একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ৩০+৩১

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৩০
রোকসানা আক্তার

মোবাইলে রিং হয়।পাশে স্মৃতি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলে বিনুনি গাঁথছে।চুলের গোছায় একহাত রেখে মোবাইলের স্ক্রিনে তাঁকায় সে।আর গলা ছেড়ে অশ্রুকে ডাকে।
“এই অশ্রু,তোমার কল আসছে।”
অশ্রু মায়ের হাতে প্লেটের গাদা তুলে দিয়ে ক্লান্তি মনে রুমে ঢোকে।এসেই টেবিল থেকে ফোন তুলে নেয়।রুমকির নাম্বার।রুমকির নাম্বার দেখে অশ্রু খানিক টুকু ক্ষান্ত হয়। স্মৃতির দিকে একফোঁড় তাকিয়ে বেলকনিতে চলে আসে।ইতস্ততা মনে কলটা রিসিভ করে কানে গুঁজে।আর ওপাশ থেকে ভার গলার আওয়াজ ভেসে আসে।
“অশ্রু,এটা তুই কি করলি?শেষপর্যন্ত তুই অরুনকে ফাঁসিয়েই দিলি!তুই জানিস?আমার স্বামী, শ্বশুর,অরুন সবাই কতটা কষ্ট পেয়েছেন!বলার মতো ভাষা নেই।আমি তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।তাকালেই বুকটার মাঝখানে ছ্যাৎ করে উঠে।অরুন যতটা খারাপ,ততটা খারাপ নয়।আমি এ ক’দিনে ওকে যতটুকু জানলাম। প্রথমে হয়তো ভুল জেনেছি।”
“অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক?অন্যায়কারীকে অন্যায় করার সুযোগ দিলে তার তো আরো শাখা গজিয়ে উঠবে,তা তো তুই-ই আমাকে বলতি।জানি এখন তোর খারাপ লাগে,কারণ সে তোর দেবর।”
“অশ্রু,তুই বুঝছিস না ব্যাপারটা!”
“আমার কিছুই বুঝতে হবে না।রাখি।”
বলেই অশ্রু কলটা কেটে দেয়। দমখিঁচে একটা রুদ্ধ শ্বাস বেরিয়ে আসে।মুখে শক্ত কথা বললেও অন্তরটা এখন খা খা করছে।এই খা খা হৃদয়টা অরুনের প্রতি প্রীতি নয় এবং অরুনের প্রতি ভালোবাসাও নয়।বলা যায় একপ্রকার আক্ষেপ।পরসু রাত যখন অরুন মেসেজ করে পাঠায় তার বাবাকে অরুন ছেড়ে দিয়েছে তখন থেকেই অশ্রু একধরনের আক্ষেপতার হৃদয় নিয়ে বিরাজ করছে।মনকে সায় দিতে পারছে না অরুনকে এভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়ায়। তাছাড়া তারও কিছু করার ছিল না।নিউজগুলো পাবলিসড হওয়ার পরপরই অরুনের মেসেজটি আসে।তবে বিষয়টি এখানে স্বার্থপরতা দেখায়।নিজের বাবার কথা ভেবে কতগুলো মেয়ের ইজ্জতকে ধূলিসাৎ করাতো উচিত নয়।যা করেছে ভালোই করেছে।নিজের বাবার কথা বাদ,তবে পর তরে নিজেকে কাজে লাগাতে পেরেই অশ্রুর শান্তি।
এই আহামরি শান্তিটাতেও এখন সে তৃপ্তি পাচ্ছে না।মনে হজারো প্রশ্নের জটলা বাঁধছে স্মৃতিকে পাঠানো অরুনের সেই মেসেজটিতে।কি কারণ ছিল এই মেসেজের পেছনে?স্মৃতি চায়টা কী অরুনের থেকে বা অরুনইবা কী করেছিল?সত্যিই কি স্মৃতি প্রেগন্যান্ট হয়েছিল নাকি অন্যকিছু!কিছুই মাথায় ঢুকছে না অশ্রুর।কিছুক্ষণ মাথাটা একটু ঝাঁকায়।

নুজিফা কোথা থেকে এসে চটকে স্মৃতির ফোনটা কেড়ে নেয়।
“এই নুজিফা,আপু এখন বাসায় চলে যাবো।আজ খেলো না প্লিজজ?আরেকদিন আসলে সময় নিয়ে গেমসটা শেষ করো।এখন আপুর যাওয়ার খুব তাড়া!”
অশ্রু পেছন ঘুরে তাকায়।নুজিফা, স্মৃতির কাড়াকাড়ি দেখে ভ্রু উঁচায়।স্মৃতি অশ্রুর দিকে তাকিয়ে ব্যর্থমনে বলল,
“প্লিজজ অশ্রু,বলো না?আমায় ফোনটা দিতে?”
“এই আপু,গেমসটা আরেকটু বাকি আছে আমার।৯৮ পয়েন্টে শেষ করেছি।আর মাত্র টু পয়েন্ট বাকি।তারপর আর হাতরাহাতরি করা লাগবে না।খেলাটা ফুলি করে একেবারে তোমার ব্যাগে তুলে দিব।খুশি?”
“শোনো মেয়ের কথা!”
“আহা স্মৃতি,ছোট বাচ্চাতো একটু বায়না ধরেছে।খেলাটা শেষ করুক না।ততক্ষণে তুমি একটু জিরাও।”
“আর কতক্ষণ অশ্রু?অলরেডি চারটা বেজে গেছে।”
“নো প্রবলেম।এই নুজি খেলাটা শেষ করতে তোর আর কতক্ষণ লাগবে?”
“এই ধরো দশ মিনিট…”
“দশ মিনিট!?”(স্মৃতি)
“উহহ আপু।দশ মিনিট কি বেশি সময়?তুমি অশ্রু আপুর সাথে কথা বলে একটু সময়টা পার করো না!গেলাম আমি।”
বলেই নুজিফা ফোন নিয়ে অন্যরুমে টো।নুজিফা চলে যাওয়ার ওর স্মৃতি বিরক্তি মুড নিয়ে বিছানার উপর বসে।অশ্রু সেদিকে তাঁকিয়ে গলায় খেকারি টেনে বলল,
“স্মৃতি তুমি এখানে একটু বসো।মা বোধহয় আমায় ডাকছেন।যেয়েই চলে আসবো।”
“আচ্ছা যাও।”
অশ্রু ভরসা পেয়ে বুকে ফু দেয়।আর আলতো পায়ে হেটে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।দরজাটা টেনে দিয়ে সোঁজা নুজির রুমে।নুজিফা অধীর মগ্নে খেলায় মনোযোগ দিয়ে গেমস খেলছে।অশ্রু সেখানে গিয়ে নুজিকে বলল,
“নুজি?আপুকে একটুর জন্যে ফোনটা দে।”
নুজিফা খেলায় পূর্ণ মনোযোগেই জবাব দেয়,
“তুমিও খেলবে?যদি খেলো এখন নয়।আমার পয়েন্ট শেষ হোক।”
“আমি গেমস খেলবো না।একটু প্রয়োজন আছে।”
“কী প্রয়োজন আমায় বলো।শুনবো।”
অশ্রুর রাগ উঠে যায়।এক ছিটকে ফোনটা নুজিফার হাত থেকে নিয়ে যায়।নুজিফা রাগ হয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আপু ফোন দাও?”
অশ্রু নুজিফার দিকে ধমক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে ঠোঁটের সামনে তর্জনী এনে ইঙ্গিত করে চুপ থাকতে।নুজিফা চুপ হয়ে যায়।অশ্রু দরজার দিকে একফাঁক দৃষ্টি দিয়ে তড়িৎ বেগে
মেসেজ অপশনে যায়।
অরুন নামটি ইনবক্সের প্রথমে থাকায় খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি।ইনবক্সের ভেতরে ঢুকে প্রথম থেকে মেসেজ গুলো পড়তে থাকে…
–Hi Arun,একটা খুশির খবর আছে!
—No response
–কি ব্যাপার এন্সার তো দিবা!ইম্পর্টেন্ট কথা আছে তোমার সাথে!
—tell.
—কাল বলবো।তোমার বাসায় গিয়ে।”
—No response
অশ্রু এটুকু পড়ে ভ্রু উঁচায়।মেয়েটি যে একদম বেহায়া তা বুঝতে তার সময় লাগেনি।তারপর অশ্রু পরের মেসেজগুলো আবার পড়তে থাকে।
—আমি যে প্রেগন্যান্ট এটার দায়ভার কে নিবে শুনি?অরুন জানো,এই বেবীটার বাবা তুমি!বেবীটা পৃথিবীতে আসলে কার পরিচয়ে তাকে আমি বড় করবো!প্লিজজ অরুন এন্সার দাও।
—No response
—অরুন প্লিজজ এন্সার মি।আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না ভাবো একবার!তোমার এই পঞ্চাশ হাজার,একলাখ আমার সম্মান এনে দিতে পারবে না।
—বললামতো এবোরেশন করিয়ে নাও।এখানে আমাকে দায়ী করো কোন যুক্তিতে?আমিতো প্রটেকশনের কথা আগেই বলেই দিয়েছি।সো,প্লিজজ আমার কানের কাছে এত গ্যাঁনগ্যাঁন না করে এবোরেশন করে ফেলো।
—কিন্তু অরুন এই বেবীটাকে আমি নষ্ট করতে চাচ্ছি না।বেবীটির তো কোনো দোষ নেই।ও নিষ্পাপ!ওকে কেন আমরা পৃথিবীর মুখ দেখাবো না,বলো?
“ডোন্ট ডিস্টার্ব মি এন্ড ডোন্ট সেন্ড এগেইম মি মেসেজ।বায়য়য়!
তার দু’দিন পর স্মৃতি আরেকটা মেসেজ পাঠায়।
—তুমি যেহেতু বেবীকে চাও না,তাই তাকে আজ নষ্ট করে এলাম।
—no reply.
—উত্তর তো দিবা?অরুন বিলিভ মি আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি।অনেক বেশি ভালোবাসি।তোমার সাথে কাটানো সে রাতের পর থেকেই তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।তোমাকে ছাড়া সত্যিই আমি অসম্পূর্ণ। বিশ্বাস করো আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি!
—Are u crazy?block korbo!
—প্লিজজ না অরুন এমনটি করো না!
অরুন আর কিছু দেয়নি।অতঃপর স্মৃতি আবারও মেসেজ দেয়।
—খুব দেমাক না তোর?বেশি ভাব লস?বেবীর নাম দিয়ে মিথ্যে বলেও তোকে টলাতে পারি নি, এবার দেখিস এই স্মৃতি তোর কি হাল করে। তা তোর পরিবার এবং তুই স্বপ্নেও ভাবতে পারবি না!

” এই নুজিফা,তোমার খেলা শেষ হয়েছে?”
রুমের ওপাশ থেকে স্মৃতির কন্ঠস্বর শোনামাত্র অশ্রু চমকে উঠে।সবগুলো মেসেজ পড়া আর হলোনা। অশ্রু তড়িঘড়ি ব্যাকে গিয়ে নুজিফার হাতে ফোনটা দিয়ে বলে,
“আমি বেলকনিতে যাচ্ছি।আমি যে এখন বেলকনিতে তা ওকে বলিস না।আর ওর ফোনটাও যে আমি হাতিয়েছি তাও বলিস না।”
“কিছু হয়েছে আপু?”
“হু।”
“কি আপু?”
“এখন বলার সময় নেই।পরে বলব।”
“আচ্ছা।”
অশ্রু বেলকনিতে গিয়ে একদম কর্ণার ঘেঁষে সরু হয়ে দাড়ায় যাতে স্মৃতি তাকে রুম থেকে এখানে না দেখতে পায়।।
(কী বুঝলেন?স্মৃতি আসলেই প্রেগন্যান্ট হয়েছিল?)
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৩১
রোকসানা আক্তার

রুমকি ট্রে হাতে অরুনের রুমে প্রবেশ করে।টি-টেবিলের উপর চায়ের ট্রে রেখে এককাপ চা অরুনের দিকে এগিয়ে বলল,
“অরুন চা টা ঠান্ডা হয়ে যাবে।চা টা খেয়ে নাও।ধরো।”
“ইচ্ছে করছে না।”
“ইচ্ছে না হলেই সারাদিন উপোস থাকবে?কাল থেকে তুমি কিছু খাও নি।এভাবে অভুক্ত থাকলে অসুখ হবে।”
“তা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।”
রুমকি খুব তীক্ষ্ণ চোখে অরুনের দিকে তাকায়।অরুনের চোখ-মুখে রাগের চাপ স্পষ্ট।রাগের উৎপত্তি কোথা থেকে তা রুমকি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল।প্রথম ধারায় সেওতো অরুনকে ফাঁসানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস সে আজ তার ভাবী। এভাবে ইমতিয়াজের বউ হবে আবার অরুন তার দেবর হবে এটাই ভাগ্যের লিখন।অরুনকে ফাঁসাতে যেচে সেও ইমতিয়াজের প্রেমে ফাঁসবে কল্পনার বাহিরে ছিল।তবে বর্তমান পরিস্থির মূখ্য দায়ী অশ্রু এবং রুমকি।এটা দুজনেই বুঝতে পারছে।সেদিনের প্লানটি না করলে হয়তো আজ এ পরিস্থিতি অরুনকে দেখতে হত না।তাই অরুনের রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।যাইহোক অরুনের রাগটা সংগোপনে আস্বাদন করে আগের মতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই রুমকি জবাব দেয়,
“আমি তোমার ভাবীর।ভাবী হয়ে দেবরের দিকে খেয়াল রাখাটা আমার দায়িত্ব। ”
“প্লিজজ যাও তো।বললাম তো আমার ইচ্ছে হয় না খেতে।কতবার বলব!”
রুমকি কথার ফসরা না তুলে চুপ হয়ে দাড়িয়ে থাকে।অরুন সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
“তোমায় বোধহয় ভাইয়া ডাকছেন।যাও।”
“ডাকে নি।আমার কানে বাজলে আমি নিজেই চলে যাবো।
অরুন বিরক্তি হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।রুমকি এবার আর চুপ থাকতে পারে নি।অদমে মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে আসে,
“রাগ করে আছো আমার উপর?”
অরুন রুমকির দিলে সুচালো চোখে তাঁকায়।সুঁচালো মুখে ফোঁড়ন টেনে বলল,
“নাহতো কেন রাগ হব।রাগ হওয়ার মতে কিছু করলেই তো রাগ হব!”
“রাগ না হলে তাহলে চা টা খেতে অত্যুক্তি হবে না আশা করি।”
“আবারও!দাৎ..!”
সোঁজা বিছানা থেকে বেলকনির দিকে চলে যায়।রুমকি সেদিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে।কি বলবে অরুনকে সে?আর কিই বা তার বলার আছে।সে নিজেও যে অরুনকে ফাঁসিয়ে দিয়ে অরুনের চোখে নিজেকে অপরাধীর খাতায় নাম বসিয়ে দিয়েছে।অরুন খুবই চাপা স্বভাবের।মুখে কিছু না বললেও অন্তরটা বিষলতা।কাউকে এর রেশ টুকু বুঝতে দেয়না।রুমকি এ কদিনে এসে তাকে যতটা বুঝলো। তাই কথা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না।পরে নিজে বলবে নিজেই শুনবে উল্টো তার থেকে ইগনোর রিয়েক্ট পেতে রুমকি প্রস্তুত নয়।তাই অরুনের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।নিচে ইমতিয়াজ পায়চারি বন্ধ করে রুমকির দিকে তাকায়।সিড়ির দিকে একধাপ এগিয়ে বলল,
“খেয়েছে ও?”
রুমকি দু’পাশে মাথা নাড়ে।ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাচ্ছিল্যতায় কর্কশ গলায় বলল,
“খাবেই আর কবে। ক’দিন পরতো জেলের চারদেয়ালে বসে বসে শুকনো রুটি গিলতে হবে!”
ইমতিয়াজের কথায় রুমকি চমকে যায়।চোখ-মুখ কিঞ্চিৎ লাল আভা ধারণ করে।
“জেলে মানে?”
“অপরাধ করেছে জেলে যাবে নাকো বিলাসিতা ভোগ করবে?ওর জন্যে জেলের চারদেয়ালের আস্তাবলই পারফেক্ট।জীবনটাকে বুঝুক একটু!জীবন যতটা সহজ ভাবে ততটা সহজ নয়!”
“তাই বলে জেলে যাবে?ও এখন জেলে গেলে ফ্যামিলি কতটা অধঃপতনে যাবে বুঝতেছ?”
ইমতিয়াজ হাত দুটো দু’দিকে ভাঁজ করে সরু এঙ্গেলে বলল,
“অপরাধী যখন অপরাধ করে তখন তোমার এবং আমার কাজ হলো আইনের কাছে অপরাধীকে তুলে দেওয়া।অপরাধীর পাঙ্গা গঁজানোর জন্যে আর একধাপ এগিয়ে দিতে নয়।ব্যাপারটা বুঝলে এবার?”
“তাই বলে…!!”
ইমতিয়াজ রুমকিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দপদপ পা ফেলে অন্যত্রে চলে যায়।রুমকিও একফাঁলি রাগ নিয়ে সোঁজা রান্না ঘরে চলে আসে।এসেই বিড়বিড় করে তোহিয়া রাণীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” শুনলে খালামণি,ইমতিয়াজের কথা?”
“শুনলাম।তবে আমার বিশ্বাস অরুন বাবা এরকমটি কখনো করতেই পারে না।ছোট থেকে মানুষ করেছি ওদের।ফ্যামিলির সম্মান ছিঁড়েফুঁড়ে খাবে এরকমটি কখনো শিক্ষা দিই নি।ছোট থেকেই ও খুব শান্তশিষ্ট ছিল, চুপচাপ থাকতো।প্রয়োজন ব্যতীত কারো সাথে দু’কটি কথাও বলতো না।অথচ আজ….বিশ্বাস হয় না আমার!”
বলেই বিভোর মনে টপটপ চোখ থেকে পানি ফেলতে থকেন।আজ সকালেই আসছেন।গতকাল আসার কথা, আসতে পারেননি স্বামীর প্রচন্ড জ্বর ছিল।তাই স্বামীকে কাল ভালোভাবে সেবা-সুস্থতা করে এবং ওষুধ-টষুধ খাইয়ে দিয়ে আজ আসছেন।তখন রাতের মধ্যেই জ্বরের প্রলাপ ১০০ ডিগ্রীর নিচে চলে আসে।
“যা হবারতো হয়েছে।বাবাতো এখন পারে ঘুষটুষ খাইয়ে দিয়ে পুলিশের মুখ চাপিয়ে রাখতে।”
তোহিয়া রাণী নাকের উপরের অংশটা ফুঁলিয়ে ফুঁলিয়ে বলেন,
“পুলিশকে থামাতে পারবে কিন্তু দেশের জনগণকে কিভাবে?অন্যদিক দিয়ে ভাইজান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টোপার।ফরেনারে যদি এর টুঁশব্দও ফসকে যা তাহলে টোপার থেকে ব্যাকডেটেড হতে হবে।জনগণের মুখতো আর ইন্টারনেটে ধামাচাপা যাবে না।”
“ওহ,বুঝতে পারলাম খালামণি।খালামণি তুমি মন খারাপ করো না।বাবা আছেন,মাহবুব আঙ্কেল আছেন।উনারা নিশ্চয়ই একটা পথ বের করবেন।”
“অরুন চা খেয়েছে?”
“নাহ খালামণি!”
তোহিয়া রাণী রুমকির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকেন।তারপর চায়ের লিকার থেকে দু’কাপ চা এবং এক পিরিচে টোস্ট বিস্কুট নিয়ে অশ্রুর হাতে এগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
“তুমি নাস্তাটা ভাইজানের রুমে নিয়ে যাও।আমি একটু অরুনের রুমে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা খালামণি।”
রুমকি চা নিয়ে ভুট্টো পোদ্দারের রুমে সামনে আসে।বলল,
“বাবা,আসবো?”
মাহবুব সাহেবও আছেন।তিনি হেসে বলেন,
“বাবার রুমে আসবে এত ফর্মালিটি লাগে না।চা টা দিয়ে যাও।গলাটা প্রচন্ড খা খা করছে।”
ভুট্টো পোদ্দার কিছু বলেননি।মাহবুবের কথায় রুমকি হেসে দিয়ে চা টেবিলের উপর রেখে চলে যায়।মাহবুব চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চায়ে এক চুমুক দিয়ে বলেন,
“এখন ছেলেকে আইনের হাতে তুলে দিবি এটাই তোর শেষ ডিসিশন? “(মাহবুব)
“উপায় নেই।ওর জবানবন্দি না খুললে হয়তো তখন অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেত।যেহেতু জনসম্মুখে সবই স্বীকার করে ফেলেছে তাহলে আইনের হাতে তুলে দেওয়ায় শ্রেয়।নাহলে আমার রেপুটেশনের প্রশ্ন!”
“ঠিক বলছিস।তবে আমার মতে আরেকটা উপায়ও আছে!”
ভুট্টো পোদ্দার আশায় ভরা চোখদুটো মাহবুবের দিকে তাঁক করেন।বলেন,
“কী সেটা?”
“আলাউদ্দিনের উপর চাপ সৃষ্টি করে কেসটাকে উল্টে দেওয়া যায়।”
“কিন্তু কিভাবে?”
“বলছি……!

পরদিন সকালে হলরুমের ড্রেসিং টেবিলের উপর
আলাউদ্দিনের অটো মোবাইলটা ভ্যাং ভ্যাং শব্দে বেঁজে উঠে।পার পাশের কর্ণারেই কিচেন রুম।কিচেনে দাড়িয়ে পারুল বেগম ঘ্যাচাং ঘচ্যাং করে ভেজিটেবল কাটছেন।তিনি এক পলক মোবাইলের দিকে দেন,আবার আরেক পলক ভেজিটেবলে রেখে গলা উঁচিয়ে আলাউদ্দিনকে ডাকেন।
” কোথায় তুমি?তোমার কল আসছে।”
আলাউদ্দিন বাথরুমে গোসল সাড়ছেন।পুরো শরীর ভালোভাবে ঢলে ঢলে ক্লিন করায় ব্যস্ত।এতটাই ক্লিন করছেন অফিসে গেলে সবাই যেন নাক দিয়ে সুঘ্রাণ নেয় আবেশে।কতদিন যাবৎ ভালো করে গোসল করা হয়নি।বিষন্নতার ভরে এতদিনে গোসলটা যেন মরেই গিয়েছিল।কিন্তু কালরাত যুগান্তর অফিস থেকে এগেইন জয়েনিং লেটার পাওয়ার পর থেকেই মরা শরীরটা আবার জীবন্ত হওয়ার আকুলে দাড়িয়ে যায়।আলাউদ্দিনের জন্যে আজকের দিনটা সত্যিই খুশির দিন।পানির ছিটকের সাথে আরেক রফা ধবনি কানে বাঁজে পারুল বেগমের।তারপর আর দেরী না করে তড়িঘড়ি করে শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসেন।
বেরিয়েই বলেন,
“বাসায় কি ডাকাত পড়ছে নাকি এত চিল্লাপাল্লা করার কি আছে,শুনি?”
পারুল বেগম আলাউদ্দিনের কথায় আড় নয়নে তাকান।বলেন,
“বাসায় ডাকাত পড়েনি।পড়ছে তোমার মোবাইলে।কি এক রিংটোন দিয়ে রাখছে যেটা খালি ভ্যাং ভ্যাং করে সারাক্ষণ বাজতেই থাকে!”
“এই সব সহ্য হয়।আমার মোবাইলকে আঙ্গুল তুলে কিছু বললে একদম সহ্য হয়না!কারণ,এই টোনটা আমার অশ্রু মায়ের পছন্দের একটা টোন!”
“যেমন বাপ তেমন বেটি।হুউুউউউউ….”
ভ্যাং.. ভ্যাং….
আবার রিং হওয়ায় পারুল বেগম সেদিকে তাকিয়ে বলেন,
“ঝগড়া বন্ধ করে আগে কলটা তো রিসিভ কর! আজাইরা প্যাঁচাল সব!”
আলাউদ্দিন পারুল বেগমের দিকে কটাচোখে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নেন।নাম্বারটি আননউন বৈ-কি।তারপরও অফিস থেকে হয়তো কল করেছে ভেবে উদ্দীপ্ত আশায় রিসিভ করেন।রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠল,
“এতবার কল দিলাম রিসিভ করলেন না।খুউউব ব্যস্ত নাকি ভাউ?”
“ব্যস্ত বৈ-কি।গোসলে ছিলাম।কে আপনি?”
“আমি সিভিল সার্জেন মাহবুব সাহেব।আরেকটা রাউন্ডে মিস্টার পোদ্দারের অন্তরঙ্গ বন্ধু।”
“তো আমাকে কল করছেন কেন?”
“দরকার তো তাই।”
‘আমাকে আবার কিসের দরকার?”
ওপাশ থেকে মাহবুব ফিকে হেসে বলেন,
“দরকার ছাড়া কেউ কাউকে কল করে না।সো, মি টু।
আপনাকে একটু পোদ্দার বাড়ি আসতে হবে।”
“ওখানে গিয়ে আমি কি করবো?”
“সখ্য করবো!ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড?”
“আমাকে থ্রেট দিচ্ছেন? ”
“নাহ।আমি জানি আপনি খুবই সাহসী।এখন একটু সাহসের পরিক্ষা না নিলেই নয়!যদি এতই সাহসী এবং প্রতিবাদী হয়ে থাকেন তাহলে পোদ্দার বাড়ি আসবেন।আর যদি না আসেন তাহলে ভাববো মৃত্যু সংকোচে আছেন।আর কথা বাড়াচ্ছি না।যা বলবো সরাসরি।বায়!”

আলাউদ্দিন মাথায় রাগ চেপে বসে।পারুল বেগম তা বুঝত এগিয়ে আসেন।বলেন,
“কিছু হয়েছে?”
“হয়নি, হবে।আমি এখন পোদ্দার বাড়ি যাবো!”

হলরুমের বাম পাশেই অশ্রুর রুম।হলরুমের সব কথা অশ্রুর রুম থেকে স্পষ্ট শোনা যায়।আলাউদ্দিন এতক্ষণ যা বললেন অশ্রু সবই শুনতে পেয়েছে।আর যে শুনেছে তার বাবা এখন পোদ্দার বাড়ি যাবে তখনতো বিষম খাওয়া অবস্থা!সে দ্রুত পায়ে হলরুমে চলে আসে।এসেই বললল,
“বাবা এখন তুমি পোদ্দার বাড়ি যাবে?”
“হুম।”
“কিন্তু কেন?”
“ওরা আমার সাহসের পরিক্ষা নিচ্ছে।তাই পরিক্ষাতে একটু এটেন্ড করে আসি।”
“কে কল করেছে তোমায়?”
“ভুট্টো পোদ্দারের বন্ধু মাহবুব সাহেব।”
“তোমার মাথা খারাপ বাবা?তুমি জানো,এখন তুমি কতটা রিস্কিতে আছো।জীবনের ভয় আমার ফ্যামিলির প্রতিটি পরিবার!”
“ভয় করলে জয় করা যায় নারে মা।আমি দেখব ভুট্টো পোদ্দারের হাত কত লম্বা।তুই টেনশন নিস না।কারণ,দেশের মানুষ তো এখন সবটা জেনেই গেছে।সো ফ্রী ফিল নাউ।ওকে?”
অশ্রু বাবাকে আর কিছু বলতে পারলো না।আলাউদ্দিনও মেয়ের কথার জবাবের অপেক্ষা করেননি।দপদপ পা ফেলে চোখের সামনে থেকে চলে যান।

এখন দুপুর গড়িয়ে আলাউদ্দিন এখনো বাসায় আসেননি।পারুল বেগম ভয়ে জবুথবু।গলার পানি যেন পাকস্থলীতে টেনেটুনে শুষে নিচ্ছে।অশ্রু বাবার ফোনে বারবার কল করার ট্রাই করছে। রিং হয় রিসিভ হয়না।ফোন সাইলেন্স মোডে থাকার ত কথা নয়।তাছাড়া,রুমকির নাম্বারটাও বন্ধ বাতাচ্ছে।ইমতিয়াজের নাম্বার তার কাছে নেই।বলতে গেলে ওই বাসায় কমিউনিকেশনের কোনো ওয়েই নেই অরুন ছাড়া!
পারুল বেগম হতাশাব্যাঞ্জক সোফায় গিয়ে ধপসে বসেন।এখনো লাঞ্চ করেননি স্বামীর চিন্তায়।সকাল সেই আঁটটায় বেরিয়েছে এখন তিনটা ছুই ছুই তারপরও বাসায় আসার নামগন্ধ নাই।অশ্রু কী করবে ভেবে কূল পাচ্ছে না।নিজের রুমে চলে আসে।ভাবে অরুনকে একবার কল করে দেখবে?কল করলে যদি বকাবকি করে!কিন্তু এখনতো তার খুব প্রয়োজন। কল করে অন্তত ত কিছুটা হলেও জানা যাবে ।ওরাইতো তার বাবাকে নিয়ে গেছে। সো এখন কল করে জানলেতো প্রবলেম নাই।
তারপর অশ্রু বুকে ষোলোআনা সাহস নিয়ে অরুনকে কল করে।অরুন তখন তার রুমে বসে বসে ল্যাপটপ নিয়ে ঘুটঘুট করছে।ফোনের উচ্চ আওয়াজে সেদিকে চোখ ফেরে।ফোনটা হাতে নিয়েই চমকানোর মতো অবস্থা তার।ইতস্ততা মনে কল রিসিভ করে।কল রিসিভ হওয়া মাত্রই অশ্রু বলে উঠল,
“আমার বাবা কোথায়?”
“স্যরি?” অনেকটা অবাক হয়ে বলল।
“মানে আমার বাবা আপনাদের বাসায় সেই সকালে গিয়েছিল।এখন বিকেল হয়ে আসছে বাবা তারপরও আসছে না কেন!?”
অরুন নড়েচড়ে বসে এবার।ফোঁড়ন কেঁটে বলল,
“আজিবতো আপনার আমাদের বাসায় আসতে যাবে কোন দুঃখে!?কীসব যা তা বলছেন!”
অশ্রু সুক্ষ্ম ধনুকের মতো বুকে তীব্র একটা আঘাত পায়।এই প্রথম অরুনের মুখে আপনি ডাক শুনলো।এই আপনিটা অপরিচিত বহন করলেও অরুনের মাঝে যে জেদ প্রকাশিত হচ্ছে তা অশ্রুর বুঝতে সমস্যা হয়নি।সে নিজেকে সামলে বলল,
“আপনার বাবার বন্ধু আমার বাবাকে কল করে আপনাদের বাসায় নিয়ে গেছে।এখন বলতেছেন আমার বাবা আপনাদের বাসায়ই যায়নি?মিথ্যে বলার অভ্যেসটা তো ছাড়ুন!”
“মুখে লাগাম টেনে কথা বলবেন!”
“কী!!” ভ্রু উঁচিয়ে বলল অশ্রু।
অরুন কলটা হোল্ডিং এ রেখে বাইরে যায় অশ্রু কি সত্য বলল নাকি মিথ্যা। সে তো কিছুক্ষণ আগেও একবার নিচে গিয়েছিল।কই নিচেতো কাউকেই দেখতে পায়নি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here