একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ২৮+২৯

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২৮
রোকসানা আক্তার

পরদিন সকালে পোদ্দার বাড়ি একটা তুমুল ঝড় লেগে যায়।ভুট্টো পোদ্দার একেবারে তেলে-বেগুনে লংকা!ছেলেটার গাল ঠাসিয়ে ১৬ পাটি দাত ফেলে দিতে ইচ্ছে হয়।দিলোতো মান-সম্মান সব ন্যাস্য করে।সমাজের কূলে মাথাটা উনার হেইট করে আনলো।সমাজের সামনে মাথা তুলে তাকাবেন কিভাবে!গেলো তো সবার বিশ্বাস ভেঙ্গে!নিজের আভিজাত্য এবং দাম্ভিকতা সবটাই ছিঁড়েখুঁড়া অবস্থা! অথচ ছেলেটা এতবড় কান্ড ঘটিয়ে ফেলল ভাবনাতেই আসছে না ভুট্টো পোদ্দারের।টি-টেবিলের উপর সাজানো ফুলদানিটা এক ছিটকে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারেন।ফুলদানি ভাঙ্গার আওয়াজে পুরো দালান কেঁপে উঠে।সাথে বাড়ির কাজের লোকগুলোও এক এক করে কাঁপতে থাকে।ছেলের নামে এমন বিভৎস নিউজ বেরিয়েছে এর আগে বাড়ির লোকগুলোও কি এর ছিটেফোঁটাও দেখে নি?সবাই কি তখন বসে বসে আঙ্গুল চুষছিলো?রাগে-ক্ষোভে বিষাদ ভুট্টো পোদ্দার!
“সবাইকে এক এক করে এই বাসা থেকে বিদেয় করবো!সবাইকে!বাসায় এতকিছু ঘটেছে অথচ কেউই আমাকে একটুখানি জানাতে পারলো না?বাসায় কি তাহলে মাইনে একলাখ খরচা করে গাধা-গাধী রাখি?”
“ওহ স্যার,ওমন কথা কইবেন না।আমি এসবের কিছুই জানি না।আমারে অরুন ভাই দু’মাসের জন্যে ছুটি দিছিলেন তাই আমি বাড়ি গেছিলাম।সত্যি বলছি।!”
“স্যারগো স্যার, আমিও এর কিছু জানি না।”
দুজনের এরকম জবানবন্দি দেখে পাশে যারা ছিল সবাই-ই তাদের বিভিন্ন রিজন দেখাতে থাকে।নাহ তারা এসব না কিছু দেখেছে আর না কিছু শুনেছে।কারণ অরুন ভাইতো তাদের সবাইকে তখন লম্বা ছুটি দিয়েছিল।
ভুট্টো পোদ্দার চোখ লাল করে এবার ছেলের দিকে তাকান।
“অরুন,তুই সত্যিই ওদের ছুটি দিয়েছিস?”
অরুন অপ্রস্তুত হয়ে যায়।পিটপিট চোখে একবার বাড়ির লোকগুলোর দিকে তাঁকায়, আরেকবার বাবার দিকে!
“আমার উত্তর কই?” চেঁচিয়ে বলে উঠেন।
অরুন কোনো উত্তর করেনা।মাথা নুইয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে।
“উত্তর নাই তাই না?আমি যখন বিদেশ ছিলাম প্রায়শই দেখতাম তোকে নিয়ে লোকজন এমন নানানও প্রশ্ন তুলতো।আমি বিলিভ করতাম না।উল্টো লোকদের দামামা দিয়ে মুখ বন্ধ করতাম।কিন্তু এখন এসব কি দেখছি,হ্যাঁ?গিভ মাই এন্সার!!”
সেখানে ভুট্টো পোদ্দারের অন্তরঙ্গ বন্ধু শাহাবুদ্দিন ও দাড়িয়ে।বাসায় কোনোরকম প্রবলেম হলে পোদ্দার আগে বিষয়টি শাহাবুদ্দিনকে জানান।শাহাবুদ্দিনও বন্ধুর বিপদের কথা শুনে শত ঘাপলা মাথায় বয়েও দৌড়ে চলে আসে।বলা যায়,শাহাবুদ্দিন পোদ্দারের বাম হাত।অরুনকে এরকম ঠ্যাটামি দেওয়ার কারণে তিনি পোদ্দারকে থামানোর বৃথা চেষ্টা।
“আহা,খামোখা না বুঝে না শুনে ছেলেকে দোষারোপ করছিস কেন?এমনো হতে পারে কেউ শত্রুতা করে এমনটা করেছে।অরুনকে ফাঁসিয়ে তোর রেপুটেশন নষ্ট করতে!”
“আমার-না প্রচন্ড রাগ উঠতেছে।বড় ছেলেটার বিয়েটা গত পরসু শেষ হলো।এরমধ্যে কুটুবাড়ির সবাই যদি এ বিষয়টি শুনতে পায় তখন ব্যাপারটা কোথায় গড়াবে ভেবে দেখেছিস?তারউপর আবার দেশের জনগণ।”
“এইযে উটকো ঝামেলা মাথায় না নিলে হয় না?বলা নেই,কওয়া নেই খামোখা রিপোর্ট বানিয়ে কারো নামে প্রকাশ করে দিলেই তা সত্য হয়ে যাবে এমনতো নয়?আচ্ছা তুই আমায় এটা বল এটা কোন পত্রিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে?”
“বাংলাদেশ প্রতিদিন।”
“বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক তো বর্তমানে শহীদুল সাহেব।”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা তুই এত বিচলিত হোস নাতো!আমি শহীদুল সাহেবকে কল দিয়ে বিষয়টি ক্লিয়ার হচ্ছি।আর এই অরুন, তুমি এখন রুমে যাও।যখন প্রয়োজন হবে তখন তোমায় ডাক দিব।”
অরুন শাহাবুদ্দিনকে সায় দিয়ে রুমে চলে যায়।শাহাবুদ্দিন শহীদুল সাহেবকে কল করেন।চার-পাঁচ বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে রিসিভ হয়।
“জ্বী,কে বলছেন?”
“আমি শাহাবুদ্দিন। ”
“সিভিল সার্জেন শাহাবুদ্দিন স্যার?”
“জ্বী।”
“স্যার,কেমন আছেন?”
“এই তো ভালো।একটা বিষয় জানতে আপনায় কল করা।আই হোপ উত্তর করবেন।”
“জ্বী,স্যার বলুন?কী উত্তর চাই?”
“আজ ভুট্টো পোদ্দারের ছেলেকে নিয়ে যে নিউজ বেরিয়েছে ওটা কি আপনি করেছেন?”
“স্যার হঠাৎ এ প্রশ্ন ?”
“প্রশ্ন করছি উত্তর করবেন।”
“জ্বী,স্যার আমিই।”
“আপনাকে রিপোর্টগুলো কে দিয়েছে?”
“আপাতত ক্লাইন্টের পরিচয় দিতে পারছি না স্যার।পরে জানতে পারবেন।আর ক্লাইন্ট একজন নয়।অনেকেই জড়িত এতে!”
“ভুলবাল নিউজ বের করবেন।আর পরিচয় দিতে গেলে ভাত ভেঙ্গে যাবে এমনতো হয়না!চাকরি খাবো আপনাদের!”
বলেই কলটা কেটে দেয় শাহাবুদ্দিন। ভুট্টো পোদ্দার এগিয়ে আতঙ্ক গলায় বলেন,
“কি বলেছেন উনি?”
“শালা নাম লুকচ্ছে।এবার শালাকে ছন্নছাড়া করবো।”
তা শুনে ভুট্টো পোদ্দারের মুখখানা চিমসে আসে।তিনি চোখবুঁজে সোফার উপর আলতোভাবে বসেন।শাহাবুদ্দিন বন্ধুর মুখের দিকে তাঁকিয়ে টাল সামলাতে পারেনি আর।নানান জায়গায় কলের সিরিয়াল বসান।
কে এসব করেছে,কাদের এসবে হাত আছে ইত্যাদি ইত্যাদি বহু লোককে তথ্যাদি সংগ্রহ করতে আদেশ করেন।
কিছু সময় পার হওয়ার পর, বাইর থেকে লোকজনের গুটুর গুটুর আওয়াজ আসতে থাকে।বাড়ির কাজের লোক সেদিকে এগিয়ে ভুট্টো পোদ্দারকে বলে,
“স্যার,মনে হয় সাংবাদিক আইছে।”
সাংবাদিকের কথা শুনে ভুট্টো পোদ্দার চমকে উঠেন।সাংবাদিকের কবলে পড়া মানেই হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া।পেটের মধ্যে জমে থাকা আঁতুড়ি পাঁতুড়িও এরা টেনেছিঁড়ে বের করে ফেলে।নাহ কিছুতেই এখন সাংবাদিকের সামনে যাওয়া যাবে না।সাংবাদিকের সামনে পড়া মানেই বিপদ।ভেবেই তিনি কাজের লোককে দরজা না খুলতে নির্দেশ করেন।কাজের লোকরা তাই মেনে নেয়।
শাহাবুদ্দিনের কল বাজে।তাকিয়ে শহীদুল সাহেবের কল।বিরক্তি চেপে বলেন,
“আবার কল?”
“স্যার প্লিজজ আমার চাকরি খাবেন না।আমি বলতেছি কে আমায় রিপোর্টগুলো পাঠিয়েছে।”
“বলুন।”
“স্যার যুগান্তর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আলাউদ্দিন আলম ।উনিই আমায় রিপোর্টগুলো পাঠিয়েছেন।”
“সিউর?”
“ইয়েস,স্যার।আর আমি যে বললাম কাইন্ডলি আমার নামটা অপ্রকাশিত রাখবেন।”
“ওকে।”
“তাহলে রাখলাম স্যার।”
“হুঁ।
শাহাবুদ্দিন কল রেখেই মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তোলে।তারপর হাসি চেপে বলেন,
“তোর শত্রুকে পেয়ে গেছি।”
ভুট্টো পোদ্দার শাহাবুদ্দিনের কথায় জিজ্ঞাসূচকে তাঁকান।
“কে হতে পারে তাইতো?”
“ইয়েস।”
“আলাউদ্দিন আলম।আই মিন যুগান্তর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক।”
“চিনলাম না ঠিক।”
“তুই চিনবি না।তবে অরুন ঠিকই চেনবে।ওয়েট আমি অরুনকে ডেকে আনতেছি।”

অরুন বিছানার চাদর খামচে ধরে।মেয়েগুলার প্রতি তার প্রচন্ড রাগ হয়।এখন এদের সামনে ফেলে চিবিয়ে খেত সে।সাহসতো কম নয় এদের! স্বইচ্ছায় এসে রুমডেট করে আবার উল্টো ফাঁসায়! মামার বাড়ির আবদার পেয়েছে নাকি?
ভেবেই অরুন ক্রোধানলে ফেঁটে যায়।রাগটাকে চাপিয়ে চোখদুটো বুঁজে আনে।পরক্ষণে আবার ভাবনাটা অন্য ভাবনায় চেয়ে যায়।নাহ এটাতো তারই দোষ।তার পাপের ফল।মেয়েরা হলো অমূল্য রতন।তাদের শরীরের প্রতিটি অংশই রক্ষণশীল। খুব লাজুকতায় নিজেকে গুঁটিয়ে রাখে সবার আড়ালে। আর সেখানে তাদের সতীত্ব নষ্ট করারতো মানে হয় না।কীভাবে পারলো সে এতটা নীচক হতে!
ভেবেই অরুন অস্থিরতায় আবার বিভোর হয়ে পড়ে। রাগে-ক্ষোভে চোখদুটো লাল আভা ধারণ করে তার।
“অরুন?এই অরুন?”
শাহাবুদ্দিনের শব্দে অরুনের ধ্যাণ ফিরে।স্বাভাবিকতা বজায় রেখে সেদিকে তাকায়।শাহাবুদ্দিন অরুনের চোখের দিকে তাঁকিয়ে পাশ ঘেঁষে বসেন আর বলেন,
“অরুন তুই চিন্তা করছিস,না?আরেহ ব্যাটা এত চিন্তার কি আছে?এই আঙ্কেলটার উপর একটুখানি ভরসা রাখতে পারিস।আর শুন,একদিন তুই আমায় যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক আলাউদ্দিনের কথা বলেছিলি না যে তোকে নিয়ে মিথ্যে রিপোর্ট লিখতে চেয়েছিল….?
“আলাউদ্দিন”নামটা শুনেই অরুন হতচকিয়ে উঠে।শাহাবুদ্দিনের কথা বলার ভঙ্গিমা বুঝতে না পেরে চুপ হয়ে থাকে।শাহাবুদ্দিন খানিক টুকু হেসে আগের প্রসঙ্গ টেনে আবার বলেন,
” ভুলে গেছিস,তাইতো?”
এবার অরুন মুখ খুলে।সরু গলায় বলে,
“নাহ,তেমন কিছু নয়।সাডেন উনার কথা?”
“আরেহ,ওই ব্যাটায়ই তো তোকে ফাঁসিয়েছে!”
অরুনের বুকের মাঝখানটা ছিঁড়ে এবার যেন কলিজাটা বেরিয়ে আসার উপক্রম। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে!
তারমানে শেষমেষ অশ্রু তাকে ফাঁসিয়েই দিল?অশ্রু এতটাই কার্পণ্য হতে পারলো?কালরাতই তো তার বাবাকে ছাড়িয় দিল আর আজ তার থেকে এমন কিছু পাওয়ার আশা অরুন স্বপ্নেও ভাবেনি।বুকটা হাঁসফাঁস করতে থাকে। পানি একেবারে চোখের কোটরে চলে আসে।এখন শুধু বেয়ে পড়ার বাকি।শাহাবুদ্দিনের সামনে চোখের পানি কিছুতেই ফেলতে দেওয়া যাবে না।
“অরুন নিচে চল।তোর বাবাকে ওই ব্যাটার সব ডিটেলস দে।আর দেখব এদের বুকেরপাটা।!”
অরুন দমখিঁচে নিজেকে শান্ত করে।বলে,
“কিছু করতে হবে না তোমাদের।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসে অরুন।পেছন পেছন শাহাবুদ্দিনও আসছেন অরুনের কথার অর্থ না বুঝতে পেরে!অরুন নিচে নেমে তার বাবার কাছে না গিয়ে সোজা সদরে চলে যায়।ভুট্টো পোদ্দার ছেলের মতি না বুঝতে পেরে দাড়িয়ে যায়।।অরুন ঠাস ঠাস করে দরজা খুলতেই কয়েকজন সাংবাদিকের গোলবৃত্তে আঁটকা পড়ে।আর বাঁধা প্রদান হয়ে যায় ভুট্টো পোদ্দারের নাগালের বাইরে।সাংবাদিকরা অরুনকে ঘিরে ধরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে।অরুন ক্ষিপ্রতা সামলে সবাইকে শান্ত হতে বলে।নাহ সাংবাদিকরা কিছুতেই ছাড়বে না আজ তাদের উত্তর চাই ই চাই।
“বলুন,মিস্টার অরুন?আপনাকে নিয়ে যেসব নিউজ বের হয়েছে তা কি আদৌ সত্য এবং এ ব্যাপারে আপনার কি মতামত?আশা করি উত্তর দিবেন।”
ছেলেকে এমন আক্কেলগুড়ুমে ফেলাতে পোদ্দার আর চোখবুঁজে সহ্য করতে পারেননি।দপদপ পা ফেলে সাংবাদিকদের সামনে এসে কড়া গলায় বলতে থাকেন,
“আমার ছেলের নামে যেসব নিউজ বেরিয়েছে সব মিথ্যে।আর কাদের এতবড় সাহস মিথ্যে নিউজ বের করে আমার ছেলেকে ফাঁসানোর এই ভুট্টো পোদ্দার তাদের দেখে নিবে।এই ব্যাপারে আর কথা বলতে ইচ্ছুক নই।আপনারা চলে যান।”
বলেই তিনি অরুনের হাত টান দিয়ে ভেতরে আনার চেষ্ট করেন।অরুন বাবার হাত ছাড়িয়ে বলে,
“বাবা আমার কিছু বলার আছে আর তা একান্তই সাংবাদিকদের সামনে।”
বলেই অরুন বাবাকে পাশ কেটে সাংবাদিকদের দিকে এগিয়ে যায়।অরুন নিজের উপর নিজেই জেদ চেপে বলতে থাকে,
“যেসব নিউজ বেরিয়েছে সবই সত্য।আমি স্বীকার করছি যারা আমার নিয়ে জবানবন্দি দিয়েছে তাদের সবার সাথে আমার রুমডেট হয়েছে।।আর আমি জানি,এখন আপনারা হয়তো আমার ঘৃণা থেকেও বেশি কিছু করেন।এতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।কারণ আমি এসবের প্রাপ্য। এখন দেশের মানুষ আমাকে যেভাবে, যেরকম শাস্তি দিতে চায় আমি তা সাগ্রহে মাথা পেতে নিব।ভালো থাকবেন।”
বলেই অরুন চোখের পানির বাঁধ সামলে চলে আসে সবার সামনে থেকে।হতভম্ব ভুট্টো পোদ্দার,হতভম্ব শাহাবুদ্দিন, হতভম্ব সাংবাদিক!হতভম্ব দেশের জনগণ। আর হতভম্ব আরেকটা মানুষ যে দূর থেকে অরুনকে লাইভে দেখছে,সে হলো অশ্রু।
!
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২৯
রোকসানা আক্তার

“জীবনে এমন সুখের মুহূর্ত আর কখনো আসে নি আমার জীবনে।আজকের দিনটা সত্যিই আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠত্ব দিন।”
বলেই স্মৃতি খুশিমনে পা নাড়াতে থাকে।অরুন তার ভুল স্বীকার করায় স্মৃতির মনে বসন্ত বয়ে যায়।আর অশ্রু দু’পাশে হাত রেখে নিবৃত্ত স্মৃতির কথা শুনে।শোনার ভঙ্গিমা রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে মেঘের ভেলার মতো।স্মৃতির সাথে যে তালে তাল মিলিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করবে অশ্রুর মাঝে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।চোখদুটোর দৃষ্টি একদিকে নিথর,মুখের বুলি সামান্য ও,হু,হা অব্দি।স্মৃতি পায়তার পায়তারা আবারও বলে উঠে,
“আচ্ছা ধরো,অরুনকে সাঁজা দিবে। সাঁজাগুলো যদি পাঁচ বছর জেল,পঞ্চাশ বছর জেল অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় তাহলে তুমি তার কোন শাস্তিটা চাইবে?”
“বলতে পারবো না।তা হাইকোর্টের মর্জি।”
“য়ু-ম মানলাম তো।তারপরও বলো তুমি কোনটা চাইবা।”
“তা জানি না।তুমি বলো।”
“আমি?আমিতো যাবজ্জীবন চাইবো।যাবজ্জীবন জেলের চারদেয়ালে থাকলে মেয়েদের সাথে আর ইটিস পিটিস করার সময় পাবে না ব্যাঁটা।হো হো হো হো।”
অশ্রু আর কথা না বাড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানে।বলল,
“স্মৃতি চলো আমরা ভেতরে যাই।এখানে আর বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না।”
“আচ্ছা চলো।”
তারপর দুজনে রেলিং থেকে স্মল জাম্প দিয়ে নিচে নামে।বারান্দা থেকে রুমে ঢোকে স্মৃতি মোবাইলটা বিছানার উপর রেখে প্যান্টের নিচে ফোল্ড করতে থাকে।ফোল্ড করতে করতে বলে,
“আচ্ছা আমি একটু বাথরুমে যাচ্ছি।তুমি থাকো।”
“যাও।”
স্মৃতি বাথরুমে যাওয়ার পর অশ্রুর মুডটা অন্যরকম হয়ে যায়।মনটা তার হাঁসফাঁস করছে।কোনোকিছুই ভালো লাগছে না।হাতের কাছে একটা ছুরি ফেলে বুকটা খন্ড বন্ড করে কলিজাটা বের করে কষ্টের দাগকাটা গুলো দেখতো।কেন এখন তার এতটা কষ্ট হচ্ছে,কী কারণে কষ্ট হচ্ছে, কীসের জন্যেই বা কষ্ট হচ্ছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো।আফসোস তা আর সম্ভব না।
পরক্ষণে কষ্টগুলোকে দমিয়ে বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অশ্রুর।বিছানার কাছে যেয়ে টাইম দেখার জন্যে হাতে ফোন নেয়। আজ সকাল থেকেই মেঘলা।চারপাশ ধূসর।রোদ নেই।কিছুক্ষণ পর পর শৈত্যপ্রবাহ এসে শীতের ছাট ছড়িয়ে দিয়ে যায়,যে শীতে কেঁপে উঠে সবাই।অশ্রু প্রথমে ভাবলো কুয়াশার কারণে এমনটি হছে।কিন্তু যখন ঘড়ির কাঁটা আটটা পেরিয়ে ন’টায় টিকটিক করে তখনই বুঝে ফেলল মেঘলার কারণে এমনটি হচ্ছে।টাইম দেখার পর ফোনটি হাত থেকে বিছানায় রাখতে গেলেই চোখ পড়ে স্মৃতির ফোনের ডিসপ্লের দিকে।মেসেজ এসেছে ।অশ্রু মেসেজের দিকে খুঁটিয়ে তাকায়,তবে চোখদুটো তার আঁটকে যায়।সেন্ডারের নামটা খুব সুন্দর করে লেখা-”অরুন!”অশ্রু সেন্ডার নামটি দেখে অনেকটা ভড়কে যায়।আদৌ এই মেসেজটি অরুনের তো?নাকি অন্যকারো।অরুন নামের তো অনেকেই আছে।নাহ,নাহ এভাবে হবে না।যে করেই হোক কনফিউজড দূর করতে হবে।দেখতো হবে মেসেজটি কে পাঠিয়েছে!.
ভেবেই অশ্রু বাথরুমের দরজার দিকে তাঁকিয়ে খুব সাবধানে মোবাইলটি হাতে নেয়।মেসেজ অপশনে ঢুকে মেসেজটি পড়তে থাকে..
“মেয়ে মানুষ এতটা নীচক হয় আমি ভাবতেও পারি না।নিজের প্রায়োরিটির জন্যে যে অন্যের ক্ষতি করে,যে অন্যের মানসম্মান ধূলিসাৎ করে তাদের কী বলা উচিত তা আমার জানা নেই।তবে,এটুকুই বলব অশ্রুকে মিথ্যে বাহবা দিয়ে যেভাবে আমায় সবার সামনে হেয় করেছো তোমাকে তার মাশুল গুনতে হবে!কঠিন মাশুল!আর আমার ভালোবাসা পেতে চেয়েছো না?তার বিপরীত কী জানো?-ঘৃণা!ঘৃণা করি তোমায়!বেহায়া কোথায়কার!”
দরজা খোলার শব্দ পেয়েই অশ্রু ব্যাক বাটনে টাস করে তাড়াতাড়ি ফোনটা আগের জায়গায় রেখে দেয়।স্মৃতি তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হয়।বলল,
“খুব শীত পড়ছে আজ।”
অশ্রু চুপ হয়ে থাকে।স্মৃতি আবার প্রসঙ্গ টেনে বলল,
“অশ্রু আমার না আজ তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। আমার কাজিন আসবে।”
“ওহ।”
“তোমার ফেইস মেক-আপ আছে?”
“হ্যাঁ।দিবা?”
“তাহলে জিজ্ঞেস করলাম কেন?”
অশ্রু হেসে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা দিচ্ছি।”
ফেইস মেক-আপ স্মৃতির হাতে দিয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি খেতে এসো।আমি বাইরে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
অশ্রু দরজার এপাশে এসেই চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে।মাথায় ইতোমধ্যে ঝিমঝিম শুরু হয়ে গেছে। স্মৃতিকে পাঠানো মেসেজের না বুঝলো অর্থ, না বুঝলো স্মৃতির রকমসকম। এখানে কাকে বিশ্বাস করবে অরুনকে নাকি স্মৃতিকে অথচ দুজনের সাথে মেসেজিং হচ্ছে।তাছাড়া স্মৃতিও তো পারত তাকে একটু জানাতে ?তারউপর অরুন এতটা ক্ষ্যাপা?একটা মেসেজে সবকিছু ক্লিয়ার হওয়া যাবে না।আরো কিছু মেসেজ চেইক করে জানতে হবে বিষয়টা।কিছুই বুঝে আসছে না অশ্রুর।মাথাটা একটু ঝাঁকায়।যে করেই হোক আর একবার স্মৃতির ফোনটা হাতে চাই তার!

অরুন চোখ বন্ধ করে বসে আছে সোফায়।পাশ থেকে ভুট্টো পোদ্দারের খরখর গলার ধমক ভেসে আসছে।অরুন তা কান ঠেকিয়ে শুনে যাচ্ছে।কিছুটি করার নেই।তাকে নিয়ে জনসম্মুখের সামনে যেসব নিউজ বেরিয়েছে, এরউপর তার জবানবন্দি এতে ভুট্টো পোদ্দার রেগে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।ইমতিয়াজ বাবার পাশে গিয়ে বসে।বলল,
“বাবা,প্লিজজ এভাবে রেগে যেও না।অরুন অবুঝ।অরুনের এখনো বুঝ হয়নি।যা করেছে সব ভুলই করেছে ও।এখন ছ্যাঁতাছ্যাঁতি,ধমকে কোনো লাভ হবে না।তারচে ভালো এর সল্যুশন বের করতে হবে!”
“স্টপ!তোর ও লজ্জা হওয়া উচিত তুই যে ওকে সাপোর্ট দিচ্ছিস।আরেহ মানহানির মামলা হচ্ছে ওর উপর।আমার মান-সম্মানটাও ধুলোয় ধূলিসাৎ হচ্ছে সেসব দেখছিস না?কিভাবে মুখ দেখাবো আমি, বল? “
“আমি বুঝছি বাবা তুমি কষ্ট পেয়েছ।তারপরও ক্ষমা করো।ভুল হয়ে গিয়েছে ওর।কারণ ও তোমার ছেলে।”
“ক্ষমা! আমি?আরেহ আমার ক্ষমা দিয়ে কি হবে?দেশের মানুষতো ওকে ক্ষমা করুক”
ইমতিয়াজ পোদ্দারকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়।ইমতিয়াজ শাহাবুদ্দিনের মুখের দিকে তাঁকায়। শাহাবুদ্দিন ইমতিয়াজকে ইশারা করে।সরিয়ে দেয়।তারপর নিজে গিয়ে বসে।বলল,
“এই তুই আমার উপর বিশ্বাস করছিস না?তোর ছেলের উপর মামলা হবে?তোর ছেলেকে জেলে নিয়ে যাবে?এই তোর ধারণা? বল?”
“ও জেলে গিয়ে পঁচুক না মরুক তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।আমার কষ্ট আমার সম্মান।ও আমার সম্মান রাখেনি।”
“আবার একই কথা!যা হবার তো হয়েই গেছে।এখন বলে কী লাভ?আর,এই আমি তোর পাশে আছি না?জেল,মামলা সব থাঁবিয়ে দিব।তুই বিশ্বাস রাখ আমার উপর!”
“বিশ্বাস!বিশ্বাস কিভাবে?ওই বদতো বিশ্বাস রাখে নি।ওর জবানবন্দিতে আর বিশ্বাস,আর আশা….
তাচ্ছিল্য গলায় বলেই চুপ হয়ে যান।
“সেটাও আমি দেখছি।এই অরুন?তুই জবানবন্দি ফিরিয়ে নে।আমি যেভাবে বলব সেভাবে করবি।পারবি তো?”
“প্রথমবার সত্য বললাম দ্বিতীয়বার মিথ্যে বলতে?”
“তাহলে তুই কি চাচ্ছিস?”
“প্রথমে কি বললাম আমি…?
বলা শেষ করেই অরুন চলে যায় উপরে।পোদ্দার কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন ছেলের চলে যাওয়ার দিকে।প্রচন্ড রাগে দাঁত কটমট করে বলল,
“ও যদি নিজের মানসম্মান না বুঝে আমরা বলেও ওকে বুঝাতে পারবো না।খামোখা কষ্ট করে কোনো লাভ নেই শাহাবুদ্দিন। ছেড়ে দে ওর আশা।”
পোদ্দার আর বসে নি।চলে যান উনার রুমে।
ইমতিয়াজ কপালের চামড়া কুঁচকে চিন্তায় মনে বসে পড়ে সোফায়।সে নিজেও বুঝছে না কি থেকে কি করবে।বাসায় অরুনকে বুঝাতে পারছে না।বাইরেও লোকজনকে শান্ত করতে পারছে না। ইমতিয়াজকে চিন্তামগ্নতায় দেখে রুমকি তার পাশে কাঁধ চেপে দাঁড়ায় আর ইমতিয়াজকে শান্ত হতে বলে।
অরুনের বিষয়টি শুনামাত্রই ইমতিয়াজ এবং রুমকি তখনই বাসায় চলে আসে।

চলবে…
(আজ ছোট হয়ে গেছে।ভাবলাম আজ গল্প দেওয়া হবে না। কিন্তু আপনাদের মেসেজ,কমেন্টস এর জন্যে স্থবির থাকতে পারিনি।
বাসায় মেহমান।বাসায় মেহমান থাকলে আমি লিখতে পারিনা।)
চলবে…
(অরুন তার অপরাধগুলো স্বীকার করার কারণ কি?আপনাদের কি মতামত এ বিষয়ে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here