ফোনের স্ক্রিনে চলমান ভিডিওতে নিজের স্বামীকে বিলাশবহুল হোটেলরুমে এক বিদেশীনির নিকটস্থ বসে থাকতে দেখে শরীরের র*ক্ত ছলকে উঠলো আর্শিয়ার। দমবন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে তার দেহ ও মন জুড়ে। কন্ঠনালী খুব আকর্ষিকভাবে রুদ্ধ হয়ে আসছে তার। নেত্রকোন বেয়ে নোনাজলের ধারা বইলেও মুখাবয়বে কাঠিন্য ছাঁপ স্পষ্ট। ফোনটাকে খুব শক্ত করে খা*মচে ধরে রেখেছে। ভিডিওটার মধ্যে যখন আর্শিয়ার স্বামী নিহাদ ওই বিদেশিনীর মুখের ওপর পরে থাকা চুলগুলো খুব যত্ন করে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী আঙ্গুল বিদেশিনীর গালে স্পর্শ করেছে তখন আর্শিয়ার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যেনো বেড়ে গেল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে তার শরীর বেয়ে শীতল স্বেদ ধারা বয়ে চলেছে।
কয়েকদিন ধরে কেউ একজন আননওন নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠাচ্ছিল আর্শিয়া ও তার ভাইকে যে, আর্শিয়ার স্বামী নিহাদ পরনারীতে আসক্ত। আর্শিয়া ও তার ভাই বিষয়টা আমলে নেয়নি। কিন্তু আজ কয়েকমিনিটের ভিডিওটা আর্শিয়া ও তার ভাইয়ের মোবাইলে পাঠিয়েছে। আর্শিয়ার নয়নযুগলে আর এসব দৃশ্য অবলোকন করার সহ্যক্ষমতা নেই।
আর্শিয়া ফোনটাকে মাটিতে আ*ছা*ড় দিয়ে নিজের মা*থার চুল টেনে ড্রেসিংটেবিল সকল প্রসাধনী, শোপিস ও ঘরে থাকা কাঁচের ফুলদানি ফ্লোরে আ*ছ*ড়ে ভেঙে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ঢুকরে কেঁদে জড়ানো কন্ঠে বলতে থাকে,
–আপনাকে ভালো রাখতেই আমি আপনাকে বিয়ে করেছিলাম কিন্তু আজ আপনিই আমাকে ধোঁকা দিলেন! কিভাবে পারলেন করতে এটা? আমি তো চাইনি বিয়েটা করতে! আপনার জীবনে জড়াতে! আপনি ও আপনার পরিবার আমাকে ও আমার পরিবারকে বাধ্য করেছেন। তাহলে আজ কোথায় গেল সেসব? আমাকে নিজের মায়ায় জড়িয়ে নিজে অন্যকারো মায়ায় কিভাবে জড়িয়ে গেলেন নিহাদ? কেনো? নিহাদ কেনো?
আর্শিয়া আবারও চিৎকার করে উঠে। ওর চিৎকারে ওর বাবা ও ভাবি এসে দরজায় ক্রমাগত ক*রাঘা*ত করে যাচ্ছে কিন্তু এতে আর্শিয়ার কোন ভাবান্তর নেই সে তো কেঁদেই যাচ্ছে। অনেকক্ষণ অনবরত ক*রাঘা*তেও যখন দেখল আর্শিয়ার মাঝে দরজা খোলার লক্ষণ নেই তখন আর্শিয়ার ভাবি মৃদুলা, আর্শিয়ার ভাইকে ফোন করে কিন্তু নাম্বার ব্যস্ত বলছে। আর্শিয়ার ভাই শাহরিফ দুবাইতে অফিসের কাজে মাসের বেশিরভাগ সময় থাকেন। আর্শিয়ার বাবা অফিসের দুবাই শাখাতে তার ছেলে ও মেয়ের জামাইকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। কিছুক্ষণ পর আর্শিয়ার ভাই তার স্ত্রীকে নিজেই ফোন করে অস্থির কন্ঠে হড়বড়িয়ে বলতে থাকে,
–মৃদু এখনই আশুর রুমে যাও। আমি ওকে অনেকক্ষণ ধরে কল করে পাচ্ছি না। দেখো আমার বোনটার কী অবস্থা। ওর মনের উপর দিয়ে কম তো ঝড় গেল না। জলদি যাও।
মৃদুলা হতবিহ্বল কন্ঠে বলল,
–কিন্তু কি হয়েছে? আপুর রুমের দরজা তো বন্ধ। ভেতর থেকে ভাঙচুর ও চিৎকারের আওয়াজে আমি ও বাবা দৌঁড়ে এসেছি। কি হয়েছে? বুঝতে পারছি না।
–তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি কাউকে খবর দিয়ে আগে দরজাটা খোলাও।
–খুব কি সিরিয়াস কিছু? আমার খুব টেনশন হচ্ছে। বলেন না।
শাহরিফ এমনেই চিন্তায় তারউপর এই মেয়ের কৌতুহলী মনের প্রশ্ন। রেগে গিয়ে ধ*মকে বলে,
–যা করতে বলছি কর না। তোর এই পিচ্চি মস্তিষ্কে এগুলো ঢুকবে না। আগে দরজা খোলার ব্যবস্থা কর যা।
মৃদুলা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
–মানলাম আমি পিচ্চি। তাই বলে আপনি আমাকে পিচ্চি বলবেন! ভুলে যাবেন না আমি আপনার বউ ও আমি ১৬+ এখন। অনেকটা বড়ো আমি হুহ্!
–হ্যাঁ ভাই! তুই অনেকটা বড়ো। আমিই বাচ্চা। এবার যা বোইন তোর চতুর বুদ্ধি কাজে লাগা।
মৃদুলা খুশি হয়ে বলল,
–আমার কাছে বারান্দার গেটের চাবি আছে। ওটা দিয়ে আশুপুর রুমে আমি ঢুকব। দেখেছেন আপনার বউ কতো বুদ্ধিমতি!
–হু। এবার জলদি কর। টেনশনের মধ্যেও তুই যে কি করে এত ফান করিস! দেখ এবার।
মৃদুলা এক ছুটে নিজের রুমে গিয়ে চাবির গোছা নিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেল। চাবি দিয়ে আর্শিয়ার বারান্দার গ্রিলের গেট খুলে লাফিয়ে রুমে প্রবেশ করে দেখল আর্শিয়া পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে শুন্য দৃষ্টিতে বিছানায় বসে আছে। মৃদুলার রুমে প্রবেশ করাতে তার কোনো হেলদোল নেই। রুমের মেঝেতে ভাঙ্গা কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর্শিয়ার চোখের কোন বেয়ে জলের ধারার ছাঁপ পরিলক্ষিত। মৃদুলা আর্শিয়ার পাশে বসল তাতেও তার কোনো ভ্রুঁক্ষেপ নজরে এলো না। মৃদুলা তো আর আসল কাহিনী জানে না। শুধু এতোটুকু জানে, আর্শিয়ার সাথে নিহাদের মনোমালিন্য চলছে। মৃদুলা আলতো করে আর্শিয়ার কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
–আশুপু! কি হয়েছে গো? তুমি কাঁদছিলে কেনো? আর ভাঙচুর করলে কেনো?
আর্শিয়া কোন জবাব দিল না। তার চোখের সামনে সেই দৃশ্যগুলো এখনো ভাসছে। আরো কিছু ছিল যার এক ঝলক দেখে নিজের ফোনের মায়া বিসর্জন দিয়েছে সে। বিদেশিনীটা যখন নিহাদের শার্টে হাত দিয়েছিল তখনই আর্শিয়া নিজের ফোনের মায়া ত্যাগ করে। আর্শিয়াকে নিরুত্তর থাকতে দেখে মৃদুলার ঠোঁট উলটে বোঝার চেষ্টা করল অতঃপর বুঝতে অসক্ষম হওয়ায় আর্শিয়ার হাত ঝাঁকিয়ে আবারো জিজ্ঞাসা করল,
–আশুপু, বলো না কি হয়েছে?
আর্শিয়া এবারও চুপ। কী মনে করে মৃদুলার নজর আলমারির কোনার দিকে গেল, সেখানে আর্শিয়ার ভাঙ্গা ফোনটা দেখে মৃদুলা চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল। অতি সাবধানতার সহিত আলমারির কাছে গিয়ে ভাঙ্গা ফোনটা তুলে এনে অসহায় কন্ঠে আফসোস করে বলল,
–ইশ! ফোনটার কী বাজে অবস্থা হয়েছে। কি এমন হয়েছিল? যে তুমি তোমার প্রিয় ফোনটার এমন বাজে অবস্থা করলে?
আর্শিয়া এবার অনুভূতিহীন রূঢ় কন্ঠে জবাব দেয়,
–পৃথিবীতে কোনো মানুষই সারাজীবন প্রিয় থাকেনা! তো মোবাইল নামক জড়বস্তুটি কী প্রিয় থাকবে!
মৃদুলা অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে থাকল। কথাগুলো কেমন অন্যরকম শোনালো। সে তার ননদ রূপক আপুকে এরকম রিক্ততাপূর্ণ কথা বলতে খুব কমই শুনেছে। আর্শিয়াকে সে সবসময় প্রানোচ্ছল ও হাসি-খুশি দেখেছে। আজ হঠাৎ কী হলো? এতো বাছ-বিচার না করে মৃদুলা জিজ্ঞাসা করেই বসল,
–নিহাদ ভাইয়ার সাথে ঝামেলা হয়েছে? তোমার ভাই আমাকে ফোনে তাগদা দিল যাতে জলদি তোমার কাছে যাই কিন্তু কারণ বলল না।
আর্শিয়া রিক্ততাপূর্ণ কন্ঠে বলল,
–যা হবার তাই হয়েছে। আমাকে লোকে কতো কিছু বলে। আমিই নাকি আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ! আরও কতোকিছু। সংসারও নাকি আমার মতো উড়নচণ্ডিকে দিয়ে হবে না। হলোও না!
মৃদুলা চিন্তায় পরে গেল। কী এমন হলো তা তার জানতে হবে। হঠাৎ দরজায় খটখট শব্দে মৃদুলার হুঁশ হলো যে তার শ্বশুর তো দরজার বাহিরে দাঁড়ানো। সে নাহয় বারান্দার গ্রিলের তালা খুলে লাফিয়ে এসেছে কিন্তু বৃদ্ধ শ্বশুর তো পারবে না। এমনিতেই শ্বশুরের হার্টে সমস্যা থাকাতে ব্যাবসার কাজ থেকে ইস্তফা নিয়ে ছেলে ও মেয়ের জামাইকে দায়িত্ব দিয়েছে। মৃদুলা দরজা খুলে দিলে মিষ্টার আশফাক দ্রুততার সাথে মেয়ের কাছে এসে বসেন। আশেপাশে নজর বুলিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহময় কন্ঠে বলেন,
–কী হয়েছে মা? এতো রাগ দেখালি কেনো?
আর্শিয়ার কাটকাট জবাব,
–তখন এতো দরদী না হলেও পারতে বাবা! আজ দেখো আমি কী অবস্থায়। নিহাদের পরিবার হাতে-পায়ে ধরাতে আমায় বললে নিহাদকে সুস্থ করতে সহোযোগীতা করতে। করতে লাগলাম সহোযোগীতা। শেষে তার মায়ায় পরে তোমাদের ইচ্ছেতে রাজী হয়ে গেলাম। এখন সে তো মায়া কাটিয়ে ফেলেছে। আমিই কোনো বোকা! বোঝা উচিত ছিল আমার যে সে আমাকে তার দুঃখ ভুলার জারিয়া বানিয়েছে মাত্র!
মিষ্টার আশফাক হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়ের চোখ বেয়ে গড়ানো নোনাজল ও মুখ নিঃসৃত বাক্যগুলো কোনো অশনি সংকেতকে নির্দেশ করে। আর্শিয়া আর কিছু না বলে বাবাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তার এখন ভরসার আশ্রয়টাই প্রয়োজন ছিল। বিশ্বাস ভরসা যখন ভাঙে তখন সবচেয়ে ভরসার মানুষকেই প্রয়োজন হয়। মিস্টার আশফাক এখন নিজেও কাঁদছেন। খোলা অন্তরীক্ষে আজ কৃষ্ণকায় মেঘের আবির্ভাব।
#এক_খোলা_অন্তরিক্ষ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব