায় সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হতে পুরো একটা মাস কেটে যায় আমার।আর এই এক মাসে অনেক কিছুই পাল্টে যায়।আমার অসুস্থ্যতার মাঝে নীরা আমায় দেখতে এসেছিলো বাড়িতে।সেদিন বাবা এ বাড়িতে ছিলো।ঐদিন প্রথম বাবার সাথে নীরার দেখা হয়।তারপর কারণে -অকারনে নীরা আমার বাড়ি আসত। আমি অবশ্য অবাক হতাম আবার পরোক্ষনে খুশি হতাম এটা ভেবে যে,নীরা আগের মতো ভালোবাসছে আমায়।সত্যি বলতে এর পিছনে যে নীরার ঘৃন্য একটা কামনা লুকিয়ে ছিলো তা আমার অজানা ছিলো।

সুস্থ হবার পর আমি আবারো হসপিটালে জয়েন করি।দিনগুলো মোটামোটি ভালোই চলছিলো।নীরার ব্যপারে সবটা জানাইলাম বাবাকে।বাবারও নীরাকে বেশ পছন্দ হলো।রইল বাকি বিয়ের কথা। সেটা নীরার ইন্টার্ণির পর ঠিক হলো।খুব খুশি আমি।একদিন চেম্বারে রোগী দেখছি বাবা আমায় কল করলেন।রিসিভ করতেই বাবার আহাজারি শুনতে পেলাম।বুকের ভিতর টা ধক করে উঠলো।কারণ প্রথম বার মা চলে যাবার পর এভাবে আহাজারি করেছিলো বাবা আর সেদিন দ্বিতীয় বার।ছুটে গেলাম বাবার নতুন বাড়িতে।সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই পুরো শরীরে ঝিমঝিম করা শুরু করল।বউয়ের সাজে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নীরা।নিজেকে সামান্য ধাতস্থ করে হাসি টেনর নীরাকে বললাম ‘বউ সেজেছ যে কারণ কি?’
নীরা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিয়েছিলো’বউ হয়েছি বলেই তো বউ সেজেছি’

ওর কথার আগামাথা কিছুই মথায় ঢুকছিলো না।পরে পাশে দাঁড়ানো বাবাকে বললাম ‘বাবা এসব কি?ও বউ সেজে এ বাড়িতে কেন’
পাশ থেকে নীরা জবাব দিলো ‘এতো ভণিতার কিছুই নেই শান। আমি আর নাটক করতে পারছি না।আমি আর তোমার বাবা আই মিন আহমেদ সদিচ্ছায় বিয়ে করেছি ‘

নীরার কথায় চোখের সামনে আমার অন্ধকার ভবিষ্যত ছাড়া কিছুই দেখছিলাম না।দ্বিতীয়বারের মতো কলিজা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো।কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এসব কিছু।বাবার সামনে গিয়ে বললাম ‘নীরা এসব কি বলছে বাবা?ও কি পাগল হয়েছে’
বাবা আমায় আশ্বস্ত করে বলেছিলো ‘তোমায় সবটা বলছি শান।একটু শান্ত হও’
আমাদের দুজনের কথার মাঝে নীরা বলে উঠল ‘এতো বলা বলির কি আছে?সন্তানপ্রদানে অক্ষম একজন মানুষের সাথে আমি কী করে সারাজীবন কাটাব?আর ওর আছেই বা কি? শুধু বাড়িটা দুটো গাড়ি আর আছে একটা চাকরি।এসবে কোনদিনও আমি সুখে থাকতে পারব না’

একই দিনে পরপর এতোগুলো শক্ড নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।শরীরটাও অনেক বেশি দূর্বল ছিলো।প্রেশার বেড়ে গেলো শরীরের বেশ বুঝতে পারলাম। চোখ দুটো বন্ধ হতেই আর কিছু মনে নেই।

চোখ খুলে তাকালাম যখন তখন বুঝে গেছি এটা হসপিটাল।অথচ আমার পাশে একটা জনপ্রাণীও নেই।নিজেকে এতো বেশি পরিমান একা লাগল।হুহুস্বরে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন।কিছুতেই মানতে পারছিলাম না নীরা এমন একটা কাজ করবে।তাও আমারই বাবার সাথে।ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই।তাই চুপ করে গেলাম।তবে মনকে কোনভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না।কিছুক্ষন পর বাবা এসে পাশে বসলেন।মুখ ফিরিয়ে নিলাম।আমার হাত টা দুহাতের মুঠোয় ভরে বললেন,’আমার কিছু করার ছিলো না বাবা।আমি তোমার বাবা হয়ে এতোবড় কাজটা করতে চাই নি।নীরা সকাল বেলা ফোন করে আমায় ডেকে নিলো।ওর নাকি কি দরকার আছে। পরে সেখানে আমায় আটকে হাত পা বেঁধে বিয়েতে বাধ্য করে।নইলে নাকি রেপ কেসে আমায় ফাঁসাবে।আর তোমাকেও মেরে ফেলবে।তোমার কথা বলাতে আমি আর না করতে পারি নি। বাধ্য হয়েই নীরাকে বিয়ে করি। আমার কোন দোষ নেই বাবা।বিশ্বাস করো।’

বলেই বাবা নিজের কান্না সংবরন করলেন।আমি জানি আমার বাবা কখনোই আমার সাথে ইচ্ছা করে এমন ঘৃন্য কাজ করবেন না।নীরা যে অর্থ সম্পদের লোভে এমন কাজ বাবাকে দিয়ে করিয়েছিলো তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো আমার মন।স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে বললাম ‘আমার অপারেশনের ডিটেইলস বলো’

তখন বাবার জবাবে জীবনে বেঁচে থাকার আর কোন আশাই খুঁজে পেলাম না।কার এক্সিডেন্টের অপারেশনের সাথে সাথে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলি বাবা হওয়ার সক্ষমতা। যেটাকে বলা হয় ইমিউনোলজিক ইনফার্টিলিটি।

রাতে বাড়ি ফিরলাম নেশাগ্রস্ত হয়ে।সিদ্ধান্ত ফাইনাল করলাম পৃথিবী ছাড়ব।কারণ নীরার দেয়া আঘাতটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।টলমলে পায়ে সিঁড়িতে পা রাখতে ইনায়াহ্ দৌঁড়ে এসে পা জড়িয়ে নেয়।মাথা তুলে কোলে নিতে ইশারা করে।মাথা নিচু কর ওকে কোলে তুলে নিতেই ইনায়াহ্ গলা জড়িয়ে নেয়।চোখ বন্ধ করে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে নিলাম।এবারও আমার সুইসাইড করা হলো না।তবে নিজেকে পুরোদমেই পরিবর্তন করলাম।ঠিক এমন ভাবে, যাতে কেউই আর ভাঙ্গতে না পারে।মেয়েদের উপর থেকে পুরোটাই বিশ্বাস নষ্ট হলো আমার।

এবারো মজার ব্যপার কি জানো পাখি?”,প্রশ্ন করে শান।

শানের বিষাক্ত অতীতের নীল জলে ডুবে যায় পাখি।গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে মানুষ কতোটা স্বার্থপর হতে পারে। শানের ডাকে সম্বিৎ ফিরে বলে,”কিহহ?”
“নীরারও ঠোঁটের নীচে সেইম স্থানে একটা কালো তিল ছিলো।সেটাই ছিলো আমার দূর্বলতা।কারণ কোথাও না কোথাও মা কে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠত।সেই অনুভূতি থেকেই নীরার ঐ তিলের প্রতি ভালোলাগা কাজ করত।কিন্তু যখন নীরাও মায়ের মতো সেইম কাজটাই করল তখন ধরেই নিলাম নারীরা জঘন্য আর এইখানে তিল যাদের তারা আরো জঘন্য।”

“আপনার বাবা এখন কোথায়?”,খুব ঠান্ডা কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।
হতাশাব্যঞ্জক হাসি দিয়ে শান বলে,”বিয়ের সাত মাস পর বাবার হার্টে এ্যাটাক আসে।ব্লক ধরা পরে চারটা।ইমিডিয়েট বাইপাস করতে হয়।আইসিইউ রুমে মূমূর্ষ অবস্থায় আমায় কাছে ডেকে বলেছিলো আমি যেন কোনদিন শর্মিলা বেগমকে ক্ষমা না করি।বাবার কষ্টটা আমি বুঝতাম।জানতাম মায়ের শোকে শোকে বাবার আজ এ অবস্থা।সে বারের মতো সুস্থ হয় বাবা

আমিও সবটা বুকের মাঝে চেপে রেখে দিন কাটাচ্ছি ইনায়াহ্’কে নিয়ে।ধীরেধীরে বেড়ে উঠছে আমার ইনায়াহ্।হঠাৎ একদিন নীরা ফোন করে বলল বাবা নাকি নেই।দুনিয়ার সবথেকে এতিম মনে হলো নিজেকে।কারণ বাবা ছাড়া আমার কেউ ছিলো না।

পরে জানতে পারি এই বাড়ি, গাড়ি ব্যতিত বাবার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদের মালিক হিসেবে নীরার নাম দলিলে উল্লেখ্য ।বুঝতে অসুবিধা হয় না নীরা জোড় করে সবটা লিখিয়ে নিয়েছে।আমার বরাবরই টাকা পয়সা,সহায় সম্পদের প্রতি কোন লোভ ছিলো না।তাই কোন প্রকার দাবি ব্যতিতই সবটা ছেড়ে দিয়েছি নীরাকে।তাতেও যদি সে খুশি থাকে।”

থেমে যায় শান।দীর্ঘশ্বাস গুলো বুকের কাছে জমা হয় দলবেঁধে।সেগুলোকে মুক্ত করে দিয়ে শান্তস্বরে শান বলে,”এই তো ! আর কি!এই আমার জীবন।এবার বলো পাখি এই নোংড়া অতীত আর আমার অক্ষমতা নিয়ে কী করে আমার জীবনে তোমায় জড়াই বলো?”
স্বগতোক্তি করে শান বলে, “আমি কোনদিনও তোমায় মা হওয়ার মতো সুখানুভূতি দান করতে পারব না পাখি ”

এতোক্ষনের জমানো কান্নাগুলো বাঁধ ভেঙ্গে যায় যেন।নিঃশব্দে কেঁদে চলে পাখি।শান দুহাতে চোখ মুছিয়ে বলে,”জীবন নাটকের থেকেও নাটকীয় জান আমার।”
শানের কথা শেষ হতেই গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেলে পাখি।
“আমি নীরা না”,কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে ।
দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান বলে,”জানি তো”
“আমাদের ইনায়াহ্ আছে ডাক্তার সাহেব।”
শান চোখ বন্ধ করে দুফোটা অশ্র বিষর্জন করে বলে,”আমায় ছেড়ে যেও না কখনো। সব বিচ্ছেদ মানতে পারলেও তোমার টা পারব না”
#আসক্তি২
পর্বঃ২৮
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সকাল বেলা পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় পাখিরম গতকাল ছাদ থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়।তবুও সবার আগে ঘুম ভাঙ্গে তার। হয়ত জীবনে নতুন এক সকাল তৈরী হবে বলেই!
সকাল সকাল ইনায়াহ্কে ডাকে শান্তকন্ঠে। নড়েচড়ে ছোট্ট কোলবালিশটা দুহাতে চেপে আবার পাশ ফিরে ঘুমায় ইনায়াহ্।মুখে হাসির রেশ অথচ উঠছে না।পাখি ঢেড় বুঝতে পারে ইনায়াহ্ জেগে আছে।তাই আস্তে করে কাতুকুতু দিতেই হাসতে হাসতে উঠে বসে পরে ইনায়াহ্।মিছে বিরক্তি দেখিয়ে বলে,”এতো সকাল সকাল কেন ডাকলে মুন সাইন?আর একটু ঘুমাই না!”
“উহু আর না।তাড়াতাড়ি উঠো। হোমওয়ার্ক আছে অনেক গুলো।আর আজ সব রান্না আমি করে রেখে তবেই স্কুলে যাবো “,তাড়া দিয়ে বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে বলে পাখি।

ইনায়াহ্ অগত্যা চোখ কচলে চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে।পাখি বিছানা ঠিক করে, ঘর গুছিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।রাহেলা তখনো ওঠে নি।উঠবেই বা কি করে তখন তো মাত্রই আলো ফুটেছে!
পাখি তড়িঘড়ি করে সবার জন্যে টুকটাক সকালের নাস্তার জন্যে ডিম চুলোয় দেয়।হাতের কয়টা কাজ এগিয়ে নেয়।এরপর ফ্রেশ হতে উপরে চলে যায়।শান এতো সকাল বেলা নাস্তা খায় না।উঠেছেও কিনা তাও জানে না পাখি।ইনায়াহ্ পড়তে বসেছে হাত মুখ ধুয়ে।সামনে হালকা কিছু খাবার আর পানির গ্লাস রেখে পাখি কপোট শাসিয়ে বলে,”একদম দুষ্টুমি না ওকে?হোমওয়ার্ক করবা সাথে খাবার গুলো শেষ করবা”
মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টিয়ে জবাব দেয় ইনায়াহ্।

শানের জন্যে কড়া করে একটা কফি রেডি করে উপরে চলে যায় পাখি।দরজার সামনে দাঁড়াতে কেমন যেন আলাদা একটা অনুভূতির জন্ম নেয়।অথচ কতোবার এ ঘরে এসেছে সে।কতোবার এ করিডোরে হেঁটেছে!
ঠোঁটের লাজুক হাসিটা ম্লান হয়ে যায় শানের অতীত ভাবলেই।সাথে সাথে শক্ত হয়ে আসে চোখ মুখ।
নিজের সাথেই বিড়বিড় করে ওঠে,”তোর এখন একটাই কাজ পাখি ভালোবাসার ঐ মানুষটাকে ভালো রাখা।তাকে তার অতীতের কালো আঁধার থেকে টেনে হিচরে বের করে আনা”
বুকের কাছে ঘনঘন কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাখি দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।

দরজায় ক্যাচ করে দুটো আওয়াজ হয়। পাখি সন্তোর্পনে দরজাটা ধরতেই আওয়াজ টা থেমে যায়।সামনে তাকিয়ে দেখে ভাঁজ করা পা দুটার হাঁটুর কাছে খুব সুন্দর করে হাত দুটো গুঁজে দিয়ে ঘুমাচ্ছে শান।থমকে যায় পাখির চোখ।বুকের ভেতর অজানা হাওয়া বয়ে যায়।ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগটা সাইড টেবিলে রেখে শানের দিকে তাকায় পাখি।কি যে মায়াময় ও মুখ! চোখের পলক ফেলা দায় হয়ে ওঠে। শানের মুখের সামনে মেঝেতে বসে পরে পাখি।দুহাত বিছানার উপর এলিয়ে তাতে মাথা এলিয়ে দেয়।অপলক চেয়ে থাকে ঘুমন্ত একটা মানুব মূর্তির দিকে।ঘুমালে প্রতিটা মানুষকেই নিষ্পাপ লাগে ;ছোট বাচ্চার মতো মনে হয়। শানকে একটু বেশিই বাচ্চা লাগছে যেন। নাক দিয়ে বের হওয়া ভারি নিঃশ্বাস টা আছড়ে পরছে পাখির কপালের কাছে।শানকে দেখলেই কেন যেন পাখির বড্ডো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এখন তো ঘুমন্ত এ সুযোগ কি করে হাতছাড়া করে! ঠোঁটে মুচকি হেসে কপালের উপর নেমে আসা চুল গুলো সরিয়ে দেয় পাখি।বাঁ হাতের পাঁচ আঙ্গুলে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় শানের গাল।নাকের ডগাটা আস্তে করে টিপে ধরতেই সামান্য নড়ে ওঠে শান।হাত সরিয়ে নেয় পাখি।ঠোঁট টিপে হেসে আবার চেপে ধরে নাকটা। ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে শানের।

সামান্য শব্দ করে হেসেই হাতের স্পর্শ চলে যায় শানের নাক আর ঠোঁটের মধ্যবর্তী নিচু সরু জায়গাটার উপর।হেসে দেয় পাখি।মূহূর্তে চোখ খোলে শান। হাতটা ধরে ফেলে আলতো হাতে।
মুচকি হেসে পাখির দিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে নেয় সে।কোন কথা নেই দুজনের।পাখির অবনত মস্তকে কাচুমাচু করার বিরল দৃশ্যটা মন্দ লাগছে না শানের।তাই তো সেটা চুপচুপ অবলোকন করছে। নীরবতা ভেঙ্গে পাখি বলে,”কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে”
ঘোরলাগা দৃষ্টিতে চেয়ে সদ্য জেগে ওঠা ঘুম জড়ানো কন্ঠে শান বলে, “কফি খাবো না”
চমকিত চোখে পাখি অপ্রস্তুত হয়ে বলে,”তাহলে কি খাবেন?চা?দুধ চা না রং চা?ওহহ সরি আপনি তো ডায়েটে? গ্রিন টি করে দেবো?সুগার ছাড়া?”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে পাখি শানের জবাবের প্রত্যাশায় চেয়ে থাকে।হাতের আলগা বাঁধনটা আরেকটু শক্ত করে চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসে শান।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।অপ্রতিভ দৃষ্টিতে লাজুক চোখে চেয়ে বলে,”কি করছেন? ”
“আমি তো নতুন কিছু টেষ্ট করতে চাই।সকালটা এখন থেকে নতুন কিছু দিয়ে শুরু করতে চাই”,কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে শান।

শানের কথার গাঢ়তায় থেমে যায় পাখির শ্বাস নেয়া।বোঝার বাকি থাকে না শান ঠিক কি বোঝাতে চাইলো।বুকে ধাক্কা মেরে চলে আসতেই দুহাতে নিজের বুকে চেপে ধরে পাখিকে।ছোট ছোট চোখে ভ্রুজোড়া দুবার উপর নিচ করে শান বলে,”কী? এতো ছটফটানি কিসের?হুমম!ডানা ভেঙ্গে দেব ”
“এতোটাই সহজ?”,অহমিকায় বলে ওঠে পাখি।
“দেখবে কী করে ডানা ভাঙ্গতে হয়?”,দুষ্টুমির হাসি ঠোঁটে এলিয়ে বলে শান।আড়চোখে তাকিয়ে পাখি বলে,”আমার ডানা এতো কমজোর নয়। ওকে মি… ”
পাখির কথা শেষ হতে না হতেই কথা বলার মতো সুযোগ হারিয়ে ফেলে সে।বুঝতে পারে কথা বলার জন্যে যে ঠোঁট দুটো দরকার, তা এখন বাঁধা।কিছুক্ষন চোখ বন্ধ রেখেই শানের বুকে কয়টা কিল বসায় পাখি।শানের তাতে কোনই পরিবর্তন হয় না।কিছুক্ষনের মাঝে নিজে থেকেই নিস্তেজ হয় পাখি।খুব ধীরে চোখ দুটো খুলে নিজের এক ইঞ্চি দূরে রাখা প্রোজ্জ্বলিত চোখ দুটোর দিকে তাকায় ।বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে না সে।ও চোখের গভীরতা যে বড্ডো বেশি।নিজেকে সেখানে নিছকই ভেসে আসা খড়কুটো মনে হয়। চোখ সরাতেই শান পূর্বের ন্যায় আবারও ভ্রু জোড়া নাচায়।ভীষণ লজ্জায় পরে যায় পাখি।আবারও ছটফট করতে থাকে নিজেকে ছাড়ানোর। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায়।
দীর্ঘক্ষণ পরে শান ওকে ছেড়ে বলে,”এটাকেই বলে ডানা ছাটা”

মুখে লজ্জার আভা বেশে ওঠে পাখির।গালের লাল সে আভাটা দৃষ্টিগোচর হতে সময় নেয় না শানের।আঙ্গুল তাক করে বলে,”দেখো গাল দুটো কি লাল হয়েছে তোমার?দেখো দেখো!”,
মনের অজান্তেই গালে হাত চলে যায় পাখির।শান শব্দ করে হেসে বলে,”সেদিন রাতে যখন ড্রাংক হয়ে আমায় কিস করলে এমন তো ছিলো না।”
পাখি বেশ বুঝতে পেরেছে এই লোক তাকে লজ্জায় মেরে ফেলবে আজ। উঠে আসতেই আবারও হাতটা ধরে একটা টান দেয় শান।তাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে পরে যায় বুকের উপর।এলোমেলো চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে শান বলে,”আই লাভ ইউ”
মাথা তুলে তাকায় পাখি।কেমন যেন হারানোর ভয় সে চোখে। আস্থার দৃষ্টিতে চেয়ে পাখি বলে,”আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি।কোনদিনও আপনাকে ছেড়ে যাবো না।এতো ভয় পেতে হবে না”
শান নিজের বুকে পাখির মাথাটা চেপে ধরে বলে,”প্রতিদিন চা, কফি’র বদলে সকালে আমি এই সুইটটা চাই”
“বেহায়া লোক”
শান হেসে ফেলে শব্দ করে।

🌸🌸

সকালে সবার জন্যে নাস্তার জোগাড় করে পাখি।রাহেলা তা দেখে অবাক হয়ে যায়। কপালে হাত দিয়ে বলে,”হায় হায় বউ মা! কি করেছো এসব?”
তোমারে আমি এসব করতে বলেছি একবারো?আমিই করতাম সবটা।তুমি করতে গেছো কেন এতোসব?”
রাহেলার কথায় স্তম্ভিত হয় পাখি।মনে মনে আওড়াতে থাকে, “চাচি একটু আগে কি ডাকলো আমায়?বউ মা!”
“কি হলো বউ মা?এখন আবার দাঁড়িয়ে অাছো কেন?খাবার বেড়ে দাও”
পাখির ভাবনার সুতো ছেড়ে রাহেলার কথায়।চকিতে চেয়ে বলে,”একরাতেই বউ মা হলাম তাই না?এতো পর করলে?”

রাহেলা লজ্জিত হয় মনে মনে ।নিজের করা দোষের জন্যে ক্ষমা চায় পাখির কাছে।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তোমার শ্বাশুরি মা এ বাড়িতে থাকলে তোমায় আদোর করে বউ মা’ই ডাকতেন।তার অবর্তমানে আমিই না হয় সে দায়িত্ব পালন করলাম।তোমার কি খারাপ লাগে মা?”
পাখি এক গাল হেসে রাহেলাকে আশ্বস্ত করে বলে,”খারাপ লাগো না।তবে…..। আচ্ছা চাচি আজ একটা কথা বলবে?”
কথার মোড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে পাখি।সায় দিয়ে রাহেলা প্রশ্ন করে,”কি কথা বলো?”
“ডাক্তার সাহেবের মা কোথায় থাকেন?সবকিছু ছেড়ে, আমার ডাক্তার সাহেবকে একা করে কেন চলে গেলেন?”

পাখির কন্ঠে শানের জন্যে অধিকারবোধের পুরু স্তর বুঝতে পারে রাহেলা।বুকের কোথাও যেন শান্তির পরশ দোল খেলে যায়।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহেলা জবাব দেয়,”কোন নারী নিজের সাজানো গোছানো সংসার ছেড়ে চলে যেতে চায় না মা।যেতে বাধ্য হয় অনেকেই।আর যারা স্বদিচ্ছেয় চলে যায় তাদের দলের মানুষ আমার ম্যাডাম নয়।তিনি সবার থেকে আলাদা।তার তুলনা তিনি নিজেই।”

পাখির মনে এখন হাজারও প্রশ্নের ছড়াছড়ি।বুঝতে পারছে না কে ঠিক বলছে।
“যদি সন্দেহ মোতাবেক সেদিনের ঐ মহিলাই ডাক্তার সাহেবের মা হোন, তাহলে তার ব্যপারে এতো পজিটিভ ধারনা কী করে মনে পুষে রাখতে পারেন রাহেলা চাচি?বা তাকে এতো সমিহ করেই বা কেন চলেন?ডাক্তারের মুখে যা শুনলাম তাতে তো উনি সত্যিই ঘৃনার পাত্রি”
ভাবনা গুলোকে একপাশে রেখে পাখি আবার প্রশ্ন করে, “এতো ভালো একজন মা কী করে নিজের সন্তানদের ছাড়তে পারে চাচি?তাও আবার নিজের সুখের জন্যে?”
রাহেলা বেশ বুঝতে পেরেছে শান নিজের অতীতের ব্যপারে সবটা বলেছে পাখিকে।ছলছলে চোখ দুটো স্থীর করে বলে,”মা গো, সবটা জানাব তোমায়।একটু সময়টা অনুকূলে আসতে দাও”

“আব্দুল্লাহ্ চাচা,আব্দুল্লাহ্ চাচা”
ডাকতে ডাকতে নিচে নেমে আসে শান।পাখি রাহেলা দুজনে সেদিকে তাকায়।পাখি খাবার পরিবেশনে মন দেয়। রাহেলা এগিয়ে গিয়ে বরে,”তোমার চাচা তো সকালে উঠেই বাজারে গেছে বাবা।গতকাল কিছু বাজার সদাই শেষ হয়ে গেলো বলে।”
স্বগতোক্তি করে বলে, “কিছু লাগবে তোমার? আমারে বলো, তোমার চাচা আসার সাথে সাথেই আমি বলে দিবো নে।
শান চেয়ার টা টেনে বসতে বসতে বলে,”তোমারে বলে লাভ নাই চাচি।এটা চাচারেই দরকার”
“ঠিকাছে আসুক তাহলে। অপেক্ষা করো”
ততোক্ষনে ইনায়াহ্ও চলে আসে নিচে।পাখি খাবার দিতে যাবে তখনি শান গম্ভীর কন্ঠে বলে,”তুমিও বসো।আমরা আমাদের টা নিয়ে নিতে পারব”
পাখি আড়চোখে সেদিকে চেয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়। শান ওর হাত টেনে চেয়ারে বসায় জোড় করে। রাহেলা সেদিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে হেসে দেয়। মাঝখান থেকে ইনায়াহ্ মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে দেয়।

খাওয়ার এক পর্যায়ে শান একটা কান্ড করে বসে। পাখির মুখের সামনে একটা লোকমা এগিয়ে বলে,”হু”
লজ্জায় মরিমরি অবস্থা পাখির।রাহেলার দিকে একনজর, ইনায়াহ্’র দিকে একনজর চেয়ে দেখে নেয় পাখি।দুজনেই হা হয় চেয়ে আছে ওদের দিকে।শানের হাতটা সরিয়ে চাপাস্বরে বলে,”কি করছেন, চাচি দেখছে”
রাহেলার কানে কথা ঢোকার সাথে সাথে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বলে,”দাদুভাই আমরা কিছু দেখছি না তাই না!”
ইনায়াহ্ রাহেলার সাথে তাল মিলিয়ে চোখ ঢেকে বলে,”হ্যা দিদা আমরা কিছু দেখছি নাতো”
একফাঁকে পাখি দ্রুত খাবার টা মুখে নিয়ে শানের দিকে তাকায়।ঘোরলাগা চাহনীতে মাথা চক্কর দেয় পাখির।বেশিক্ষন তাকাতে পারে না শানের দিকে।
ইনায়াহ্’র কানে মৃদু টেনে বলে,”ভারি পাকনা হইছো,না!”
হেসে ওঠে সবাই।

🌸🌸

“এই যে নেও ধরো ধরো তোমাদের বাজার।বাবারে বাবারে জান বের হয়ে গেলো যেন।এতো ভীড় এতো সকালে! ভাবা যায়”, আপনমনে বকবক করতে করতে বাজারের ব্যাগ সমেত বাড়িতে ঢোকে আব্দুল্লাহ্।কয়দিনের গরমে জনজীবন অতিষ্ট যেন।আর বাজারের গরম তো আরো অসহ্য লাগে।ঘেমে নেয়ে একাকার আব্দুল্লাহ্’র শরীর।রাহেলা এগিয়ে গিয়ে বলে,”এতোক্ষন সময় লাগালে বাজার করতে”
“না, ওখানে আড্ডা মারতে গিছিলাম, জানো না?”,গরমে রাগে মাথার রগ তিড়তিড় করে কাপছে আব্দুল্লাহর। তার মাঝে রাহেলার এমন কথা।

শান পাখিকে নিজে হাতে তুলে খাওয়াচ্ছে আর পাখি সুযোগ বুঝে টুপ করে খেয়ে নিচ্ছে। আব্দুলাহ আর রাহেলার মিষ্টি তর্ক শুনে শান হেসে বলে,”চাচা এদিকে আসো।তোমার পেট খালি, মাথার ছাদটাও খালি তাই রাগ হচ্ছে।পেটে কিছু দাও, ঠান্ডা হও”
“আর তোমার কাজ আছে”,স্বগতোক্তি করে শান।
আব্দুল্লাহ্ ডায়নিং এ এগোতে এগোতে বলে,”কি কাজ রে বাপ”
শান উঠে বেসিনে হাতটা ধুয়ে তোয়ালেতে মুছে বলে।
“কার্ড ছাপাও।আগামি পরশুদিনের ইনভাইট করো সকলকে ।”,বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলে শান।
শানের কথায় উপস্থিত সবাই চমকে যায়।সরু চোখে শানের দিকে তাকায় পাখি।

রাহেলা এগিয়ে এসে বলে,”কিসের কার্ড বাবা?”
“আমার আর পাখির বিবাহত্তোর অনুষ্ঠানের কার্ড।যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি সকলকে জানাতে চাই আমাদের বিয়ের কথা।আব্দুল্লাহ্ চাচা সকল আত্মীয়-স্বজনদের ডাকো।পাশে যে এতিমখানা আছে সেখানকার সবাইকে ডাকো।”,এক নাগাড়ে কথা বলে পাখির দিকে তাকায় শান।চক্ষুচড়ক গাছ পাখির।সকালটা যে এতোটা সুন্দর হবে ধারনা ছিলো না পাখির।চোখের কোণে চিকচিক করা জল টা নজর এড়ায় না শানের।সেদিকে এগিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলে খুব নিংড়িয়ে নেয় সে জল।খানিকক্ষণ পাখির দিকে চেয়ে বলে,”আমাদের একা বাঁচার দিন শেষ;একসাথে বাঁচার দিন শুরু ”

শানের চোখেমুখে তৃপ্তির খুশি ঝলমল করে ওঠে।খুশিতে ইনায়াহ্ হাতে তালি দেয়।সবাই যেন এমন একটা সকালেরই প্রতিক্ষায় ছিলো এতোদিন।
শান উপরে উঠে যেতে যেতে বলে,”পাখি আজ স্কুলে গিয়ে সবাইকে ইনভাইট করে এসো।আর তোমার জানের অর্ধেক রাখিকে বলতে ভুলো না ”
সেদিকে চেয়ে পাখি ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে, “রাগি হিটলার”

🌸🌸

শান আর পাখির বিয়ের কথা শুনে খুশিতে গদগদ হয় রাখি।অসন্তোষের সাথে দূঃখ প্রকাশ করে যে,তাদের বিয়ে হয়ে গেছে আগে।এখন বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে যাচ্ছে সে।খুশিটা চেপে গাল ফুলিয়ে বলে,”এতো বড় কথাটা লুকাতে পারলি আমার থেকে?এখন বাসি বিয়েতে ধেইধেই করে নাচতে নাচতে যাবো না আমি”
সেদিনের ঘটনা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পাখি।সব ঘটনা খুলে বলে।রাখি হাসিতে ফেটে পরে বলে,”যাই হোক, তোর আয়ান ভাই একটা থ্যাংকসের হকদার”

“বাদ দে সেসব।কাল আসবি কিন্তু।তোকে কাল থেকে চাই আমি ব্যাস।আর স্কুলে ছুটির এপ্লাই করব আমি। ক্লাস আছে, আসছি এখন। “,বলেই চলে যেতে রাখি খপ করে হাতটা ধরে বলে,”তোকে ছুটি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।মাকে সবটা আমি বলবোনে।এতে ফর্মালিটিজ করতে হবে না।বিয়েতে ফোকাস কর। গ্লো কর গ্লো, বুঝলি?”
রাখির কথাকে উড়িয়ে পাখি বলে,”আমার এতো গ্লো করা লাগবে না।যে ভালোবাসার সে বাসলেই হলো”
#আসক্তি২
পর্বঃ২৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সকালে বেশ তাড়াতাড়ি উঠে পরে পাখি।স্নিগ্ধ একটা সকালের উপস্থিতি মন চাঙ্গা করে তোলে।আজ বাদ কালকে তার বিয়েটা প্রকাশ্যে আসবে। এর থেকে আনন্দের বা কি হতে পারে এই মূহূর্তে!আড়মোড়া ভেঙ্গে ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশরুমে।আজ আর ইনায়াহ্’কে ডাকে না।বিয়ের জন্যে যে কয়দিনের ছুটির আবেদন করেছে, তার সাথে ইনায়াহ্’র ও ততোদিনের ছুটি নিয়েছে।ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বুঝতে পারে সদর দরজা খোলা।অবাক হয় পাখি।
“এতো সকালে কে উঠেছে?”,ভাবতেই ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ পরে যায়।এগিয়ে যায় দরজার দিকে।শান দুজন ছেলে সহ ফোন কানে হুরমুর করে এদিকে আসে।হাতে হরেক রকমের ফুল।একটু পর গাড়ির শব্দে মাথা উচিয়ে পাখি দেখার চেষ্টা করে।

গাড়িটা এসে থেমে যায় বাড়ির আঙ্গিনায়।পাখি বুঝতে পারছে না শান এতো সকালে কি ওতো করছে।সদর দরজার কাছে এসে পাখিকে চোখে পড়ে শানের। ফোনটা কানে রেখেই বলে,”এখানে কি?ভিতরে যাও”
পাখি কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় শান।বুঝতে পারছে না বিয়ে কাল অথচ আজ এতো সকালে এসব করছে শান!

ফিরে এসে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপোট ধমকে বলে,”এখানে দাঁড়িয়ে ওনাদের দেখে কি চক্ষু শীতল করা হচ্ছে?”
আগত লোকদের ইশারা করে শান।পাখি অবাক হয়ে যায় শানের এমন তেড়ছা কথায়।রাগ দেখিয়ে হনহন করে রান্নাঘরে চলে যায়।শান সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে আবারও লোকগুলোকে তাড়া দেয়।
“তাড়াতাড়ি হাত চালাও, সময় কম”

রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে বার বার ড্রয়িং রুমে দেখছে পাখি।একটু পর বুঝতে পারে লোকগুলো বাড়ি সাজাতেই এসেছে।একে একে বাড়ির প্রতিটা দেয়াল, সিঁড়ি সব তাজা ফুলে ভরে ওঠে।চোখ বন্ধ করে প্রান ভরে ফুলের সুবাস নেয় পাখি। কিছুক্ষন পর বাহিরে তাকাতেই শানের সাথে ধাক্কা লাগে।কখন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারে নি।একটু সরতেই হাত চেপে ধরে শান।
“আমায় খুঁজছিলে বুঝি!”
“বয়ে গেছে”
“সত্যি!”
“একদম”,বলেই পাখি রান্নায় মনোযোগ দেয়।পিছন থেকে দুটো শক্ত হাত পেটের কাছে অনুভব করে।শিউরে ওঠে সাড়া শরীর।কেমন অস্বস্তি হচ্ছে পাখির।নিঃশ্বাস টা আটকে আটকে আসছে যেন।শানকে সরাতে চেয়েও পারছে না।কাঁধের উপর থুতনিটা আলতো করে রেখে শান বলে,”খারাপ লাগছে?”
কি উত্তর দেয়া উচিত পাখির জানা নেই।তবে এটুকু বুঝেছে এখন শান না ছাড়লে দম আটকে মরে যাবে সে।স্পর্শের গতি আরো গাঢ় হতেই পাখি সরে যায়।

লজ্জায় নজর এদিক সেদিক করে বলে,”কি হচ্ছে এগুলো?কেউ দেখে ফেলবে”
“বাড়ির কেউ ওঠে নি এখনও।আর বাহিরের কারো সাহস হবে না তোমার ধারে কাছে আসার। তাই কারো দেখার…… ”
“একদম না,এগোবেন না একদম”,শানকে থামিয়ে বলে পাখি।গরম খুন্তিটা উচু করে ধরে বলে,”এএতো বেহায়া কেন আপনি!আগে তো এমন ছিলেন না?”
শান হেসে ফেলে পাখির অবস্থা দেখে। একহাত কোমড়ে আরেক হাতে কপাল স্লাইড করতে করতে বলে, “তোমার কি মনে হয় আমি আগে ভালো ছিলাম?”
“মানে?”,ভ্রুকুচকে প্রশ্ন করে পাখি।
শান হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে এনে আবার জড়িয়ে নেয় পিছন থেকে।কাঁধে মুখ ঠেকিয়ে বলে,”তোমার কপাল,কপোল,কাঁধ এসবকে জিজ্ঞেসা করে দেখো তো এরা আমার স্পর্শ চেনে কিনা!”
চোখ কপালে উঠে যায় পাখির।ভাবতেও পারছে না শান এতোদূর!

“আপনি কবে কবে এসব করেছেন?”
“তা তোমার না জানলেও চলবে।”,বলেই কাঁধে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দেয় শান।হাতের খুন্তি পরে যায় পাখির।মেঝেতে সেটার ঝনঝন আওয়াজ উঠতেই শান ঠোঁট প্রসস্ত করে হেসে বলে,”ঘুমালে তো আর মানুষ থাকো না”
খুন্তি টা তুলে হাতে ধরাতে ধরাতে বলে,”ঘরে মেহেদীর ড্রেস রাখা আছে।পরে নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে আসো। মেহেদি ফাংশন শেষ করো।”
হেসে উল্টো পথে পা বাড়াতেই পাখি ডাকে।
“শুনুন”
“কী”
“বললেন না তো! কবে কবে……. “,মিনমিন করে বলে পাখি।
আরেকটু এগিয়ে এসে শান বলে,”কাল রাতে বলব।তৈরী থেকো”
শানের যাওয়ার দিকে হা করে চেয়ে থাকে পাখি।তার মাথায় খেলছে না এসব তিনি কবে করেছেন।কপাল চাপড়ে নিজের ঘুমকে দোষারোপ করছেন বার বার।

হঠাৎ মাথায় হলো মেহেদীর ড্রেসের কথা।
“তারমানে উনি এসবেরও আয়োজন করেছেন!”
অবাক হয়ে ভাবতে থাকে পাখি।একটু পরে বাড়িতে আসে রাখি।পাখির কথামতো আগের দিনই বেশ তাড়াতাড়ি চলে আসে সে।

সবাই সকালের নাস্তা সেড়ে সবে মাত্র উঠতে যাবে তখন আগমন ঘটে দুজন মেয়ের।শানকে দেখে সালাম দিলেন। মুচকি হেসে শান পাখির দিকে ইশারা করলেন।মানে বুঝিয়ে দিলেন উনিই ব্রাইড।

পাখি ভ্রুকুচকে সেদিকে চেয়ে আছে।মেয়েদুটো স্বভাবসুলভ হাসি ঠোঁটে রেখে বলেন,”ম্যাম এবার কি মেহেদীর কাজ শুরু করব!”
আরেক দফা অবাক হয়ে যায় সে।ভাবতেও পারছে না শান পার্লার থেকে মেহেদীর জন্যে লোক আনিয়েছেন।হা করে চেয়ে থাকে শানের দিকে।মুচকি হেসে শান অনত্র চলে যায়।

হাতের সবকাজ মিটিয়ে ইনায়াহ্,রাখি, রাহেলা বসে পরে ড্রয়িং রুমে মেহেদী দেবে বলে।একটু পরেই পাখি শানের দেয়া পাতার রঙ্গের সবুজ ড্রেস টা পরে নিচে আসে।মাথার লম্বা চুলোগুলো বেশ সুন্দর করে বিনুনি করে একপাশে রাখা।শান মুগ্ধ চোখে সেদিকে চেয়ে থাকে।পাখির মাঝে অন্যরকম সৌন্দর্য খুঁজে পায় শান।শুনেছে বিয়ের রঙ্গে নাকি মেয়েরা রঙ্গিন হলে সৌন্দর্য দ্বিগুন বেড়ে যায়। হয়ত পাখিরও তাই চোখ সরানো দায় হয়ে পরে শানের।

একজন মেয়ে খুব নিখুঁতভাবে পাখির হাত সাজিয়ে দিচ্ছে।শান একবার আড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখে আবার নিজের কাজে মন দেয়।রাখি ব্যপারটা বুঝতে পারে। উঠে শানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।গলায় খাঁকারি দিয়ে বলে,”বউকে এভাবে দেখতে হয় না।বীর পুরুষের মতো সিনা টা করে সামনে বসে দেখতে হয়”
রাখির কথায় হেসে ফেলে শান।ওর হাত ধরে পাখির পাশে নিয়ে বসায় রাখি।এরপর পার্লারের মেয়েটাকে বলে, “দিন তো হাতের মাঝে ইংরেজিতে শান লিখে দেন তো বড় করে। বেচারা আড়চোখে তাকিয়ে কূল পাচ্ছে না”
শান লজ্জায় পরে যায় এবার।লজ্জায় মিইয়ে যায় পাখিও।মেয়েটা কথামতো ডান হাতের তালুর মাঝে শান লিখে দেয়।শানের সেখানে থাকাটা কেমন অস্বস্তি লাগছে কারণ রাখি থেকে থেকে এটা সেটা নিয়ে ওর সাথে মজা করছে।আবার পাখির পাশে থাকতে খুব ভালোই লাগছে তার।

মেহেদীর ফাংশন শেষ করে পার্লারের মেয়েদুটো চলে যায়।শান রাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আর কি যেন সব রিচুয়াল আছে?আমি তো জানি না আসলে….”.
“উমমম,হলুদ! হলুদ হবে না?”,কিছুক্ষন বিজ্ঞের মতো ভেবে জবাব দেয় রাখি।পাখি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে,”এতোসবের কি দরকার? ”
“কেন, ডিরেক্ট ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে বুঝি”,রাখির ফিসফিসিয়ে বলা কথাটা পাখির কান গরম করে দেয়।তাকিয়ে দেখে শান শুনল কিনা!
মাথা তুলে তাকাতেই শান বাম চোখে টিপ মেরে রাখিকে ইশারা করে।যার মানে রাখির কথা সে শুনেছে।

🌸🌸

সময়ের সাথে মেহেদির রংটাও গাঢ় হয়ে ওঠে।বার বার উল্টে পাল্টে হাতদুটো দেখে পাখি।আশপাশ চোখ বুলিয়ে কাউকে পাশে না পেয়ে শানের নাম লেখা জায়গাটায় চুমু এঁকে দেয়।দরজার আড়াল থেকে সেটা শানের দেখতে অসুবিধা হয় না।দরজা পুরোটা খুলে ভিতরে ঢোকে।গলায় একটু কাশির শব্দ করে নিজের উপস্থিতি জানান দিতেই পাখি নড়েচড়ে বসে।
“এভাবে চুমু না খেয়ে ডিরেক্ট বললেই তো হয় যে….”
“এই না না না, থামুন বলছি”,দুহাতে কান চেপে চোখ মুখ কুচকে বলে পাখি।

“এটা হলুদের শাড়ি।পরে তবেই নিচে আসবে।না পড়লে খবর আছে”,বলেই প্যাকেট টা পাখির হাতে ধরিয়ে বাহিরে চলে যায় শান।পাখি একের পর এক অবাক হচ্ছে শানের আচরনে।প্রতিটা মেয়েরই স্বপ্ন থাকে বিয়েতে অনেকটা অানন্দ করার।পাখিরও ব্যতিক্রম ছিলো না।বিয়েটা ওভাবে হওয়াতে সব আশা, সব স্বপ্ন যেন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।যা এখন জীবন্ত করছে শান।

বিকেল হতেই পাখি রাখির সহযোগীতায় এবার বেশ ভালো করেই হলুদের শাড়িটা পড়ে নেয়।পরিবারের কয়জন আর রাখি মিলে শুরু হয় পাখির হলুদের আয়োজন।শানকে হলুদ লাগাতে চাইলে সে নাকোচ করে দেয়।এও বলে দেয়, “এ আয়োজন শুধু আমার পাখির জন্যেই”
শানের আচরনে উপস্থিত সবাই আত্মতৃপ্ত হয়।ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি খেলে যায়।একে একে সবাই পাখিকে হলুদ ছুঁইয়ে মিষ্টি মুখ করিয়ে দেয়।

“ম্যাডাম!”,রাহেলার কন্ঠে কথাটা কানে আসতেই শান স্তম্ভিত হয়ে যায়।ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে বিপরীত মুখে।ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে পাখির দিকে এগিয়ে আসে। শান উত্তেজিত হয়ে পরে এক মূহূর্তেই।একপ্রকার গর্জন করে ওঠে,”উনাকে কে ডেকেছে এখানে?”
ভয়ে কেপে ওঠে আহমেদ ম্যানশন।রাহেলার দিকে শানের নজর ফিরতেই কটমটে চোখে তাকিয়ে শান বলে,”এমন ঔদ্ধত্য দেখাবে না চাচি।”,
পাখির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”তোমায় বলেছিলাম না একজন নারীর কথা।যিনি সংসার রেখে, সন্তান রেখে নিজের সুখের আশায় চলে গেছে।সে আর কেউ না। ইনি”
স্বগতোক্তি করে বলে,”ইনি হচ্ছেন সেই শর্মিলা আহমেদ।ওপস,শর্মিলা খান।

শানের অপমানে জর্জরিত শর্মিলার চোখ মুখ।তবুও কোথাও যেন নিজেকে ঠিক রেখেছেন। হয়ত সকলের সামনে কেঁদে ফেলাটা বেমানান, তাই নিজেকে শক্ত খোলসে ঢেকে রেখেছেন।
শানের কথার কোন প্রতিউত্তর না করে শর্মিলা এগিয়ে যায় পাখির দিকে।পাখি হতভম্বের ন্যায় চেয়ে দেখছে আগত শানের মুখে শোনা তার মাকে।
কি সুন্দর মুখের শ্রী।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।তার পুরো গঠনেই যেন আভিজাত্য জানান দিচ্ছে আপন আপন মহিমায়।শানের মুখে শোনা কথাগুলোর সাথে এই মানুষটার এক রত্বিও মেলবন্ধন খুঁজে পায় না পাখি।সেদিনও নান;আজও না।চেয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। মনে মনে ভাবে,”আমার তো তাকে ঘৃনা করা উচিত।কিন্তু কেন জানি না তাকে আমার বেশ ভালো লাগছে।চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে মুখটা দেখে। তার সাহচর্য খুব ভালো লাগছে।

পাখির গায়ে হলুদ ছোঁয়াতেই সম্বিৎ ফেরে পাখির।শর্মিলা পাখির সারা মুখে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে বললেন,”বেঁচে থাকো মা।অনেক সুখী হও জীবনে।পারলে আমার খালি বুকটা আবার ভরে দিও”
পাখি বেশ ভালোভাবে খেয়াল করে শেষের কথাটা বলতে কন্ঠে একটা তীব্র আকুলতা ছিলো।আর চোখের কোণে চিকচিকে জল।এরপর তিনি ঠিক যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই নীরবে চলে গেলেন।রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন।

🌸🌸

মাঝেমাঝেই শর্মিলা এ বাড়িতে আসেন বা শানের কেবিনে যান।কিন্তু শান কখনোই তার দিকে ফিরেও তাকায় না।আর যেদিস তিনি আসেন পুরোটা দিন মন খারাপ থাকে শানের।আজও তার ব্যতিক্রম হয় না।বিকেলের পর থেকে অন্যরকম ছটফটানি দেখা যায় শানের মাঝে।হলুদের ফাংশনের পর ইনায়াহ্ রাখি মিলে অনেক নাচ গান করে।এখন ওরা ভীষণ ক্লান্ত।সোফায় শুয়ে,বসে টিভি দেখছে।আর রাহেলা রাতের রান্নার কাজে ব্যস্ত।

পাখি শানের মনের অবস্থা ধরে ফেলে।ফ্রেশ হয়ে শানের ঘরের দিকে চলে যায়।চোখ বুলিয়ে কোথাও খুঁজে পায় না।বেলকোনিতে গিয়েও চোখ ব্যর্থ হয় শানকে খুঁজতে।দরজার কাছে পা রাখতেই সিগারেটের কড়া গন্ধে নাক কুচকে আসে পাখির।নাক টেনে ভালো ভাবে দুবার বোঝার চেষ্টা করে গন্ধটা এতো কড়া কেন।মনে হচ্ছে আশেপাশেই কোথাও!কিন্তু বুঝতে পারে না এ বাড়িতে ছেলে মানুষ বলতে আব্দুল্লাহ্ চাচা আর শান।তারা কেউই সিগারেট খায় না তাহলে?
বাতাসের সাথে গন্ধের দিক অনুসরন করে এগিয়ে যায় পাখি। দরজা ঠেলে পা রাখে ছাদে।আবার নাক টেনে বুঝতে পারে খুবই কাছে গন্ধটা।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কেউ একজন ছাদের রেলিং এ এক পা তুলে স্টোর রুমটার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে খুব আয়েশ করে সিগারেট টানছে।

পাখি অবাক হয়ে যায়।চাঁদের ক্ষীন আলো আজ।সে আলোয় মুখটা অস্পষ্ট।বুকে সাহস সঞ্চার করে এগিয়ে গিয়ে লাইটের সুইচটা অন করতেই চোখ মুখ কুচকে ফেলে শান।পাখিকে দেখে খুব দ্রুত সিগারেটটা ফেলে দেয়।
“আপনি সিগারেট খান!”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পাখি।চোর ধরা পরার মতো অবস্থা যেন শানের।আমতা আমতা করে বলে,”ককই ননাতো”
পাখি হনহন করে এগিয়ে গিয়ে কলার চেপে মুখের গন্ধ শুঁকে বলে, “ছিঃআপনি সিগারেট খান ভাবতেও পারছি না।তাও একজন ডাক্তার হয়ে ”
“বাদ দাও এসব,দেখি মেহেদী কেমন রং হলো?”,বলেই পাখিকে নিজের একদম কাছে টেনে আনে শান।
শানের বুকে দুহাত ঠেলে মাথাটা পিছনে পিছিয়ে পাখি বলে, “সরুন।ছাড়ুন আমায়।ছিঃ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে”
শান ফট করে ছেড়ে দেয় পাখিকে।
“কথা বলবেন না আমার সাথে।কাছেও ঘেঁষবেন না একদম”,কাঠকাঠ গলায় অভিমানি সুরে বলে পাখি।
শান অপ্রতিভ হয়ে বলে,”নিয়মিত খাই না; ডিপ্রেশনে”
“জানতে চাই না”
শানকে ছাদে রেখে নিচে চলে আসে পাখি।মনটা বেজায় খারাপ হয় তার।সিগারেটখোর মানুষ পাখির একদম সহ্য হয় না।আর সেই কিনা!

🌸🌸

সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে বাড়িতে মানুষের সমাগম বেড়ে যায়।আজ এতো বড় আয়োজন বলে কথা।মেহমানদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় শহরের বেশ নামকরা হোটেল থেকে।আব্দুল্লাহ্ও এটা সেটা কাজে ভীষণ ব্যস্ত।
কাজের মাঝে সময়গুলো খুব দ্রুত কেটে যায়।

সকাল থেকে একবারো দেখা হয় নি পাখির সাথে।পার্লার থেকে লোক আনিয়েছে শান।তারা ঘন্টা দুয়েক ধরে সাজাচ্ছে পাখিকে।আর এসময় ও ঘরে যাওয়া মানে কেলেঙ্কারি।এদিকে মনটাও খুব ছটফট করছে একবার পাখিকে দেখতে।

দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে নিচে কাজ বুঝিয়ে শান চলে যায় পাখির ঘরে।দরজায় দুটো নক করতে দরজা খোলে একটা মেয়ে।হয়ত পাখির স্কুলের কলিগ হবে।শানকে দেখে মুচকি হেসে বলে,”কি চাই?”
“পাপাখি আছে?”
“থাকবে না মানে? অবশ্যই আছে।তবে এখন তো দেখা হচ্ছে না মিস্টার।আর এতো তাড়া কিসের রে ভাই?”
শান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।মেয়েটার কথায় ঘরের সব মেয়েরা হেসে ওঠে।পাখি দরজার দিকে একবার তাকাতে কেমন যেন খুব মায়া অনুভব হলো।উঠে আসতেই কেউ একজন পিছন থেকে টেনে বসিয়ে বললো,”আর একটা ঘন্টা মাত্র”
ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে পাখি,”এক ঘন্টা, তাও মাত্র!”
“আচ্ছা বাকিটা পরে করছি, উনার কিছু লাগবে মনে হয়। আমায় যেতে হবে”
বলেই ভীড় ঠেলে দরজায় আসে পাখি।শান তখন প্রস্তুতি নেয় পিছন ফিরে চলে যাওয়ার।পাখির কন্ঠে থমকে দাঁড়ায়।
“কিছু লাগবে?”,অভিমানী কন্ঠে প্রশ্ন পাখির।শান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, “একটু কথা ছিলো।আমার রুমে এসো”

পাখি শানের কথামতো সেদিকে যেতেই হৈহৈ করে ওঠে মেয়েগুলো,”আরে রাতে তো পাচ্ছোই দেখা”
পাখি কর্ণপাত করেনা সেদিকে।সে জানে নিশ্চই কোন দরকার আছে।ঘরে ঢুকতেই শান মাথা নিচু করে বলে,”সরি”
“কেন?”
“আর হবে না”
“লাগবে না। চলছে যখন, চলুক না!”
“বললাম তো”
“মুখ দেখি?”,প্রশ্ন করে পাখি।শান মুখটা তুললেও চোখ খোলে না।জোড় করে চোখ খোলায় পাখি।
“লাল কেন?,ঘুমোন নি রাত?”
“আসে নি”
“সিগারেট কম পরেছিলো বুঝি!”,কটাক্ষ করে বলে পাখি।

শান স্থীর হয়ে এবার তাকায় পাখির দিকে।তার পছন্দের মেরুন রঙ্গের শাড়িটা পড়েছে পাখি।সাজ এখনো বাকি দেখেই বুঝা যায়। অপলক চোখে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”অপূর্ব!”
মুখ ফিরিয়ে নেয় পাখি।শান অতর্কিত পাখিকে দুহাতে জড়িয়ে বলে,”আমি মা কে খুব ভালোবাসি পাখি।কিন্তু তার থেকে ঘৃনা করি বেশি।তাই কাল ডিপ্রেসড ছিলাম।সিগারেটের নেশা উঠে যায়।বিশ্বাস করো নিয়মিত খাই না।তোমার চোখের আড়াল হতে ছাদকে বেছে নেই।আর কখনো খাবো না, বললাম।তবু রাগ করে থেকো না।আমায় ছেড়ে যেও না”
শানের কথাগুলো কলিজা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে যেন।কতো টা ভালোবাসলে এভাবে ভালোবাসা যায় পাখির জানা নেই।কিছুক্ষন ওভাবে থাকতেই দরজায় নক পরে।শান নাক টেনে সরে আসে পাখির থেকে।
“যাও রেডি হয়ে নাও”
“আপনি কখন আসবেন?”
“রেডি হয়ে আসছি”

🌸🌸

বেলা বাড়তে বাড়তে আত্মীয়-স্বজনে ড্রয়িংরুম গিজগিজ করছে।শান পাখি বসে আছে পাশাপাশি রাখা দুটো সুন্দর নকশা করা চেয়ারে।সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।আর শান বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে পাখির দিকে।পাখি সেটা খেয়াল হতেই মুচকি হেসে ওঠে।শান হাতটা চেপে ধরে চাপাস্বরে বলে,”এনাউন্সমেন্ট হয়ে গেলেই আমি তোমায় ঘরে দিয়ে আসব”
“কেন?”
“এখানে হাজার লোকের হাজার নজর।”
“জ্বলছে?”,বলেই ঠোঁট টিপে হাসে পাখি।

কিছুক্ষন পর খাওয়াদাওয়া শেষে সকলের উদ্দেশ্যে শান বিয়ের কথাটা এনাউন্স করে দেয়।পাখির অন্তরাত্মা খুশিতে কেঁপে ওঠে যেন।কান যেন অধীর আগ্রহে বসে ছিলো একটা নামবিহীন সম্পর্কের নতুন আর স্থায়ী নামকরন শোনার জন্যে।অনেকেই খুশি হয় অনেকেই মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে,”বিয়ে ছাড়াই এতোদিন থেকে এখন লোক দেখানো বিয়ে।কতোদিন যে সংসার চলবে জানা আছে”

রিনি ভিতর ভিতর দংশিত হচ্ছে বারংবার।নিজের সাথে পাখিকে মেলাচ্ছে।খুব কষ্ট হচ্ছে তার অথচ প্রকাশ করার জায়গা মিলছে না।এভাবে কতোক্ষন!
সন্তর্পনে চলে যায় সে।

শান রাখিকে চোখের ইশারা করে পাখিকে নিয়ে যেতে।পাখি যাবে না বলে জিদ ধরেছে।কারণ উপস্থিত নাবিদ চারদিকে থেকে পাখিকে দেখছে আর হাসছে। যেটা শানের গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে যেন।আর এ দৃশ্য ঠোঁট টিপে হেসে উপভোগ করছে পাখি।এক পর্যায়ে শান ওকে হাত টেনে উপরে নিয়ে যায়।ঘরে বসিয়ে বলে,”সব খুলে ফেলো।সাজতে হবে না তোমার।সাজার হলে রাতের জন্যে সাজো;আমার জন্যে”
থমথমে মুখে বলে চলে যায় শান।পাখি সেদিকে চেয়ে শব্দ করে হেসে দিয়ে বিড়বিড় করে,”আপনাকে খেপাতে আমার ভালো লাগে ”

চলবে…….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here