উমা পর্ব -১৬

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#১৬তম_পর্ব

রুদ্রকে এড়িয়ে যেতে চাইলে তার স্পর্শ গভীর হলো। আকুল স্বরে বললো,
“এই একটা সপ্তাহ কিভাবে কেটেছে আমি জানি। আমার বুকের কুঠরে হাহাকার শুরু হয়েছিলো। আমি সত্যি নেশাখোর। দেখো না, মদ ছেড়ে তোমার নেশায় মত্ত হয়েছি। আর এই নেশাটা মারাত্নক। রক্তে মিশে গেছে। তুমি ছাড়া জীবনটা যে ক্ত অসহায় সেই ঝলক পেয়েছি। চাইলেও তোমার কন্ঠ শুনতে পারছিলাম না, তোমার কোমল মুখখানা দেখতে পারছিলাম না। লোকে বলতো আমি নাকি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কিন্তু আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এই রুদ্র সিংহ ও প্রেমে পড়েছে। উমার প্রেমে, বড্ড ভালোবাসি তোমায় বউ”

রুদ্রের ঈষৎ কম্পিত কন্ঠের প্রেম নিবেদন শুনে থমকে যায় উমা। কি উত্তর দিবে, জানা নেই। উমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রুদ্র খানিকটা আহত হয়। এক অজানা হাহাকার বুক চিরে ফেলছে যেনো, নীল বিষাদ দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে অন্তরটাকে। এতদিন কেবল মন নিয়ে পুতুল খেলাটাই জানাছিলো তার। কখনো মনের আদান প্রদানের খেলাটি তার খেলা হয় নি। মনের আদান প্রদান যে এই ভুবনের সবথেকে ভয়ংকর খেলা। একবার এই খেলায় আসক্ত হলে পৃথিবীর সবথেকে অকর্মন্য পদার্থে পরিণত হয় এই মানুষ। যেমনটা রুদ্র হয়েছে। মারাত্মক গুরুত্বপূর্ন কাজ ফেলে সে চলে এসেছে তার প্রেয়সীর নিকট, এই আশায় যে প্রেয়সীর সন্নিকটে শান্তির পরশ পাবে। কিন্তু প্রেয়সীর মনের দরজায় কড়া নাড়া কি এতই সহজ! যে প্রেয়সীর কাছে রুদ্র কেবল ই দুঃস্বপ্ন। উমার নীরবতাকে উত্তর রুপে গ্রহন করলো রুদ্র। তার কোমড় ছেড়ে ভেতরে চলে গেলো সে। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। বড্ড ক্লান্ত সে, ক্লান্তির ভারে চোখ বুঝে আসছে বারংবার। কাজের ভারে তিন দিন যাবৎ চোখ এক করে নি সে। এই ক্লান্তি এখন যম রুপে তার সামনে প্রকট হচ্ছে। ভগ্ন হৃদয়ের চিনচিনে ব্যাথা যেনো ক্লান্তিকে আরোও বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। বারান্দা ছেড়ে উমা পাশে বসে তার। আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,
“খাবেন না?”
“ক্ষুধা নেই”
“দেরি হলো যে আসতে?”
“কাজের চাপ ছিলো বড্ড, চাইলেও শেষ নামাতে পারি নি।”
“অহ”
“কিছু বলবে?”

কপালে বাহু ঠেকিয়ে রেখেছে রুদ্র। রুদ্রের প্রশ্নে উমা কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। মনের কথাগুলো জট পাকাচ্ছে। ঠিক সাজানো মুশকিল হয়ে উঠছে, রুদ্রের প্রতিক্রিয়া ও তার অজানা। লোকটি যে কখন কি করে তা এই দু মাসেও আন্দাজ করতে পারে নি সে, মুহুর্তে গোখরার ন্যায় বিষাক্ত তো মুহুর্তেই শ্বেত পদ্মের ন্যায় কোমল এবং স্নিগ্ধ। উমার নীরবতা দেখে হাত সরিয়ে উঠে বসলো রুদ্র। চোখ কুঞ্চিত করে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? কুলুপ আটলে যে বড়?”
“আসলে…”
“কি?”
“আমি কলেজে ভর্তি হতে চাই।”

আড়ষ্টতা কাটিয়ে একদমে কথাটা বললো উমা। রুদ্রের নয়ন সংকুচিত হলো। মুখোভাব বদলালো কিঞ্চিত। উমা উত্তরের অপেক্ষায় বসে রয়েছে। এক ক্ষীন আশা জন্মালো, রুদ্র তাকে ভালোবাসলে এই আবদারটুকু রাখা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। অন্যদিকে, মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ প্রবল ভাবে বিরোধ করছে রুদ্র কখনোই তার ইচ্ছার দাম দিবে না। সে কেবল ই তার পার্থিব শরীরটাকে ভালোবাসে। অন্তঃরাত্মাকে ভালোবাসার রহস্য তার অজানা। উমার চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে রুদ্র বলে উঠলো,
“পড়তে ভালো লাগে তোমার?”
“প্রচন্ড”

জড়তা কাটিয়ে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে উঠলো উমা। উমার উৎসাহিত উজ্জ্বল মুখখানা দেখে রুদ্র খানিকটা অবাক হলো। যাকে ভালোবাসে দাবী করছে তার ইচ্ছার ভনক পেতে তার এত সময় লেগে গেলো। রুদ্র স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“আমি বাবার সাথে কথা বলবো দেখি। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। রাত হয়েছে।”

বলেই পুনরায় গা এলিয়ে দিলো রুদ্র। উমার মনের আঙ্গিনায় যেনো কোমল, স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে গেলো। এ যেনো এক অন্য আনন্দ। রুদ্র নামক ব্যাক্তিটিকে সত্যি ই বুঝতে পারে না সে। মস্তিষ্ককে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে অন্তরটা বলে উঠলো,
“সে আমাকে আশাহত করে নি। তার ভালোবাসাটা হয়তো একাংশ হলেও সত্যি”

১১.
গতরাতে শিশির পড়েছিলো বেশ। ঘাসগুলো ভিজে আছে, পা দিলেই শিশিরবিন্দু পা জোড়া আটকে ফেলছে। নগ্ন পায়ে শীতল স্পর্শ মন্দ লাগছে না উমার। সূর্যমামা বেশ আলসেমি করছে আজ৷ কিন্তু উমার আলসেমি করলে চলবে না। সে তার সময় মতো ফুল তুলবে। পুজোর ফুল তুলতে ভালো লাগে তার। নিরব কোলাহলবিহীন পরিবেশে একান্ত সময় কাটাতে মন্দ লাগে না। এর মাঝেই পা ঘষার শব্দ কানে আসে উমার। পেছনে তাকাতে দেখতে পায় সফেদ পাঞ্জাবীতে শাশ্বত হাটাহাটি করছে। উমাকে দেখেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। এগিয়ে এসে বললো,
“নগ্ন পায়ে হাটাহাটি কি তোমার অভ্যাস?”

উমাও প্রতিত্তরে হেসে বললো,
“ফুল তোলাটা আমার অভ্যাস। আপনি তো ছাদে হাটেন, আজ এ মুখো?”
“শিশিরের ছোয়া পেতেই এখানে আসা। সেদিন বলছিলে তুমি পড়তে জানো, কতদূর পড়ালেখা করেছো?”
“স্কুল পাশ করেছি এই বছর।”
“সামনে পড়ার ইচ্ছে আছে?”
“ইচ্ছে তো আছেই, কিন্তু সেই ইচ্ছে বাস্তবায়ন কবে হবে সেটার অপেক্ষা। আমার কথা ছাড়ুন। আপনি যে জন্য এখানে এসেছেন সেই কাজ কি পূরণ হলো?”

শাশ্বত চুপ করে কিছুক্ষন উমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। প্রত্যন্ত গ্রামের ষোড়শীর বুদ্ধিতে সে সত্যি অবাক। এই বাংলার আনাচে কানাচে কত মেধা লুকিয়ে আছে। শুধু তাদের চাই সামান্য পথপ্রদর্শন। শাশ্বত মুচকি হেসে বললো,
“তুমি খুব বুদ্ধিমান মেয়ে জানো তো?”
“মনগড়া কথা সব”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো উমা। শাশ্বত তাকে আশ্বত করে জোর দিয়ে বললো,
“সত্যি, বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“নাহ”
“তোমাকে দেখলে আমার একটা চরিত্রের কথা খুব মনে পড়ে জানো তো”
“কোন চরিত্র?”
“বিনোদিনী”
“সেটা কোন চরিত্র?”
“চোখের বালি পড়ো নি?”
“পাঠ্যপুস্তক কিনতে পেরেছি এই কত!”
“আমার কাছে আছে, নিও ক্ষন”
“আমার ফুল তোলা শেষ, যেতে হবে”
“রক্তজবা তুলেছো?”
“তুলেছি। আপনার ভালো লাগে?”
“খুব, রক্তজবা আমার এতো ভালো লাগে কেনো জানো, কারণ জবার মাঝে এক শক্তি আছে, এক অন্যরকম শক্তি। যে একই সাথে কোমল আবার কঠোর। তাই তো এই জবা নারীর খোঁপার অলংকার হয় আবার হয় অসুর বধের আভুষণ”

শাশ্বতের কথা বরাবর ই অবাক করে উমাকে। এই অরাজকতায় এতো স্নিগ্ধ মানুষ কি করে হয় ভেবে পায় না সে। মুচকি হেসে বলে,
“থাকুন তবে, আজ আসি”
“এসো”

অমায়িক হাসি দিয়ে শাশ্বত কথা বললো৷ উমা অপেক্ষা করলো না। পা বাড়ালো অন্দরে। শাশ্বত হাসিটা স্থায়ী করে সামনে এগোলো। তাদের এই ক্ষণটার সাক্ষী হলো বাগান, নীল আকাশ এবং এক জোড়া রক্তিম চোখ।

অভিনব সিংহ পায়চারী করছেন। রাগ দমানোর চেষ্টা বারংবার ব্যার্থ হচ্ছে। তার শক্ত চোয়াল এবং রক্তিম চোখ দেখে যে কেউ ভয় পাবে। কিন্তু রুদ্রের মনে ভয় নেই। সে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রের সামনে এসে বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠেন,
“একটা কাজ তুমি ঠিক ভাবে করতে পারো না। একটা কাজ ও না। কি দরকার ছিলো ওই অফিসারকে ছোড়া মারার কি দরকার ছিলো। ভাগ্যিস দীপঙ্কর ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। তোমার কোনো আন্দাজ আছে তুমি কি করেছো? আমার ক্ষমতা আছে বলে তুমি যা খুশি করবে?”
“বেঁচে আছে তো জানোয়ারটা তাহলে কিসের সমস্যা?”

রুদ্রের বেপোরোয়া উত্তরে আরো ও মেজাজ বিগড়ে গেলো অভিনব সিংহের। তেড়ে এসে সজোড়ে আঘাত করে বসলেন তিনি। আকস্মিক ঘটনায় ধাতস্থ হতে কিছু সময় লাগলো রুদ্রের। অভিনব সিংহ এর পর যা করলেন তাতে রুদ্র বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেলো। রুদ্রের ঘাড়টা শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রেখে বললেন,
“আমার এখন ইচ্ছে করছে তোর অবস্থাও ওই লোকের মতো করতে। ভুলে কেনো যাস তোর নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতা নেই। আমি না বলা অবধি শ্বাস ও নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এই শেষ বারের মতো বলছি, আমার বলার আগ পর্যন্ত কিছু করবি না তুই।”

অভিনব সিংহের কথাগুলো শুনে থমকে গেলো রুদ্র। নিবৃত্ত চিত্তে ছাই চাঁপা আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। রাগ সংযত করার জন্য চোখ বুজে নিলো সে। পরমুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। শক্ত হাতে অভিনব সিংহের হাত সরিয়ে নিলো। তারপর তার চোখে চোখ রেখে বললো…….

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here