এক খোলা অন্তরিক্ষ পর্ব -০৫

#এক_খোলা_অন্তরিক্ষ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫
আরও কিছুদিন পার হলো। ডিভোর্স পেপার তৈরি। নিহাদ সাইন করে আর্শিয়ার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর্শিয়া নিহাদের সাইন দেখে তাচ্ছিল্য হেসে কালক্ষেপণ না করে নিজেও সাইন করে দিলো। যে নিয়ে এসেছিল সে ডিভোর্স পেপার নিয়ে চলে গেছে। আর্শিয়া লম্বা শ্বাস নিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় তাকায় আজ তার জন্মদিন। হ্যাঁ। জন্মদিনের দিনই সে আজ সেরা উপহারটা পেলো! আর্শিয়া নিজের মনের বোবাকান্না দমাতে তার বান্ধুবীদের ফোন করে ঘুরতে যাবার প্ল্যান করল।

এদিকে নিহাদ ও রাসিফ যে বাংলাদেশে এসেছে তা কেউ জানেনা। আর্শিয়ারা যেখানে যাচ্ছে আড়ালে নিহাদও যাচ্ছে। মন ভরে দেখে নিচ্ছে। রাসিফও আজ প্রথমবার আর্শিয়াকে দেখল তাও শুধু দুটো মায়াবি চোখ। রাসিফ পেশায় ডাক্তার। নিহাদ ওর অভজার্ভেশনেই আছে। নিহাদের ব্রেইন টিউমারের সেকেন্ড স্টেজ। তাও এমন জায়গায় যে অপারেশন করা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। অপারেশন করার অবস্থায়ও নেই। টিউমারটা ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে এবং খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিহাদ চায় না আর্শিয়া জানুক। মেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা চলছে।

রাসিফ বলে,
–ওটাই তোর আর্শিয়া?

–হ্যাঁ। চিরকাল সে আমার মনে আমার থাকবে। তাকে মুভঅন করতেই তো মুক্তি দিলাম। তার অতোটা সান্নিধ্যে আমার যাওয়া হয়নি তাই তাকে বিনাশর্তে মুক্তি দিলাম। সে সামলে নিবে আশাকরি।

রাসিফ অদূরে আড়াল থেকে আর্শিয়ার ফটোগ্রাফি দেখছে। ফ্রেন্ডদের সাথে কিছুসময় হাসি-খুশি থাকার প্রয়াস। মুগ্ধ হলো সে। নিহাদের মুখ থেকে প্রতিনিয়ত আর্শিয়ার কথা শুনতে শুনতে খুব দেখতে ইচ্ছে হতো। সে কিন্তু চায়নি ওদের ডিভোর্স হোক কিন্তু ডিভোর্স না হলেও বিধবা তো হতো। রাসিফ অনুভব করল ওই দুটি চোখ বড্ড মায়াবি ও চঞ্চল। আজ চঞ্চলতার আড়ালে বিরহও প্রতিয়মান। রাসিফ নিহাদকে বলল,

–ডিভোর্স বা বিধবা। দুইটাই কিন্তু একটা মেয়েকে সমাজের চোখে অন্যরকম প্রকাশ করায়। আজও সমাজ নারীদেরকেই এসবের কারণ ভাবে। আর্শিয়াকেও এসব শুনতে হবে। এর থেকে ভালো তুই ওর সাথে নিজের শেষ সময়টা অতিবাহিত করতে পারতি।

–নাহ্। আমার মৃত্যুর আগেই ও ঠিক মুভঅন করবে। নিজেকে আরও শক্ত করতে পারবে। আমি ওকে চিনি।

নিহাদের হতাশ কন্ঠস্বর শুনে রাসিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কালকে কোর্টে ডিভোর্স পেপার জমা দিয়ে নিহাদ ও রাসিফ সিঙ্গাপুরে চলে যাবে। এরপর কোর্টের হেয়ারিংয়ের সময় এসে আবার চলে যাবে।

________

কোর্টে পেপার জমা দিয়ে সিঙ্গাপুর ফিরে গেছে ওরা। এদিকে নিহাদের পরিবার ডিভোর্সের ব্যাপারে জানতো না। রফিক সাহেব ও আফসানা বেগম আর্শিয়াদের বাড়িতে আর্শিয়াকে দেখতে গেলেন। কুশল বিনিময়ের পর জানতে পারলেন ডিভোর্স পেপারের কথা। রফিক সাহেব অবাক হয়ে বললেন,

–কবে হলো এসব? আমাদের জানালি না?

–তোমাদের ছেলে তোমাদের জানায়নি? ডিভোর্স তো তারও হচ্ছে তাই না?

রফিক সাহেব আর্শিয়ার সরাসরি জবাবে আহত হলেন। আর্শিয়াকে তিনি মেয়ের মতো ঘরে তুলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার ছেলেই সবটা ঘেটে দিয়েছে। তিনি বললেন,

–ভালো থাকিস মা। আমার ছেলের সাথে তোর সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক তুই আজীবন আমার মেয়ে থাকবি।

আর্শিয়া মলিন হাসলো। আফসানা বেগমও বললেন,
–খুব ভালো কাউকে দেখে বিয়ে করিস পরেরবার। আমি চাইনা আমার মেয়েটা আবারও ঠকে যাক।

–না মা। আমি আর অতো সহজে বিয়ের পিঁড়িতে বসব না। নিজেকে আমি নিজের যোগ্যতায় প্রমান করব। তোমাদের ছেলেকে যখন বিয়ে করি তখন কী সে খারাপ ছিল? না তো। হুরকে সে প্রচন্ড ভালোবেসেও হারানোর পর যদি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়, সেই ছেলেকে তখন খারাপ বলা যায়? না। এখন হয়তো তার মন বদলেছে কারণ সে আর আগের নিহাদ নেই। মানুষ যেকোনো সময় বদলাতে পারে। গ্যারান্টি দিয়ে কিভাবে বলব নতুন কেউ আসলে সে বদলাবে না? নিহাদের বদলানোটাই তো আমি আশা করিনি। যদি কাউকে মন থেকে ভরসা করতে পারি তো ভেবে দেখব।

আফসানা বেগম আর্শিয়ার মাথায় হাত রেখে মলিন হাসলেন। আরও কিছুক্ষণ থেকে উনারা চলে গেলেন। আর্শিয়ার দিনগুলো ভালোই কাটলেও রাতগুলো হাহাকারে ভরা।

এদিকে মৃদুলাকে আশেপাশের প্রতিবেশিরা বলছে বাচ্চা নিয়ে নিতে। শাহরিফও যদি বিদেশে গিয়ে বদলে যায়! এই ভয়টা মৃদুলার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা। যেদিন ডিভোর্স পেপারে সাইন করাতে লোক এসেছিল সেদিনই এক কান দুকান করে এলাকা ছড়িয়ে গেছে। মানুষের তো কোনো কিছু পেলে রটিয়ে বেড়ানোর স্বভাব। মৃদুলা সত্যি মনে মনে ভয়ে আছে। মৃদুলা এই পরিবারে এসে বাবার, বোনের সব ভালোবাসা পেয়েছে সাথে স্বামীর তো আছেই। আর্শিয়া ও নিহাদের রাত জেগে কথা বলার সাক্ষীও সে মাঝেমাঝে হয়েছে। ওদের রাগ-অভিমান সবই দেখেছে। সেই মিষ্টি মধুর সম্পর্কটা এক ঝড়ে তছনছ হয়ে গেল। মৃদুলা শাহরিফকে বাচ্চার কথা বললেই শাহরিফ বলে,

–তুই নিজেই এক বাচ্চা। আবার নাকি সে বাচ্চা নিবে!

–এই আমি বাচ্চা না। একদম বাচ্চা বলবেন না।

শাহরিফ বাঁকা হেসে বলে,
–তা তোর বয়স কতো? ১৮ হয়েছে?

মৃদুলা তোঁতলাতে তোঁতলাতে বলে,
–হয়নি তো কী হয়েছে? আমার বয়সি মেয়েদের দেখেন গিয়ে গ্রামে, ওদের বাচ্চাও আছে।

–দরকার নেই বাচ্চার। আরে আমি তো তোর যন্ত্রনাতেই কুপোকাত তো আরেক বাচ্চা কেমনে পালবো?

–কী বললেন? আমি আপনাকে জ্বা*লাই? বিদেশে আপনি কী কোনো শাঁ*ক*চু*ন্নির সাথে পিরিত লাগাইছেন? সত্যি করে বলেন?

শাহরিফ চোখ মুখে অসহায় করে বলে,
–নারে বইন! আমি এক বউ সামলাতে পারিনা আবার আরেকটা!

–আমি আপনার বইন লাগি?

–উপস! মিস্টেক। বউ। আমার একমাত্র বাচ্চা বউ। শোনো বউ, তুমি এখন বাচ্চা। আমি তো তিন বাচ্চা সামলাতে পারব না। আমার বোনটা কী কম বাচ্চা! বাচ্চা, বাচ্চার মা, ফুফি সবাই তো বাচ্চা। কিভাবে সামলাবো বলো? তুমি একটু বড়ো হও। তারপর বাচ্চার কথা চিন্তা করব।

–না না না। বাচ্চা তো আমি নিবোই। বাচ্চা না নিলে আপনি দুবাই যেতে পারবেন না। সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকবেন।

অনেক বুঝানোর পরও যখন মৃদুলা নাছোড়বান্দা তখন শাহরিফ বিরক্ত হয়ে বলে,
–যা নিস। এবার থাম। আমাকে কাজ করতে দে।

মৃদুলা খুশিমনে চলে গেছে।

________

আজ কোর্টে হেয়ারিং। দুই পক্ষকে ডাকা হয়েছে নিজেদের মতামত জানাতে। আর্শিয়া আজ অনেকগুলো দিন পর নিহাদকে দেখছে। তার চোখের কোনে জল জমলেও সে আজ পাত্তা দিবে না। বেই*মা*নকে সে মনেও রাখতে চায় না। নিহাদের বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই এসেছে। ওরা এসেছে আর্শিয়ার তরফ থেকে। আর্শিয়ার সাথে ওর ভাই গিয়েছে। কোর্ট ওদের থেকে জানতে চায় ওরা দুইজনেই কী ডিভোর্স চায় কী না? নিহাদকে হ্যাঁ বলতে শুনে আর্শিয়াও হ্যাঁ বলে দেয়। কোর্ট নির্দিষ্ট সময় পর ডিভোর্স ফাইনাল করবে। আর্শিয়া কোর্ট থেকে বের হয়ে নিহাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে ঘুরে চলে গেছে।

কোর্ট চত্তরেই নিহাদের বাবা আজকে ছেলের থেকে হতাশামিশ্রিত কন্ঠে জানতে চান, কেনো আর্শিয়াকে ধোঁকা দিলো? কেনো তাদেরকে আর্শিয়ার সামনে নিচু করল?

নিহাদ প্রতিউত্তরে বলল,
–আমার হাতে সময় খুব কম বাবা। আমি ওর জীবন থেকে সব রঙ কেড়ে নিতে পারিনা। ওর সাথে আমার শুধু কাবিন হয়েছিল। ভালোবাসা সেটা তো মনের। এটুকুর জন্য ওর অনাগত ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারিনা। ও খুব ভালো। ওর মতো ফুলকে অকালে মুষড়ে যেতে দিতে পারিনা।

নিহাদের পরিবারের সকলে অবাক ও ভয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে প্রশ্নের সমাহার। নিহাদ তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,

–আমি আর মাত্র কয়েকদিনের অতিথি বাবা! মানুষ তার মৃত্যুর তারিখ বলতে পারেনা। আজ আছে তো কাল সকালে ঘুম ভাঙবে কিনা বলতে পারেনা কিন্তু হাজারো কল্পনা-ঝল্পনা করে প্ল্যানিং সাঁজায়। মানুষ তাতেই বাঁচে। তাতেই খুশি থাকে। কিন্তু আমার দ্বারা তো সেটাও করা সম্ভব না। আমি জানি আমার হায়াত বেশিদিন নেই। টিউমারটা বড়ো হয়ে গেছে অনেক গভীরে যা উন্নত চিকিৎসায় সম্ভব হলেও আমি বাঁচবো কিনা তার কোনো শিউরিটি নেই। টিউমারটা মেডিসিনের মাধ্যমে ছোটো করে তারপর অপারেশন করবে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমার। তাই যদি বাঁচি তো বাঁচব আর নাহলে তো আর্শিয়া ভালো থাকবেই।

আফসানা বেগম ছেলেকে ধরে কাঁদতে থাকেন। রফিক সাহেব, নিধি, রাফিও কাঁদছে। নিহাদ ওদের থেকে ওয়াদা নিয়ে নিয়েছে যাতে ডিভোর্স হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ আর্শিয়াকে এসব না জানায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here