উমা পর্ব -১৭

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#১৭তম_পর্ব

পরমুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। শক্ত হাতে অভিনব সিংহের হাত সরিয়ে নিলো। তারপর তার চোখে চোখ রেখে বললো,
“সম্মান করি বলে আমাকে গোলাম ভেবো না। ভুলে যেও না এই রুদ্র সিংহ বাদে অভিনব সিংহ কিছুই না। সকল দৈত্যের একটা জানপাখি থাকে, পাখিকে টিপ দিলেই দৈত্যের পরাণ ফুর”

অভিনব সিংহের চোখে কালো ভয়ের ক্ষীন মেঘ জমলো। আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
“তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?”
“ভয় পাওয়া না পাওয়া আপনার ব্যাপার। আমি সত্যিটা বললাম। আর একটা কথা, আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি নেবো আপনি নয়৷ আমার যদি কাউকে মাটিত গাড়তে ইচ্ছে হয় আমি গাড়বো। যদি বাঁচাতে ইচ্ছে করে তবে বাঁচাবো। বাবা, বাবার মতো থাকুন। এর পর থেকে আমার উপর কোনো হুকুম জারি করতে আসবেন না, নয়তো ওই কাস্টমস অফিসারের মতো আপনার হাল হতেও দু মিনিট লাগবে না”

দাঁতে দাঁত পিষে ধীর স্বরে কথাটা বললো রুদ্র। দৃষ্টি স্থির, দৃঢ়। অভিনব সিংহের পা নড়বড়ে। পুত্রের এমন পরিবর্তন যেনো হজম হচ্ছে না। যে ঘোড়ার লাগাম শুধু তার হাতে ছিলো আজ সেই ঘোড়া লাগাম ছাড়া হতে ছাড়া। লাগাম ছাড়া ঘোড়া যে কতটা মারাত্মক হতে পারে সেই ধারণা তার আছে। রুদ্র বহমান নদী কখনোই ছিলো না, সে ছিলো আগ্নেয়গিরির লাভা। অভিনব সিংহ নিজের স্বার্থপূ্তির জন্য এতকাল এই লাভাকে ব্যাবহার করে এসেছেন। কিন্তু আজ সেই আগ্নেগিরির লাভা তার বিরুদ্ধেই প্রবল বেগে প্রবাহ হচ্ছে। একবার স্পর্শ করলেই সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম। রুদ্র অভিনব সিংহের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অভিনব সিংহ ধপ করে বসে পড়লেন। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্ত বয়ে গেলো। কপালে ঘাম জমছে। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগলো কিন্ত হেরে যাবার পাত্র তিনিও নন। রুদ্র ঠিক ই বলেছে প্রতিটি দৈত্যের একটি প্রানপাখি থাকে। সেই প্রানপাখির গলা টিপলেই দৈত্যের পরাণ ফুরুত। আর রুদ্রের প্রানপাখি হলো উমা। মাথার চুল রোদে পাকে নি অভিনব সিংহের। কুকুরের লেজ সোজা কিভাবে করতে হয় তার খুব ভালো ভাবেই জানা। মুখে বিকৃত হাসি ফুটে উঠলো অভিনব সিংহের।

রাত আটটা,
খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। অভিনব সিংহ, রুদ্র এবং শাশ্বতকে লক্ষী দেবী এবং উমা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। মালিনী সর্বদাই আলাদা খাওয়া দাওয়া করে তাই তার খাবার খাওয়া অনেক পুর্বেই শেষ। উমা এই ক দিন রুদ্রের জন্য অপেক্ষা করেছে। ভেবেছে হয়তো রুদ্র ই নিজ থেকে তার কলেজের কথাটা পাড়বে। কিন্তু এই ক দিন রুদ্র একবার ও কলেজের কথা তুলে নি। তাই আজ এক রাশ সাহস নিয়ে নিজ থেকে কলেজের আর্জি নিয়ে কথা বলবে উমা। শ্বশুরকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে আকুতির স্বরে বললো,
“বাবা, একটা কথা ছিলো।“

উমার জড়তাময় কন্ঠে খাবার মুখে তুলতে তুলতেও থেমে গেলেন অভিনব সিংহ। শাশ্বত অবাক নয়নে উমার দিকে তাকালো। তার বড় কৌতুহল হচ্ছে। মেয়েটি ঠিক কি বলতে চায়। রুদ্রের ভাবমূর্তির পরিবর্তন হল না। সে তার মত আয়েশেই খাবার খেতে লাগলো। অভিনব সিংহ ভ্রু কুঞ্চিত করে উমার দিকে তাকালেন, ধীর কন্ঠে বললেন,
“কি বলবে?”
“বাবা, আমি কলেজে ভর্তি হতে চাই। আমার মেট্রিকের ফলাফল ভালো। আমি খুব ভালো কলেজেই চাইলে পড়তে পারব।“

লক্ষী দেবী সুর টানলেন,
“কলেজে গিয়ে কি বিদ্যাবতী হয়ে যাবে?”
“মা, আমার পড়ালেখা করার ইচ্ছে আছে। আমি ডাক্তার হতে চাই।“
“কেনো গো, আমরা তো এতো পড়ালেখা করি নি,। আমাদের কি দিন চলতেছে না?”
“আমি সেটা বলি নি মা, আমি শুধু বলতে চাচ্ছি আমার পড়ার খুব ইচ্ছে। আগে আপনাদের সময়ের ব্যাপার আর এখন অনেক পার্থক্য। এখন মেয়েরা পড়ালেখা করছে। ডাক্তার হচ্ছে, উকিল হচ্ছে, ব্যারিস্টার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও নারী। হেসেল একজন নারীর জীবন হতে পারে না মা। একজন নারী প্রকৃতির সৃজন করে, সেই নারী সময় এলে অসুর ও বধ করে। তাহলে আমরা নারীরা কেনো নিজেদের এই ঘরের চার দেওয়ালে নিজেকে আটকে রাখবো। মা, এই গ্রামে একটা ভালো ডাক্তার নেই, আমি যদি সেই স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি তবে চেয়ারম্যান বাড়ির সম্মান হানি হবে না বরং বাড়বে।“

উমার এক দমে বলা কথাগুলো শুনে মুখে প্রসারিত হাসি ফুটে উঠলো শাশ্বতে্র। অভিনব সিংহ গলা খাকারি দিয়ে উঠলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
“বউ মা, আমার মনে হয় না চেয়ারম্যান বাড়ির সম্মান বাড়ানোর দায়ভার তোমার। মে্যেদের কাজ বাড়িতে, হাসপাতালে নয়। তোমার পড়ার ইচ্ছে, বাড়ি থেকে পড়। আমি মানা করব না। অহেতুক কলেজে পড়ে কি করবে?’

অভিনব সিংহের কথায় দমে গেলো উমা। শাশ্বত কিছু বলতে গেলো, কিন্তু অভিনব সিংহ তাতে বাধ সাধলেন,
“শাশ্বত, এটা আমার ঘরের ব্যাপার। তাই থেমে যাও।“

শাশ্বত হাত মুষ্টিবদ্ধ দাঁত চেপে বসে থাকে। ঠিক সেই সময় রুদ্র বলে উঠে,
“আমি উপজেলা যেতে চাই বাবা, এবার পার্টির নির্বাচনে আমিও পদ চাই। কতদিন আপনার ছায়ায় থাকবো বাবা?”
“মানে?”
“মানে টা স্পষ্ট, আমি একটা পোস্ট চাই। গ্রামের গুদামে বসতে আমার আর ভালো লাগে না। এমনি তেও আমার সপ্তাহে দুবার সেখানে যেতেই হয়। আমার টেন্ডরের কাজটাও শুরু হবে। গ্রামে বসে আপনার মুখ ডুবানোর থেকে সেখানে নিজের কিছু করা কি খুব খারাপ হবে? কেনোনো আমি আর উমা সেখানেই চলে যাই। উমার যদি কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছাই থাকে ক্ষতি কি? ওখানে তো সারাদিন হেসেল টানতে হবে না”

রুদ্রের এমন কথায় খানিকটা স্তব্ধ হয়ে যায় অভিনব সিংহ। উমার অবাক নয়নে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। মনের আঙিনায় এক মৃদু কল্লোল বয়ে যাচ্ছে। এক প্রশান্তির ঢেউ। চোখের কোন চিকচিক করছে উমার। বহুদিন বাদে কা্রোর স্নেহছায়া পেলো যেনো উমা। তার মাতাল, নিষ্ঠুর মানুষটা তার জন্য কথা বলবে এ যেনো নিছক কল্পনা। এর মাঝেই…………

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here