এক খোলা অন্তরিক্ষ পর্ব -০৬

#এক_খোলা_অন্তরিক্ষ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
“সুখের লাগি হৃদয় অন্তরিক্ষে আঁকা প্রতিচ্ছবি,
মেলে ডানা এক খোলা অন্তরিক্ষে!”
______তিথী

সময় চিরকাল বহমান। সময়ের পরিক্রমায় দুইটা মাস পেরিয়ে গেছে। আর্শিয়ার সাথে নিহাদের বোন নিধির ও ভাই রাফির ফেসবুকে কথাবার্তা হতো কিন্তু হুট করে নিধি আর্শিয়াকে ব্লক করে দিলো। রাফির ফেসবুক ডিএক্টিভ। সাথে ওদের দুইজনের সিমকার্ড বন্ধ। রফিক সাহেবেরও ফোন বন্ধ। আর্শিয়া ভাবলো, ‘চাইলেই রক্তের সম্পর্কের বিপরীতে গিয়ে একটা বাইরের মেয়ের জন্য ভাবাটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।’

ওরা এজন্যই হয়তো আর্শিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছুক না। আর্শিয়াও আর ঘাটালো না কিন্তু মনে খুঁতখুঁত লেগেই আছে। আর্শিয়ার এক বান্ধুবী যে কীনন নিহাদদের প্রতিবেশি, সে এসে জানিয়েছে যে নিহাদের বাবা-মা, ভাই-বোন গত দুই তিনদিন ধরে বাড়িতে নেই। তারউপর এখন ফোনও বন্ধ। চিন্তা হচ্ছে তার।

ভার্সিটি-বাড়ি এই দুইয়েই কেটে যাচ্ছে আর্শিয়ার দিনগুলো। এর মধ্যে মৃদুলা প্রেগনেন্ট। মৃদুলার বয়স কম আর শরীর দুর্বল। ডাক্তার বলেছে, এবোর্ট করতে কিন্তু মৃদুলা কোনোমতেই করবে না। এরপর ডাক্তার ওকে নিয়মিত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেতে বলেছে। শাহরিফ রেগে আছে মৃদুলার উপর। জেদী মেয়ে কারও কথাই শোনে না। শাহরিফ দুবাইতে গেলে আর্শিয়া ভার্সিটি থেকে ফিরে সারাদিন মৃদুলার পেছোনেই লাগিয়ে দেয়। ওকে টাইম মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো সবকিছুর।

চারদিন পর, আর্শিয়া নিহাদদের প্রতিবেশি বান্ধুবীর মাধ্যমেই জানতে পারলো নিহাদরা বাড়ি ফিরেছে। আর্শিয়া তৎক্ষণাৎ নিধিকে ফোন করলো কিন্তু কল ঢুকলো না। নিহাদের বাবার ফোনও বন্ধ। এখন রাফিকে ফোন করলে প্রথমবার রিং হয়ে কেটে যায়। দ্বিতীয়বার রিং হলে রাফি হড়বড়িয়ে বলে,

–পরে কথা বলব ভাবি। ভাইয়াকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে।

কথাটা বলেই রাফি ফোন রেখে দেয়। আর্শিয়া অবাক সাথে উৎকণ্ঠিত হলো। তার বান্ধুবীকে ফোন করল।

–হ্যালো মিতু, দেখ না নিহাদদের কী হয়েছে? একটু দেখে আমাকে জানা। খুব জরুরীরে।

–আচ্ছা দেখছি।

মিতু নিহাদদের বাড়ির দিকে গেলো। সেখানে দেখল রাফি নিহাদকে ধরে গাড়িতে তুলছে। মিতু নিধিকে জিজ্ঞাসা করল,

–কী হয়েছে ভাইয়ার?

নিধি থতমত খেয়ে গেলো। মিতু যে আর্শিয়ার সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ে তা সে জানে। আমতা আমতা করে বলল,

–আরে বলিস না! ভাইয়ার ফুড পয়*জনিং হয়েছে। এখন তাই হসপিটালে নিবো আর আগামীকাল ভাইয়ার ফ্লাইট তো। সুস্থ হতে হবে।

মিতু বলে,
–ওহ আচ্ছা। সাবধানে যাস।

মিতু আর্শিয়াকে ফোন করে জানালো। লম্বাশ্বাস নিয়ে আর্শিয়া ফোন রেখে গোধূলির ছটা দেখছে। কী সুন্দর বিশাল অন্তরিক্ষে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। মেঘপুঞ্জ সোপানের মতো ভেসে আছে। আর এক মাসের মধ্যে কোর্ট ওদের ডিভোর্স কনফার্ম করবে। আর্শিয়া আপন মনে বিভোর। ভাবনাহীন শুধু আকাশের দিকে চেয়ে আছে। টুংটাং শব্দে ধ্যান ফিরে আর্শিয়ার। মৃদুলা খুব আয়েশ করে আর্শিয়ার পাশে বসেছে সাথে চায়ের কাপ, পিরিচ, চিনির বয়াম সাথে গুড়োদুধের পট ও কাচের কেটলিতে চা নিয়ে এসেছে একটা ট্রে তে করে। আর্শিয়া বলে,

–তুই এখন এসব করতে গেলি কেনো?

–আরে আমার খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই বানালাম। এখন দুই বোনে মিলে চা খাবো।

–তুই দুপুরের অর্ধেক খাওয়া খাবার খেয়েছিলি?

মৃদুলা চোখ মুখ খিঁচে দাঁত দিয়ে জিভ কে*টে বলে,
–খিদে নেই আপু। খেতে ইচ্ছে করছে না।

আর্শিয়া ভ্রুঁ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–তোর খেতে ইচ্ছে করে কখন বলতো? ভালো খাবার নিয়ে যতো বাহানা। এখন যদি চাচি আচার এনে দেয় তো পুরো বয়াম সাবাড় করে দিবি।

মৃদুলা দাঁত কেলিয়ে বলে,
–দিচ্ছে না তো। তবে আমি তার ঘরে বয়াম থেকে কিছু আচার চু*রি করে এনেছি।

আর্শিয়া ধ*মকে বলে,
–কয়েকদিন আগে না তোকে আমি পেটব্যথার জন্য হাসপাতাল থেকে আনলাম? তোর প্রেগনেন্সির মাত্র ছয় সপ্তাহ চলে আর এখন তোর সাবধানে চলতে হবে। ভাইয়া কিন্তু রেগে আছে।

মৃদুলা কথা উড়িয়ে দিয়ে বলে,
–উফ! চুপ করে এই গোধূলি বেলায় চায়ের সাথে সেলিব্রেট করো। কিছুক্ষণ পর আজান হবে। চা টাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

আর্শিয়া বক্রদৃষ্টিতে মৃদুলার দিকে তাকালো তারপর চায়ের কাপটা নিলো। ননদ-ভাবী দুইজনে মিলে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তটা উপভোগ করছে চায়ের সাথে। মৃদুলা হঠাৎ বলে উঠে,

–আশুপু তোমার ফোনটা একটু দেও তো।

–কেন কী করবি? তোর ফোন তো তোর কাছেই।

–আরে দেও না।

আর্শিয়া ফোনটা দিলে মৃদুলা হোয়াটসএপে গিয়ে শাহরিফকে ফোন করে। শাহরিফ মৃদুলার কল তুলছে না কারণ মৃদুলা খাওয়ার অনিয়ম করছে। ফোন রিসিভ করে শাহরিফ বলে,

–কী হয়েছে বল?

–না মানে…

শাহরিফ মৃদুলার কন্ঠ শুনে ফোন কে*টে দেয়। আর্শিয়া দেখল মৃদুলা কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুলা বলল,

–আপা তোমার ভাই এবার এলে তারে আমি শিল পাটায় পি*ষবো। আরে জোর করে খেলে আমার বমি হয়। বুঝে না কেন!

আর্শিয়া চায়ের কাপ সহ ট্রেটা তুলে বলল,
–আজান হচ্ছে ঘরে যা। নামাজ পরে ভাত নিয়ে বসবি নাহয় আমি তোরে পি*ষব।

মৃদুলা মুখ কালো করে উঠে গেলো।

______

আজ শেষমেশ আর্শিয়ার সাথে নিহাদের ডিভোর্স হয়েই গেলো। আর্শিয়া আজকে নিহাদের সামনা সামনি হতে চাইলো না। পরীক্ষাটা শেষ হলেই আর্শিয়া তার মামার বাড়ি চলে যাবে। মৃদুলাকেও ওর মামার বাড়ি পাঠানো হয়েছে। এখানে থাকলে আর্শিয়া একা পারেনা এই বি*চ্ছু মেয়েরে খাওয়াতে। মৃদুলার তিন মামা-মামী ও নানীর ভয়ে তো খাবে।

নিহাদের বাবা-মা আর্শিয়াকে নিরবে ভালো থাকতে বলে চলে যান। দেখতে দেখতে আর্শিয়ার পরীক্ষাও শেষ হলো। এখন সে মামাবাড়ি যাবে। আর্শিয়ার দুই মামী ওকে নিজের মেয়ের মতোই রাখে। আর্শিয়া এখানে এসে তার কাজিনদের সাথে ভালোই হাসি-মজাতে আছে। ঘোরাফেরা করে দিন কা*টছে।

আর্শিয়ার বড়ো মামা তার স্ত্রীকে জানালেন,
–রাহিদা, আমার একটা ইচ্ছা আছে।

–হ্যাঁ বলেন।

–আশুর সাথে যদি আমাতের রাহানের বিয়ে দেওয়া যায়?

–কী বলছেন আপনি?

আর্শিয়ার মামীর হকচকিয়ে প্রতিউত্তরে আর্শিয়ার মামা বলেন,
–দেখো, আশুর তো কোনো দোষ ছিল না। যা হয়েছে সব ভাগ্যের দোষে। আমাদের আশু এমনিতে কতো মিষ্টি ও আদুরে একটা মেয়ে। ওকে পুত্রবধূ করার ইচ্ছা আমার আগে থেকেই ছিল।

আর্শিয়ার বড়োমামী ডিভোর্সি মেয়ে ভেবে একটু নাকচ করতে চাইলেও তিনি তো আর্শিয়াকে ছোটো থেকে দেখছেন আর আর্শিয়ার মায়ের অনুপুস্থিতিতে পেলেছেনও কিছু সময়। তাই আর দ্বিমত করলেন না। রাহানকে জানানো হলে রাহান দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে,

–তোমরা যা ভালো বুঝো করো। এমনিতে আশু মেয়ে হিসেবে ভালোই। ওর ডিভোর্স হওয়া নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। ওই নিহাদ বুঝলো না ও কি হারিয়েছে।

আর্শিয়ার বড়ো মামা ছেলের সম্মতি পেয়ে আর্শিয়াকে জানাবেন বলে মনোস্থির করলেন। আদৌ আর্শিয়া কী রকম রিয়াক্ট করবেন সেই ব্যাপারে তিনি সন্দিহান। এদিকে আর্শিয়ারা প্ল্যানিং করেছে ওরা নদীর পাড়ে ঘুরতে যাবে। সব কাজিনরা মিলে বিকেলে যাবে। নৌকাতেও চড়ার ইচ্ছে আছে। নদীর ঘাটে গিয়ে সবাই একেক রকম ভাবে ছবি তুলছে। আর্শিয়া কিনারার দিকে গেলো ছবি তুলবে বলে। ছবিও ভালো আসছে। ছবি তুলতে তুলতে এতোটাই বিভোর যে আর এক পা পেছোলে আর্শিয়া নদীতে পরে যাবে তার হুঁশ নেই। পা পিছলে পরে যেতে ধরলে রাহান সাইড থেকে আর্শিয়ার হাত ধরে টান দেয়। হকচকিয়ে আর্শিয়া ভয় পেয়ে যায়। পেছোনে ঘুরে দেখে যেখানে আর্শিয়া দাঁড়িয়ে ছিল সেই স্থানের কিছু মাটি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। রাহান রেগে বলে,

–মন কোথায় থাকে তোর? একটু হলেই নদীতে পরতি।

আর্শিয়া থতমত খেয়ে চুপ করে গেছে। অন্যান্য কাজিনরাও ভয়ে চুপসে গেছে। রাহানের ছোটো বোন অরিন ছুটে এলো আর্শিয়ার কাছে। রাহান আবারও বলে,

–আর এক মিনিটও এখানে থাকবি না কেউ। বাড়ি চল।

কথাটা বলা মাত্র রাহান হনহনিয়ে স্থান ত্যাগ করে। আর্শিয়া একদম বোকা বনে গেলো। এখন আর ওরা এখানে থাকতেও পারবে না কারণ রাহান নয়তো খুব বকবে। নৌকায় চড়া হলো না ওদের।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here