একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব -০৯

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৯.
#writer_Mousumi_Akter

রোশান স্যার গম্ভীর আর থমথমে মুডে স্হির হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।ভ্রুযুগল কুচকানো।মুখের অদলে অদ্ভুত এক ভঙ্গি।এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেনো পৃথিবীর সব থেকে আশ্চর্যজনক কিছু দেখছেন, চোখ দুটো স্হির আমার দিকে রয়েছে।আমি দ্রুত ফোনটা কেটে বেআক্কেলের মত উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।কারো সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলার পর যখন দেখা হয় সে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার মতো লজ্জা দুনিয়াতে আর দ্বীরীয় টি নেই।শাড়ির আঁচলের কোনা দু’ হাতের মুঠোয় নিয়ে কচলাচ্ছি, কেমন যেনো অস্হিরতা অনুভব করছি।

উনি গম্ভীর মুডে স্হির থেকে কপাল টানটান করে হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ওয়াই নাইস!’

উনি গম্ভীরতা ভেদ করে কথা বলে উঠতেই বুকের মাঝি বাড়ি মেরে উঠল আমার।আমি ভেবেছিলাম উনি হয়ত এবার ও এড়িয়ে যাবেন।কেননা উনার স্বভাব ই ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এড়িয়ে যাওয়া।এর আগেও বহুবার উনি এসব ব্যাপার এড়িয়ে গিয়েছেন।গম্ভীরতা ভেঙে যে আজ কথা বলে উঠবেন আমি ভাবতেই পারিনি।আমার এমন বিশ্রি ফিলিংস হচ্ছে তা বলার মত নয়।আমি যে কি বলব,কি উত্তর দিবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।ইয়া মাবুদ কি সমস্যায় ফেললে আমাকে। নিচের ঠোঁট কামড়ে বোকার মত উনার দিকে তাকিয়ে আছি।চোখে মুখে করুণ অসহায়ত্ত্ব আমার।এইভাবে কেউ ধরা খায়,উনার আমার সম্পর্কে কি কি ধারণা হয়েছে তার ঠিক নেই।আমাকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার ও থমথমে মুডে চোয়াল শক্ত করে বললেন,

‘জাস্ট চমৎকার। ‘

আবার ও বুকের মাঝে বাড়ি মেরে উঠল আমার।উনার ওই গম্ভীরতা ভেদ করে বেরিয়ে আসা প্রতিটা কথা আমার হৃদয়ে সূচের মত ধারালো হয়ে ফুটছে।কলেজেও আমার এমন হত।ঘন্টায় দুই’একটা কথা বলতেন উনি আর আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন উনার মুখ দিয়ে কথা বেরোবে।উনার এক একটা কথা হৃদস্পন্দনে তুফান তুলত আমার।আজ ও হঠাত তাই হচ্ছে।দুরুদুরু করা বুক নিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম,

‘কি স্যার।’

‘তোমার বাসর ঘরের গল্প।ফোনে গল্প শোনাচ্ছিলে ওটা তোমারই বাসর ঘরের গল্প ছিলো তো তাইনা?’

‘ইয়ে মানে, না মানে স্যার আসলে।’

‘ইয়ে মানে টা কি?’

বলেই রোশান স্যার এক’ পা দু’পা করে আমার দিকে থমথমে মেজাজেই এগোতে লাগলেন।আমি উনার মতি গতি বুঝতে পারছিনা আমিও এক পা দু’পা করে পিছিয়ে যাচ্ছি।আর উনি আমার দিকেই এগোচ্ছেন।কাল থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার শাস্তি কি উনি আমাকে একবারে দিতে চান নাকি।ওভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?উনি আমাকে ধরলে তো নড়তেও পারব না।যে শশক্তপোক্ত হাতের হাত উনার।এই কচি হাত ধরলেই তো তুষ তুষ হয়ে যাবে।এখন কি করব আমি।জানালার গ্রিল খুলে দৌড় মারব নাকি।সে উপায় ও তো নেই।আস্তে আস্তে পিছিয়ে যেতে যেতে ওয়াশরুমের দরজায় গিয়ে পিঠ ঠেকল আমার।উনিও এসে দরজায় হাত ঠেকিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালেন আমার দিকে।
আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ত্ব নেই এখন কিঞ্চিত পরিমান ফাঁকা।দুজনের উষ্ণ নিঃশ্বাস দু’জনের চোখে, মুখে আচড়ে পড়ছে।আমি বার বার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছি আর বড় বড় চোখ করে উনার দিকে তাকাচ্ছি।উপর উপর যতই ঝগড়া করি মুখ চলিয়ে জিততে পারলেও গায়ের শক্তিতে তো আর পারব না।উনি এবার আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,

‘অপূর্ব।’

হঠাত উনার মুখের প্রশংসায় বেশ খানিকটা অবাক হলাম আমি, লজ্জা ও পেলাম।লজ্জামিশ্রিত চোখে,মুখে ওনার দিকে তাকালাম।

উনি আবার ও বললেন,

‘বিউটিফুল।’

লজ্জার মাত্রা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো।লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম।উনি যে কখনো এইভাবে আমাকে অপূর্ব বা বিউটিফুল বলবেন আমি ভাবতেও পারিনি।লজ্জায় শাড়ির আঁচল আরো ঘন ঘন কচলাতে কচলাতে বললাম,

‘আমি অতটাও বিউটিফুল নয়।’

‘তোমাকে বলিনি, তোমার ফুলসজ্জার কথা বলেছি।’

উনি যে এমন কিছু বলবেন আমি ভাবতেও পারিনি।সারাহ! সব সময় বেশী বুঝিস বলে আজ এই জঘন্য লজ্জাটায় না পেতে হলো।কি দরকার ছিলো এই এক লাইন বেশী বোঝার।যা বুঝেছিস বুঝেছিস ভালো কথা একটু ধৈর্য ধর।সে ব্যাক্তি কেনো বলেছে কি উদ্দেশ্য বলেছে ক্লিয়ার করুক তার আগেই তোর অস্হির মন তা প্রকাশ করে লজ্জা পেয়ে গেলো।বেশী বোঝা ছেড়ে দে সারাহ। উনি বা কি বলতে চাইছেন আর তুই বা কি ভেবেছিস।রোশান সিদ্দিকী এতটা রোমান্টিক হবেন নিজের বউ এর রুপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রশংসা করবেন এসব ভাবিস কিভাবে।এরই মাঝে রোশান স্যার বলে উঠলেন,

‘তো মিসেস সারাহ সিদ্দিকী তারপর কি হলো তোমার ফুলসজ্জার। তোমার জামাই কি চুমু খেতে সক্ষম হল।আই আম ভেরি ইন্টারেস্টেড দ্যাট সাব্জেক্ট। ‘

ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা কি বলব এখন।কিছু একটা করে এখান থেকে পালাতে হবে আমাকে।পেছনে হাত বাড়িয়ে আস্তে করে ওয়াশ রুমের দরজা খুলে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করতেই উনি দরজা হাত দিয়ে ঠেলে নিজেও ভেতরে প্রবেশ করলেন।ভেবেছিলাম ওয়াশ রুমের দরজা অফ করে বলব, ‘স্যার আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসেছি।’ কিন্তু কি হলো উল্টো বিপদ বাড়ল।তাড়াহুড়ো তে ভেতরে প্রবেশ করতেই তাল না সামলাতে পেরে পড়ে গেলাম। নিজেকে রক্ষা করতে উনার শার্ট খামছে ধরতেই উনিও পড়ে গেলেন আমার উপর।ট্যাবের নিচে বালতি ভর্তি পানি ধাক্কা লেগে কাত হয়ে পড়ে যেতেই ভিজে গেলাম দুজনেই।ইস কি লজ্জা।এমন পরিস্হিতি আগে কখনো হয়নি আমার।লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রইলাম।কি বাজে পরিস্হিতি।এই প্রথম কেউ আমার উপর এসে এভাবে পড়েছে।উনিও বোধহয় খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছেন।দ্রুত উঠে পড়লেন।গায়ের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,

‘অঘটন ছাড়া ঘটাতে পারো না তাইনা?ওভাবে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করার কি প্রয়োজন ছিলো।’

আচমকা পড়তেই মেরুদন্ডে খুব জোরে আঘাত পেলাম।চেষ্টা করেও উঠতে পারছিনা।আমার মুখে যন্ত্রনার অবয়ব দেখে উনি বুঝতে পারলেন আমি হয়ত ব্যাথা পেয়েছি।ঝুকে এসে আমাকে পাজা কোলে তুলে বললেন,

‘এভাবে জ্বালাতে চাও আমাকে?এমনি পুড়ছি আর পুড়িওনা।’

‘আপনাকে কিভাবে জ্বালালাম, ব্যাথা তো আমি পেয়েছি।আপনি তো পাননি।’

‘কোলে তুলতে হলো কাকে?’

‘তুলেছেন কেনো?অন্য কাউকে ডাকতেন।’

‘বউ আমার অন্য কেউ কোলে তুলবে।’

উনার মুখে বউ কথাটা শুনে আবার ও লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি।এরই মাঝে জিনাত নক না করেই আমাদের রুমে প্রবেশ করল।আমাদের এইভাবে দেখে জিনাতের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।জিনাতের সামনে এই অবস্হায় ভীষণ লজ্জা পেলাম আমি।রোশান স্যার ও খুব লজ্জা পেলেন বোধহয়।উনি আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে জিনাত কে বললেন,

‘জিনাত এসো বসো।’

রোশান স্যার আলমারি থেকে একটা পাঞ্জাবি বের করে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলেন।জিনাত আপু আমার সামনে এসে বললেন,

‘এইভাবে দরজা খোলা রেখে বেহায়াপানা করছো।বাড়িভর্তি মানুষ লজ্জা থাকা উচিত।’

‘আপনি নক না করে কেনো ঢুকেছেন?’

‘আমি কি জানতাম দিনে দুপুরে লীলা চলছে।কিভাবে পারো অপরিচিত একটা পুরুষের সাথে একদিনে এত ক্লোজ হতে।’

‘আপনি বাড়ি যাননি এখনো।’

‘এখনো বাড়ি যায় নি মানে?এটা আমার ফুপির বাড়ি।এখানে যখন ইচ্ছা আসি -যায় আমি।তুমি কোন রাইটে একথা বললে।’

‘অপরাধ হয়েছে আমার, কারণ আমি ভাড়াটিয়া এ বাড়ির।এ বাড়ি ভাড়া থাকতে এসছি আমি।’

‘সারাহ! তোমার মাঝে ভদ্রতার অভাব আছে অনেক।কে বলবে তুমি নতুন বউ।’

‘ভদ্রতা শেখাবেন প্লিজ।অন্যর বেডরুমে নক না করে ঢোকার ভদ্রতা, অন্যর জামাই এর দিকে নজর দেওয়ার।’

‘রোশান ভাইয়া এটা কি বিয়ে করেছেন আপনি।এ কোনো মেয়ে।এর মাঝে টোটাল কোনো ভদ্রতা নেই।অসভ্যদের মত তর্ক করে।ঘরে দরজা খোলা রেখে নোংরামো করে।’

‘জিনাত উই আর ম্যারেড।দিন আর রাত বলে কথা নেই।নাউ ইউ গেট লস্ট।আর হ্যাঁ ও আমার ওয়াইফ।এখন আর শুধু সারাহ নয়।সারা সিদ্দিকী।সো ওকে রেস্পেক্ট করতে না পারলে আমার মুখোমুখি হতে হবে।ও এখন সিক ওকে রাগিও না।’

জিনাত এর মাথায় যেনো আকাশ যেনো ভেঙে পড়ল।হনহন করে বেরিয়ে গেলো।আমার মুখে মুহুর্তের মাঝে হাসি ফুটল।অদ্ভুত এক ভাল লাগা দোলা দিলো মনের মাঝে।

পরেরদিন খুব ভোরে হাই তুলতে তুলতে ঘুম থেকে উঠলাম আমি।ওশান কে ফাঁকা জায়গা পাচ্ছিনা।ওশানের সাথে বোঝাপড়া আছে আমার।বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে ওশান কে দেখব।আজ নাকি যেতে হবে।ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার দাদু আর রোশান স্যারের দাদু দুজনে মসজিদ থেকে ফিরছেন গল্প করতে করতে।তরী উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে।তরীর থেকে ঝাড়ু টা নিয়ে বললাম,

‘ওয়াও বেবি এগুলা কাজ আমার দারুণ লাগে।দাওনা আমি করি।

‘না ভাবি প্লিজ।কাল রাতে আম্মা আমাকে গালি দিয়েছে খুব।বলেছে আপনাকে আমি কেনো কাজে দিয়েছি।রোশান ভাইয়া মাছ ধুতে বললে আমি কেনো এগিয়ে গেলাম না এসব।আরো অনেক কথা।ভাবি আরো অনেক কথা আছে।কাল আপনার দেবর আর ছোয়া সারাদিন ঘুরাঘুরি করে এসেছে।কেমন লাগে ভাবি বলুন তো আমার পাশে সুয়ে যদি বলে তোমার সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো ভীষণ মিস করছি।রাতে একা ঘুমোতে ভাল লাগেনা।ছোয়া কাল রান্না করে পাঠিয়েছে।শ্বাশুড়ি ভীষণ খুশি জানেন।তার ছেলে পাপ করে এসে মায়ের কাছে বলে আর তার মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।’

‘তরী আমি আছিনা।ছোয়া আর ওশানের রিলেশন দেখবা নেই।’

‘কিভাবে?’

‘ছু মন্তর ছু, ইরিবিরিছিরি এই মন্ত্র ছুড়ে মারব।’

‘কাল আম্মার ভাতিজির মুখ টা দেখার মত ছিলো।জীবনে প্রথম আমি খুশি হয়েছি।আমাকে খুব জালিয়েছে জিনাত।’

‘ও নেক্সট এ বাড়িতে আসুক।ওর জন্য এই ওঠান ঝা”ড়ু দেওয়া ঝা” টা ওর জন্য রেখে দিলাম।জানো তরী আমি অন্যায় দেখতে পারিনা।একটুও পারিনা।আমার খুব প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করে।বিশেষ করে ওইসব মানুষ দের বেশী অপছন্দ যারা পরকিয়াতে লিপ্ত।নিজের ওয়াইফ রেখে অন্য নারীতে আসক্ত এরা এক সাথে কয়েকটা জীবন নষ্ট করে।এদের অন্ডকোষ কর্তন করা উচিত আমি মনে করি।এদের মায়েরা কি আসলেই মা।কিভাবে ছেলেদের এই অন্যায় সাপোর্ট করে।এইসব মায়েদের ও শিক্ষা হওয়া উচিত।আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম এদের জন্য আলাদা আইন চালু করতাম।আনম্যারেড মেয়েদের কাছে নিজেকে অবিবাহিত বলে পরিচয় দিয়ে তাদের মন নিয়ে খেলার জন্য উপযুক্ত শাস্তি দিতাম।আমি জানিনা তরী কেনো এসব আমি সহ্য করতে পারিনা।আর জানো তোমার দিকে তাকালেই আমার কষ্ট হয়।আমার মনে হয় যদি তোমার সবটুকু কষ্ট আমি নিয়ে নিতে পারতাম ওই যন্ত্রণা যদি আমি সহ্য করে তোমাকে সুখি করতে পারতাম আমি শান্তি পেতাম।’

‘আমার জীবনের কোনো পূণ্যর ফলে আপনার সাথে পরিচয় ভাবি।আপনার মত মেয়ে প্রতিটা ঘরে ঘরে লাগবে ভাবি।ওশান,জিনাত,আম্মা,ছোয়া এদের শাস্তির জন্য।আর রোশান ভাইয়া খুব লাকি ভাবি।’

‘উনাকে তো ভালই বাসিনা।কিভাবে লাকি হল।’

‘ভালবাসেন না তাহলে জিনাত এর উপর ক্ষেপলেন কেনো?’

‘আমিও ভালবাসব না কাউকে বাসতেও দিবোনা বুঝলে।’

চলবে?

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here