এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ২৮

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-২৮♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

—– নিশান্ত ভাইয়া কী এন্সার দিয়েছে অন্বি বল আমায়? চুপ করে থাকিস না প্লিজ বল!

শিখার লাগাতার প্রশ্নে অতিষ্ঠ হয়ে কপাল কুঁচকালো অন্বিতা। গত ১৫ মিনিট যাবৎ একই ভাঙা টেপরেকর্ডার কানের কাছে বাজতে থাকার দরুন বিরক্তিতে রি রি করে উঠছে তার পুরো শরীর। যেই প্রশ্নটার থেকে পিছু ছোটাতে প্রতিদিনকার রুটিন ভঙ্গ করে ১১ টা নাগাদ কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোনোর ভান ধরেছিলো সেই প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে হওয়ায় মেজাজ তুঙ্গে পৌঁছেছে তার।
অন্বিতা বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালো। শিখার অজস্র প্রশ্নের এক কথায় উত্তর স্বরূপ বলল,

—– হি রিজেক্টেড মি শিখা! এই নিয়ে দ্বিতীয় কোনো কথা উঠুক তা আমি পছন্দ করবো না মোটেই। বাড়ি যা তুই, এই রাত-বিরেতে একা একটা মেয়ে কোন সাহসে আমার বাড়ি এসেছিস ভেবে পাচ্ছিনা আমি।

অন্বিতার কথায় বড়সড় ধাক্কা খেলো শিখা। নিশান্ত যে অন্বিতাকে রিজেক্ট করতে পারে এরকম নেগেটিভ চিন্তা এক মুহুর্তের জন্যও মাথায় আসেনি তার। বরং সে তো ৯০% শিওরই ছিলো যে নিশান্ত একটু দোমনা ভাব নিলেও নিজে থেকেই হ্যাঁ বলবে তৎক্ষণাৎ। যে ছেলে অন্বিতার প্রতি এতো কেয়ারিং, একটু কিছু হলেই কপালের ঘাম ছুটিয়ে নিজের ব্যস্ত সময়েরও তোয়াক্কা করে না সে কিনা অন্বিতাকে রিজেক্ট করলো! তার জানা মতে নিশান্তের তো কোনো গার্লফ্রেন্ডও নেই। তবে রিজেক্ট করার কারণটা কী? তাছাড়া সে যদি রিলেশনশিপে যেতে না চায় যেত না। একাবারে বিয়ে করতে ক্ষতি কি ছিলো? অন্বিতাতো রিলেশনশিপ এর জন্য প্রপোজ করে নি। সে তো শুধুমাত্র নিজের মনের কথাটা পেড়েছে। তবে একবাক্যে রিজেক্ট কেনো করবে নিশান্ত? এরকম আরো অসংখ্য প্রশ্নের ঝুড়ি উপচে পড়তে লাগলো শিখার।

বাবলীকে সাজাতে সাথে পাত্রপক্ষের আপ্যায়নের তাগিদে শিখাও গিয়েছিলো বাবলীদের বাড়িতে। এতোক্ষণ যাবৎ সেখানেই ব্যস্ত থাকায় বাড়ি ফেরা হয়নি তার। অন্বিতার কী হলো? নিশান্তের দেখা কী পেয়েছিলো আর যদি পেয়েও থাকে তবে বলতে পেরেছিল কী সে তার মনের কথা? এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফেরার বদলে শিখা গিয়ে ওঠে অন্বিতাদের বাড়িতে। তারপর থেকেই তার মুখ থেকে খই এর মতো ফুটে চলেছে হাজারও প্রশ্নমালা। শুয়ে থাকা অন্বিতাকে টেনে উঠিয়ে হলেও তার প্রশ্নের উত্তর যেনো চাইই চাই!

অন্বিতা শিখার রিয়াকশন দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে কারো নম্বরে ডায়াল করে কানে ধরলো। একবারের পর দুবারের শুরুতেই রিসিভ হলো কলটা। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় শিখার বড় ভাই বলে উঠলো,

—– আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?

—– ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া, আমি অন্বিতা বলছি, শিখার বান্ধবী। আসলে ও এতো রাতে একা বাড়ি ফিরবে ব্যাপারটা খারাপ দেখায় তাই বলছিলাম যে আপনি কি ওকে নিয়ে যেতে পারবেন এখন?

“অন্বিতা” নামটা শ্রবণগোচর হতেই গম্ভীর কন্ঠ নরম হলো সৌরভের। কেনো যেনো অন্বিতা মেয়েটাকে দারুণ লাগে তার। হয়তো তার চঞ্চলতা কিংবা উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার জন্য। তবে কারণ যাই হোক অন্বিতা মেয়েটাকে একজন মানুষ হিসেবে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের বলেই মনে হয় তার৷ যার দরুন আমোদিত গলায় সৌরভ বলল,

—– ওহ আচ্ছা শিখা তোমাদের বাড়িতে! আমি আবার বাবলীদের বাড়িতে যাবার জন্য বোকার মতো বেরিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি আসছি।

অন্বিতা মৃদুস্বরে হেসে বললো,

—– জ্বি ধন্যবাদ ভাইয়া, আসুন!

বলেই ফোনের লাইন কেটে শিখার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অন্বিতা। শিখা ভ্রু কুঁচকে বললো,

—– সমস্যা কী তোর অন্বি? ভাইকে এতো জলদি আসতে বললি কেনো! ইচ্ছে করে আমার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতে চাইছিস কেনো তুই?

অন্বিতা মুচকি হাসলো, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

—– কথা বাড়াস না শিখা! আর আমি তোর কোনো কথাই এড়িয়ে যাচ্ছিনা আমি। আমার জাস্ট এসব ভালো লাগছে না। আই জাস্ট নিড সাম পিস ম্যান! এসব কোনো ফ্যাক্টই নয়।

—- কিন্তু…..

—– আর কোনো কিন্তু নয় শিখা।
আমরা মানুষ, আমাদের জীবনে যেমন ভালো সময় আসে তেমনই মাঝে মাঝে কিছু খারাপ সময়েরও সম্মুখীন হতে হয় বৈকি। নয়তো জীবনের ভারসাম্যটা ঠিক বজায় থাকতোন। আর খারাপ সময়গুলোকে নিয়ে যতো বেশি নাড়াচাড়া করা হয় ততোই বেশি জট পাকিয়ে ক্রিটিকাল হয়ে পড়ে জীবনটা। আমাদের উচিত খারাপ সময়গুলোতে ধৈর্য্য ধরা। “খারাপ সময় কেটে একদিন না একদিন আলোর দেখা পাবো” এই ভাবনা নিয়েই দিন পাড় করাতেও এক তীব্র আশা কিংবা প্রত্যাশা জড়িত থাকে। যা না থাকলে হয়তো জীবনের যথার্থ মর্মটাই ব্যহত হতো।

শিখা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। সে জানে অন্বিতার সাথে কথায় পেরে ওঠা যাবেনা কোনো কালেই। তখনই নিচে বাইকের হর্ণে বুঝলো সৌরভ এসে পড়েছে। যার দরুন একবুক ভরা হতাশা নিয়ে বের হতে হলো তাকে। অন্বিতা দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। মুখে যতোই বলুক না কেনো ভেতর থেকে ভালো নেই সে। দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে চলেছে তার হৃদয়টা প্রতিক্ষণ। জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে চলেছে তা সর্বক্ষণ। চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে নিশান্তের হাসি মুখে করা প্রত্যাখ্যান! সাথে টুকরো টুকরো খন্ডে বিভক্ত হওয়া হৃদপিন্ডের করুন অনুনাদ!

অন্বিতা নিশান্তের উষ্ণ বুকে ঠাই পেয়ে নিজেকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলো তার মাঝে। সে জানে না কেনো এরকম অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করে চলেছে তাকে। কিন্তু সে এটুকু ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে নিশান্তের বুকে সে সেইফ। এই জায়গাটা শুধুমাত্র তারই জন্য, অন্য কেউ সেই জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও না।
তবে তার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আশা নিমিষেই ভেঙে গুড়িয়ে যায় মুহুর্তেই। নিশান্ত অন্বিতাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেই অতি সাবধানে। নির্বিকার চাহনি বদলে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে,

—- আমায় ক্ষমা করবেন মিস অন্বিতা। আপনি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছেন। আমি আপনার ভালোবাসা পাবার যোগ্য নই। ওই জায়গাটায় আমার থাকা চলে না। কোনোদিনও না!

কথাটা বলে নিজের হাতে থাকা গ্লাসটা চোখে পড়ে নিয়ে অন্বিতাকে পাশ কাটিয়ে দু ধাপ এগিয়ে থমকে দাঁড়ায় নিশান্ত। মুখ না ফিরিয়ে ধরা গলায় আবারও বলে উঠে,

—– আমি কখনোও আপনাকে হারতে দেখিনি মিস অন্বিতা। আমি দেখেছি আপনাকে অসম্ভবকে সম্ভব করেও অবলীলায় হাসতে। আমায় না পাওয়াটা আপনার হার নয়, আপনার জিত। আপনার আগত ভবিষ্যতের ছোট্ট একটা কাঁটা স্বরূপ আমি। আমি জানি আপনি আমায় ভুলতে পারবেন। ঠিক যেমন পেরেছিলেন হাজারও কান্নারত মানুষের ঠোঁটে হাসি ফোটাতে। আপনার চোখে যে কান্না একদম মানায় না মিস অন্বিতা। কাঁদবেন না প্লিজ! আপনার ঠোঁটে হাসিটাই যে শোভা পায়, আর নোনাজল? সে তো আপনাতে বড্ড বেমানান।

এই ছিলো নিশান্তের বলা শেষ কথা। এরপর সে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় নি সেখানে। বড়বড় পায়ে অন্বিতাকে একলা ফেলেই চলে যায় নিজ গন্তব্যে। একটি বারের জন্যও ফিরে তাকায়নি সে। যদি তাকাতো তবে কান্নারত নয়, জমে পাথর হয়ে যাওয়া অন্বিতাকে আবিষ্কার করতো নির্ঘাত।

অন্বিতা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আবারও স্মৃতির পাতা উল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই বৃষ্টিভেজা এক টুকরো হাহাকার বুকে চেপে মিথ্যে হাসির খেলায় দগ্ধ হওয়া মনটা আবারও নেতিয়ে পড়ছে তার। অন্বিতা চোখ দুটো বুজে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো। সকলের আড়ালেই চোখের কিনারা বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু-ফোঁটা নোনাজল। ভালোবাসা ভুলে যাওয়া বুঝি এতোটাই সহজ? যদি সহজই হবে তবে কেনো এতোটা জ্বালাতনের সহিত সাক্ষাৎ হচ্ছে তার? কেনো এক নিমিষেই স্মৃতি থেকে ধোঁয়াশার মতো মুছে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না নিশান্তকে?

তখনকার বৃষ্টিতে ভেজার পর টানা তিন ঘন্টা ওয়াশরুমে ঝড়নার নিচে বসে চোখের জল বিসর্জন দেবার দরুন ঠান্ডাটা বোধহয় ভালোমতোই গায়ে বসে গিয়েছে অন্বিতার। আজ বহু বছর পর মন খুলে কেঁদেছে সে। শেষ কবে এভাবে কেঁদেছে মনে নেই তার। ছোট্ট ভাইটার জন্য কখনোও মায়ের শোকে ডুকরে কেঁদে উঠাও হয়নি তার। চাপা আর্তনাদে ফেলা দীর্ঘশ্বাসই ছিলো তার নিত্যসঙ্গী।

অন্বিতা পাশ ফিরে বালিশে মাথা রাখলো। মাথাটা বড্ড ভারী ভারী লাগছে তার। শরীরটাও যেনো উত্তাপ ছড়িয়ে চলেছে। তবে কি অবশেষে জ্বর বাঁধিয়ে ফেললো সে? জ্বরের আশংকা করতেই কপালে ডান হাতের উল্টো পিঠ স্পর্শ করালো অন্বিতা। উষ্ণ অনুভুতি হতেই কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফুটে উঠলো তার। অসুস্থতা নামক বিশ্রী অনুভুতিটা ভাগে কম পড়লেও পরিবারের খাতিরে একটু বেশিই বিরক্তিকর মনে হয় অন্বিতার। কিন্তু আজ কেনো যেনো ইচ্ছে হচ্ছে না আর ওষুধ খেয়ে তাপমাত্রাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিকতায় আনতে। যেমন চলছে চলুক না? সামান্য জ্বরই তো, বায়োলজির ভাষায় জ্বর তো কোনো অসুখ নয়। এতো শুধুমাত্র শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি! এ আর এমন কী? কিই হবে এতো যত্ন নিয়ে?

অন্বিতার ভাবনার মাঝেই হাল্কা শব্দে নড়ে উঠলো দরজাটা। অন্বিতা ঘোলাটে চোখে ভারী মাথাটা সামান্য উঁচু করে তাকালো। চিকুকে কোলে নিয়ে আনন্দ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দরজার দ্বারে। অন্বিতা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা সেই রহস্যের সমাধানেই বর্তমানে গোলকরন্ধ্র আগ্রহী হয়ে ঘুরে চলেছে তার। অন্বিতা আনন্দকে দেখে মুচকি হাসলো। হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলতেই চটপট ঘরে ঢুকে বোনের পাশে বসে পড়লো আনন্দ। চিকু আনন্দর কোল থেকে নেমে অন্বিতার গা ঘেঁষে লেপ্টে শুয়ে পড়তেই অন্বিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,

—– এখনোও ঘুমোসনি কেন ভাই?

আনন্দ ঠোঁট উল্টালো। অন্বিতার কোলে মাথা রেখে বলল,

—– জানো তো আপু, ঘুমটা ইদানীং খুব পঁচা হয়ে যাচ্ছে। যতোই আমি তার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইছি ততোই সে আমার সাথে আড়ি করে চলে যাচ্ছে। এমনই চলতে থাকলে কী করা যায় বলো তো?

অন্বিতা হাসলো। ভাইয়ের যে এখন বোনের কোলে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমোবার বায়না হয়েছে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে সে। আনন্দ বুক ভরা তীব্র শ্বাস টেনে চোখ দুটো বুজে নিতেই, ভাইয়ের ঝাঁকড়া চুলের মাঝে হাত চালিয়ে অন্বিতা বললো,

—– আসলেই তো! ঘুমটা বড্ড পাজি হয়ে যাচ্ছে। আমার ভাইয়ের সাথে আড়ি করা তাইনা? এতো অন্যায়, রীতিমতো ঘোর অন্যায়! ঘুমটাকে কী শাস্তি দেওয়া যায় বলতো?

বোনের কথায় আনন্দ দাঁত বের করে হাসলো। অন্বিতাও হেসে ভাইকে ঘুম পারাবার জন্য ক্ষীণ গলায় গল্প ধরলো। মনে মনে সংকল্প করলো আর কান্না নয়! তার কান্না করাটা যে অন্যায়। তাকে হাসতে হবে। নিজের জন্যে না হোক তার মুখের দিকে চেয়ে থাকা মানুষগুলোর জন্য তাকে হাসতেই হবে।

______________________________

—– আব্বু আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব ১০ দিনের মধ্যে ঠিক করো। আমি এই কয়দিনের মধ্যেই দেশ ছাড়বো, এন্ড দ্যটস ফাইনাল!

কথাটা বলেই ফোনের লাইন কেটে তীক্ষ্ণ শ্বাস ফেললো নিশান্ত। সানি-রিভান একে-অপরের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কেনো যেনো গতকাল রাতের ভয়াবহ মুহুর্তের পর থেকে নিশান্তের সামনে যেতেও হাটু কাঁপছে তাদের। অথচ অন্য কোনো সময় হলে আজ সানি-রিভান সবথেকে বেশি খুশি হতো। তাদের এতো দিনের প্রচেষ্টা সফল হলো, অন্বিতা অবশেষে নিশান্তের প্রেমে পড়লো কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টাল না নিশান্তের দৃঢ় মন। সেই আগের যুক্তিহীন অঙ্গিকার নিয়েই পড়ে রইলো সে।

নিশান্ত উল্টো দিকে ফিরে ভ্রু কুঁচকালো। সানি-রিভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—– সমস্যা কী? এভাবে চেয়ে আছিস কেনো আমার দিকে? কিছু বলবি?

সানি-রিভান একরাশ হতাশা নিয়ে তাকালো আবারও। সানি ভেজা বেড়ালের মতো মিনমিন করে বলল,

—– মামা, তুই এখনই বাইরে যাবি কেন? রেজাল্ট পাবলিশ হইতে তো এখনোও মেলা দিন বাকি।

নিশান্ত ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,

—– একটা অচেনা জায়গায় হুট করে গিয়ে এডজাস্ট করে নেওয়া এতোটা ইজি না সানি। এখন ফ্রি টাইম, যাই যেয়ে ঘুরেফিরে দেখার সময় পাবো অনেক। তাছাড়া রেজাল্ট না দিলেও রেজাল্ট ঠিক কেমন আসবে এটা নিয়ে আমার কোনো ডাউট নেই। এক্সামটা তো আমিই দিয়েছি তাইনা? সো এতো চিন্তা করার কিছু নেই।

সানি ঠোঁট উল্টালো। নিশান্তের এভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা যে তার বিন্দুমাত্রও পছন্দ হয়নি তা তার রিয়াকশনেই স্পষ্ট। রিভান নিশান্তের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নিঃশব্দে তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি হেসে মনে মনে বলল,

—– তুই নিজের অজান্তেই অন্বিতাকে ভালোবেসে ফেলেছিস রে পাগলা! এই অনুভূতি থেকে পালাতে যেখানেই যাস না কেনো, প্রেম তোকে ঠিকই খুঁজে নেবে। সেই সাথে দিয়ে যাবে তার নিদারুণ যন্ত্রণা!

________________________________

পুবাকাশের উদ্দীপ্ত সূর্যের প্রখর রোদ মাথায় করে গানের সমিতি থেকে বাড়ি ফিরছে অন্বিতা। শরীরটা ভীষণ নিস্তেজ লাগছে তার। এই বোধহয় প্রথম দিন যেদিন গানের সমিতিতে যাবার পরও গান গাইতে না পেরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাকে। আজ হঠাৎ কী হলো অন্বিতার? এতো চেষ্টা করার পরও কেনো সুর তুলতে পারলো না সে? মন ভালো নেই বলে নাকি শরীর খারাপ থাকার ফলে! কোনটা? উত্তর জানা নেই অন্বিতার। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শরীরটা ক্রমশই ভারী ভারী লাগছে তার। ঘেমে পরনের শাড়িটা ভিজে লেপ্টে অাছে গায়ের সাথে। বল প্রয়োগ করে পা দুটো ধাপ ফেলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই অসম্ভব কষ্টসাধ্য বলে মনে হচ্ছে তার।

আরো কয়েক ধাপ ফেলে এগিয়ে একটা চায়ের স্টলের পাশে গিয়ে থামলো অন্বিতা। গলাটা বড্ড শুকিয়ে এসেছে তার। এই শুষ্কতা কমাতে পানির প্রয়োজন অপ্রতিরোধ্য। যার দরুন স্টলের সামনে গিয়ে ৪০০ মি.লি এর একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনল সে। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে গলা ভেজানো হয়ে এলে একটু হলেও অস্বস্তি দূর হলো তার। অন্বিতা বোতলের ক্যাপ লাগিয়ে স্টল থেকে বের হতে নিতেই থমকে দাঁড়ালো। স্টলের এক কোণের বেঞ্চে বসে চা হাতে কিছু একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে সানি-রিভান। তাদের দুজনেরই কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ। যেনো বিরক্তির অতুল পর্বতের শীর্ষে পৌঁছেছে তারা উভয়েই। অন্বিতা ভ্রু কুঁচকালো। কী এমন গুরুতর ব্যাপার নিয়ে আলোচনায় মত্ত তারা যার দরুন ঠিক সামনে দিয়ে যাবার পরও অন্বিতাতে নজর পড়লো না তাদের? এমনি সময় হলে তো ১০ হাত দূর থেকেই সানি হাত উঠিয়ে বলতো “আসসালামু আলাইকুম ভাবী!”
তবে আজ হটাৎ কী হলো?

অন্বিতা নিজের কিউরিওসিটির দরুণ এক কোণে গিয়ে আড়ালে দাঁড়ালো। ক্ষীণ আওয়াজে সানি-রিভানের কন্ঠ ভেসে আসতেই গভীর মনোযোগী হলো।

—— কিচ্ছু ঠিক নেই রে সানি লিওন, কিচ্ছু না! এভাবে চলতে থাকলে সব ভেসে যাবে। আফসোসের বন্যা বইয়েও আর কোনো লাভ হবে না পরে।

—– ধুর! কোন এক বাল ছাল নিয়ে এখনোও পইরা আছে নিশান্ত, হেইডাই তো মেজাজ খারাপ কইরা ফেলাইতাছে আমার। আমি হইলে এক চান্সে এক্সেপ্ট করে ফেলতাম ভাবীকে। এরকম মেয়ে কি সচারাচর পাওয়া যায় নাকি? নিশান্তটানা আসলেই গাধা, বলদ একটা!

—– আহ সানি! অলওয়েজ নিজের মতো করে ভাববি না। তুই বা আমি দুজনেই জানি নিশান্ত কিরকম। ও যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে। হোক ছোটতে কিংবা বড়তে, ওর ফার্স্ট লাভ ছিলো। ওই মেয়েটাকেই নিশান্ত একবার নিজের লাইফ পার্টনার বানানোর প্রমিজ করেছে মানে সেই জায়গাটা আর অন্য কেউ নিতে পারবে না। কোনোদিনও না। আমার সেটা নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই। প্রবলেমটা হলো ওই মেয়েটা আদৌ বেঁচে আছে না মরে ভূত হয়ে গেছে এইটা নিয়ে। যদি বেঁচেই থাকে তবে এতোদিনেও কেনো নিশান্ত খুঁজে পেলো না তাকে? আর যদি মরে গিয়ে থাকে দেন সেই মেয়েটার জন্য নিজের জীবনটা অহেতুক নষ্ট করছে নিশান্ত………….

এর বেশি আর কোনো কিছু শোনার মতো ক্ষমতা ছিলো না অন্বিতার! যা দরুন বড়বড় পায়ে স্টল থেকে বেরিয়ে এলো সে। পা দুটো কেমন যেনো থরথর করে কাঁপছে তার। তবে কী এইজন্যেই নিশান্ত অন্বিতাকে প্রত্যাখ্যান করলো? তার মন জুড়ে আগে থেকেই অন্য কারো রাজত্ব ছিলো! ছিঃ এরকম একটা ভুল কি করে করলো সে? কেনো এই কথাটা আগে জানতে পারেনি সে? যদি জানতো তবে নিজের অবাধ্য মনটাকে সেই তখনই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে পারতো যখন নিশান্তের সাথে ঝগড়া-বিবাদেই কাটতো দিন। প্রতিশোধের নেশায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে চলতো মন।
অন্বিতার নিজের প্রতিই বড্ড বেশি ঘৃণা জমতে শুরু করলো। আরো দু-ধাপ এগোতেই থমকে গেলো পা দুটো। মাথাটা বড্ড ঝিমঝিম করছে তার। চোখে ঘোলাটে দেখতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে! ক্লান্ত শরীরটা শক্তি হারিয়ে পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে আসতেই ডান হাতে মাথা চেপে ধরলো সে। অবশেষে সড়কের ধারেই ভার ছেড়ে পড়ে রইলো অচেতন অন্বিতা!
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here