এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ৩১

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-৩১♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

বোনের কোলে মাথা রেখে চোখ দুটো বুজে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে আনন্দ। আবার তার কোল ঘেঁষেই ছোট্ট চিকু লেপ্টে লেজ গুটিয়ে শুয়ে পড়েছে নির্দ্বিধায়! টানা ৩-৪ দিন বিনিদ্র রাত্রি যাপন করতে হতে পারে, সেই সন্দেহেই ঘুমের প্রতি তোড়জোড় চলছে সবার। আজই পাত্রপক্ষ দেখতে এলো! আবার কালই গায়ে হলুদ, তারপরের দিনই বিয়ে! ভাবা যায়? সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্নের মতো দ্রুততর বেগে বেয়ে চলেছে। সময় হবার পূর্বেই এবার ঘটতে চলেছে কাঙ্ক্ষিত বৈ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা!

শাহীন এমবিবিএস কমপ্লিট করলেও এক্সপেরিয়েন্সের অভাবে ততোটা পারদর্শী হয়ে উঠেনি এখন পর্যন্ত। একজন ভালো হাতের সাথে সুক্ষ্ম মস্তিষ্কের ডাক্তার হওয়া চারটে খানি কথা নয়। সমাজের কিছু হতমূর্খ টাইপ লোকেদের মতে মেডিকেল থেকে ভালো নম্বর পেয়ে বের হলেই যে কেউ ডাক্তার হয়ে যায়, ব্যাপারটা সত্য বহি ডাহা মিথ্যের প্রথম লিস্টেই পড়ে। সার্টিফিকেট হাতে থাকলেও এক্সপেরিয়েন্সের বড্ড অভাব থাকায় চেম্বার খুলা মাত্রই রোগীর বন্যা বহাতে পারেনা কেউ। রোগীরা নামি-দামি ডাক্তার ছেড়ে নবীনদের কাছে হুট করেই যেতে যাইবে না। তার জন্য প্রথমত অভিজ্ঞ হওয়া বাঞ্ছনীয়! তার জন্য চাই রেফারেন্স সাথে একজন অভিজ্ঞ ডক্টরের শরণাপন্নতা! যার দরুন কিছু কোর্স করে এক্সপেরিন্স বাড়াতে পরের সপ্তাহেই দেশ ত্যাগ করার কথা ছিল শাহীনের। সেখানে ১ বছরের মতো সময় কাটাতে হতে পারে কিংবা তারও বেশি! এই দীর্ঘ সময়টা একলা পাড় করাটা যে সহজ নয় তা দু পরিবারই আঁচ করতে পেরেছিল ভালো ভাবেই। এই নিয়ে বহু আলাপ-আলোচনা, প্রলাপ বিতরণের পর সকলেই একটা কঠিন সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হন অবশেষে। ছেলে ও ছেলের বউকে একসাথে বিদেশে পাঠালে দেশ ঘোরা সাথে ছেলের কষ্ট কমবে এমন একটা ধারণা করেই হুট করে ১ দিন বাদেই বিয়ের ডেইট ফাইনাল করে হয়েছে। এইটুকুনি সময়ের মাঝে এতো আয়োজন কি করে করবে ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়লেও অভয় দেন খান পরিবার। দায়ভারের ৯৫% ই নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে আমজাদ হোসনকে শুধুমাত্র আত্মীয় স্বজনদের যথাসময়ে দাওয়াত এবং ডেকোরেশনের গাইড হতে বলেছেন স্রেফ। বাদবাকি বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট তারা নিজেরাই সুক্ষ্ম ভাবে সামলে নিতে পারবে বলেই দৃঢ় অঙ্গিকার তাদের।

বিয়ের দিনক্ষণ এভাবে এতোটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঠিক হয়ে যাবে তা কল্পনারও বাহিরে ছিলো অন্বিতার। দু-পরিবারের আলাপ-আলোচনার মাঝে সামান্যতম ফিলিং লেস রোবটের মতোই বসে ছিলো সে। সবার হ্যাঁ তে হ্যাঁ এবং না তে না বলার সিস্টেমই যেনো শুধুমাত্র অন করা ছিলো তার সার্ভারে। আমজাদ হোসেন বুকে পাথর চেপে মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিতে রাজি হন। বুকটা ভারী হয়ে এলেও একদিন না একদিন এই দিনটা দুয়ারে এসে কড়া নাড়তো ভেবেই সম্মতি সূচক জবাব দেন তিনিও।

অন্বিতার পাহাড় সমান অনুভূতিতে কেউ ক্রমাগত ছুড়ির বর্ষণ নামিয়েছে। কাটা-ছেঁড়া জায়গাগুলোতে যেনো নতুন করে ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে তার। ভাইকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মন শক্ত রাখার যুদ্ধে ভীষণ নির্মম ভাবে হার হলো তার। একে পরিবার ছেড়ে থাকার ক্রন্দন তার সাথে নিশান্তের অবহেলায় মাখা প্রহর সবটা যেনো ভেতর থেকে শেষ করে চলেছে তাকে। তবু কাঁদতে মানা তার! রামগরুড়ের ছানা মতো হাসতে মানা না হলেও হাসির বদলে কান্নাটা বড্ড বেমানান অন্বিতাতে। সে কাঁদলে বাবা-ভাই এরা কীভাবে সামলাবে নিজেদের? ভাইটা কার কোলে এসে ঘুমোবার বায়না ধরবে প্রতি রাতে? কে আমজাদ হোসেনকে মাঝ রাত্তিরে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলবে “মধ্যরাতের শীতলতম মেলায়, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই বাবা!” অন্বিতা ডুকরে কাঁদতে পারছেনা। থেকে থেকেই চোখের পাতাগুলো ভিজে আসছে তার। বিস্ফোরিত চোখদুটো জ্বলছে ভীষণ। গাল বেয়ে নোনাজল গড়াতে চেয়েও শক্ত থাকার তাগিয়ে আগেভাগেই মুছে নিচ্ছে অন্বিতা।

আচ্ছা যার জন্য এতোবড় বিসর্জন সে দিতে চলেছে, তার মনে কি একফোঁটাও মায়া কাজ করেনা? মাঝারাতে হুট করেই তার ভাবনায় সেকেন্ডের জন্য হলেও মত্ত হয়না? অন্বিতা চলে গেলে বুঝি ছেলেটা খুব বেশি ভালো থাকবে? হাসবে বুঝি মন খুলে? হয়তো! এই হয়তোর ওপর নির্ভর করেই জীবনটা ছারখার হয়ে চলেছে অন্বিতার। হয়তোবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সম্ভাবনার অনুভূতি বুকে আগলেই রাখতে হবে তাকে। নিশান্তকে হয়তো ভুলতে পারবে এই অজানা ” হয়তো” নিয়েই নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাতে চলেছে সে।

_______________________________

রাত ২ টো কি ৩ টের মাঝামাঝি অবস্থানে ঘন্টার কাটার বিচরণ। আকাশে মস্ত বড় থালার ন্যায় চাঁদটা সূর্যের মতোই লুকোচুরি খেলে চলেছে মেঘেদের সাথে। তাকে ঘিরে রয়েছে একগুচ্ছ জ্বলজ্বল করতে থাকা তারা। প্রকৃতিটা বিকেলের পর থেকে হুট করেই তাপমাত্রার মন্দন ঘটছে যেনো। এই শরৎেও হাল্কা হাল্কা শীত শীত অনুভূত হচ্ছে সকলের। তবে এই হিমশীতল আবহাওয়াতেও দহনে পুড়ে চলেছে একই সুতোয় বাঁধা দুটো প্রাণ। দেহ ভিন্ন হলেও তাদের হৃদয়ে একই জ্বালাপোড়া প্রবাহমান!

বারান্দার রেলিং ঘেঁষে হাতে রাখা ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবিটার দিকে হাজারো অনুনয় ঘিরে দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে নিশান্তের। লাল বর্ণ ধারণ করা চোখ দুটোর সেকি অসম্ভব জ্বালা-যন্ত্রণা! যেনো চোখ থেকেই উত্তাপ ছড়াচ্ছে তার। নিশান্ত জানে না কেনো তার এই হাল, তার তো খুশি হওয়া উচিত অথচ বিষন্নতায় কুঁকড়ে উঠছে তার মন। কেনো কেনো কেনো? কেনো এতোটা পাগলাটে লাগছে তার? সেকি দিন দিন মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে? নিজের সুস্থতা নিয়ে নিজেরই বড্ড সন্দেহ লাগছে এবার। নিশান্ত ছবিটায় আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। ধরা গলায় টলমল চোখে চেয়ে বলল,

—– এই আয়ু, আয়ুউউ! তুই না বলেছিলি কখনোও ছেড়ে যাবিনা আমায়। তাহলে কেনো চলে গেলি? আমি যে পারছিনা আর! তুই ফিরে আয় নয়তো আমার মন থেকে সরে যা, একদম দূরে সরে যা। এই জ্বালা আর সহ্য হচ্ছে না আমার! তুই কেনো বুঝিস না আমাকে? বল কেনো বুঝিস না? তুই জানিস আমি কতোটা কষ্টে আছি? এসে দেখ বুকটা জ্বালা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে আমার!

উন্মাদের মতো ভেজা গলায় কথাগুলো বলেই রেলিং ছেড়ে বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো নিশান্ত। স্বচ্ছ চোখে জমাট বাঁধা জলগুলো গড়াতে বাঁধা দিতেই উপরে মুখ করে তাকালো৷ তবে জিত হলো না তার। দু ফোঁটা নোনাজল হাজারো বাঁধা ভঙ্গ করে চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়লো তার। নিশান্ত নিজের এলোমেলো চুলগুলো বা হাতে খামচে ধরলো। ডান হাতে রাখা ছবিটা আবারও চোখের সামনে এনে কাঁপাকাঁপা গলায় বলতে শুরু করলো,

—– জানিস তো আয়ু, অন্বিতার না বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! ছেলে ডাক্তার। বিয়ের ২ দিনের মাঝেই কোর্সের উছিলায় নাকি হানিমুনের উদ্দেশ্যে আমেরিকা যাবে। অ…অ…অন্বিতার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আয়ু, ও…ও.. অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে!

মুখ ফুটে আর কোনো বাক্য ফোটাতে পারলো না নিশান্ত। কথাগুলো গলাতেই জট পাকিয়ে দমে রইলো তার। দু-হাটুর মাঝে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। ক্রন্দনের তাড়নায় শরীর কম্পিত হতে লাগলো তার। নিশান্তের কান্নায় ভেঙে পড়ে করা চাপা আর্তনাদে নিস্তব্ধ বারান্দাটাও যেনো হঠাৎ করেই চমকে উঠলো। তার কান্নার মাঝেই থেমে গেলো বাতাস! প্রকৃতিও হয়তো নিশান্তের ক্রন্দনে থমকে দাঁড়ালো। গুমোট বাঁধা গাছপালা গুলোও অদৃশ্য ভঙ্গিতে কান্না করে উঠলো তাল মিলিয়ে। দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনির আলোড়ন সৃষ্টি করলো নিশান্তের ডুকরে কেঁদে উঠার হৃদয় ভাঙা আকুঞ্চন!

নিশান্ত বার কয়েক হেঁচকি তুললো। চাপা আওয়াজেই চোখ ভেজাতে ভেজাতে বলল,

—– আ…আয়ু, তোর মনে আছে আমি একদিন মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে পার্কের দোলানাটায় বসে কাঁদছিলাম। সেদিন তুই কোথায় থেকে যেনো গুটিগুটি পায়ে হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে এসে বলেছিলি, “রাই ভাইয়া, এরপর যদি তুমি কখনোও কান্না করেছো তবে তোমার ভাগের আইসক্রিম আমি নিজেই খেয়ে ফেলবো হুম!” সেদিন তোর কথায় কান্না থামিয়ে হু হা করে হেসে ফেলেছিলাম আমি। দেখ আজও আমি কাঁদছি, তুই কী আসবি না আমার কান্না থামাতে? আমায় হাসাতে? তোকে বরং আমি এতো এতো আইসক্রিম কিনে খাওয়াবো। তাও একটাবারের জন্য দেখা দে প্লিজ! এতোটা পাষাণ কি করে হলি তুই? কি করে হলি বলনা….!

নিশান্ত আবারও কান্নায় বুক ভেজাতে ব্যস্ত হলো। আজ বহু বছর পর এভাবে মন খুলে কাঁদছে সে। নিজের মনের সুপ্ত অনুভূতি গুলো বিলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিতে। তবে অদ্ভুত হলেও এই ক্রন্দনের সঠিক কারণটা জানা নেই তার। টানাপোড়েনের কঠিনতম ফাঁদে বন্দী হয়ে পড়েছে সে। এর থেকে পরিত্রাণ পাবার কী আদৌ কোনো উপায় আছে? যদি উপায় নাই থেকে থাকে তবে কী সারাজীবনই এমন হাহাকার নিয়ে বাঁচতে হবে তাকে? জীবনটাকে নরক বানিয়েই কাটাতে হবে হাতে থাকা বাকি সময়টুকু!

______________________________

রাতের থমথমে পরিবেশটা সকালে হঠাৎ করেই রূপ বদলেছে। চারিদিকে মানুষের আনাগোনায় ভীড় জমেছে বাড়িতে, বাগানে সাথে ছাদেও। হলুদে তেমন কোনো আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া না হলেও প্রতিবেশীদের ভীড়েই উপচে পড়ছে ছাদটা। অন্বিতা মেয়েটার অতি সাধারণের মাঝেও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য সকলেরই প্রিয় এবং আদরের। তার উপস্থিত বুদ্ধি নিয়ে চলা পদক্ষেপের দরুন পাশের বাসার আন্টি টাইপ মহিলারাও নিন্দা করতে লজ্জিত হয়! এতোটাই আপন করে রাখে মেয়েটা সকলকে! তবে তার হলুদে বুঝি না এসে থাকা যায়? হলুদ ছোঁয়ানোর নাম করে মাথায় হাত রেখে দোয়া করার লোভটাই যে অধিক হারে গ্রাস করেছে তাদের!

ডেকোরেশনের লোকেরা ভোরবেলায় এসেই সাজিয়ে দিয়ে গেছে পুরো বাড়ি৷ আগের দিন বিকেলেই সমস্ত কেনাকাটা সেড়ে ফেলেছে দু পরিবারই! তবে অন্বিতা ছিলো নিশ্চুপ! তার নিজের কোনো কার্যক্রম প্রতিফলিত হয়নি এখন পর্যন্ত। আজ শিখা বাবলী চোখে মুখে আনন্দের থেকে হতাশা কাজ করছে বেশি! বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েতে যেখানে নাচতে নাচতে স্টেজ ভেঙে ফেলার কথা ছিলো সেখানে তাদের মনে জমেছে এক পশলা কালো মেঘ। নূহা-আনন্দ বিয়ের অর্থের বিশেষ কোনো সংজ্ঞা না জানলেও চুপটি করে বসে আছে অন্বিতার পাশে। আমজাদ হোসেন ভারী হৃদয় নিয়েই মেয়ের হলুদে অতিথি আপ্যায়ন করে চলেছেন। নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো রকনের ত্রুটি হোক তা চান না তিনি কোনোকালেই।

অন্বিতা হলুদ-কমলার কম্বিনেশনে হাল্কা কাজের শাড়ি পড়েছে। জুয়েলারি হিসেবে পড়েছে ফুলের অর্নামেন্টস! সাজগোজ ততোটা পছন্দ না করায় পার্লারের মেয়েরা তাকে হাল্কাভাবে সাজিয়েই থেমেছে। এতোটুকুতেই অন্বিতার রূপের বাহার ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে! তবে সাজানো হয়ে গেলেও হাতে মেহেদী পড়ানোটা হয়ে ওঠেনি এখনোও। সকলের কথামতো ছাদের মাঝে স্টেজে বসিয়েই হাতে মেহেদী পড়ানো হবে তার। প্যান্ডেলের পাশে আফসানা বেগম ডালা সাজাচ্ছেন। তাতে ফলমূল এবং ৫ ধরণের মিষ্টির সমাহার জমিয়েছেন। রফিক আহমেদ অফিসে গিয়েছেন বাকিদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে জলদি করে ফেরার উদ্দেশ্যে। এই মুহুর্তে আরো একজোড়া হাতের বড্ড প্রয়োজন ছিলো আফসানা বেগমের! বাড়ির ছেলে বাড়িরই অনুষ্ঠানে গা ছাড়া ভাব নিয়ে অবেলায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগছে না তার। বেশকিছু দিন যাবৎই ছেলের এমন অনিয়ম বড্ড চোখে লাগছে তার। নিশান্ত এতোটা কেয়ারলেস কবে থেকে হলো হাজার ভেবেও উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না আফসানা!

বেলা ১১ টা বেজে এসেছে প্রায়, ঘরের জানালার ওপর পর্দা টেনে দেওয়ায় রোদের ঝিলিক মাঝ পথেই থেমে গিয়ে ঘরে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। যার দরুন ঠিক কটা বাজছে বুঝে উঠতে পারছেনা নিশান্ত। বিছানা ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙে পাশে রাখা এলার্ম ক্লকটার দিকে ঝাপসা চোখে তাকালো সে। ঝিম ধরা মাথায় চোখ মেলে তাকাতে বড্ড বল প্রয়োগ করতে হলো তার। ঘড়িতে ঘন্টার কাটা ১১ টা ছুঁইছুঁই দেখেই মাথাটা যেনো চক্কর দিয়ে উঠলো। চটজলদি কোনোরকমে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। হলুদের অনুষ্ঠান কী তবে শেষ হয়ে গেলো? অন্বিতার গালে সামান্য হলুদের ছোঁয়া দেবারও সুযোগ হলো না বুঝি তার?

নিশান্ত পোশাক না প্লাল্টেই এলোমেলো চুল নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো। চোখ দুটো কাল রাতে কান্না করে ঘুমানোর দরুন ফুলে উঠেছে তার। অক্ষিগোলক দ্বয়ের মাঝে রক্ত জমাট বাঁধার মতো বর্ণের খেলা চলছে। ব্রাউন সেইডের এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো কপালের সাথে লেপ্টে আছে তার।
নিশান্তকে এই অবস্থায় ছাদের দরজায় এসে থমকাতে দেখে চমকে উঠলো অন্বিতা। পার্লার থেকে আগত রেজভী নামের মেয়েটা তার হাতে মেহেদী পড়াতে ব্যস্ত ছিলো। হাতে ফুলের নকশা তুলতে তুলতেই বরের নাম জানবার তাগিদে অন্বিতাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়ল,

—– আপু, আপনার উডবির নামটা?

নিশান্তের দিকে গভীর মনোযোগী হওয়ায় রেজভীর প্রশ্নটা শ্রবণগোচর হলো না অন্বিতার। আনমনেই অস্ফুটস্বরে অবাক চোখে চেয়ে সে বলল,

—– “নিশান্ত!”

রেজিভী মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো। হাতের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিশান্তের নামটা লিখল অতি সযত্নে। অন্বিতার চোখেদুটো নিশান্তকে এভাবে অগোছালো অবস্থায় আবিষ্কার করে আবারও জ্বলে উঠলো। নিশান্তের ফোলা চোখদুটো সোজা বুক বরাবর আঘাত করলো তার! নিশান্তের তো আজ খুশির দিন, সে কেনো এতোটা অগোছালো হয়ে রয়েছে তবে? ফর্সা ত্বকটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে কেনো তার? সে কি কান্না করেছে কোনো কারণে? কিন্তু কেনো? তবে কী ওই মেয়েটার জন্যেই নিশান্তের এমন করুন অবস্থা! এতোটাই ভালোবাসে সে মেয়েটাকে!

কথাগুলো নিজ মনে আওড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অন্বিতা। চোখ নামিয়ে জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। মেহেদী পড়ানো হয়ে যেতেই হলুদ ছোঁয়ানোর তোড়জোড় শুরু হলো মুহূর্তেই। নিশান্তকে এভাবে এলোমেলো অবস্থায় আবিষ্কার করে ভ্রু কুঁচকালেন আফসানা। ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাহুতে হাল্কা ধাক্কা মেরে বললেন,

—— তোকে নিয়ে আমি আর পারিনা নিশান্ত! আজ একটা শুভ দিনে এতো মানুষের ভীড়ে কেউ এভাবে আসে? অন্তত কুঁচকে যাওয়া শার্টটা বদলে চুলে চুরুনী তো করবি নাকি!

নিশান্ত উত্তর দিলো না। রক্তিম আভা ছড়ানো ফোলা চোখদুটো লুকিয়ে এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো। আফসানা বেগম তীক্ষ্ণ শ্বাস ফেললেন। এই ছেলেটা বিদেশে গিয়ে কীভাবে চলবে ভেবেই বুকটা কেঁপে উঠছে তার। গোছালো ছেলেটা হঠাৎ করেই এতোটা অগোছালো কেনো হলো? এতোটা পরিবর্তনের মূলে কি রয়েছে? উত্তরগুলো জানবার হক ষোল আনা হলেও ব্যস্ততায় ভাবার সময়টুকুও পেলেন না আফসানা। অন্বিতার গায়ে হলুদ ছোঁয়াতে চটজলদি এগোলেন তিনি।

একে একে সবার হলুদ ছোঁয়ানো হয়ে আসতেই এদিক-ওদিক দ্বিধাভরা চোখে তাকাতে লাগলো নিশান্ত। আগ বাড়িয়ে অন্বিতাকে হলুদ লাগানোটা কি ঠিক হবে? ভাবতেই হৃদপিন্ডের স্পন্দনটা ক্রমাগত বাড়তে লাগলো তার। আফসানা বেগম সকলের দিকে চেয়ে কেউ হলুদ ছোঁয়ানো থেকে বিরত আছে কিনা খুঁজতে নিতেই নিশান্তের ওপর দৃষ্টি ফেললেন। হাতের ইশারায় কাছে ডাকতেই একরাশ অস্বস্তি নিয়ে এগোলো নিশান্ত। আফসানা বেগম হলুদের বাটিটা নিশান্তের হাতে ধরিয়ে দিলেন। মুচকি হেসে বললেন,

—— পরিচয়ের পর থেকে তো প্রতিটাদিন ঝগড়াতেই পাড় করে গেলি তোরা! শেষ সময়ে এসে হলুদ ছুঁইয়ে খুশির দিনগুলোতে একটু তো ভাগীদার হ!

নিশান্ত বিস্ময় মাখা চোখে মা’য়ের পানে তাকালো। এই মুহুর্তে আফসানা বেগমকে টাইডলি হাগ করে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে তার! পৃথিবীর সব মা’ই বুঝি এমন হয়? মুখ ফুটে না বলতেই মনের কথাগুলো চট করে ধরে ফেলে! নিশান্ত হলুদের বাটি থেকে ডান হাতে সামান্য পরিমাণে হলুদ লাগালো। অন্বিতার সামনে হাটু গেড়ে বসে ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো। অন্বিতার চোখে মুখে বিস্ময়ের বিচরণ! চোখে হাজারো অভিযোগের ছড়াছড়ি! নিশান্ত সামান্য ঝুঁকে বসলো। গালে আলতো করে নিজের হলুদ মাখা হাত ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠলো অন্বিতা। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমাগত ঘনঘন ওঠা-নামা করতে লাগলো তার। শিহরণে ছেয়ে গেলো বক্ষ সাথে শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা! নিশান্তের চোখে বৃহৎ কোনো প্রাপ্তির ছাপ!ঠোঁটের কোণে ঝিলিক মেরে উঠছে সেই প্রাপ্তির প্রশান্তি! আহা ভালোবাসা! ভালোবাসায় এই ছোট্ট ছোট্ট প্রাপ্তির মাঝেও কতশত মায়াভরা অনুভূতির জোয়ার!

নিশান্ত হলুদের বাটিটা একপাশে রাখলো। সে বসা থেকে উঠতে নেবে এমন সময় পেছন থেকে ভাইকে ডাকতে যেয়ে ভুলবশত পা বেজে তার পিঠে ধাক্কা দিয়ে ফেললো নূহা। হাটুর ওপর সমস্ত ভর দিয়ে বসে থাকায় সামান্য ধাক্কাতেই ব্যালেন্স বিগড়ে গেলো নিশান্তের। টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে সে পড়লো অন্বিতার ওপর। অন্বিতা সচেতন চোখে চেয়ে ঝটপট বাহু ধরে আটকালো তাকে। তবে শেষ রক্ষা হলো না। নিয়তির চরম পরিহাসে নিশান্ত সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে তার ওপর পড়ে না গেলেও বিরাট বড় অঘটন ঘটে গেলো জনসম্মুখে! অন্বিতার হলুদে লেপ্টানো বাম গালে ডান গাল গিয়ে লাগলো নিশান্তের। এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মহিলারা আঁচলে মুখ লুকালেন। চারপাশ থেকে চাপা গুঞ্জন কানে ভেসে আসতে লাগলো মুহূর্তেই। হলুদের ঠান্ডা স্পর্শ নিজের গালে অনুভূত হতেই চমকে উঠলো নিশান্ত। দুজনই ছিটকে সড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো তৎক্ষণাৎ! নিশান্ত আনমনেই নিজের হলুদ লাগা গালে হাত স্পর্শ করালো। হাতটা সামনে এনে ধরতেই বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে এলো তার। এমনটা তো হবার কথা ছিলো না! আজ তো অন্বিতার গায়ে হলুদ! তবে তার গায়ে কেনো লাগলো হলুদের ছোঁয়া? নিয়তি এ কেমন নির্মম খেলায় নেমেছে তাদের নিয়ে? পরিশেষে কী হতে চলেছে এর পরিণতি?

#চলবে____________________

(অনেকে বলছেন স্যাড এন্ডিং যেনো না হয়। তাদের উদ্দেশ্যে আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত :

—- নাহ বাবা না, আমার দাঁড়া কোনো স্যাড এন্ডিংওয়ালা গল্প লেখা পসিবল নয়! রাতে সামান্য নিশান্তকে কাঁদাতে যেয়ে নিজেরই চোখে পানি চলে এসেছিল! আর তো স্যাড এন্ডিং! 😑)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here