এক জীবনে অনেক জীবন পর্ব ২৪

#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(২৪)
**********************************

সীমা খালা বললেন –

তোকে আমি আগেই বলেছিলাম আমাকে কোনো বিপদে ফেলিস না বাবা । আল্লাহ ই জানেন কোন বিপদে পড়বো এখন । আমার শাশুড়ি বাড়িতে পুলিশ দেখেই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন । তাড়াতাড়ি আয় ওনারা অপেক্ষা করছেন আর খবরদার আমাকে যদি কোনোভাবে এর মধ্যে জড়িয়েছিস তো খুব খারাপ হবে বলে দিলাম ।

রফিক জারাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সীমা খালা ধমকে উঠলেন –

পরে কথা বলবি, আগে ড্রইংরুমে আয়। এই মেয়ে তুমিও এসো ।

রফিক গালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো ভালোই ফুলে আছে । এমন একটা জায়গা যে ঢাকারও কোনো উপায় নেই । রফিক নিরুপায় হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো, তার পেছনে জারা ।

মেইন ডোর খোলা , ল্যান্ডিংয়ে দু’জন পুলিশ
দাঁড়িয়ে আছেন । দুরুদুরু বুকে রফিক রুমে ঢুকলো । এমন পরিস্থিতির জন্য যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না । এখানে আসার কথা কেউ জানে না, মোবাইল অফ রেখেছে , একটা ফোনও সে কাউকে করেনি । তাহলে পুলিশ একদম বাড়িতে এসে হাজির হলো কী করে ! তাহলে কী জারা করলো কাজটা ? জারা তাকে মিথ্যে বলেছে !

দুজন মানুষ বসে আছেন রুমে । একজনের পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম, অন্যজন সাধারণ পোশাকে । রফিক রুমে ঢোকার পর সেই সাধারণ পোশাক পরা লোকটা তাকে বসতে বললেন । রফিক বুঝতে পারছে না লোকটা কী পুলিশ না-কি অন্য কেউ । রফিক এসে বসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন –

আপনার নাম রফিক ?

জ্বি ।

মুখে কী হয়েছে ?

কিছু না ।

হুম । আদিত্য শাহরিয়ার কে ?

রফিক একটু চমকে উঠলো । সে ঠিক করে রেখেছিল, পুলিশ কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে কাবিননামার ছবি দেখিয়ে দেবে । সে তার বিয়ে করা বউ নিয়ে এখানে আছে আর জারা’র বয়সও আঠারো পেরিয়ে গেছে, কাজেই টেনশনের কিছু নেই । সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো –

আমার ডাক নাম আদিত্য ।

আমি আদিত্য বলিনি, আদিত্য শাহরিয়ার বলেছি ।

দু’টোই আমার নাম, ডাক নাম ।

এই ডাক নামে আপনাকে কয়জন মানুষ চেনেন মানে সবাই কী জানেন যে এটা আপনার ডাক নাম ?

যারা আমাকে চেনে তারা সবাই জানে এটা আমার নাম ।

তার মানে আপনার ফ্যামিলির লোকজন, আপনার বন্ধুবান্ধব এরা কেউই আপনাকে ঠিকমতো চেনেন না । চিনলে তো এই নামটা তাঁদের কাছে পরিচিত মনে হতো কিন্তু আপনার বাসার মানুষ তো এই নামটা আগে কখনো শোনেইনি ।

রফিক চুপ করে থাকলো ।

আপনি আদিত্য শাহরিয়ার ছিলেন এই মেয়েটার কাছে, তাই না ? ফেসবুকে ফেক আইডি খুলে, সমস্ত ভুল ইনফরমেশন দিয়ে আপনি তার সাথে রিলেশনে জড়িয়ে তারপর শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে ফেলেছেন । এই ব্যবসা কয়দিন ধরে করছেন ?

রফিকের খুব রাগ হলো কথাটা শুনে । এই লোকটাও কী পুলিশ ! এরকম কঠিন করে কথা বলছে কেন তার সাথে ? জারা’র সামনে এমন অপমান তার খুব গায়ে লাগছে । পুলিশ হয়েছে দেখে কী উল্টোপাল্টা যা খুশি বলে যাবে না-কি ? সে বললো –

ব্যবসা করবো কেন ? আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল, এখন আমরা বিয়ে করেছি । আপনি ওকেই জিজ্ঞেস করেন ৷ কাবিননামা দেখতে চান ?

লোকটা হাসলেন । বললেন –

আপনার সাহস আছে, সাহস না থাকলে অবশ্য এতো কিছু করে ফেলতে পারতেন না । অনেক কিছু করেছেন আর অনেক দূর পর্যন্ত করে ফেলেছেন । অসুবিধা নেই, আপনার সব কাজের হিসেব নেয়া হবে কড়ায়গণ্ডায় ।

এতক্ষণ তিনি রফিকের সাথেই কথা বলছিলেন । জারা’র দিকে ফিরেও তাকাননি, বসতেও বলেননি । জারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল । তার খুব অপমান লাগছিল, একই সাথে লজ্জা আর অসহায়ত্ব ঘিরে ধরছিল । জহির আংকেল যেন তাকে চিনতেই পারেননি । অন্য সময় হলে কতো সুন্দর করে কথা বলতেন , পড়ালেখার খোঁজ নিতেন অথচ এখন এমন ভাব করছেন যে মনে হচ্ছে জারাকে আজকের আগে তিনি কখনো দেখেননি । জারা’র দিকে তাকিয়ে এবার বললেন –

বসো ।

জারা রফিকের পাশে না বসে অন্য পাশের চেয়ারটায় যেয়ে বসলো ।

এখন বলো তোমার সমস্যা কী ?

জারা কোনো উত্তর দিতে পারলো না ।

আমি এক জারাকে চিনতাম কিন্তু সে তো এমন কাজ করার মেয়ে না । সেই জারা এতো চালাক-চতুর না তোমার মতো । তুমি তো দেখছি বেশ স্মার্ট ।

জারা তবুও মাথা নিচু করে বসে আছে দেখে জহির সাহেব বললেন –

বলো তোমার কিছু বলার থাকলে বলো । এতো বড় একটা কাজ যখন করতে পেরেছো, তোমার নিশ্চয়ই কিছু বলার আছে । তুমি এখন অ্যাডাল্ট হয়েছো, নিজের ডিসিশন নিজে নেয়ার মতো স্বাধীনতা তোমার আছে । আমার তো মনে হয় নিজের জন্য বেস্ট ডিসিশনটাই তুমি নিয়েছো, কী বলো ?

অনেকক্ষণ পর জারা কথা বললো –

সরি আংকেল ।

না না সরি বলছো কেন? তুমি একদম ঠিক কাজটাই করেছো । ভুল তো করেছে তোমার বাবা-মা । সব দোষ তাঁদের ।

আংকেল আমি বাসায় যাবো ।

বাসায় যাওয়ার জন্য তো এই কাজ করোনি । কী করেছিলে ? তুমি আমার মেয়ে হলে তো এখানেই তোমার বিচার, ব্যবস্থা করে ফেলতাম । বন্ধুর মেয়ে দেখে বেশি কিছু বলতেও পারছি না ।

রফিক অবাক হয়ে তাকালো জারা’র দিকে । তার মানে জারা পুলিশকে ফোন করেছিল আর সে বোকার মতো জারা’র বলা মিথ্যেগুলোকে বিশ্বাস করে চুপচাপ বসেছিল এতক্ষণ ! এখন আবার এই লোক বলছেন তিনি জারা’র বাবার বন্ধু । জারা যদি এখন উল্টোপাল্টা কিছু বলে তাহলে সে নির্ঘাত বাজেভাবে ফেঁসে যাবে । সে তাড়াতাড়ি বললো –

আমরা দু’জন নিজেদের ইচ্ছায় ঘর ছেড়ে এসেছি । জারাকে কেউ জোর করেনি । আমরা কোনো রুলস ভঙ্গ করিনি ।

পাশে বসে থাকা অফিসার এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন । বারবার রফিক একই কথা বলায় তিনি রেগে গেলেন । বললেন –

তথ্য গোপন করে, মিথ্যা কথা বলে মেয়েদের ফাঁসানোর যে ধান্দা শুরু করেছো এটা কতো বড় ক্রাইম তুমি জানো ? সমস্যা নাই, জায়গা মতো নিয়ে তোমাকে সমস্ত রুলস শিখিয়ে দেয়া হবে । এই পর্যন্ত এমন কতোগুলো বিয়ে করেছো তুমি ?

ইশারায় অফিসারকে থামতে বলে জহির সাহেব বললেন –

জারা তুমি আমাকে ঠিক করে বলো, তোমার কোনো কমপ্লেইন্ট আছে এই ছেলের বিরুদ্ধে ?

কমপ্লেইন্ট থাকবে কেন স্যার? রফিক বললো ।

জহির সাহেব এমন ভাবে তাকালেন রফিকের দিকে, ভয়ে রফিকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো ।

জহির সাহেব এবার জারা’র ওপর ধমকে উঠলেন –

কী জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে, উত্তর দিচ্ছো না কেন?

জারা’র মাথাটা ঘুরছে । একসাথে অসংখ্য চিন্তা এসে উঁকি দিচ্ছে মনে । এই যে সে আদিকে এতো ভালোবাসলো, সে হঠাৎ রফিক হয়ে গেল, এটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না আবার মানুষটার মুখের দিকে যখন তাকাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে তার আদি তো তার সামনে বসে আছে । কে রফিক, কিসের রফিক ?

কী হলো জারা, কথা বলছো না কেন ?

জারা’র কেমন হতবিহ্বল লাগছে । এই বিহ্বলতা থেকে বাঁচাতেই কেউ যেন তার ভেতর থেকে বলে উঠলো –

জারা শোনো এই মুহূর্তে তুমি যা বলবে, সে কথার ওপর তোমার পরবর্তী জীবনের পথ তৈরি হয়ে যাবে । ভেবেচিন্তে কথা বলো জারা । জীবন একটাই, অনেক ভুল তুমি এর মধ্যেই করে ফেলেছো । বারবার ভুল শুধরানোর সুযোগ আসবে না । দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও জারা । সময় চলে যাচ্ছে, জলদি জারা জলদি । কী ভাবছো, মা রাগ হয়ে আছেন , তাতে কী ? মা’র হাত ধরে প্রয়োজনে হাজারবার ক্ষমা চেয়ে নিও । আব্বু নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন । কে কী বলবে না বলবে , ফিরে গেলে সবাই হাসাহাসি করবে, এইসব একদম ভুলে যাও । জীবনটা তোমার, কে কী বললো তাতে জীবনের একটা মুহূর্তও থেমে থাকবে না । শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবো । আর কোনো ভুল না জারা ।

নিজের মনকে শক্ত করলো জারা । বললো –

আংকেল ও ফেক আইডি খুলে আমার সাথে রিলেশন করেছে । ও যে রফিক এটা আমি আজই জানতে পেরেছি । আমি ওকে আদিত্য নামেই চিনতাম । ও আমার কাছে সব মিথ্যে বলেছে । বাবা-মা, বাড়িঘর সবকিছু নিয়েই মিথ্যে বলেছে আমাকে ।

জারা তুমি মিথ্যা বলছো কেন ? রফিক বললো ।

আমি মিথ্যা বলছি !

জহির সাহেব বললেন –

বুঝলাম সে মিথ্যা বলেছে কিন্তু সে তো তোমাকে বিয়ে করার জন্য জোর করেনি । তাহলে এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তুমি ওকে বিয়ে করলে কেন ?

ভুল হয়ে গেছে আংকেল ।

ভুল হয়নি, অন্যায় হয়েছে । সে যা করেছে সেটা তো বড় ক্রাইম কিন্তু তুমি যেটা করেছো জারা সেটাও এক ধরণের ক্রাইম । তোমরা বাবা-মা’র ভালোবাসার, তাঁদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের ইমোশনের সাথে খেলা করো । তোমরা তাঁদের কতোটা অসহায় অবস্থায় ফেলে দাও, একবার চিন্তা করে দেখেছো ? একজন বাবা কতটা অসহায় হতে পারেন, কোনো ধারণা আছে তোমার ? দেখতে চাও ?

জহির সাহেব ফোন করে বললেন –

কায়সার ওপরে এসো ।

জারা’র পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন অবশ হয়ে গেল । আব্বু এসেছে ! আব্বুর চোখের দিকে সে কেমন করে তাকাবে ? এরচেয়ে তো মরে গেলে বেশি ভালো হতো । এমন একটা মুহূর্ত কেন এলো তার জীবনে ? এই রফিক কেন তার জীবনে এলো ? এই ছেলেটার কারণে তার জীবনটার আজ এই অবস্থা । ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওর মুখটা আরো ক্ষতবিক্ষত করে দিতে ।

কায়সার রুমে ঢুকতেই মেয়ের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল তাঁর । জারা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো । ঐ এক পলক চাহুনিতেই জারা’র হার্ট বিট থেমে গেল যেন । আব্বুকে দেখতে এমন লাগছে কেন ! সারাজীবন আব্বুকে ভীষণ পরিপাটি থাকতে দেখেছে তারা । অথচ এখন দেখে মনে হচ্ছে অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন । চুলে চিরুনি পড়েনি , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । জারা’র ভীষণ কান্না পেল, গলার কাছে কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে । ছুটে গিয়ে আব্বুর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে –

বড্ড ভুল করে ফেলেছি আব্বু , এবারের মতো ক্ষমা করে দাও কিন্তু সে তো তার জায়গা থেকে নড়তেই পারছে না । পাথরের মতো জমে গেছে যেন ।

কায়সার রফিকের দিকে একবার তাকিয়ে জহির সাহেবের পাশে যেয়ে বসলেন । রফিক জারা’র বাবাকে দেখেই চিনতে পারলো কিন্তু ওনার পেছনে সাদাতকে ঢুকতে দেখে খুব বেশি অবাক হয়ে গেল । বললো –

তুই এখানে কেন ?

সাদাত কথার উত্তর না দিয়ে জারা’র পাশে যেয়ে বসলো ।

জহির সাহেব বললেন –

তোমার মেয়ের কাছে নিয়ে আসলাম তোমাকে । এখন তোমরা যা করতে চাও তাড়াতাড়ি করো । আমাকে পরবর্তী কাজগুলো শুরু করতে হবে । মেয়েকে জিজ্ঞেস করো সে কী চায় কারণ তার কথার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে ।

কায়সার বললেন –

আমার কিছু বলার নেই জহির । মেয়ে বড় হয়েছে, সে যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে তা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে । ও বলুক ও কী চায় ।

জারা এতক্ষণ খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিল, এবার আর পারলো না । কাঁদতে কাঁদতে যেয়ে কায়সারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো –

আব্বু আমার খুব ভুল হয়ে গেছে । মাফ করে দাও আব্বু ।

মেয়ের ওপর এই প্রথম খুব রাগ হলো কায়সারের । বললেন –

জায়গায় যেয়ে বসো ।

জারা আর কিছু না বলে জায়গায় যেয়ে বসলো ।

জহির সাহেব রফিকের খালাকে ডেকে কথা বললেন । সীমা খালা বারবারই বললেন, তাঁর ভাগনের কোনো দোষ নেই । তারা তো বৈধভাবেই বিয়েটা করেছে ।

রফিক অনেক ভাবেই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো, জারাকে বারবার নিজের দিকে টানার চেষ্টা করলো । এরমধ্যে রোজা’র সাথে জারার ফোনে কথা হয়েছে দুই বার । রোজা তাকে খুব করে সতর্ক করেছে, সে যেন কোনোভাবেই আবার রফিকের কথায় পটে না যায় ।

অনেক কথাবার্তা, বাকবিতন্ডার পর সীমা খালার বাসা থেকে সবাই যখন বের হলো তখন ক্যালেন্ডারে নতুন তারিখ এসেছে । সীমা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু রফিককে বাঁচাতে পারলেন না । রফিক একবার একাকী কথা বলতে চেয়েছিল জারা’র সাথে কিন্তু জহির সাহেবের কাছে পাত্তাই পায়নি কথাটা ।

ওরা বেরিয়ে গেলে সীমা রফিকের বাসায় ফোন দিলেন । রফিকের মা সীমার কথার কিছুই যেন বুঝতে পারছেন না । তিনি অবাক হয়ে বললেন –

রফিক বাড়ি ছাড়লো সাত দিনও তো হলো না । সে বিয়ে করলো কখন, বউ পুলিশ ডাকলো কখন আর রফিক জেলে গেল কখন !

আপা আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো । এখন খোঁজ নাও রফিককে নিয়ে পুলিশ কোথায় যাচ্ছে , মির্জাপুর থানায় না-কি ঢাকায় ?

.
.

জহির সাহেব আসামী নিয়ে রওনা দিলেন আর অন্য গাড়িতে কায়সারের সাথে সাদাত আর জারা । তাবাসসুমকে ফোন করে লাভ হবে না । সে এখন কোনো কথাই বলবে না । আর এমনিতেও অনেক রাত হয়ে গেছে । কায়সার রোজাকে ফোন দিলেন । রোজা জেগেই ছিল । বললো –

আব্বু তোমরা এখন কোথায় ?

বের হয়েছি মাত্র, আসছি । তোমার মা ঘুমিয়েছে ?

বুঝতে পারছি না । আমি এতক্ষণ মা’র রুমেই ছিলাম । মা অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন । অস্থিরতার কারণে ঘুমাতে পারছিলেন না । আব্বু জারা কোথায় ?

আছে । পেছনে বসে আছে সাদাতের সাথে ।

ও কী বাসায় আসবে ?

না বাসায় আসবে না । তোমার মা’র মাথা ঠান্ডা হোক তারপর দেখা যাবে ।

তাহলে জারা এখন কোথায় থাকবে ?

ফাইজার বাসায় দিয়ে আসবো ?

না আব্বু ফুপির বাসায় যেয়ো না । ফুপি অনেক উল্টোপাল্টা কথা শোনাবে জারাকে ।

তাহলে কী করবো ? তোমার বাসায়ও তো যাওয়া যাবে না । তোমার শাশুড়ি জানেন বিষয়টা ?

আমি তো বলিনি । সিয়াম বলে দিয়েছে । আমার ওখানে যাওয়া যাবে না আব্বু । আমার শাশুড়ি ব্যাপারটা সহজভাবে নেবেন না ।

কায়সার মেয়ের সাথে এতো আস্তে কথা বলছিলেন যে পেছনে বসে ওদের পক্ষে কোনো কথা শোনা সম্ভব হচ্ছিল না কিন্তু সাদাত অনুমান করতে পারছিল খালু কী কথা বলছেন । সে বাসায় থাকতেই খালার সিদ্ধান্ত শুনেছিল । সে কায়সারকে বললো –

খালু জারাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো ?

সাদাতে’র কথা শুনে জারা খুব অবাক হলো কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না ।

তোমাদের বাসায় ? আপা কী বাসায় চলে গেছেন ?

জ্বি, মা বাসায়ই আছেন ।

তোমাদের সমস্যা হবে না তো ?

না না সমস্যা হবে কেন ? কোনো সমস্যাই হবে না ।

কেউ আর কোনো কথা বললো না ।

জারা’র ভেতরটা খুব উশখুশ করছে । কেন সে নিজের বাড়িতে না যেয়ে খালার বাড়িতে যাচ্ছে ? কেন আব্বু তার সাথে ঠিক করে কথা বলছেন না আর সে-ই বা কেন আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছে না আব্বুর সাথে ? ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে আসছে অথচ এতোটুকুও ঘুম নেই চোখে । চোখ বন্ধ করে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করলো জারা । আদিত্যের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে । সাথে সাথে চোখ মেললো সে । এই মুখটা সে আর কখনো মনে করতে চায় না । গত এক বছরের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সে আর কখনোই মনে করবে না । সব স্মৃতি মুছে ফেলবে মেমরি থেকে কিন্তু কীভাবে তা এখনো জানে না সে ।

সাদাত অনেকক্ষণ যাবত জারা’র অস্থিরতা খেয়াল করছিল । জারা’র এতো মলিন চেহারা সে আগে কখনো দেখেনি । এই বয়সে যে মানসিক ধাক্কাটা সে খেলো , সেটা কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর হয়ে যাবে যদি বাড়ির মানুষ সাপোর্ট না করে । দু’দিন ধরে ঐ বাড়িতে থেকে ছোটো খালার রাগ সে বেশ ভালোভাবে টের পেয়েছে । এতো সহজে জারা’র ওপর থেকে খালার রাগ কমবে না । রোজা তো ওখানে থাকে না । সে কতটুকুই বা সাপোর্ট দিতে পারবে জারাকে ? সাদাতের খুব ইচ্ছে করছে জারা’র হাতটা ধরে বলতে –

ভয় পেয়ো না জারা , আমি তোমার পাশে আছি । জড়তা আর লজ্জা গ্রাস করলো সাদাতকে । হাতটাও ধরা হলো না, কথাটাও বলতে পারলো না ।

গাড়ি যখন সাদাতদের বাড়ির সামনে এসে থামলো ততক্ষণে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে । সাদাত আর জারাকে নামিয়ে দিয়ে কায়সার চলে গেলেন । যওয়ার আগে জারাকে বলে গেলেন –

বাসায় যেয়ে রেস্ট নাও ৷ একটা কথা মনে রেখো, তোমার মা তোমার ওপর ভীষণ রেগে আছেন । তিনি তোমাকে কবে ক্ষমা করবেন জানি না । আর যেন কোনো ভুল কোরো না । ভুলের ক্ষমা একবার হয় , বারবার কিন্তু হয় না ।

নিলুফার জেগেই ছিলেন । দরজা খোলার পর ওরা ভেতরে ঢুকলে বললেন –

টেবিলে খাবার রাখা আছে । তোদের যদি ক্ষিদে লাগে তো খেয়ে নিস । আমি যাই, একটু ঘুমাবো । সারারাত ঘুমাইনি তাই মাথাটা একটু ব্যাথা করছে ।

সাদাত মনে মনে মা’র প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ হলো জারাকে কিছু জিজ্ঞেস না করায় । সে বললো –

তুমি কিছু খাবে জারা?

না ।

ঠিক আছে তুমি আমার রুমে যেয়ে রেস্ট নাও । পরে কথা হবে ।

জারা রুমে চলে গেল । সাদাত এখন আর ঘুমাবে না । একটু পরেই তো অফিস যেতে হবে । শরীরের ক্লান্তি দূর করতে সে বেশ সময় নিয়ে গোসল করলো তারপর এক কাপ চা তৈরি করে বারান্দায় এসে বসলো ।……………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here