#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_৩
#শামছুন্নাহার
রাতে খাবারের টেবিলে আবার দেখা হয়ে গেল ওয়াসিফ ও মিহির। মনে মনে অনেকগুলা কথাও শুনিয়ে দিয়েছে সে। হয়তো সরাসরি মুখের ওপর কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে পারলে বেশ খুশি হত, গায়ের জ্বালাটাও কমতো কিছুটা। কিন্তু তা আর হল কই? ঈশা ছাড়া ব্যাপারটা কেউ জানেও না। বাড়িভর্তি লোকের সামনে কিছু বলাও যাচ্ছে না। ইশশ কি ভাব নিয়ে খাচ্ছে যেন আমাকে চিনেই না,মনে হয় যেন একটু আগের ঘটনা পুরুটা মিথ্যা। আড়চোখে ওয়াসিফের দিকে তাকালো মিহি,ভাবছিল সব। ফরিনা বেগমের ডাক কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ধ্যান ভাঙ্গলো তার। কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন তিনি। মিহি ডানে বামে মাথা নাড়লো অর্থাৎ লাগবে না। মিহি একটু চুপ থেকে বললো-” আন্টি আপনারা খাবেন না?”
—” খাবো,তোমরা খাও। বাড়ির বড়রা পরে খাবে তাছাড়া বড় আপা রান্নাঘরে (মিলির শাশুড়ি) ব্যস্ত। ওনার হাতের কাজটা শেষ হোক তারপর একসাথে বসবো।”
মিহি কথা বাড়ালো না,চুপচাপ খাবার শেষ করল।ইতিমধ্যে ফরিনা বেগম সবার পরিচয় দিচ্ছে মিহির কাছে। শেষে জানতে পারলো ওয়াসিফ ওনার ছেলে,একমাত্র ছেলে। মেয়ে আছে একজন, আমেরিকা থাকে স্বামীর সাথে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মিলিকে বাসরঘরে বসিয়ে আসলো ঈশা। কিন্তু মৃদুলকে রুমের ভিতরে যেতে দিচ্ছে না ঈশা,ওয়াসিফ, মিহাদ। টাকার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মিহি দূরে দারিয়ে ওদের কান্ড দেখছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির বড়রা মিটিমিটি হাসছে। রাত তখন বারোটা পঁচিশ মিনিট। টাকা না দিলে যে ওরা ছাড়বে না এটা বেশ বুজে গেছে মৃদুল। শেষে উপায় না পেয়ে দুহাজার টাকা ধরিয়ে দিল ঈশার হাতে। ব্যাস ঈশা দরজা ছেড়ে চলে গেলেই মৃদুল রুমে আসে। কিছু নিয়ম পালন করে সবাই রুম থেকে বের হতেই মৃদুল এসে দরজা বন্ধ করে দেয়।
মিহি ঈশার থাকেই থাকবে। বাড়িতে মেহমানভর্তি লোকজন। একটা রুমও ফাঁকা নেই। ঈশার ফুফু, দুই খালা,ইলমা আপু,মিহাদ, ওয়াসিফ সবাই আলাদা আলাদা রুমে। রুমে আসার পর ঈশা অনেক কথা বলছে কিন্তু একটা উত্তরও দেয়নি মিহি। বোধহয় ঈশার উপর রাগ তার। এটা বেশ বুজতে পারছে ঈশা। অবশ্য রাগ করাটাই স্বাভাবিক। ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পরলো দুজন। নিরব দুুজন। মিনিট পাঁচেক গেলে ঈশাই প্রথম শুধালো- ” রাগ করেছো মিহি আপু?”
—” তুমি কাজটা ঠিক করোনি ঈশা।”..
—“আমি জানি। সরি ভুল হয়ে গেছে আমার,প্লিজ রাগ করোনা?”
—” দেখো ওই বজ্জাত ওয়াসিফ আমার হাতটা কি করেছে।এত শক্তভাবে ধরেছে যে লাল হয়ে গেছে।”( মোবাইল ফ্লাশলাইট অন করে দেখালো)
মিহির কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো ঈশা। একটু থেমে আবার বললো—-” জানো? ভাইয়া তোমায় পছন্দ করে? তুমি যে আমায় একটা পিক দিয়েছিলে ? ওটা দেখেই বেচারা তোমার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে।”মৃদু হেসে বললো সে।
—” ছবির কথা জানি না তবে পছন্দ করে বলেছে।”
—” কি বলেছে? ”
— “আপনাকে আমার ভালো লাগে।”
কথার ঝুড়ি নিয়ে বসেছে থুক্কু শুয়েছে ঈশা। পুরো পরিবারের ব্যাখ্যা দিয়ে দিল ইতিমধ্যে। ঈশার মন ভীষন পরিষ্কার। মনে কোনো হিংসা নেই তার,ভালো মেয়ে।ঈশাকে থামিয়ে মিহি প্রশ্ন ছুড়লো -“হলুদে তোমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে কয়েকজন যাওয়ার কথা ছিলো,গেলো না কেন ঈশা?”
—” ওয়াসিফ ভাইয়ার জন্যই তো যাওয়া হয়নি।”
—” কেন?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো মিহি।
— আর বলো না ভাইয়ার পরিক্ষা ছিল, অনার্স ৩য় বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা,গতকালই শেষ হল। মৃদুল ভাইয়ার বিয়েটাও হুটহাট হয়েছে না?পরিক্ষার পর ওয়াসিফ ভাইয়ার অফিস আছে না? সব কাজ শেষ করে ঢাকা টু কুমিল্লা আসতে আসতে রাতের আটটা বেজে গিয়েছিল। তাই আর যাওয়া হয়নি।
—” ওনি জবও করে? অনার্সে পড়লে জব করা যায় নাকি?”
—“হ্যা। এসএমসি কোম্পানির মার্কেটিং মেনেজার,ঔষধ কোম্পানি আরকি! জব নিয়েছে ছয়মাসও হবে না।আন্টি বলেছিল মাস্টার্স শেষ করে তারপর জব নিতে। কিন্তু কে শুনে কার কথা!
—” ঘ্যারত্যাড়্যা একটা। আচ্ছা ওনার বাবা কিছু করে না?”
—“করবে না কেন? করে তো। বাইং হাউজের হেড অফিসার”।
গল্প করতে করতে ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসলো। দুজনে উঠে একদম নামাজ শেষ করে তবেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো।
সকালবেলা।
ঈশাদের বাড়ির কাজের মেয়ে জবা নাস্তা বানাচ্ছে। হাতে হাতে সাহায্য করছেন ফরিদা বেগম(ঈশার মা)ও তার ছোট বোন ফিরুজা বেগম। ফরিনা বেগম তার ছেলে ওয়াসিফের রুমে যাচ্ছে, হাতে এক কাপ চা।ওয়াসিফের একটা অভ্যাস হল ঘুম থেকে উঠে খালি মুখে এক কাপ চা খাওয়া,এরপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে সে। রুমে এসে বিছানায় বসলেন তিনি। চায়ের কাপটা টি টেবিলে রেখে ছেলের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে ডাকলো তাকে। ঘুমকাতুরে ওয়াসিফ বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে তখন। ফরিনা বেগম ফের ডাকলেন তাকে-“ওয়াসিফ? এই ওয়াসিফ? সকাল হয়ে গেছে,উঠ খোকা। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো!”
ওয়াসিফ উঠে বসলো। ছেলে উঠছে দেখে চলে যেতে গেলেই ওয়াসিফ মায়ের হাত ধরে বসতে ইশারা করল।ফরিনা বেগম বসলেন। ওয়াসিফ একচুমুকে চা শেষ করে মায়ের সামনে বসে তার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো। ছেলের এমন কান্ডে তিনি অবাক হলেন না,একদমই না। কারন ওয়াসিফ প্রায় এমন করে বায়না ধরে। ছেলের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন- “কী?”
— “আগে বলো বললে রাগ করবে না…?”
—“শুনি আগে?”
—“মৃদুল ভাইয়ের শালী মিহিকে তোমার কেমন লাগে আম্মু? ”
—“খুব মিশুক একটা মেয়ে একদম আমাদের ঈশার মতো।ভীষন ভালো মেয়ে,ওকে আমার পছন্দ হয়েছে। মনের মতো,দেখেই বুঝা যায় নম্র, ভদ্র। তা তুই হঠাৎ ওর কথা জানতে চাইছিস কেন?”
—“ইয়ে না মানে……
—” ইয়ে মানে কি? পছন্দ করিস?”
—” আসলে হ্যা আম্মু।”( নিচের দিকে তাকিয়ে বললো ওয়াসিফ)
—“শুধুই পছন্দ করিস? ”
—“জানি না।”
—” মেনে নিলাম।”
— “কি মানলে”( মায়ের কথায় অবাক হল সে)
—” তোর পছন্দকে। তবে এনিলার মত ও তোর প্রেমে পড়বে বলে মনে হয়না। যা বুজলাম ছেলেদের সাথে একটু কমই কথা বলে। মিহাদের সাথেই ভালো করে কথা বলে না। আর আমাদের সাথে,ঈশার সাথে কি সুন্দর হাসে!
—“ওর হয়ে চ্যালেঞ্জ করছো? ”
—” না,শুধু বললাম আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না।তার আরেক প্রমাণ মিহিকে দিয়ে পাবি।”
—“এনিলার কথা ছাড়োতো! আমি জানি মা তুমিই সেরা।”( বলেই জড়িয়ে ধরলো)
—“হইছে ছাড় এখন,তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে আয়”।
মাকে ছেড়ে দিলো ঠিকি কিন্তু নাস্তা করতে গেলো না।মোবাইল নিয়ে শুয়ে পরল আবার। ফরিনা বেগম ফের ডাকতেই ওয়াসিফের উচ্চ আওয়াজ ভেসে আসলো-“খাবো না এখন,পরে খাবো।”
ঘুমঘুম চোখে মোবাইলে কয়টা বাজে দেখতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মিহি। আটটা বেজে দুই মিনিট। এত বেলা হয়ে গেলো টেরই পেলো না। বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় ঈশাকে ডেকে গেলো সে। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো সে আবার ঘুমাচ্ছে। ঈশাকে জোড় করে উঠিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে চিরুনি নিয়ে বসলো ডেসিন্টেবিলের সামনে। এরপর দুজনে পরিপাটি হয়ে বের হয়ে গেল নাস্তা করতে।
ডাইনিং টেবিলে এসে ওয়াসিফকে দেখা গেলো।তারমানে তিনিও ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছে। ভাবলো মিহি। ভাইকে দেখে মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসলো ঈশা। ঈশার মা ফরিদা বেগম নাস্তা নিয়ে আসছেন রান্নাঘর থেকে। ঈশাকে দেখেই তিনি শুধালেন-“কি নবাবের বেটি এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলেন যে?”
—“আহ আপা আগে খেতে দাও। খাওয়া শেষ হলে নাহয় বকবে।” ফরিনা বেগম বললেন। ওনার সাথে তাল মিলিয়ে ঈশার ছোট খালামনিফিরুজা বেগম বললো–“ঠিকি বলছে আপা,ওরে কিছু বলিও না,মাঝেমধ্যে একটু তো দেরি হবেই”।
ঈশার ফুফু বললেন -“নতুন বউডা একা একা নাস্তা করলো, মিহাদ ছাড়া কেউ আইলো না।”
ফুফুর প্রতিউত্তরে মিহি বললো – “আসলে হইছে কি আন্টি, ঈশা কালকে গল্প বলতে বলতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গেছে,সত্যি বলতে ফজরের আজান শুনা গেছিলো। তাই দুজনে একদম নামাজ পড়ে তারপর ঘুমিয়েছি আর সেজন্যই উঠতে দেরি হয়ে গেছে”।
মিহি কথাগুলো বলছিল ঈশার ফুফু আমিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে। লাস্ট অর্থাৎ “দেরি হয়ে গেছে” এই কথাটা বলার সময় মুচকি হেসে ঈশার দিকে তাকাতেই দেখলো ঈশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মনে হয় যেন বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে মিহি। পরক্ষনেই এমনভাবে তাকালো যেন এক্ষুণি কেঁদে দিবে ঈশা।বাড়ির সবাই মিলে যেন তাকে এক্ষনি পিষে ফেলবে। মিহি তার এমন চাহনিতে চমকালো, ভড়কে গেলো খুব। আড়চোখে ওয়াসিফকে দেখে নিল একবার,ওয়াসিফ মিটিমিটি হাসছে। ঈশা ওয়াসিফের হাসি দেখে শব্দ করে কেঁদে দিলো। উপস্থিত সবাই তার এমন কান্ড দেখে হাসতে লাগলো।
আসল কথা হচ্ছে এ বাড়ির নিয়ম সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হয়। মিহি না জানলেও এ বাড়ির মেয়ে ঈশা তো ঠিকই জানে। তাই মায়ের ভয়ে কেঁদে দিয়েছিল সে। ভাগ্যিস ফুফু খালামনিরা ছিলো!
খাওয়া শেষে মৃদুলের রুমে আড্ডা বসেছে। উপস্থিত আছে ইলমা আপু, তার মেয়ে ঐশি,ঈশা,মিহি,ওয়াসিফ, মৃদুল আর মিলি। এমন সময় হাজির হল মিহাদ, পিছনে ব্যাগ স্পষ্ট। জরুরী কাজে এখনই মেসে ফিরতে হবে তার। আগামীকাল বৌ ভাতে সে থাকতে পারবে না।বিদায় নিতে এসেছে সবার কাছে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই একটু ঘুমালো। বিকেল হতেই ফরিনা বেগম মিহি আর ঈশাকে নিয়ে মার্কেটে গেলেন। বৌ ভাতের অনুষ্ঠানের পর মিহি তার পরিবারের সাথে ফিরে যাবে তাই তাকে কিছু কিনে দিবেন ফরিদা বেগম। নিজে ব্যস্ত বলে বোন আর মেয়েকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। ওয়াসিফ তখন ঘরে বসেই ল্যাপটপে তার অফিসের কাজ করছিলো। একসপ্তাহ সময় নিয়ে মায়ের সাথে এসেছে সে,কিন্তু ল্যাপটপের মাধ্যমে অফিসের কাজ শেষ করছে । মোবাইলে টুংটুং শব্দ আসায় তাকাতেই দেখলো ঈশার মেসেজ। সিন করে বিড়বিড়ালো লেখাগুলো — ভাইয়া আমরা মার্কেটে আসছি,রসুলপুরের বড় মার্কেটে। আমার সাথে তোমার আম্মু আর মিহি আপু আছে। আসবে নাকি?”
চলবে…