ইস্ক সাহেবান পর্ব -০৬

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-৬||

★———ইফতি আমার ফুফাতো বোন তুমি কেন বলোনি দাদু? ফুফি মারা গেছেন কিন্তু আঙ্কেল? আঙ্কেল কোথায়? ইফতির আসল বাবা আসল পরিবার কোথায় দাদু? কেন ইফতি অন্য একটি পরিবারে বড় হয়েছে? ইবাদ দিদার মাহসানের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক প্রশ্ন করতেই থাকে। দিদার মাহসান প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,

—-সবকিছু জানতে নেই দাদুভাই। ইফতি আমার বড় শখের। তোমাকে আমি যতটা ভালোবাসি ততটা ভালো আমি ইফতিকেও বাসি। ইফতির আচরণ দেখেছো তুমি? মেয়েটা বড্ড লক্ষি। দাদুভাই! তোমার দাদু আজ পর্যন্ত কোনো ভুল করেনি। আমার সমস্ত কাজের পেছনে কোনো না কোনো কারণ নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। তুমি আমায় ভুল বুঝো না। কথা শেষ করেই দিদার মাহসান বেরিয়ে গেলেন। ইবাদ কিছুই বুঝতে পারছেনা। প্রশ্নের মারপ্যাঁচ ইবাদ সইতে পারছে না। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো ইবাদ। ক্লান্ত দেহ নিয়ে কোনো মতে রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। উপর থেকে মারিয়াম কে বলল,

—-মারু?

—জি ভাইসাব!

—একটা কফি বানিয়ে দিস তো ভাইয়াকে।

—আনতাছি ভাইসাব তুমি যাও। ইবাদ রুমে ঢুকে পড়ে। রকিং চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে দিলো। ফোন হাতে নিয়ে সাহেবান দিয়ে সেভ করা নাম্বারটিতে কল দিলো। এটাই ইবাদের একমাত্র শান্তির জায়গা। ইবাদের শান্তি। ইবাদের সমস্ত ক্লান্তি দূর করার জন্য এই একটা কন্ঠে মি. ডাক্তার শব্দটিই যথেষ্ট। কান থেকে ফোন সরিয়ে নিলো ইবাদ। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নাম্বার বন্ধ আসছে। এই অসময়ে নাম্বাত তো বন্ধ থাকে না। কি হলো মেয়েটার? ইবাদ নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো। ইবাদের ভাবনা কেটে উঠলো মারিয়ামের ডাকে,

—– ভাইসাব?

মাথা তুলে মারিয়াম এর দিকে তাকালো ইবাদ। ভ্রু কুঁচকে কন্ঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

—ওদিকে রাখ। আর তোকে কত বার বলেছি শুধু ভাইয়া বলবি। কি ভাইসাব বলিস? আর যেন না শুনি।

—অভ্যাস হইয়া গেসে যে। মাথা চুলকে বলে মারিয়াম।

—চেঞ্জ কর। যা এখন…. ইবাদের মৃদু ধমকে মারিয়াম ভড়কে গেল। দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল মারিয়াম। কফির মগ তুলে চুমুক দিল ইবাদ। দ্বিতীয় চুমুক দিতেই ইবাদ থেমে গেল। ইবাদের কানে এলো একটি মিষ্টি কন্ঠস্বর। ইবাদ রকিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ইবাদের পাশেত ঘরটায় ইফতি রয়েছে। কফির মগ হাতে নিয়েই ইবাদ ইফতির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজা খোলা থাকায় ইবাদ দরজা ঠেলে একটু উঁকি দিতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। ইফতির হাতে গিটার। চুল গুলো খোলা। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় বেসামাল উড়ছে ইফতির চুল। ইফতির চোখ বন্ধ। গিটার এর সুরের সাথে সাথে ইফতি গাইতে থাকে,

★এই মন পড়েছে আমার বড় দোটানায়
প্রেম বয়ে আনলো হঠাৎ দমকা হাওয়ায়…

এই আশিকি… আশিকি….
করলো কি জাদু হায়….

এই আশিকি…আশিকি
করলো কি জাদু হায়…..

উড়তে বসেছি, প্রেমে পুড়তে বসেছি
কখনো আগে হয়নি এমন আমার সাথে

বুঝতে চেয়েছি, তোকে খুঁজতে চেয়েছি
লেখা আছে সে সবই কারণ আমার হাতে…

এই আশিকি….আশিকি
করলো কি জাদু হায়….

সরে আসে ইবাদ। আর শুনবে না। ইফতির কন্ঠস্বরে কারো জন্য মারাত্মক ভালোবাসা ভেসে আসছে। ইফতিকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে ইবাদ। এইতো সন্ধ্যে বেলায় এই মেয়ে কত ভাঙচুর করলো আর এখন? ইবাদ কফির মগ রেখে আবারো রকিং চেয়ারে বসলো। হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই ইফতির গান গাওয়ার দৃশ্য ভেসে উঠলো বন্ধ চোখের সামনে। ইবাদ সোজা হয়ে বসে পড়লো।

—–কি ভাবছি আমি? উফফফ! আমার মাথা শেষ… দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ইবাদ। এক হাতের মুঠোই টেনে ধরে মাথার চুল। ইচ্ছে করছে সমস্ত চুল ছিড়ে ফেলতে। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালো ইবাদ। ইফতির ঘর থেকে আসছে আওয়াজ। ইবাদ দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে ইফতির ঘরে গেল। নাহিদা বেগম কে দেখে হাতের গিটার দিয়ে ইফতি নিজের মাথায় আঘাত করেছে। বারংবার আঘাতে ইফতির কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। ইফতির এমন ভয়ানক রুপ মেনে নিতে না পেরে নাহিদা বেগম কেঁদে দিলো। ইফতিকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। ইবাদ দ্রুত গিয়ে ইফতির হাত থেকে গিটার নিয়ে নিলো। ইফতি ছটফট করতে থাকে। ইবাদ ইফতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইফতির মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,

—–শান্ত হোন আপনি। এমন কেন করছেন? শান্ত হোন প্লিজ। ইফতি যখন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। ইবাদ আরো শক্ত করে চেপে ধরে। ইবাদকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ইফতি। নিজের মাথার চুল টেনে ধরতেই ইবাদ ইফতির গালে চড় বসালো। ইফতি সাথে সাথে ইবাদের বুকে ঢলে পড়ে। ইবাদ ইফতিকে দু’হাতে আগলে নেয়। নাহিদা বেগম কাদঁতে কাদঁতে ফ্লোরে বসে পড়ে। ইবাদ ইফতিকে জড়িয়ে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ইবাদের শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। এই কয়দিনে যে মেয়ের টু শব্দ ইবাদের কানে আসেনি সেই মেয়ের এমন আচরণ ইবাদকে ভাবিয়ে তুলেছে। ইবাদ কিছুতেই বুঝতে পারছে না কি কারণে ইফতি এমন করছে। এতটা বদরাগী, বদমেজাজি তো ইফতি না। ইফতিকে নিজের থেকে হালকা সরিয়ে ইফতির রক্তে মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইবাদ। দিদার মাহসান নাহিদা বেগম কে নিয়ে বেরিয়ে আসেন রুম থেকে। ইবাদ ইফতিকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ইফতির কপাল,গাল, গলা থেকে রক্ত পরিষ্কার করে ইফতির মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিলো ইবাদ। ব্যান্ডেজ শেষে ইবাদ ইফতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই আচরণের সাথে ইবাদ পরিচিত। কিন্তু ইফতি তো এমন না তাহলে কেন? ইফতি তো সুস্থ একজন মানুষ। সুস্থ হয়েও কেন অসুস্থদের মত আচরণ করছে ইফতি? ইবাদ উঠে আসতে নিলেই থেমে গেল। বিছানায় বসে ইফতির হাতের দিকে তাকালো ইবাদ। হাতের রগে ইনজেকশনের দাগ। মোটা সিরিজের ইনজেকশন হওয়ায় দাগ এখনো রয়েছে। ইবাদ ভালো করে দেখতেই দেখলো একবার না একাধিক বার ইনজেকশন পুশ করায় ইফতির হাতের রগ ফুলে গেছে। যার কারণে দাগ বসে গেছে হাতে। ইবাদ ইফতির মুখের দিকে তাকালো। ইফতির পুরো ঘর ইবাদ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো সিরিজ পেলো না।

—– ইফতি যদি ড্রাগ এডিক্ট হয় তাহলে তো কিছু না কিছু থাকবে। কিন্তু তা তো নেই। যদি এমন টা না হয় তাহলে ইফতির হাতে কিসের দাগ ওটা। আমি ভুল হতে পারি না। ওটা ইনজেকশনের সুইয়ের দাগ। কিন্তু ইফতির শরীরে কিভাবে কি? ইবাদের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আলমারি ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়ে ইবাদ। ইফতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু আগেই মেয়েটি কত সুন্দর গান গাইছিলো আর এখন? কি থেকে কি হচ্ছে ইবাদ কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

★নাহিদা বেগমের পাশে বসতেই নাহিদা বেগম দিদার মাহসান কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। দিদার মাহসান নাহিদা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

—-তুই আমাকে ভুল বুঝছিস?

—-আমার মেয়েকে রেহাই দিয়ে দাও মামা। আমার মেয়ে কেমন করছে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আমার ফুলের মত মেয়ের গায়ে এই দু’দিনে হাজার দাগ বসে গেছে। আমি পারছি না মামা ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে।

——আমি তোর মেয়ের জীবন বাঁচাতে চাইছি রে। আমি তোর মেয়ের জীবন দুর্বিপাকে ফেলতে চাইছি না।

—–মানে? অশ্রুসিক্ত নয়নে দিদার মাহসানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো নাহিদা।

—–ইবাদের একজন বন্ধু আছে ইরফান। ও অসুস্থ! ইবাদ ওর চিকিৎসা করে। ইরফান সেদিন এসেছিলো। ইফতিকে দেখার পর ইরফানের আচরণ আমার কাছে ভালো ঠেকলো না। আমি পরে ইবাদের ঘরে যেতে গিয়ে শুনেছি ইরফান ইফতি কে পছন্দ করে। ইরফান অনেক ভয়ংকর একটা ছেলে। আমাদের ইফতির জীবন শেষ হয়ে যাবে। ইরফান যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে নিজেকেই জানোয়ারের মত আঘাত করে। সেখানে আমার নাতনী কিভাবে ভালো থাকবে? আমি সবটা শোনার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ইফতিকে আমার ইবাদের জন্য নিয়ে আসবো। আমার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই রে মা। আমি ইবাদ কে বলেছি আমার অনেক আগের ইচ্ছে। মিথ্যে না বললে যে ইফতিকে ইবাদ বিয়ে করবে না। আর আমার বিশ্বাস ইফতি ইবাদের মন খুব শীগ্রই জয় করে নেবে। দুজন দুজনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেই তুলবে। তুই চিন্তা করিস না। দিদার মাহসানের কথা শুনে নাহিদা বেগম শান্ত হয়ে পড়লো।

★ রাত ৩টা!! ইবাদ বার বার ‘সাহেবান’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটিতে কল করেই যাচ্ছে। ফোন বার বার বন্ধ বলছে। ইবাদের সব কিছু অসহ্য লাগছে। বারান্দার দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে ইবাদ। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে ভাসতে থাকা নামটির দিকে তাকিয়ে থাকে ইবাদ।

——কোথায় আপনি? আপনার কণ্ঠস্বরটা কি আমি একটু শুনতে পাবো না? আমার অস্থিরতা যে কিছুতেই কমছে না সাহেবান…এই পরিবেশ, এই রাত আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাই। আপনি ছাড়া যে এটা অসম্ভব। আপনি ছাড়া আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবো না। আপনি আমার প্রিয়জনের সাথে সাথে প্রয়োজনও। কোথায় আপনি? সাহেবান……

চোখ বন্ধ করে নিল ইবাদ। হৃদয়ের গহীন থেকে আসা ডাক কি উপেক্ষা করতে পারবে ইবাদের সাহেবান। ইবাদের অন্তর-আত্মার আহুতি কি পৌঁছাবে ইবাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় সাহেবানের কাছে? ★

চলবে…..?

||ইরফান কে দেখা যাচ্ছে না কেন? নো চিন্তা ডু ফুর্তি! ইরফান কে নেক্সট পর্বে নিয়ে আসবো😁।||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here