এই রাত তোমার আমার পর্ব ২৩

#এই_রাত_তোমার_আমার
#সানজিদা_ইসলাম
#২৩তম_পর্ব

কয়েক বার ডোর বেল বাজানোর পরও কেউ দরজা খুললো না ফিমার অস্থির লাগছে।আর একবার বেল বাজাতে লজ্জা লাগছে হয়তো তারা ইচ্ছে করেই দরজা খুলছে না।ফিমা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসলো। দুই দিন সে মা ডাক শুনে না।বাচ্চা দুটো সরা ঘর ছুটাছুটি করে না। এদেরকে দিয়েই তো এতো দিন নিজের সন্তান হারানোর দুঃখ চাপা দিয়েছিলো কিন্তু এখন কি করে থাকবে?

নানান ভাবনা চিন্তার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো,ফিমা এক পলক তাকিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার সে ফোন রেখে দিলো কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ফিমা সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল হাতটা আপনা আপনি চলে গেলো পেটের কাঁটা জায়গায় এইখানেই তো ছিলো তার রাজপুত্র।কত স্বপ্ন ছিলো তাকে নিয়ে কিন্তু নিয়তি আজ কোথায় নিয়ে এসেছে। রাজপুত্র নিশ্চয়ই এখন কথা বলতে পারে হাঁটতে পারে। তাকে নিয়ে হয়তো মাহিয়াত খুব ভালো আছে।

ফিমার হাতের ফোন আবার বেজে উঠলো প্রথমে ফিমা বিরক্ত হলো এতো বার আননোন নাম্বার থেকে কে ফোন করছে পরক্ষনেই মনে পরলো কোনো কাষ্টমার নয় তো?

ফিমা ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই কেউ বললো,

—ফিমা আমি আনাস বলছি। কুইন এলিনের বাবা। আমার কাথা মন দিয়ে শুনুন আপনি যেখানেই থাকেন না কেন দ্রুত আপনার ভোটার আইডি কার্ড আর জন্ম নিবন্ধন এর কাগজ নিয়ে আমার পাঠানো ঠিকানায় মত দ্রুত সম্ভব চলে আসুন।

—কিন্তু,

—কোনো কিন্তু নয় আমাদের আপনার হেল্প অনেক প্রয়োজন প্লিজ তারাতাড়ি চলে আসুন আমাদের হাতে সময় খুব কম।

বলে ফোন রেখে দিলো।ফিমা অস্থির হয়ে উঠলো কুইন এলিনের কোনো সমস্যা হয়নি তো?নইলে ওর বাবা কেনো তাকে এমন জরুরি ভাবে যেতে বলবে তাও আবার ভোটার আইডি কার্ড আর জন্ম নিবন্ধন নিয়ে?

ফিমা আর ভাবার সময় পেলো না।দ্রুত তার দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেলো সে একটা চারতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো আবার আনাসকে ফোন দিতেই একজন মহিলা নিচে নেমে তাকে সাথে করে নিয়ে গেলো প্রথমে বাড়ির ঠিকানা দেখে যাও একটু ভয় পেয়েছিল তা সাথে সাথে কেটে গেলো।

তারা সিড়ি দিয়ে দুইতলায় উঠলো ফিমার সবকিছু কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে সত্যিই কি বাচ্চাগুলোর কিছু হয়েছে এই মহিলাকে দেখে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।আর বাচ্চাদের কিছু হলেও এতে তার কাগজ পত্রের কি কাজ সে বুঝতে পারছে না। এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে কিছু চিন্তা করার অবশ্য ছিল না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছু একটা ঝামেলা আছে সে রাস্তায় মহিলাটিকে কুইন এলিনের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছে কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। কলিং বেল দেয়ার সাথে সাথে দরজা খুললো আনাস যেনো তাদের আসার অপেক্ষায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।

সে তাকে কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলো।সে এমন ভান করছে যেন তার কথা শুনার সময় তার কাছে নেই সে ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত।হুট করেই আনাস তার হাত থেকে কাগজ গুলো নিয়ে দেখে নিলো। তারপর কাউকে ডাক দিয়ে বললো এগুলোর কপি করে নিয়ে আসতে।

তারপর ফোনটা পকেটে রেখে কোত্থেকে একটা কাগজ এনে ফিমার হাতে দিয়ে বলল,

—সাইন করুন।

ফিমা ভ্রু কুঁচকে ফেললো,
—বলা নেই কওয়া নেই এত জরুরি তলব দিয়ে ডেকে এনে একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে বলছেন সাইন করুন।মানে কি? বাচ্চারা কোথায় আর এইটা কিসের কাগজ দিচ্ছেন?

কথাটা বলেই যেন ফিমা বড় কোনো ভুল করে ফেললো,আনাস দ্রুত পায়ে একেবারে ফিমার মুখের সামনে গিয়ে জোরে ধমক দিলো।

—আপনি আমার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছেন?এতো বড় সাহস আপনার‌? আমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে? সাইন করতে বলেছি চুপ চাপ সাইন করুন এতো কথা কিসের।

ধমক শুনে প্রথমে ফিমা কিছুটা দমে গেলেও কাগজের লেখা পড়ে ফিমা নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না সেও দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে উঠলো,

—এই সবের মানে কি? আপনার সাহস কিভাবে হয় আমার মতামত না নিয়ে আপনি ধরকা ধকমি করে আমাকে বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার সাইন করতে বলেছেন? আমাকে কি আপনার গাধা মনে হয়?

—মনে হওয়ার কি আছে আপনি তো গাধাই। এবার বেশি চিল্লাচিল্লি না করে সাইনটা করে দিন তো। তার পর আরো অনেক কাজ আছে। আপনার মত তো আর আজাইরা থাকি না। অনেক ব্যস্ত মানুষ আপনার হবু স্বামী।

ফিমা রাগ সংযত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
—দেখুন মুখ সামলে কথা বলুন। কে আমার হবু স্বামী?আর রেজিস্ট্রির কথা বলছেন তো ঠিক আছে বলে ফিমা হাতে থাকা কাগজ টা ছিড়ে ফেললো,আনাসের কোনো ভাবান্তর হলো না যেন সে এমন একটা পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো।ফিমা কাগজটা ছিঁড়ে আনাসের মুখ বরাবর ছুড়ে মারলো। তারপর চলে যেতে নিলে আনাস তাকে আটকায়।

—কাগজে সই করা ছাড়া আপনি এই বাড়ি থেকে এক পাও বের করতে পারবেন না ফিম।তাই শুধু শুধু হেঁটে দরজা পর্যন্ত গিয়ে আপনার শক্তি নষ্ট করার দরকার নেই।এখনো ভালো ভাবে বলছি চুপ চাপ সাইটা করে দিন।

ফিমা তার কথা শুনল না, সে দরজা খোলার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। আর না সে নিজে খুলতে পারলো।ফিমা‌ মনে মনে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে কি থেকে কি হয়ে গেলো?কেনো যে সে এই অসভ্য লোকটার কথা শুনতে গেল আর কেনই যে এখানে আসে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলো?

কি মনে করেছে লোকটা তাকে ছলে এখান পর্যন্ত নিয়ে এসে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করে নিবে আর ফিমা চুপ চাপ তাই করবে?এতোটাও বোকা নয় সে।আর বিয়ে? বিয়ে তো সে আর এ জীবনে করবে না।আর কত হাত বদল হবে সে?সে কি মানুষ না নাকি? আল্লাহ তাকে একটার জায়গায় দুটো বিয়ে দিয়ে জীবনের মত বিয়ের সাধ ঘুচিয়ে দিয়েছে।সে দরকার হয় সারাজীবন একা থাকবে তাও বিয়ে করবে না।আর এই বজ্জাত লোকটা কে তো জীবনেও না। দরকার নেই তার কাউকে।আজ থেকে সে কুইন এলিনের থেকেও দূরে থাকবে আর যত দ্রুত সম্ভব বাসা চেঞ্জ করবে। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।

আনাস ফিমার অবস্থা দেখে মিটমিট হাসছে।যা ফিমার রাগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে,

—আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পাগলের মত এমন হাসছেন কেনো? দেখুন ভালোয় ভালোয় আমাকে যেতে দিন নইলে কিন্তু…

—কি করবেন মেরে ফেলবেন?ওকে তাই করুন দেখি আপনি কতটুকু পারেন তবে আমিও কিন্তু হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো না বাঁচার জন্য ডিফেন্স করব তখন আপনার কিছু হলে আমাকে বলতে পারবেন না। তার থেকে ভালো বিয়েটা করে নিন আমি কোন ঝামেলা চাচ্ছি না। আর নয়তো আমার সাথে এখানেই আটকে থাকুন,হাম তুম এক কামড়ে মে বান্ধ হে…

আনাস ফিমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে গান গাইলো যা ফিমার ভয় আরো বাড়িয়ে দিলো।

—কেনো এমন করছেন?কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার? আমাকে যেতে দিন আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বোঝার চেষ্টা করুন।আমি কথা দিচ্ছি আর কোনো দিনই আপনার মেয়েদের আশেপাশে যাবো না।

বলে ফিমা কান্না করে দিলো।আনাস দুষ্টুমি ছেড়ে সিরিয়াস হয়ে গেলো। তারপর এক গ্লাস পানি ফিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

—প্লিজ কান্না করবেন না।আই এম সরি আসলে আপনার সাথে এমন আচরন করা উচিত হয় নি। আপনি পানিটা খান প্লিজ। তারপর আমি দুই মিনিট আপনার সাথে কথা বলি।তারপর আপনি যা বলবেন তাই হবে।

ফিমা কান্না থামিয়ে একবার আনাসের দিকে তাকাল। হয় তারপর হাত থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে সামনের সোফায় গিয়ে বসল।আনাসও ফিমার মুখোমুখি বসলো তারপর একটা বড় দম ফেলে বললো,

—প্রথমত দেখুন আমি আপনাকে বিয়ের আগে বা পরে ফিমা বলতে পারবো না। কেমন মা মা টান এসে পরে তাই আমি আপনাকে ফিম বলেই ডাকবো। বিয়ের আগ পর্যন্ত আপনি আপনি বলবো তার পর কিন্তু এতো ফর্মালিটি করতে পারবো না।তুমি করেই বলবো বউ কে আপনি সমন্ধন করতে কেমন জানি অকওয়ার্ড ফিল হয়।

ফিমা ভ্যাবলার মত আনাসের কথা শুনছে।কি বলছে এই লোক।বিয়ে হবে কি না তার গেরান্টি নেই আবার বিয়ের পর কি ডাকবে তা আলোচনা হচ্ছে!ফিমা চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বললো,

—এক্সকিউজ মি! আপনি কি এসব বলার জন্য আমাকে দুই মিনিট বসতে বলেছেন?

—হ্যা বিয়ের পরের ব্যাপার গুলো আগেই ক্লিয়ার হওয়া উচিত না?

—আপনি শিওর কিভাবে যে আমি আপনাকে বিয়ে করবো?

—আরে আমার সেল্ফ কনফিডেন্স আছে না। তার থেকেই বলতে পারি আমি আপনাকে বিয়েতে রাজি করতে পারবো।

—শেষ আপনার? এখান উঠবো?

—আরে না না,এখনোতো আসল কথাই বলিনি।তাহলে শুরু করি,মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনবেন আর যা সিদ্ধান্ত নিবেন ভেবে চিন্তে নিবেন ঠিক আছে?

—দেখুন,

—দেখছি তারপর কি তা বলুন?

—আরে আপনি কথার মাঝে কথা কেনো বলেন আমি মোটেও এটা পছন্দ করি না। আর বড়দের কথার মাঝে কথা বলতে হয় না এটা কি আপনি জানেন না?তাহলে আমার মেয়েরা কি শিখবে আপনার থেকে?

—আপনি কি কথায় কথায় ভুল ধরা বন্ধ করে আসল কোথায় আসবেন?

—ওহ হ্যা, দেখুন আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি এর মানে এই না যে আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি বা তার উপর মুগ্ধ হয়ে আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।আসলে আমার মেয়েদের জন্য এক জন ভালো মা এর খুব দরকার।

-এমন না যে আমি আমার মেয়েদের ভালোর দিকে তাকিয়ে সারাজীবন একা পার করে দিতে পারবো,দিন শেষে আমিও একজন মানুষ আমার কিছু জৈবিক এবং মানসিক চাহিদা আছে আমারও সঙ্গী প্রয়োজন। তাই আজ হোক কাল হোক আমাকে বিয়ে করতেই হবে।বিয়ে করে আমি নিজের জন্য ভালো স্ত্রী পাবো নিশ্চিত কিন্তু আমার মেয়েদের জন্য সে ভালো মা নাও হতে পারে।

-এখান আমি নিজের প্রয়োজনের কারণে তো আমার মেয়েদের ক্ষতি করতে পারি না।তাই আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।আর আমার মেয়েরা ও মা সবাই আপনাকে খুব পছন্দ করে। মেয়ে দুটোর তো মা বলতে পাগল।আর আমার মাও সারাদিন কানের সামনে ফিমা ফিমা টেপ রেকর্ডার ছেড়ে রাখে যা আমি বন্ধ করতে চাচ্ছি।

-যদিও আমার এখন বিয়ে করার কোনো প্লান ছিলো না মেয়েগুলো আরো বড় হলেই বিয়ে করতাম কিন্তু ইদানিং আমার মেয়েগুলোর মায়ের প্রয়োজন অনেক বেশি।আমি সারাদিন বাড়িতে থাকি না মা আর ওদের কেয়ার টেকার দুজনে মিলে সারাদিন ওদের সামলালেও রাতে মার ভিশন কষ্ট হয়ে যায়। এতদিন আপনি রাত পর্যন্ত রাখতেন তাই সমস্যা হয়নি কিন্তু দুইদিন যাবৎ তারা আপনাকে না দেখে আপনার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। কিছু খেতে চাইছে না ঘুমাতে গেলে প্রচুর বিরক্ত করছে।আর কাল থেকে দুজনেই অসুস্থ হয়ে পরেছে।

বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে শুনে ফিমা অস্থির হয়ে উঠলো,

—কি হয়েছে ওদের? হঠাৎ অসুস্থ কেনো হলো?

—আমি আপনাকে নিষেধ করেছি কথার মাঝে কথা না বলতে!ফিমা চুপ হয়ে গেলো তার ভালো লাগছে না। না জানি বাচ্চারা কি করছে?সামান্য অসুস্থ হলেই এরা দুজন বাড়ী মাথায় তুলে ফেলে ফিমাও সহজে তাদের সামলাতে পারেনা না। জানি ওদের দিদা কিভাবে ওদের সামলাচ্ছে‌?

-আমি অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার বাচ্চা গুলোর তা মাকে খুব প্রয়োজন। আপনাকে প্রয়োজন।হবেন তাদের মা?

ফিমা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল,
—সম্ভব না মাফ করবেন। বলে উঠে যেতে নিলেই ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো।ফিমা ভালো করে শুনে বুঝতে পারলো না এটা কুইন’এলিনের কান্নার আওয়াজ। সে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকতে নিলে আনাস তাকে আটকায়।

—প্লিজ আপনি চলে যান। আপনি যেহেতু বিয়ে করবেন না তাহলে আপনি যেতে পারেন।

—কিন্তু বাচ্চারা কান্না করছে।আমি একটু তাদের শান্ত করে দিয়ে আসি,

—কি দরকার শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে?এমনিতেই দুইদিন খুব কষ্টে ওদের সামলিয়েছি এখন আপনাকে দেখলে আরো বেশি কান্নাকাটি করবে। তার চেয়ে বরং আপনি আজ থেকে আমার মেয়েদের থেকে দূরে থাকুন। আপনি যত ওদের কাছাকাছি থাকবেন ততই ওরা আপনাকে ওদের মা ভেবে আপন করে নেবে। তারপর আপনি চলে গেলে খুব ভেঙে পড়বে তখন ওদের রাখা মুসকিল হয়ে যাবে।তারচেয়ে বরং ওরা এখনই বুঝতে শিখো ওদের মা নেই।

ফিমা চেয়েও কিছু বলতে পারলো না আস্তে আস্তে দরজার দিকে যেতে লাগল অন্যদিকে বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ বাড়তে লাগল আর সাথে সাথে ফিমার ভেতরের অস্থিরতা ও। বাচ্চাগুলো বারবার মা মা করছে।ফিমা দরজা পেরিয়ে যেতে পারলো না ঘুরে এসে সোজা বাচ্চাদের ঘরে ঢূকতে নিলে আনাস আবার তাকে আটকায়,

—দেখুন আমাকে যেতে দিন বাচ্চাগুলো কান্না করছে আমি ওদের শান্ত করে দিয়েই চলে আসবো। আমাকে আটকাবেন না প্লিজ।

—লিগ্যালি কুইন এলিনের মা হয়ে যান আর আমার বউ।কেউ আপনাকে তাদের কাছে যেতে আটকাবে না। আপনার কোনো সংকোচ হবে না ওদের উপর অধিকার খাটাতে।ওরাও মা পেয়ে যাবে আর আপনি সন্তান।

–সেটা সম্ভব না কখনো।আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আপনাকে কেনো কাউকে না।বিয়ে নামক সম্পর্ককে আমি বিশ্বাস করি না। আর আপনি আমার অতীত সম্পর্কে জানেন না তাই এই কথা বলছেন জানলে…

—জানি,সব জানি আমার আপনার অতীত নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।আমি সবকিছু জেনেই আপনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।

ফিমা চমকালো। অনেক টা!যা তার মুখেও প্রকাশ পেলো তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

—দয়া দেখাচ্ছেন?

—নাহ।দয়া না। বলতে পারেন ভালোলাগা থেকেও করছি।ঐ যে বললাম না মা কানের সামনে সারাদিন ভাঙ্গা রেকর্ডারের মত ফিমা ফিমা করতে থাকে।প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও আস্তে আস্তে তা ভালোলাগার রুপ নেয় আর ভালোলাগাই তো ভালোবাসার প্রথম ধাপ তাই না?

-আর দেখুন আপনি অনেক সময় পাবেন যত দিন পর্যন্ত আপনি আমাকে মেনে না নেবেন ততদিন আমি আপনার উপর স্বামীর অধিকার ফলাব না। আমার নিজের উপর যথেষ্ট কন্ট্রোল আছে। ততদিন আপনি না হয় আমার বাচ্চাগুলোর ভালো মা আমার মায়ের ভালো বউ মা আর আমার বন্ধু হয়ে থাকবেন।

-এরপরও যদি আপনি বলেন যে কোনো দিন বিয়ে করবেন না। তাহলে এইটা আপনার সবচেয়ে বড় বোকামি কারণ যাদের জন্য আপনি মনে কষ্ট পুষে একা থাকবেন দিন শেষে তারা ভালোই থাকবে।আর তারা আপনার ভালোবাসা ডিজার্ব করে না। হয়তো পুরুষ জাতির উপর আপনার বিশ্বাস উঠে গেছে কিন্তু হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না তেমন সব ‌পুরুষও এক হয় না। একবার না হয় আমার উপর বিশ্বাস করেই দেখেন।

-আর যদি আপনি মনে করে থাকেন আপনার অতীত কে আপনি ভালোবাসেন তাহলে সেগুলো আপনার বোকামি।সরি টু সে কারণ আপনি আপনার প্রথম স্বামী কে মনে রেখেছেন সে আপনাকে ধোঁকা দিয়েছে বলে।যদি সত্যিই ভালোবাসতেন তাহলে এত সহজে তাকে ভুলে দ্বিতীয় স্বামীর প্রেমে পরতেন না।

-হ্যা, আপনি আপনার দ্বিতীয় স্বামীকেও ভালোবাসেন নি। আপনি তার ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়ে তার প্রমে পরেছিলেন। আর নয়তো এত সহজে আপনি মুভ অন করতে পারতেন না। কিন্তু আপনার এখনো তাকে মনে পরে কষ্ট হয় কারণ আপনি একটা পিছুটান ফেলে এসেছেন তার একটা চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন এ ছাড়া কিছুই না। আপনি ভালোবাসার সংজ্ঞাই জানেন না।

-যখন একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে তখন তারা একে অপরের ব্যাপারে care করে, ভাবে। একজন আরেকজনের ব্যাপারে ছোটখাট বিষয় নিয়েও মাথা ঘামায়। একজন আরেকজনের ক্ষতি দেখতে পারে না বরং সবসময় তার ভাল চিন্তা করে। একজন আরেকজনকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। একে অপরকে সবসময় দেখতে ইচ্ছে করে, একসাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত মনের ভিতর আগলে রাখতে ইচ্ছে করে। একজন আরেকজনকে দেখলে বুকের ভেতরে একটা শান্তির অনুভূতি সৃষ্টি হয়। একজন আরেকজনের দিকে তাকালে মনে হয় যেন, ‘দুচোখ ভরে দেখি।’ ভালোবাসা মানে জাস্ট আপন করে পাওয়া – একে অপরের প্রতি অধিকার সৃষ্টি ভালোবাসার অন্যতম আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ত্যাগ স্বীকার করা। ভালোবাসার মানুষটির জন্য অনেক সুবিধা ছেড়ে দেয়া বরং অনেকটা আনন্দের বিষয় হয়ে থাকে।

-কিন্তু আপনি কি তা করছেন?ত্যাগ করেছেন ঠিক কিন্তু ভুলতে পারেননি। আসল ভালোবাসা তো আপনার দ্বিতীয় স্বামী প্রথম স্ত্রী করেছে। তার ভালোবাসাকে ভালো রাখার জন্য স্বামীকে বিয়ে দিয়েছে।নিজে কষ্ট সহ্য করেছে।সেই তার স্বামীকে ডিজার্ভ করে আপনি না। আপনি তো তাকে ভালোই বাসেননি।

-আর একটা কথা সত্যি করে বলুন তো আমার মেয়েদের কাছে পেয়ে কি আপনার প্রক্তন দ্বিতীয় বা প্রথম স্বামীর কথা মনে পড়ে?

ফিমা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে তার এগুলো শুনতে ভালো লাগছে না।তাই সে শুধু মাথা নেড়ে না করলো।

-তাহলে আপনি বলুন সত্যিই আপনি তাদের কাউকে ভালোবেসেছেন কিনা? আপনি আপনার বাচ্চাকে ভালোবাসতেন তাই তার কথা মনে পরে যার অভাব আপনি আমার বাচ্চাদের দিয়ে পূরণ করেন তাই আর তার কথা মনে পরে না।এটা আপনার ভালোবাসা না। বুঝতে পারছেন?

-আরে ভালোবাসা এতো সহজে ভোলা যায় না।জনম জনম মনের মধ্যে দাগ কেটে বসে থাকে। বুকের মধ্যে সারাক্ষণ একটা চিন চিন ব্যাথা হয়। সে হারিয়ে গেলে তার স্মৃতি টুকু আগলে রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। অবশ্যই তার সাথে কাটানো ভালো সময় টুকর স্মৃতি। খারাপ স্মৃতি নয় খারাপ স্মৃতি মনে করাকে ভালোবাসা বলে না। নিজের কষ্টকে বাড়ানো বলে।

-আর আপনার বয়সই বা কতটুকু? সারাজীবন একা থাকা মুখের কথা না।একা একজন মেয়ের মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন ব্যাপার। দুনিয়াটা ঘুরে দেখুন সব বুঝতে ‌পারবেন।

-আপনি হয়তো ভাবছেন আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য হয়তো এতো এতো মিথ্যা বলছি। কিন্তু সত্যি বলতে আপনাকে বিয়ে করাতে না পারলে নিজেকে সামলানো কঠিন হবে না। কারণ আপনি আমার ভালো লাগা। ভালোবাসা না। ভালোবাসা হলে এতো লেকচার দিয়ার সময় কই? মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে সংসার করতাম এতোদিনে।তবে হ্যা একটা আফসোস থাকবে মেয়েগুলোর জন্য তারা একজন চমৎকার মা হারিয়েছে।

-এখান আপনার সিদ্ধান্ত আপনি কি করবেন।আমি আপনাকে সম্পূর্ণ বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছি এইবার আপনি কি করবেন আপনার ইচ্ছাতেই সব মেটার করে। এইবার যান তো আমার চোখের সামনে থেকে তারপর লজ্জা পেয়ে নিজের ঠোট কামড়ালেও সমস্যা নেই এখানে বসে কামড়ালে আমার সমস্যা হবে পরে দেখা যাবে দড়ি দিয়ে বেঁধে বিয়ে করে ফেলেছি।

ফিমা এতোক্ষণ মন দিয়ে বসে আনাসের লেকচার শুনছিল মাঝে মাঝে তার কথায় লজ্জা পেয়েছে আবার মাঝে মাঝে অপমানিত বোধ করেছে তো মাঝে মাঝে রাগ হয়েছে।এই লোকটার সহস কিভাবে হয় এতো কিছু বলার? কিন্তু শেষ কথাটা শুনে প্রায় দৌড়ে বাচ্চাদের রুমে চলে গেল।

বাচ্চারা দেখেই তাকে মা মা বলে জাপটে ধরলো ফিমাও তাদের বুকে টেনে নিলো। নিমিষেই মনের মধ্যে যে ব্যাথা টুকু ছিল তা গায়ের হয়ে গেলো আর লোকটার উপর রাগ উঠে গেলো তার সাহস হয় কিভাবে তা ভালোবাসা কে অপমান করার? পরক্ষনেই ভাবে সত্যিই কি সে কাউকে ভালোবেসেছিলো?

তারা অনেক সময় একসাথে কাটালো তারপর দুজনেই মায়ের কোলে চড়ে বসলো তাকে যেতে দেবে না। ফিমাও তাদের ছারলো না।সে মনে মনে ভাবলো সত্যি কি নিজেকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিত বাচ্চাগুলোকে আপন করে নেওয়া উচিত? তাদের ছাড়া থাকতে তারও কষ্ট হবে ঠিক কিন্তু আমার বিয়ে করলে লোকে কি বলবে? তিনটা বিয়ে ছিহ সে নিজেই নাকি সিটকালো। অবশ্যই এধরনের মেয়েদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না।

এবার সে দ্বিধায় পড়ে গেল। কি করবে? এরমধ্যে আনাস তারা দিতে শুরু করলো বাসায় যাওয়ার জন্য। ফিমা বের হতে নিলেই আনাস জিজ্ঞেস করে,

—কি সিদ্ধান্ত নিলেন?

ফিমাকে বিচলিত দেখালো মানে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে তাকে আশ্বাস দিল,

—দেখুন সমাজের কথা চিন্তা করে না করবেন না প্লিজ।কারণ আমরা কষ্টে থাকলে সমাজের মানুষ তা কমাতে আসে না।এক বেলা না খেয়ে থাকলে খাবার দেয় না কিন্তু কথা দিয়ে আঘাত করতে পারে ভালো। তারা একদিন দুইদিন বলবে তিনদিনের দিন এমনিতেই ভুলে যাবে। এখান বলুন।

ফিমা কিছু বলতে পারলো না,তাই আনাস আবার বললো,

—আচ্ছা ঠিক আছে আপনি কিছুদিন সময় দিন আপনার পরিবারের সাথে কথা বলুন তারপর আপনার সিদ্ধান্ত আমাকে জানাবেন ঠিক আছে।সিমা ঘার নাড়িয়ে সম্মতি দিল তারপর বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল।

বাড়িতে ফিরে বেস্ট দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়েই ফিমা আনাসের কথা ফাহি আর ফাহিমকে জানালো। ফাহি তো খুব খুশি হয়ে গেলো আর ফিমাকে তার কথায় রাজী হয়ে যেতে বললো। পিচ্চি দুটো কে ওর খুব ভালো লাগে। ফাহিম কে জানানোর পর সে সাথে সাথে কিছু বললো না শুধু বললো সে আনাসের সাথে কথা বলতে চায়।

এর পর সময় পেরিয়ে গেল খুবই দ্রুত। ফাহিম আনাসের সাথে কথা বলে তার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে ফিমাকে নিঃসন্দেহে রাজি হয়ে যেতে বলে। ফিমার বাবা মা ও খুব খুশি হয়ে যায়।আর মাস দুইয়ের মধ্যেই তাদের বিয়ে হয়ে‌ যায়।

আর বলা বাহুল্য মাহিয়াতের টাকা তারা নেয়নি পরের দিনই আজমীনের নামে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।তারা মেয়ের সুখ চাইছিলো তাই হয়নি টাকা দিয়ে কি করবে? দেরিতে হলেও তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে।

তার পর সময় কোন দিক দিয়ে চলে যায় কেউ বলতে পারে না। আস্তে আস্তে কুইন এলিন বড় হতে থাকে সাথে আনাসের সাথে ফিমার সম্পর্কও সহজ হতে থাকে।ফিমা তার ব্যাবসা অনেক বছর পর্যন্ত নিয়ে দেখাশোনা করেছে ব্যাবসায়ের পরিধি বড় হয়েছে এখন আনাসই লোক দিয়ে তা দেখা শুনা করায়। বিয়ের দশ বছর পর তার কোল আলো করে আরো এক সন্তান জন্ম নেয়।আরাজ তাদের ছোট ছেলে দুই বোন আর দাদুর চোখের মনি সে।লোক জনের যে কথা শুনতে হয়নি তা কিন্তু নয় অনেক শুনেছে কিন্তু আনাস তাকে ভেঙে পরতে দেয় নি। শাশুড়ির সাপোর্ট পেয়েছে পুরোদমে। এখান বয়স হয়েছে শুধু একটাই আফসোস হয় একটাই ইচ্ছে তার অপূর্ণ নিজের প্রথম সন্তান কে দেখা…
‌।


নুহার ভাই আরাফ বিয়ে করেছে তাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে।নাতনি কে নিয়ে আমেনার দিন ভালোই কাটছে। আনোয়ার সাহেব মাঝে মাঝে ফোন দেয় মাঝে মাঝে কথা বলে আবার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফোন রিসিভ করে না।

আনোয়ার সাহেব আর নয়ন এক সাথে থেকেও এখন একা। আনোয়ার সাহেবের শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না তাই মাঝে মাঝে আমেনাকে চলে আসতে বলে শেষ সময়টুকু তার সাথে কাটাতে চান। কিন্তু আমেনা সাফ সাফ জানিয়ে দেন সারাজীবন সুখের সময় টুকু তার সাথে কাটায়নি তো এখন শেষ পর্যায়েও তাকে তার দরকার নেই। পুত্র বধু আর নাতনি নিয়ে বেশ আছে তারা।




মাহিরের 18 বছর পূর্ণ হয়েছে কিছুদিন আগে সেই রাতের পর থেকে সে বাবা মায়ের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই চলে যা নুহাকে খুব কষ্ট দেয়।কিন্তু বোঝা হালকা হয়।সে তার ছেলেকে চেনে তাকে সময় দেয় সহজ হওয়ার সে জানে তার সন্তান আবার আগের মত হয়ে যাবে।

সকাল‌ থেকেই মাহির মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে কিছু বলছে না। কিন্তু নুহা জানে সে তাকে কিছু বলতে চায়।নুহা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি কারণ অনেক দিন পর ছেলে তার কাছে এসেছে সময় কাটাচ্ছে।

কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর সে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে তাকে কিছু বলল,যা বুঝতে পেরে নুহার আত্না কেঁপে উঠলো…

চলবে…

(ঘোরার ডিম শেষ হয় না।আর লিখতে ইচ্ছে করে না এই গল্প। আজকে শেষ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু হয়নি। গল্প দেরি করে দেয়ার জন্য দুঃখিত দুই দিন অসুস্থ ছিলাম কিছু লিখতে পারিনি।আর বাকি দুইদিন মাথায় কিছু আসছিলো না।এই গল্প লিখতে গিয়ে অন্য দুইটা গল্পের একটা একটা পর্ব লিখে ফেলেছি কিন্তু এটা এক লাইন ও লিখতে পারিনি। আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠে লেখা শুরু করে এখন শেষ করলাম।দেরি করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত 😔)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here