#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(২৪)
**********************************
সীমা খালা বললেন –
তোকে আমি আগেই বলেছিলাম আমাকে কোনো বিপদে ফেলিস না বাবা । আল্লাহ ই জানেন কোন বিপদে পড়বো এখন । আমার শাশুড়ি বাড়িতে পুলিশ দেখেই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন । তাড়াতাড়ি আয় ওনারা অপেক্ষা করছেন আর খবরদার আমাকে যদি কোনোভাবে এর মধ্যে জড়িয়েছিস তো খুব খারাপ হবে বলে দিলাম ।
রফিক জারাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সীমা খালা ধমকে উঠলেন –
পরে কথা বলবি, আগে ড্রইংরুমে আয়। এই মেয়ে তুমিও এসো ।
রফিক গালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো ভালোই ফুলে আছে । এমন একটা জায়গা যে ঢাকারও কোনো উপায় নেই । রফিক নিরুপায় হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো, তার পেছনে জারা ।
মেইন ডোর খোলা , ল্যান্ডিংয়ে দু’জন পুলিশ
দাঁড়িয়ে আছেন । দুরুদুরু বুকে রফিক রুমে ঢুকলো । এমন পরিস্থিতির জন্য যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না । এখানে আসার কথা কেউ জানে না, মোবাইল অফ রেখেছে , একটা ফোনও সে কাউকে করেনি । তাহলে পুলিশ একদম বাড়িতে এসে হাজির হলো কী করে ! তাহলে কী জারা করলো কাজটা ? জারা তাকে মিথ্যে বলেছে !
দুজন মানুষ বসে আছেন রুমে । একজনের পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম, অন্যজন সাধারণ পোশাকে । রফিক রুমে ঢোকার পর সেই সাধারণ পোশাক পরা লোকটা তাকে বসতে বললেন । রফিক বুঝতে পারছে না লোকটা কী পুলিশ না-কি অন্য কেউ । রফিক এসে বসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন –
আপনার নাম রফিক ?
জ্বি ।
মুখে কী হয়েছে ?
কিছু না ।
হুম । আদিত্য শাহরিয়ার কে ?
রফিক একটু চমকে উঠলো । সে ঠিক করে রেখেছিল, পুলিশ কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে কাবিননামার ছবি দেখিয়ে দেবে । সে তার বিয়ে করা বউ নিয়ে এখানে আছে আর জারা’র বয়সও আঠারো পেরিয়ে গেছে, কাজেই টেনশনের কিছু নেই । সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো –
আমার ডাক নাম আদিত্য ।
আমি আদিত্য বলিনি, আদিত্য শাহরিয়ার বলেছি ।
দু’টোই আমার নাম, ডাক নাম ।
এই ডাক নামে আপনাকে কয়জন মানুষ চেনেন মানে সবাই কী জানেন যে এটা আপনার ডাক নাম ?
যারা আমাকে চেনে তারা সবাই জানে এটা আমার নাম ।
তার মানে আপনার ফ্যামিলির লোকজন, আপনার বন্ধুবান্ধব এরা কেউই আপনাকে ঠিকমতো চেনেন না । চিনলে তো এই নামটা তাঁদের কাছে পরিচিত মনে হতো কিন্তু আপনার বাসার মানুষ তো এই নামটা আগে কখনো শোনেইনি ।
রফিক চুপ করে থাকলো ।
আপনি আদিত্য শাহরিয়ার ছিলেন এই মেয়েটার কাছে, তাই না ? ফেসবুকে ফেক আইডি খুলে, সমস্ত ভুল ইনফরমেশন দিয়ে আপনি তার সাথে রিলেশনে জড়িয়ে তারপর শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে ফেলেছেন । এই ব্যবসা কয়দিন ধরে করছেন ?
রফিকের খুব রাগ হলো কথাটা শুনে । এই লোকটাও কী পুলিশ ! এরকম কঠিন করে কথা বলছে কেন তার সাথে ? জারা’র সামনে এমন অপমান তার খুব গায়ে লাগছে । পুলিশ হয়েছে দেখে কী উল্টোপাল্টা যা খুশি বলে যাবে না-কি ? সে বললো –
ব্যবসা করবো কেন ? আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল, এখন আমরা বিয়ে করেছি । আপনি ওকেই জিজ্ঞেস করেন ৷ কাবিননামা দেখতে চান ?
লোকটা হাসলেন । বললেন –
আপনার সাহস আছে, সাহস না থাকলে অবশ্য এতো কিছু করে ফেলতে পারতেন না । অনেক কিছু করেছেন আর অনেক দূর পর্যন্ত করে ফেলেছেন । অসুবিধা নেই, আপনার সব কাজের হিসেব নেয়া হবে কড়ায়গণ্ডায় ।
এতক্ষণ তিনি রফিকের সাথেই কথা বলছিলেন । জারা’র দিকে ফিরেও তাকাননি, বসতেও বলেননি । জারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল । তার খুব অপমান লাগছিল, একই সাথে লজ্জা আর অসহায়ত্ব ঘিরে ধরছিল । জহির আংকেল যেন তাকে চিনতেই পারেননি । অন্য সময় হলে কতো সুন্দর করে কথা বলতেন , পড়ালেখার খোঁজ নিতেন অথচ এখন এমন ভাব করছেন যে মনে হচ্ছে জারাকে আজকের আগে তিনি কখনো দেখেননি । জারা’র দিকে তাকিয়ে এবার বললেন –
বসো ।
জারা রফিকের পাশে না বসে অন্য পাশের চেয়ারটায় যেয়ে বসলো ।
এখন বলো তোমার সমস্যা কী ?
জারা কোনো উত্তর দিতে পারলো না ।
আমি এক জারাকে চিনতাম কিন্তু সে তো এমন কাজ করার মেয়ে না । সেই জারা এতো চালাক-চতুর না তোমার মতো । তুমি তো দেখছি বেশ স্মার্ট ।
জারা তবুও মাথা নিচু করে বসে আছে দেখে জহির সাহেব বললেন –
বলো তোমার কিছু বলার থাকলে বলো । এতো বড় একটা কাজ যখন করতে পেরেছো, তোমার নিশ্চয়ই কিছু বলার আছে । তুমি এখন অ্যাডাল্ট হয়েছো, নিজের ডিসিশন নিজে নেয়ার মতো স্বাধীনতা তোমার আছে । আমার তো মনে হয় নিজের জন্য বেস্ট ডিসিশনটাই তুমি নিয়েছো, কী বলো ?
অনেকক্ষণ পর জারা কথা বললো –
সরি আংকেল ।
না না সরি বলছো কেন? তুমি একদম ঠিক কাজটাই করেছো । ভুল তো করেছে তোমার বাবা-মা । সব দোষ তাঁদের ।
আংকেল আমি বাসায় যাবো ।
বাসায় যাওয়ার জন্য তো এই কাজ করোনি । কী করেছিলে ? তুমি আমার মেয়ে হলে তো এখানেই তোমার বিচার, ব্যবস্থা করে ফেলতাম । বন্ধুর মেয়ে দেখে বেশি কিছু বলতেও পারছি না ।
রফিক অবাক হয়ে তাকালো জারা’র দিকে । তার মানে জারা পুলিশকে ফোন করেছিল আর সে বোকার মতো জারা’র বলা মিথ্যেগুলোকে বিশ্বাস করে চুপচাপ বসেছিল এতক্ষণ ! এখন আবার এই লোক বলছেন তিনি জারা’র বাবার বন্ধু । জারা যদি এখন উল্টোপাল্টা কিছু বলে তাহলে সে নির্ঘাত বাজেভাবে ফেঁসে যাবে । সে তাড়াতাড়ি বললো –
আমরা দু’জন নিজেদের ইচ্ছায় ঘর ছেড়ে এসেছি । জারাকে কেউ জোর করেনি । আমরা কোনো রুলস ভঙ্গ করিনি ।
পাশে বসে থাকা অফিসার এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন । বারবার রফিক একই কথা বলায় তিনি রেগে গেলেন । বললেন –
তথ্য গোপন করে, মিথ্যা কথা বলে মেয়েদের ফাঁসানোর যে ধান্দা শুরু করেছো এটা কতো বড় ক্রাইম তুমি জানো ? সমস্যা নাই, জায়গা মতো নিয়ে তোমাকে সমস্ত রুলস শিখিয়ে দেয়া হবে । এই পর্যন্ত এমন কতোগুলো বিয়ে করেছো তুমি ?
ইশারায় অফিসারকে থামতে বলে জহির সাহেব বললেন –
জারা তুমি আমাকে ঠিক করে বলো, তোমার কোনো কমপ্লেইন্ট আছে এই ছেলের বিরুদ্ধে ?
কমপ্লেইন্ট থাকবে কেন স্যার? রফিক বললো ।
জহির সাহেব এমন ভাবে তাকালেন রফিকের দিকে, ভয়ে রফিকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো ।
জহির সাহেব এবার জারা’র ওপর ধমকে উঠলেন –
কী জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে, উত্তর দিচ্ছো না কেন?
জারা’র মাথাটা ঘুরছে । একসাথে অসংখ্য চিন্তা এসে উঁকি দিচ্ছে মনে । এই যে সে আদিকে এতো ভালোবাসলো, সে হঠাৎ রফিক হয়ে গেল, এটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না আবার মানুষটার মুখের দিকে যখন তাকাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে তার আদি তো তার সামনে বসে আছে । কে রফিক, কিসের রফিক ?
কী হলো জারা, কথা বলছো না কেন ?
জারা’র কেমন হতবিহ্বল লাগছে । এই বিহ্বলতা থেকে বাঁচাতেই কেউ যেন তার ভেতর থেকে বলে উঠলো –
জারা শোনো এই মুহূর্তে তুমি যা বলবে, সে কথার ওপর তোমার পরবর্তী জীবনের পথ তৈরি হয়ে যাবে । ভেবেচিন্তে কথা বলো জারা । জীবন একটাই, অনেক ভুল তুমি এর মধ্যেই করে ফেলেছো । বারবার ভুল শুধরানোর সুযোগ আসবে না । দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও জারা । সময় চলে যাচ্ছে, জলদি জারা জলদি । কী ভাবছো, মা রাগ হয়ে আছেন , তাতে কী ? মা’র হাত ধরে প্রয়োজনে হাজারবার ক্ষমা চেয়ে নিও । আব্বু নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন । কে কী বলবে না বলবে , ফিরে গেলে সবাই হাসাহাসি করবে, এইসব একদম ভুলে যাও । জীবনটা তোমার, কে কী বললো তাতে জীবনের একটা মুহূর্তও থেমে থাকবে না । শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবো । আর কোনো ভুল না জারা ।
নিজের মনকে শক্ত করলো জারা । বললো –
আংকেল ও ফেক আইডি খুলে আমার সাথে রিলেশন করেছে । ও যে রফিক এটা আমি আজই জানতে পেরেছি । আমি ওকে আদিত্য নামেই চিনতাম । ও আমার কাছে সব মিথ্যে বলেছে । বাবা-মা, বাড়িঘর সবকিছু নিয়েই মিথ্যে বলেছে আমাকে ।
জারা তুমি মিথ্যা বলছো কেন ? রফিক বললো ।
আমি মিথ্যা বলছি !
জহির সাহেব বললেন –
বুঝলাম সে মিথ্যা বলেছে কিন্তু সে তো তোমাকে বিয়ে করার জন্য জোর করেনি । তাহলে এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তুমি ওকে বিয়ে করলে কেন ?
ভুল হয়ে গেছে আংকেল ।
ভুল হয়নি, অন্যায় হয়েছে । সে যা করেছে সেটা তো বড় ক্রাইম কিন্তু তুমি যেটা করেছো জারা সেটাও এক ধরণের ক্রাইম । তোমরা বাবা-মা’র ভালোবাসার, তাঁদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের ইমোশনের সাথে খেলা করো । তোমরা তাঁদের কতোটা অসহায় অবস্থায় ফেলে দাও, একবার চিন্তা করে দেখেছো ? একজন বাবা কতটা অসহায় হতে পারেন, কোনো ধারণা আছে তোমার ? দেখতে চাও ?
জহির সাহেব ফোন করে বললেন –
কায়সার ওপরে এসো ।
জারা’র পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন অবশ হয়ে গেল । আব্বু এসেছে ! আব্বুর চোখের দিকে সে কেমন করে তাকাবে ? এরচেয়ে তো মরে গেলে বেশি ভালো হতো । এমন একটা মুহূর্ত কেন এলো তার জীবনে ? এই রফিক কেন তার জীবনে এলো ? এই ছেলেটার কারণে তার জীবনটার আজ এই অবস্থা । ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওর মুখটা আরো ক্ষতবিক্ষত করে দিতে ।
কায়সার রুমে ঢুকতেই মেয়ের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল তাঁর । জারা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো । ঐ এক পলক চাহুনিতেই জারা’র হার্ট বিট থেমে গেল যেন । আব্বুকে দেখতে এমন লাগছে কেন ! সারাজীবন আব্বুকে ভীষণ পরিপাটি থাকতে দেখেছে তারা । অথচ এখন দেখে মনে হচ্ছে অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন । চুলে চিরুনি পড়েনি , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । জারা’র ভীষণ কান্না পেল, গলার কাছে কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে । ছুটে গিয়ে আব্বুর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে –
বড্ড ভুল করে ফেলেছি আব্বু , এবারের মতো ক্ষমা করে দাও কিন্তু সে তো তার জায়গা থেকে নড়তেই পারছে না । পাথরের মতো জমে গেছে যেন ।
কায়সার রফিকের দিকে একবার তাকিয়ে জহির সাহেবের পাশে যেয়ে বসলেন । রফিক জারা’র বাবাকে দেখেই চিনতে পারলো কিন্তু ওনার পেছনে সাদাতকে ঢুকতে দেখে খুব বেশি অবাক হয়ে গেল । বললো –
তুই এখানে কেন ?
সাদাত কথার উত্তর না দিয়ে জারা’র পাশে যেয়ে বসলো ।
জহির সাহেব বললেন –
তোমার মেয়ের কাছে নিয়ে আসলাম তোমাকে । এখন তোমরা যা করতে চাও তাড়াতাড়ি করো । আমাকে পরবর্তী কাজগুলো শুরু করতে হবে । মেয়েকে জিজ্ঞেস করো সে কী চায় কারণ তার কথার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে ।
কায়সার বললেন –
আমার কিছু বলার নেই জহির । মেয়ে বড় হয়েছে, সে যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে তা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে । ও বলুক ও কী চায় ।
জারা এতক্ষণ খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিল, এবার আর পারলো না । কাঁদতে কাঁদতে যেয়ে কায়সারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো –
আব্বু আমার খুব ভুল হয়ে গেছে । মাফ করে দাও আব্বু ।
মেয়ের ওপর এই প্রথম খুব রাগ হলো কায়সারের । বললেন –
জায়গায় যেয়ে বসো ।
জারা আর কিছু না বলে জায়গায় যেয়ে বসলো ।
জহির সাহেব রফিকের খালাকে ডেকে কথা বললেন । সীমা খালা বারবারই বললেন, তাঁর ভাগনের কোনো দোষ নেই । তারা তো বৈধভাবেই বিয়েটা করেছে ।
রফিক অনেক ভাবেই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো, জারাকে বারবার নিজের দিকে টানার চেষ্টা করলো । এরমধ্যে রোজা’র সাথে জারার ফোনে কথা হয়েছে দুই বার । রোজা তাকে খুব করে সতর্ক করেছে, সে যেন কোনোভাবেই আবার রফিকের কথায় পটে না যায় ।
অনেক কথাবার্তা, বাকবিতন্ডার পর সীমা খালার বাসা থেকে সবাই যখন বের হলো তখন ক্যালেন্ডারে নতুন তারিখ এসেছে । সীমা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু রফিককে বাঁচাতে পারলেন না । রফিক একবার একাকী কথা বলতে চেয়েছিল জারা’র সাথে কিন্তু জহির সাহেবের কাছে পাত্তাই পায়নি কথাটা ।
ওরা বেরিয়ে গেলে সীমা রফিকের বাসায় ফোন দিলেন । রফিকের মা সীমার কথার কিছুই যেন বুঝতে পারছেন না । তিনি অবাক হয়ে বললেন –
রফিক বাড়ি ছাড়লো সাত দিনও তো হলো না । সে বিয়ে করলো কখন, বউ পুলিশ ডাকলো কখন আর রফিক জেলে গেল কখন !
আপা আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো । এখন খোঁজ নাও রফিককে নিয়ে পুলিশ কোথায় যাচ্ছে , মির্জাপুর থানায় না-কি ঢাকায় ?
.
.
জহির সাহেব আসামী নিয়ে রওনা দিলেন আর অন্য গাড়িতে কায়সারের সাথে সাদাত আর জারা । তাবাসসুমকে ফোন করে লাভ হবে না । সে এখন কোনো কথাই বলবে না । আর এমনিতেও অনেক রাত হয়ে গেছে । কায়সার রোজাকে ফোন দিলেন । রোজা জেগেই ছিল । বললো –
আব্বু তোমরা এখন কোথায় ?
বের হয়েছি মাত্র, আসছি । তোমার মা ঘুমিয়েছে ?
বুঝতে পারছি না । আমি এতক্ষণ মা’র রুমেই ছিলাম । মা অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন । অস্থিরতার কারণে ঘুমাতে পারছিলেন না । আব্বু জারা কোথায় ?
আছে । পেছনে বসে আছে সাদাতের সাথে ।
ও কী বাসায় আসবে ?
না বাসায় আসবে না । তোমার মা’র মাথা ঠান্ডা হোক তারপর দেখা যাবে ।
তাহলে জারা এখন কোথায় থাকবে ?
ফাইজার বাসায় দিয়ে আসবো ?
না আব্বু ফুপির বাসায় যেয়ো না । ফুপি অনেক উল্টোপাল্টা কথা শোনাবে জারাকে ।
তাহলে কী করবো ? তোমার বাসায়ও তো যাওয়া যাবে না । তোমার শাশুড়ি জানেন বিষয়টা ?
আমি তো বলিনি । সিয়াম বলে দিয়েছে । আমার ওখানে যাওয়া যাবে না আব্বু । আমার শাশুড়ি ব্যাপারটা সহজভাবে নেবেন না ।
কায়সার মেয়ের সাথে এতো আস্তে কথা বলছিলেন যে পেছনে বসে ওদের পক্ষে কোনো কথা শোনা সম্ভব হচ্ছিল না কিন্তু সাদাত অনুমান করতে পারছিল খালু কী কথা বলছেন । সে বাসায় থাকতেই খালার সিদ্ধান্ত শুনেছিল । সে কায়সারকে বললো –
খালু জারাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো ?
সাদাতে’র কথা শুনে জারা খুব অবাক হলো কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না ।
তোমাদের বাসায় ? আপা কী বাসায় চলে গেছেন ?
জ্বি, মা বাসায়ই আছেন ।
তোমাদের সমস্যা হবে না তো ?
না না সমস্যা হবে কেন ? কোনো সমস্যাই হবে না ।
কেউ আর কোনো কথা বললো না ।
জারা’র ভেতরটা খুব উশখুশ করছে । কেন সে নিজের বাড়িতে না যেয়ে খালার বাড়িতে যাচ্ছে ? কেন আব্বু তার সাথে ঠিক করে কথা বলছেন না আর সে-ই বা কেন আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছে না আব্বুর সাথে ? ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে আসছে অথচ এতোটুকুও ঘুম নেই চোখে । চোখ বন্ধ করে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করলো জারা । আদিত্যের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে । সাথে সাথে চোখ মেললো সে । এই মুখটা সে আর কখনো মনে করতে চায় না । গত এক বছরের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সে আর কখনোই মনে করবে না । সব স্মৃতি মুছে ফেলবে মেমরি থেকে কিন্তু কীভাবে তা এখনো জানে না সে ।
সাদাত অনেকক্ষণ যাবত জারা’র অস্থিরতা খেয়াল করছিল । জারা’র এতো মলিন চেহারা সে আগে কখনো দেখেনি । এই বয়সে যে মানসিক ধাক্কাটা সে খেলো , সেটা কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর হয়ে যাবে যদি বাড়ির মানুষ সাপোর্ট না করে । দু’দিন ধরে ঐ বাড়িতে থেকে ছোটো খালার রাগ সে বেশ ভালোভাবে টের পেয়েছে । এতো সহজে জারা’র ওপর থেকে খালার রাগ কমবে না । রোজা তো ওখানে থাকে না । সে কতটুকুই বা সাপোর্ট দিতে পারবে জারাকে ? সাদাতের খুব ইচ্ছে করছে জারা’র হাতটা ধরে বলতে –
ভয় পেয়ো না জারা , আমি তোমার পাশে আছি । জড়তা আর লজ্জা গ্রাস করলো সাদাতকে । হাতটাও ধরা হলো না, কথাটাও বলতে পারলো না ।
গাড়ি যখন সাদাতদের বাড়ির সামনে এসে থামলো ততক্ষণে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে । সাদাত আর জারাকে নামিয়ে দিয়ে কায়সার চলে গেলেন । যওয়ার আগে জারাকে বলে গেলেন –
বাসায় যেয়ে রেস্ট নাও ৷ একটা কথা মনে রেখো, তোমার মা তোমার ওপর ভীষণ রেগে আছেন । তিনি তোমাকে কবে ক্ষমা করবেন জানি না । আর যেন কোনো ভুল কোরো না । ভুলের ক্ষমা একবার হয় , বারবার কিন্তু হয় না ।
নিলুফার জেগেই ছিলেন । দরজা খোলার পর ওরা ভেতরে ঢুকলে বললেন –
টেবিলে খাবার রাখা আছে । তোদের যদি ক্ষিদে লাগে তো খেয়ে নিস । আমি যাই, একটু ঘুমাবো । সারারাত ঘুমাইনি তাই মাথাটা একটু ব্যাথা করছে ।
সাদাত মনে মনে মা’র প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ হলো জারাকে কিছু জিজ্ঞেস না করায় । সে বললো –
তুমি কিছু খাবে জারা?
না ।
ঠিক আছে তুমি আমার রুমে যেয়ে রেস্ট নাও । পরে কথা হবে ।
জারা রুমে চলে গেল । সাদাত এখন আর ঘুমাবে না । একটু পরেই তো অফিস যেতে হবে । শরীরের ক্লান্তি দূর করতে সে বেশ সময় নিয়ে গোসল করলো তারপর এক কাপ চা তৈরি করে বারান্দায় এসে বসলো ।……………….