একতরফা ভালোবাসা পর্ব -০২

#একতরফা ভালোবাসা (পর্ব -২)
#মৌমিতা হোসেন

দিন কাটতে থাকে। শিউলি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে একটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়। ওর বিয়ের জন্য পরিবার এর সবাই ছেলে দেখা শুরু করে। এদিকে তুহিন এর জন্য মেয়ে দেখতে থাকে। তুহিনের কাছে কেমন মেয়ে পছন্দ জানতে চাইলে ও বলে,”শিক্ষিতো, চাকরিজীবী, আর অবশ্যই ভালো পরিবারের হতে হবে।”তুহিনের পছন্দ মতোই ওর বাবা-মা মেয়ে খুঁজতে থাকে।

এদিকে শিউলি কলেজে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই তুহিনদের বাসায় বিভিন্ন বাহানায় যেতে থাকে। যাওয়ার সময় প্রায়ই বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যায়। এতে সবাই বেশ খুশিও হয়। তুহিনের মা,বোন,ভাবি সবাই শিউলির ব্যবহারে বেশ খুশি হয়। মনে মনে তারাও শিউলিকে তুহিনের বৌ বানানোর পরিকল্পনা করতে থাকে।

শিউলির জন্য ওর বাবা খুব তাড়াহুড়ো করে ছেলে দেখতে থাকায় আর কোন উপায় না পেয়ে অনেক সাহস করে শিউলি বাসায় তুহিনের কথা জানায়। তুহিন এর কথা শুনে বাসার সবাই বেশ খুশি হয়। কারন ঐ এলাকায় তুহিনের মতো দ্বিতীয় ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুব ভালো ছেলে তুহিন। তাই সবাই মিলে ঠিক করে পারিবারিকভাবেই তুহিনের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। হুট করেই এক শুক্রবার শিউলির বাবা-মা আর ভাইরা তুহিন এর বাসায় যায়। অফিস ছুটি থাকায় তুহিন সেদিন বাসায় থাকে। শিউলির পরিবারকে ওর আগে থেকেই অপছন্দ। তাই হঠাৎ তাদের বাসায় দেখে তুহিন কিছুটা বিরক্ত হয়। তুহিন দ্রুত কুশলাদি বিনিময় করে কাজের অজুহাত দেখিয়ে বাইরে চলে যায়।

শিউলির বাবা-মা তুহিনের বাবা-মাকে শিউলির ব্যাপারে সব বলে। আর শিউলি যে সেই ছোট্ট বেলা থেকেই তুহিনকে পছন্দ করে সেটাও জানায়। তুহিনের মা সব শুনে বেশ অবাক হয়। কারন তার যতোটুকু ধারনা সে শিউলিকে পছন্দ করলেও তুহিন শিউলিকে পছন্দ করেনা। তাই কীভাবে কী করবে ভাবতে থাকে। আর তুহিনের বাবা সব শুনে বলে,”শিউলিকে আমারও খুব পছন্দ। আমাদের সামনেই তো বড় হলো মেয়েটা। তবে বিয়েটা তো করবে তুহিন। আর তোমরা তো জানোই ও ভদ্র, ঠান্ডা হলেও ও ওর নিজস্ব কিছু নীতিতে চলে। ওর পছন্দ অন্যরকম। তাই আগে ওর সাথে আলাপ করে তারপর নাহয় আমরা সিদ্ধান্তটা জানাবো।”

শিউলির বাবা-মা তুহিনের বাবার কথায় রাজি হয়ে বলে,”আপনাকে আমরা বড় ভাইয়ের মতো জানি ভাইজান।তাই আপনার কথার ওপরে কোন কথা বলার সাহস আগেও যেমন দেখাইনি এখনো তেমন দেখাবো না। আমরা আপনাদের মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম।” এরপর শিউলির বাবা -মা খাওয়া দাওয়া করে চলে যায়।

এদিকে তুহিন রাতে বাসায় এসে সব শুনে খুব অবাক হয় আর সাথে খুব রেগেও যায়। কারন তুহিন কখনোই শিউলিকে সেরকম চোখে দেখেনি। আর শিউলির পরিবারকে ওর একেবারেই পছন্দ নয়। তাই তুহিন বিরক্ত হয়ে ওর বাবা-মাকে বলে,”আমার জন্য খুব সুন্দরী মেয়ে তোমাদের দেখতে হবে না মা। মোটামুটি সুন্দরী হলেই চলবে। তবে মেয়ের সাথে সাথে পরিবারের সবারও শিক্ষিত হতে হবে,ভদ্র হতে হবে। যেটার কোনটাই ওদের পরিবারে নেই। তাই তোমরা কথা না বাড়িয়ে আজকেই ওদের না করে দাও।”
তুহিনের বাবা-মা বুঝতে পারে যে তাদের ছেলে কোনভাবেই শিউলিকে বিয়ে করবে না।তাই এই ব্যাপারে আর কথা বাড়ায়না।

তুহিন পরদিন ভোরে অফিসে চলে যায়। তুহিন এর কথা মতো ওর বাবা শিউলির বাবার কাছ ফোন করে সব কিছু খুলে বলে না করে দেয়। এসব শুনে শিউলি মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়ে। ও কোন কিছুতেই এটা মানতে পারেনা। তাই ঐ দিন বিকেলে বান্ধবীর বাসার নাম করে তুহিন এর বাসায় যায় ওর সাথে দেখা করার জন্য। এই প্রথম সাহস করে মনের কথা সরাসরি জানাতে চায়। কিন্তু গিয়ে দেখে তুহিন বাসায় নেই। শিউলি তুহিনের মায়ের সামনে কান্নায় ভেঙে পরে।তুহিনের মা শিউলিকে পছন্দ করলেও তুহিনের কথার ওপর কিছুই বলতে পারে না। তাই শিউলিকে সান্তনা দেয়, নানাভাবে বোঝায়। কিন্তু শিউলি কোন কিছুই শুনতে চায়না।বরং কাঁদতে কাঁদতে সাবেরা বেগমের হাত ধরে বলে,”মা আপনি আমাকে যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই চলবো। কোনদিন আপনাদের কারো কথার অবাধ্য হবো না। তবুও আমাকে পর করে দেবেন না। প্লিজ ওনাকে রাজি করান। ওনাকে ছাড়া আমি মরে যাবো। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে আমি ওনাকেই ভালোবেসেছি। ওনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না মা।”

শিউলিকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে ,ওর পাগলামি দেখে সাবেরা বেগমের খুব খারাপ লাগে। সে শিউলিকে অনেক বোঝায় আর বলে যে সে আরেকবার তুহিনের সাথে কথা বলবে। আসলে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে মেয়েটাকে। তাই ওর এতো আকুতি,কান্না দেখে তার আর ভালো লাগছেনা। অনেক বোঝানোর পর শিউলি কান্না থামিয়ে বাসায় চলে যায়।

তুহিন এবার আর শুক্রবার বাসায় আসেনা। অফিসের কাজের বাহানায় ওখানেই থেকে যায়। শিউলি একদিন পরপরই আসে তুহিন এর সাথে একটিবার কথা বলার জন্য। কিন্তু তুহিনকে না পেয়ে হতাশ হয়ে চলে যায়। বারবার তুহিনের মোবাইলে ফোন করে। কিন্তু তুহিন ফোন রিসিভ করেনা। এদিকে শিউলি যে প্রায় দিনই বাসায় আসে আর মাকে বিয়ের ব্যাপারে আবার কথা বলার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করে সে সম্পর্ক তুহিন বোনের কাছ থেকে সব কিছুই জানতে পারে। তুহিন তাই শিউলির ওপরে আরো বেশি বিরক্ত হতে থাকে। এভাবেই প্রায় বিশ দিন কেটে যায়।

এই কদিনে শিউলি না খেয়ে চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হতে থাকে।তার খাওয়া, ঘুম ,আনন্দ সবই যেনো জীবন থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে। চোখের নীচে কালি পরে যায়। এ অবস্থা দেখে ওর ভাইরাও বেশ কষ্ট পায় আর তুহিনের ওপরে রেগেও যায়। শিউলির ভাইয়েরা ঠিক করে ওরাই তুহিনের সাথে আবার কথা বলবে । যেই ভাবা সেই কাজ। তুহিন কে ফোন করলে তুহিন ফোন রিসিভ করেনা। এতে রেগে দুই ভাই একদিন সরাসরি তুহিনের অফিসে চলে যায়। অবশ্য তুহিনের অফিসে ঢোকার সময় ওনাদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। অনুমতি না থাকায় এক প্রকার জোর করেই অফিসে প্রবেশ করে তারা। অফিসে ঢুকে প্রথমে তারা তুহিনকে ঠান্ডা মাথায় বলে শিউলিকে বিয়ে করতে। কিন্তু তুহিন এতে রাজি হয়না। পরে বেশ হুমকি দিয়ে অনেক আজেবাজে কথা বলে। এতে করে তুহিন ও অনেক রেগে যায়। এক পর্যায়ে অফিসের অন্যান্য লোক, সিকিউরিটি গার্ড মিলে শিউলির ভাইদের অফিস থেকে বের করে দেয়। শিউলির ভাইদের এমন আচরনে শান্ত,ভদ্র তুহিন অনেকটাই রেগে যায় আর বেশ অপমান বোধ করে। আর মনে মনে শিউলির ওপর যেটুকুও স্নেহ ছিলো তাও চলে যায়।

কেটে যায় বিশ দিন। এতো দিন পর আজ তুহিন বাসায় আসে। এসেই দেখে শিউলি ড্রইং রুমে বসে আছে। শিউলিকে দেখেই তুহিনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তাই মাকে জোরে ডাক দিয়ে বলে,”মা শিউলি এখানে কেনো?”

তুহিনের কথা শুনে শিউলি যেনো আত্মায় প্রান ফিরে পায়।বিশ দিন…….বিশটা দিন কি কম কথা?ঘন্টায় হিসেব করলে চারশো আশি ঘন্টা, মিনিটে আঠাশ হাজার আটশো মিনিট,আর সেকেন্ড এর হিসেবে এক লক্ষ সাতশ আঠাশ হাজার সেকন্ড। এই প্রতিটা মুহূর্ত তুহিনকে এক পলক দেখার জন্য, একটু কথা শোনার জন্য শিউলির মনের ভেতরে যে তোলপাড় চলেছে, যেই অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করেছে সেটা বুঝবে এমন সাধ্য কি তুহিনের আছে? শিউলি এক দৃষ্টিতে তুহিনের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে থাকে আর চোখের তৃষ্ণা মেটাতে থাকে। চোখ থেকে না চাইতেও পানি ঝরতে থাকে।

সাবেরা বেগম এতো দিন পর ছেলেকে দেখে বেশ খুশী হয়। তবে ছেলের মেজাজ দেখে একটু চিন্তিত কন্ঠে বলে,”এতো দিন পর এসেছিস আগে ফ্রেশ হয়ে আয় তারপর নাহয় কথা বলি। তোর সাথে জরুরি কথা আছে বাবা।”

তুহিন রেগে বলে,”কি কথা এখনি বলো মা। তুমি বা বাসার অন্যরা কি চাও না যে আমি বাসায় আসি? এতো দিন পরে এসেও শান্তি নেই?”

শিউলি এতোক্ষন চুপচাপ তুহিনের মোহে আচ্ছন্ন থাকলেও এবার সাহস করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,”তুহিন ভাই আমার জন্য মায়ের সাথে রাগ করবেন না প্লিজ। যা বলার আমাকেই বলুন। আর আমারও আপনাকে কিছু কথা বলার আছে। সেজন্যই প্রতিদিন এসে ঘন্টার পর ঘন্টা আপনার অপেক্ষায় বসে থাকি। আমাকে একটি বারের মতোন কিছু বলার সুযোগ দিন প্লিজ। একটা বার আমার সাথে একটু কথা বলুন। দয়া করে আমার থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। আমি এটা মানতে পারছিনা। আর কিছুদিন এভাবে থাকলে দম বন্ধ করে আমি মরে যাবো।”

শিউলির কথা শুনে তুহিন আরো বিরক্ত হয়, রেগে যায়। মায়ের ইশারায় , অনুরোধে খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে,”কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো। আমার সময় নেই।”

তুহিন কথা বলতে রাজি হওয়ায় ওদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে সাবেরা বেগম সেখান থেকে চলে যায়। শিউলি কাঁপা কন্ঠে বলে,”আমার অপরাধ জানতে চাই তুহিন ভাই। আমি কি দেখতে খুব খারাপ? আপনি যেভাবে বলবেন আমি ঠিক সেভাবেই চলবো তুহিন ভাই। কোনদিন আপনার অবাধ্য হবো না। একটি বারের মতো আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখেন। দয়া করুন আমার প্রতি। আপনাকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে ভালোবেসেছি। আপনাকে না দেখলে আমার ঘুম হয়না,দেখুন এই কয়টা দিন ধরে আপনাকে দেখার তৃষ্ণায় আমার চোখ অস্থির হয়ে আছে। দেখুন না তুহিন ভাই। আপনার কন্ঠ না শুনলে আমার বুকের ভেতর কেমন যেনো করে। এই ব্যাথা আপনাকে বোঝাতে পারবো না। আপনি ছাড়া অন্য কাউকে জীবন সঙ্গী ভাবা আমার জন্য বিশাল অন্যায় হয়ে যাবে তুহিন ভাই। কারন এই জায়গায় আমি যে আপনাকে অতি সম্মানের সাথে অনেক বছর আগেই বসিয়ে রেখেছি। অন্য কাউকে আমি এভাবে ভাবতেই পারিনা তুহিন ভাই। অন্য কোন মানুষকে আমি এই জায়গায় কখনোই বসাতে পারবো না।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here