#এই_রাত_তোমার_আমার
#সানজিদা_ইসলাম
#১১তম_পর্ব
মানুষের মন বড়ই বেহায়া স্বভাবের না চাইতেও এমন মানুষের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে যে আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে না। তাকে নিজের করে চাওয়া আকাশ কুসুম স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। তবুও ভালোবাসে।কেনো ভালোবাসে তার উত্তর জানা নেই।আসলে কাউকে ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না। হঠাৎ করেই কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিকে ভালোবাসে ফেলে।আর তাকে ভালোবাসার জন্য কোনো কারণ প্রয়োজন হয় না।যাখন ভালোবাসা হয় তখন তার ধমক,চোখ পাকানো, অপমান সব কিছুই ভালো লাগে।আর ভালোবাসা মানে এটা নয় যে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কষ্ট, অবহেলা, অপমান, আঁঘাত পেয়ে তাকে ভুল বোঝা বা ভুলে যাওয়া ।ভালোবাসা মানে এটাই যে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে হাজারো কষ্ট পাওয়ার পর নিঃস্বার্থ ভাবে তাকেই ভালোবেসে যাওয়া।থাকনা অপর পাশের মানুষের মনে অন্য কারো বসবাস এক পাক্ষিক ভালোবাসার যে যন্ত্রনা তার মধ্যেও একটা সুখ সুখ ব্যপার আছে।আমি একজন কে ভালোবাসি মনে মনে তাকে নিয়ে হাজার কল্পনা করি কিন্তু সামনের মানুষটা আমার অনুভূতির কথা জানবেও না সেই অনুভূতি, যন্ত্রণা শুধু আমার হবে অন্যকারো না।
—উহু উহু
মাহিয়াত তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ফিমা এতক্ষণ বারান্দায় বসে মাহিয়াতকে ভালোবাসার কারণ বের করছিলো।কি কারণে সে মাহিয়াতের উপর দূর্বল? কেনো তাকে কড়া কথা শোনানোর পর তার কষ্ট হয়? কিন্তু ফলাফল শূন্য মাহিয়াতের সাথে তার কোনো সুন্দর মূহুর্ত নেই আর না আছে কোনো ভালো স্মৃতি বা সম্পর্ক তবুও ভালোবাসে হয়তো একটা পবিত্র সম্পর্ক আর কিছু পবিত্র বাক্যের জের ধরেই এই অনুভূতির সৃষ্টি।মাহিয়াতের গলা ঝাড়ার আওয়াজে সে তার ভাবনার ভূবন থেকে বেরিয়ে এলো।
—আসতে পারি?
—আপনার ঘর আপনার বাড়ি আপনি যখন খুশি যেখানে খুশি আসা যাওয়া করতে পারেন। আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই আমি তো কয়েকদিনের মেহমান মাত্র।
—বেস কথা বলতে পারেন দেখছি।আমি তো মনে করেছিলাম আপনি কথাই বলতে পারেন না বা খুবই শান্ত স্বভাবের কিন্তু এখন তো আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল করে দিলেন।
—পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয় সাহেব। আজকে আমাকে যেমন দেখছেন আমি কখনোই এমন ছিলাম না। একবার পরিস্থিতি আমাকে শান্ত করে দিয়েছিলো এখন আবার আস্তে আস্তে প্রতিবাদি হতে শিখাচ্ছে।
মাহিয়াত ফিমার একদম কাছ ঘেঁষে বসে পড়লো তারপর তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে বললো,
—পরিবর্তন ভালো বেগাম,শুধু মনে রাখবেন জীবনে যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজের মনবল হারাবেন না।
-নানা কারণেই জীবন চলার পথে আমাদের মনোবল ভেঙে পড়তে পারে। নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণ না হওয়া, সব সময় সমালোচনার মাঝে থাকা এবং জীবনে সফলতা না পাওয়ার কারণে যে কারোরই মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে। কিন্তু নিজেকে যদি খুব বেশি বিষণ্ণতার মধ্যে ফেলতে না চান তাহলে অবশ্যই নিজের মনোবল ধরে রাখতে হবে।
-যতো কষ্টই হোক না কেন মনোবল ভেঙে পড়তে দেয়া চলবে না। কারণ মনোবল ভেঙে পড়ার অর্থ আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাওয়া। এবং আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেলে আপনি নিজের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলবেন। এতে করে আপনি হেরে যাবেন কঠিন বাস্তবতার সামনে। জীবনটাকে সুখী করতে চাইলে মনোবল না হারিয়ে নিজেকে শক্ত করে তুলতে হবে। মনকে শক্ত করতে হবে।
-নিজেকে বদ্ধ না রেখে অন্যের মতামত গ্রহন করুন
নিজের মন মানসিকতা একটি জায়গায় বন্ধ করে না রেখে অন্যের পরামর্শ নিন।
-অতীত মুছে ফেলুন, অতীত নিয়ে বসে থাকবেন না
আপনার কোনো অতীত স্মৃতি আপনাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
-একই ভুল বারবার করবেন না ভুল থেকে শিক্ষা নিন
আপনি যদি একই ভুল বারবার করেন আপনার সাথে একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে এবং ফলশ্রুতিতে আপনার মনোবল ভেঙে পড়তে থাকবে। তাই ভুল বারবার করবেন না। প্রথম ভুল থেকে শিক্ষা নিন। দেখুন আপনার ভুলটি কোথায়। দ্বিতীয় বার সেই ভুলটি এড়িয়ে চলুন। এতে করে আপনার চিন্তা করার ক্ষমতাও বাড়বে এবং মানসিক শক্তিও বৃদ্ধি পাবে।
-নিজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রাখবেন না
আপনি যদি নিজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রাখেন তাহলে অন্য মানুষ নয় আপনি নিজেই নিজেকে ছোটো করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।যার দরুন একসময় আপনি প্রচন্ড হতাশায় ভুগবেন যা একসময় মারাত্মক আকার ধারণ করবে, আর মনে রাখবেন আপনি যত নরম হবেন মানুষ আপনাকে ততই দাবাতে চেষ্টা করবে তাই শক্ত হতে শিখুন। মানুষের জীবন এত সহজ নয়। বেঁচে থাকার জন্য প্রচন্ড স্ট্রাগেল করতে হয়। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি?
ফিমা হা হয়ে মাহিয়াতের কথাগুলো শুনছিলো,মানুষটা এত মোটিভেশনাল কথা বলতে পারে তা তার জানা ছিল না।তাই সে প্রশ্ন করেই বসলো,
—সত্যি করে বলুন তো আপনি সত্যি কি জব করছেন? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমার শিক্ষক আর আমি আপনার ছাত্রী আর আপনি আমাকে লেকচার দিচ্ছেন।
—হা হা হা তাই নাকি?বাদ দিন তো এবার বলেন সারারাত কি এখানে বসেই কাটিয়ে দিবেন নাকি ঘরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে? রাত তো অনেক হলো ঘুমাবেন না?
—এখন তো আর ঘুম হবে না। আমার রাত তো এভাবেই কাটে।আমি এখানেই থাকবো আপনি বরং ঘরে চলে যান।
—কেনো আপনার সাথে আমি থাকলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
—হ্যা তা তো হবেই এই রাত শুধু আমার আমার একার।এই নিঃসঙ্গতা আমার খুব প্রিয় আমি চাইনা এতে কেউ ভাগ বসাক।
—আচ্ছা তাহলে তো আমি আপনাকে একা ছাড়ছিনা বেগাম। আপনি একা এই সব কিছু অনুভব করবেন আর আমি সবকিছু থেকে বঞ্চিত থাকবো?নো নো আমিও তো দেখি আপনি কেনো এই রাতের আঁধার এত পছন্দ করেন কি এমন স্পেশাল আছে এতে।
—কিছুদিন আছি এই বাড়িতে ততদিন নাহয় এই পরিবেশটাকে আমাকে একাই উপভোগ করতে দিন তারপর নাহয় আপনি দেখে নিবেন। আপাতত এই বারান্দাটা আমার দখলে থাক আপনার তো সারাজীবন পারে আছে রাতগুলো উপভোগ করার। কিন্তু আমি তো কিছু দিনের মেহমান।
—এমন তো নাও হতে পারে। মানুষের মন পরিবর্তনশীল জানেন নিশ্চয়ই।
মাহিয়াতের কথার প্রেক্ষিতে ফিমা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো বিনিময়ে মাহিয়াত একটা রহস্যময়ী হাসি উপহার দিলো যার অর্থ ফিমার বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণ তারা দুজনেই নিরব থেকে অন্ধকার রাতের কোলাহল মুক্ত স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করল পাশেই গাছে বেশি ফুল ফুটেছে যার মাতাল করা গন্ধ পরিবেশটাকে আরো মহোনীয় করে তুলেছে।মাহিয়াতের নিজেরও খুব ভালো লাগছে এইরকম করে রাত জেগে কখনো অন্ধকারের সৌন্দর্য উপভোগ করা হয় নি।
কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর মাহিয়াত বললো,
—আগে কখনো রাত গুলো কে এভাবে দেখা হয়নি।ঘুমের বিভোর হয়ে আমরা এত সুন্দর জিনিস মিস করি তা আগে জানলে কোনো রাতই ঘুমিয়ে কাটাতাম না।
—আচ্ছা তাহলে রাতে না ঘুমিয়ে কাজ করতেন কিভাবে?আপনি জানেন না রাত জাগলে অনেক সমস্যা হয় রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, হার্টের সমস্যা হয়,ডায়বেটিসের ঝুঁকি থাকে,হজমে সমস্যা হয় এছাড়াও দৈনন্দিন রুটিনে ব্যাঘাত হয়।আরো নানান শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায় তাই পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন আছে শুধু রাত জেগে থাকলেই চলবে না শরীরের প্রশান্তির জন্য ঘুমের ও প্রয়োজন আছে।
—তাহলে তো আপনার ও ঘুমের প্রয়োজন আছে বেগাম তারাতাড়ি উঠুন এমন রাত জেগে থাকলে আপনার সাথে সাথে আমার বাবারও কষ্ট হবে।
—আমার এখন ঘুম আসবে না।আর এমনিতেও আমি সকালে বা বিকেলে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেব। আমার তো আর আপনার মত কাজ করতে হয় না। বেকার সারাদিন ঘুরে বেড়াই আর ঘুমাই তাই আমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আর আল্লাহ চাইলে আপনার সন্তান সুস্থ ভাবেই দুনিয়ার আসবে আমি প্রতিদিন তার কাছে প্রার্থনা করি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও যেন সে সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসে।আর এমনিতেও কারো বোঝা হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না।
ফিমার মন খারাপ হতে দেখে মাহিয়াত কথা বলে তাকে আবার আগের মত উল্লাসিত করার চেষ্টা করলো,
—আমার কাছে কিন্তু ঘুম পাড়ানোর ঔষধ আছে আপনি চাইলে আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।
—বললেই হলো। আমার ঘুম আসবে না আমি জানি।
—আমি যদি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেই তার বিনিময়ে আমাকে কি দেবেন?
—আমার কাছে আপনাকে দেওয়ার মত কিছুই নেই।
—আছে আছে আমি সময় হলে চেয়ে নেবো। এখান চুপচাপ আমার পায়ের উপর শুয়ে পরুন তো। জানেন নুহা কি বলে আমার কন্ঠে নাকি ঘুমের ঔষধ আছে যে নাকি আমার গান শুনবে সে ঘুমাতে বাধ্য আমিও তো দেখি ওর কথাটা কতটুকু সত্য।
ফিমা আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—আপনি গান গাইতে পারেন?
—এই তো একটু আকটু। আপনি পছন্দ করেন?
—হুম অনেক,বলেই মাহিয়াতের ঊরুতে মাথা রাখলো তারপর তার দিকে তাকালো। মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা দিচ্ছে।যেন পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েকে চকলেট বা বেলুন কিনে দেয়া হয়েছে।মাহিয়াত আনমনেই হাসলো মেয়েটাকে হাঁসি খুশি দেখলে মনটা একটু শান্তি পায়। অপরাধ বোধ টা একটু কমে যায়।সে ফিমার চুল থেকে কাটাটা খুলে নিয়ে আস্তে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গাওয়া শুরু করলো,মাহিয়াতের এমন স্নেহের স্পর্শ পেয়ে ফিমা চোখ বুজে ফেললো মনের ভেতরের দীর্ঘ নিঃশ্বাস আর চোখের জল বেরিয়ে এলো অজান্তেই।মাহিয়াত কি জানে তার এই ব্যাবহার ফিমাকে তার প্রতি কত দূর্বল করে দিচ্ছে।সে যে তার এমন নিঃসঙ্গ রাত তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে তার স্নেহের স্পর্শে কাটাতে চাইছিলো তা কি কোনো ভাবে জেনে গিয়েছিল?মাহিয়াত তার সাথে এমন আচরন করলে সে কিভাবে তাকে ছেড়ে যাবে?আদোও কি তাকে ছাড়া থাকতে পারবে?আর যদি তার মায়ের কথা সত্য হয়।মাহিয়াত যদি তাকে ভালোবাসে ফেলে তাকে ছেড়ে না দেয় তাহলে নুহার কি হবে মাহিয়াত তো তাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে তাকে কি ছেড়ে দেবে? দশ বছরের ভালোবাসা কি এই একবছরে শেষ হয়ে যাবে?তাহলে এ কেমন ভালোবাসা যা অন্য কারো আগমনে শেষ হয়ে যায়? কিন্তু মাহিয়াত যে বললো মানুষের মন পরিবর্তনশীল, তাহলে কি মাহিয়াতের মনে নুহার পরিবর্তে তার স্থান হয়েছে?নাকি তাকে ঘোরের মধ্যে রাখছে নুহার অনুপস্থিতিতে তাকে ব্যবহার করার জন্য,
এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনে
এই রাত তোমার আমার
তুমি আছো আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে পাই
তুমি আছো আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে পাই
শুধু দুজনে
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের…
নানান আজেবাজে চিন্তা ভাবনা আর মাহিয়াতের গান শুনতে শুনতে ফিমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো আর ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলো।
চলবে…
(কাল রাতে দেয়ার কথা ছিল কিন্তু টাইপিং করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।)