একজীবন
পর্ব: ১
★
আমার যখন পনের বছর বয়স, বয়সন্ধির গোলাপ সবে কুঁড়ি ফোটাতে শুরু করেছে- ঠিক তখনই মায়ের আদেশে বাবা আমার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করে দেন। এই ২০১৮ তে এসে মাত্র পনের বছরে একটা মেয়ের বিয়ে কেন দেয় বলুনতো? আচ্ছা, আমিই বলছি- মেয়ের যন্ত্রণায় মা-বাবা অতিষ্ঠ হয়ে পরলে, অথবা রাগী, জেদী মেয়েকে বশে আনতে অক্ষম হলে…
অথবা?
অথবা, মেয়েটি মাতৃহারা হলে। আমার দশ বছরের জন্মদিনের দিনে আমার জন্মদাত্রী মা’কে হারাই আমি। মাস ছয়েকের ভেতরেই মেয়েকে দেখাশোনার অজুহাতে দিব্যি এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিয়ে আসেন আমার বাবা। আমার দেখাশোনা করেছেন বটে আমার সেই নতুন মা, দেখে শুনে কম খরচের একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন আমায়, আমার আগের খরুচে স্কুলটা ছাড়িয়ে। দেখে শুনেই আমার থাকার ঘরটা গেস্ট রুম বানিয়েছেন তার ভাই-বোনেদের থাকার সুবিধার্থে, আমাকে স্টোর রুমে ঠেলে দিয়ে। বাবাকে বিয়ের বছরখানেক বাদেই ফুটফুটে পুত্র সন্তানের মা হয়ে এই সংসারে জোরেসোরে খুঁটি গেড়েছেন আর শেষমেশ আমার পনেরতে পা পরতে না পরতেই আমার জন্য বিয়ের পয়গাম দেখা আরম্ভ করে দিয়েছেন।
আমি অরু, জন্মের আগেই শখ করে আমার অরুন্ধতী নামটা ঠিক করে রেখেছিলেন আমার মা। তারই সংক্ষেপ রুপ- অরু। এই নাম নিয়েও কম কাহিনী করেননি আমার ছোট মা, মানে বাবার সেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করা বউটি আরকি। আমার নাকি হিন্দুয়ানী নাম, নামের দোষেই মা’কে খেয়েছি, আমার অপয়মন্ত উপস্থিতি তার সদ্য জন্মানো ছেলেটির জন্য ক্ষতিকর – আরও কত কী! এমনকি আমার নামটা বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন পর্যন্ত, কিন্তু পরে দেখা গেল বার্থ সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে স্কুলের কাগজপত্তর- সব এক এক করে বদলাতে হবে তাই সে যাত্রায় বেঁচে গেল মায়ের দেওয়া নামখানা। নয়ত এক লহমায় আমার শৈশব, আমার নিজের থাকার একান্ত ঘরটুকু, আমার ছেলেবেলার স্কুল আর আমার বাবাটির মত এই ‘অরুন্ধতী’ নামটাও হয়ত ছোট মায়ের কাছে বলি হয়ে যেতো! ছোট মা অল্পবয়েসী, ছোট মা সুন্দরী, ছোট মা আমার জ্যান্ত স্বত্তাটাকে সইতে অনিচ্ছুক আর তার চেয়েও বড় সব কিছুর ঊর্ধে যে সত্য তা হলো- আমার একমাত্র কাছের মানুষটা, আমার বাবা- ছোট মায়ের অন্ধভক্ত! আর তারই পরিণতিতে আজকে স্কুলফেরত বাড়ি এসে সাজতে বসে গেছি আমি, পাত্রপক্ষের সামনে যাবার জন্য। গ্রামের বাড়িতে দূরসম্পর্কের এক দাদী থাকেন আমার, বাবার অনুরোধে তিনিই এই পাত্রের খোঁজ এনেছেন। পাত্রের কোনো দাবি-দাওয়া নেই, কেবল এক কাপড়ে মেয়ে তুলে নিলেই খুশি- তাই ছোটমাও একবাক্যে রাজি হয়ে গেছেন তাদের প্রস্তাবে। আমাকে কোনোমতে কারো ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে ছোটমা হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন- হোক না দোজবরে, বছর চল্লিশের বুড়ো, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অঙ্কের মাস্টার!
★
-‘কই আপনের মাইয়ারে আনেন! কতখন বইসা থাকমু… লুকজন নিয়া আবার ফিরত যাইতে হইব ত!’-
চুন মাখানো ঝাঁঝালো পান গালে ঠেসে ততোধিক ঝাঁঝালো গলায় বললেন আলেয়া খাতুন, সব ঠিকঠাক(!) থাকলে এই মহিলাটিই আমার হবু শাশুড়ি। দাদীর কাছে শুনে শুনে এদের বাড়ির সকলের ঠিকুজিকোষ্ঠী ঠোঁটস্থ কণ্ঠস্থ হয়ে গেছে আমার! আসার পর থেকে কিছু না কিছু বলেই চলেছেন এই আলেয়া খাতুন নামের মহিলা আর নিতান্ত নিপাট মানুষটির মত এক কোণায় বসে আছেন আমার হবু দোজবরে বর- মোহাম্মদ আনিসুর রহমান (আনিস)। যেমন ক্ষ্যাত পরিবার, তেমনি ক্ষ্যাত একখানা নাম! আমার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে এদের দু’জনকেই কেবল দেখা যাচ্ছে, যদিও আনিস সাহেবকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছিনা মাথা নিচু করে রয়েছেন বলে।
মায়ের কথা বড্ড মনে পরছে। ইশ, মা বেঁচে থাকলে কখনোই এমন হতে দিতোনা! নিজের মেয়ের নাম অরুন্ধতী রেখেছিলো যে মা, গ্রাম থেকে উঠে আসা চল্লিশ বছরের বুড়ো আনিসুর রহমানের গলায় কক্ষনোই সেই নাড়ি ছেঁড়া ধন-কে ঝুলিয়ে দিতে পারতো সে। কক্ষনই না! ভাবতে ভাবতে অজান্তেই চোখ বেয়ে নোনাজল ঝরছিলো আমার, দাদীর গুঁতো খেয়ে সম্বিত ফেরে।
-‘কিরে নাতিন, কান্দস যে! আইসা থিকা দেখতাসি মুখে হাসি নাই, য্যান ফাঁসি দিতাসে তরে এমন কইরা রইসস, ক্যান? কিছু কওনের থাকলে আমারে ক, দূরসম্পর্কের অইলেও তর দাদী লাগি আমি…
-‘দাদী, এই বুড়ো হাবড়া, অঙ্কের মাস্টাররে আমি বিয়ে করতে পারবনা। আপনে বাবারে বলেন…
-‘শুন ছেমড়ির কতা! ‘বাবারে বলেন!’ কী কইতাম তর বাপেরে? অইডা ত একটা ভেড়া। লক্ষীমন্তর বউডারে হারায়া কামরুপকামাক্ষার ডাকিনিরে বিয়া কইরা ঘরে আনসে অখন হের ভেড়া হইয়া ভ্যাভ্যা করতাসে। শুন, কথায় কয়- ‘মা মরলে বাপ তালুই!’ তাতে তুমি আবার পাইসো সৎ মা! সেরের উপরে সোয়া সের। পোলার বয়স এট্টু বেশি, তাতে কি হইসে? তর দাদা আমার চে’ বিশ বছরের বড় আছিল না? হেইল্লিগা কি আমি জামাই বুইড়া কইয়া কানসি নি? এই বাড়িত থাকলে তিল তিল কইরা মরবি দিদি, এরচে এই প্রস্তাবে রাজি হইয়া যা। পোলার মা এট্টু ক্যাটক্যাটি খাতুন হইলেও পোলাডা এক্কারে সোনার টুকরা, তরে মাথাত কইরা রাখব কইলাম! তুই ত ভালা ছাত্রী, অই বাড়িত যায়া পড়ালেখা করবি, আনিসেই করাইব- হেই জ্ঞান তার আছে। সোনার আংটি, তার আবার ব্যাকাত্যারা! আশেপাশের দশ গেরামে আনিসের মত একটা ভদ্দর পোলা নাই…’
একমনে গজগজ করে চলেছেন দাদী, সেই পুরানো আলাপ- ভদ্র ছেলের গ্রাম্য সংজ্ঞা! গ্রাম্য পরিবেশে বড় হওয়া, পঁচিশ বছরের বড় একজনের সাথে বাকি জীবন কাটাতে তো হবে আমার, আমি ত জানি কী ভয়ানক দুর্বিষহ সময় অপেক্ষা করছে সামনে আমার জন্য! রশ্মি,মিতু, আনিশা- আমার সব বন্ধুরা কত হ্যান্ডসাম ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ায়, আর আমার কপালেই কীনা…!
-‘কই খালাম্মা, অরু রে নিয়াসেন!’- বাহিরঘর থেকে বাবার চিৎকার শুনে ঘোর কাটে আমার। সাত পাঁচ ভাবছিলাম বসে বসে, আচ্ছা পালিয়ে টালিয়ে গেলে কেমন হয়? অনেক ভেবে মনে হলো, এটাই সবশেষ সমাধান!
★
সাত পর্বে সমাপ্য।