এক ঝাঁক জোনাকির আলো পর্ব ৪৫+৪৬

#একঝাঁক~জোনাকির~আলো🍁
#writer~হাফসা~আলম 🍂
.
.
৪৫.
_________________
সাফা নিজের রুমে এসে জামাকাপড় চেঞ্জ করে। রুমের পর্দা ঠেলে আবার একবার লোকটাকে দেখে নেয়।কে এই লোক??ভারী অদ্ভুত। ঝুমা বিছানায় উপুত হয়ে শুয়ে অভির সাথে কথা বলছে।অভীর চাকরি হয়েছে।সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে।সাফা সন্দেহ চোখে একবার চোখবুলিয়ে বিছানায় বসে পরে।ঝুমা ফোন রেখে বালিশ বুকে নিয়ে উঠে বসে।সামনের চুলগুলো সরাতে সরাতে বললো,
—” লোকটা অদ্ভুত না??”
সাফা অন্যমনস্ক হয়েই জবাব দেয়,
—” হুম।এত কিছু বললাম কিন্তু কিছুই মনে করেনাই।ব্যাপারটা অবাক করার মত।”
—” হুম ভাই আমারও তেমনই লাগছে।আর আঙ্কেল হঠাৎ বাসায় কেনো আনলো।মানে উনি তো কাউকেই বাসায় আনে না।”
—” জানি না।বাবা আসুক তারপর না হয় জিজ্ঞেস করে নিবো।”
ঝুমা ছোট করে বললো,
—” হুম।”

সারিক রুমে ডুকতেই কপাল কুঁচকে যায় তার।সামনে চার চারটা চোখ অধীর আগ্রহে তার অপেক্ষায় ছিলো তা তিনি বুঝতে পেরেছেন।তবে কেনো তা বুঝতে না পেরেই তার এমন কপাল কুঁচকে যাওয়া।তিনি বিছানার দিকে এগোতেই সাফা আর ঝুমা সরে জায়গা করে দেয়।তিনি বসেন।মেয়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলেন,
—” কি হয়েছে?এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো??”
সাফা সোজা হয়ে বসে।সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
—” বাবা লোকটা কে???”
—” আমার ক্লাইন্ড। কয়বার বলবো।”
—” আমার মনে হয় না। লোকটাকে কেমন রহস্যময় রহস্যময় লাগে।মনে হচ্ছে সে খুব একটা সুবিধার লোক না।”
সারিক জোড়ে দম নিয়ে মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।সাফা বুঝে না এর মানে কি।তারপর তিনি বললো,
—” এই কয়েক দিনে কত পরিবর্তন হয়ে গেছো তুমি??আগের চাঞ্চলতা আগের সেই সাফা তুমি নেই।সাধারন একটা লোককে এত সন্দেহ করার কি আছে বলো তো??”
সাফা কিছু বলে না।আসলেই তার মাঝে কত পরিবর্তন চলে এসেছে।আগের মত সব মজা, নরমাল,সাধারন লাগে না।সব কেমন জটিল জটিল লাগে।সাফা চোখ পিরিয়ে আবার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
—” তেমন কিছু না বাবা।লোকটাকে এত কথা শুনালাম কিন্তু কিছুই বললো না।তাই একটু.. ”
—” সন্দেহ হচ্ছে। এই তো??”
সাফা চোখ নামিয়ে বলে,
—” হুম।”
—” আমার ক্লাইন্ড ও।রাস্তায় মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলেই সে আমাকে ধরে। সাথে বাসায় নিয়ে আসে।ব্যস আর কিছু না।”
সাফা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
—” ওহ।”
সাফা তার বাবার কোলে মাথা রাখে।ঝুমাও জড়িয়ে ধরে।সারিক দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে গোপনে কিছু দীর্ঘশ্বাস লুকায়।তার মেয়েটা সত্যিই অনেক বড় হয়েগেছে। এটা তিনি অনেক আগেই বুঝেছেন।সেই রাতে।
__________________
রুহি নিভ্রর সামনে দাড়াঁতেই নিভ্র ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে চোখ বাকিয়ে তাকায়।রুহির আরো আগ্রহ বারে।কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিভ্র উঠে পরে।সামনে হাঁটে কিছুদূর। রুহি পিছন থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকে,
—” নিভ্রনীল!!! ”
নিভ্র পিছনে ফিরে তাকায়।সাথে বিরক্ত মুখ।চোখে মুখে রাগ।রুহি একটু ভয় পায়।কিন্তু কিছুটা এগিয়ে বললো,
—” আমি রুহি। আরিফের মামার মেয়ে।”
নিভ্র ভণিতা না করে বললো,
—” তো আমি কি করবো??”
রুহি বেশ অবাক।সামনে একটা সুন্দরী মেয়ে দাড়িয়ে থাকলে কোনো ছেলের মুখ দিয়েই এমন কথা আসতে পারে এটা তার জানা ছিলো না।এমন কি তার দিকে একবার তাকাচ্ছে ও না।চোখ জোড়া আগে পিছে আশেপাশে ঘুড়ছে।স্থির দৃষ্টি দিয়ে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না নিভ্র।রুহি এখনো তাকিয়ে আছে।যতটানা সুন্দর দুর থেকে লেগেছে কাছ থেকে আরো বেশি সুন্দর লোকটা।আর সবুজ চোখজোড়া তো মারাত্মক। নিভ্রর রাগ লাগছে।সামনে তাকিয়ে আবার হাঁটা দেয়।এমন বহু মেয়েই তাকে দেখলে ডাকে।সে ফিরে।যদি কোনো একদিন সাফা ডেকে উঠে–ডাক্তার সাহেব বলে।সেই আশায় একবার পিছনে তাকায় সে।রুহি দ্রুত পায়ে নিভ্রর সামনে এসে দাঁড়ায়। একটুর জন্য ধাক্কা লাগে নি।নিভ্র কপাট রাগ নিয়েই বললো,
—” চোখে দেখেন না বুঝি??ফালতু।সামনে এভাবে হুমড়ি খাওয়ার মানে কি??এখনইত ধাক্কা লাগতো।”

রুহি আরো অবাক।বাকি ছেলেদের চেয়ে এর মাঝে আলাদা কিছু ব্যক্তিত্ব,বৈশিষ্ট্য আছে। ছেলেরা তো সাধারনত ধাক্কা ধাক্কি পছন্দ করে বলেই তার মনে হয়।আর নিভ্রনীল এভাবে দূরে থাকে??ভেড়ী ইন্টারেস্টিং। রুহি হালকা হেঁসে বললো,
—” আপনি কি সব সময় এমন রেগে থাকেন??”

নিভ্র নিশ্চুপ। ফ্লোরে তার চোখ বিচরন করছে।সাথে রাগে মাথা রি রি করছে। কারনে অকারনে তার মাথায় রাগ চোড়ে বসে।তার উপড় এইসব মেয়েকে তো তার মোটেও পছন্দ না।আরিফের বিয়েতে ঝামেলা করতে চায় না সে।তাই এভাবে দূরে থাকা।রুহি হেঁসে আবার বললো,
—” আপনাকে আমি ছবিতে দেখেছি।সেই ছবিতে কিন্তু আপনি খুব সুন্দর করে হাসছিলেন।”
নিভ্র মাথা তুলে তাকালো।বিরক্তি নিয়ে বললো,
—” ছবিতে অনেক কিছুই দেখা যায়।আর আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই।সো আউট..”

নিভ্র পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যায়।রুহি তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে।এত এটেটিউড!! বাপ রে।

আরিফের বিয়ে শেষ।নিভ্রকে ধরে বেধে আজ অনেক দিন করে খাওয়াতে পেরেছে সবাই।নিভ্রর একদম খেতে ইচ্ছে করছিলো না।তবুও খেতে হয়েছে।আরিফের জন্য।আরিফ মহা খুশি।রুহি সব সময় শুধু নিভ্রকে দেখে গেছে।তার নিভ্রকে ভিনগ্রহের প্রানী মনে হচ্ছে। সবার থেকে আলাদা পার্সোনালিটি। স্টাইল।সামান্যতে এত স্টাইলিশ লাগছে।যদি পরিপাটি হয়ে আসতো তবে না জানি কি হতো।দুঃখের বিষয় তার বয়ফ্রেন্ড আছে।তা না হলে নিভ্রকে জোড় করে হলেও বিয়ে করে নিতো সে।কথাটা ভেবেই রুহি হাঁসে।
___________________
রাফা ঝুম ধরে বসে আছে চেয়ারে।গভীর চিন্তায় সে মগ্ন। অভ্র পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে।রাফার সে দিকেও খবর নাই।সে গভীর ভাবে চিন্তিত।অভ্র মুখের সামনে দুই তিনবার হাত নাড়ায়।কিন্তু তাতেও রাফার মনযোগ আকর্ষণ করতে পারলো না।তাই গলা খাঁক খাঁক করে ছেড়ে উঠলো।রাফা চোখ ঘুড়িয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে একবার চোখবুলিয়ে আবার ভাবনায় মনোযোগী হলো।অভ্র একটু অবাক হয়ে বসেই থাকে।কিছুসময় বাদে রাফা নিরবতা ভেঙে বললো,
—” ভাইয়া একটা কথা অনেক দিন মাথায় ঘুড়ছে।বলবো বলবো বলে বলা হয় না।”
অভ্র চেয়ারের পিছনে ঠেসে বললো,
—” তো বলে দে।”

রাফা সিরিয়েস ভাব নিয়ে অভ্রর দিকে তাকালো।অভ্রও সিরিয়েস ভাব নিয়ে শুনার ভঙ্গি করলো।রাফা বললো,
—” ভাইয়া কোনো কারনে সাফার চলে যাওয়ার পিছনে আমাদের হাত নেই তো??”
অভ্র ভয়াত্নক চোখে রাফার দিকে তাকায়।চোখ বড় বড় করে বলে,
—” কি যা তা বলছ!!আমরা কেনো দায়ি হবো??আর সাফা তো বলে যায় নাই। হুট করেই চলে গেছে।খুঁজার কত চেষ্টা করছি পাচ্ছি না।”
—” সেটা ইতো ভাইয়া।খুঁজে কেনো পাচ্ছ না??কারন ও নিজে থেকেই ধরা দিতে চাইছে না।আমি মিষ্টির দোকানকে যতটুকু চিনি খুবই ইমোশনাল আর একটু বাচ্চা বাচ্চা।কোনো ভাবে যদি সে রাতের কথা গুলো..

অভ্র আতঁকে উঠে।কঠিন চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে কোনো ভাবে যে কথাটা কারো সামনে আনতে চায় না তা কেনো সব সময় তার সামনে তুলে ধরা হয়?ভালোবাসেছে।একতরফা ভালোবাসা।সব তো নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখতে চায় সে।কিছুতেই কারো সামনে আনতে চায় না।আর যে ভয়ে চায় না সেটা তো নিভ্র।সে কিছুতেই নিভ্রর কষ্ট দেখতে পারবে না।নিভ্র যদি জানে সেও সাফাকে ভালোবাসে তাহলে খুব কষ্ট পাবে।কিন্তু নিজের অজান্তে সে নিভ্রকে কষ্ট দিচ্ছে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে অভ্র নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না।কথা গুলো ভেবে অভ্রর মাথা ভার হয়ে আসে।রাফা অভ্রর দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বললো,
—” সাফা যদি আমাদের কারোনে চলে যায় তবে নিজেদেরকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না ভাইয়া।”

অভ্র মাথা তুলে রাফার দিকে তাকায়।তারপর বললো,
—” এটা হতে পারে না।সেদিন আশেপাশে কেউ ছিলো না।আর অনেক রাত ছিলো সবাই ঘুমিয়ে পরেছিলো।তাই বাদদে এটা হবে না।”

রাফা বুঝতে পারে অভ্রর মনে অপরাধ বোদ কাজ করছে।সে কিছুতেই এমন একটা ঘটনার কারন হতে চায় না।যেখানে সে নিজের আবেগ অনুভুতি সব লুকিয়ে রেখেছে।কষ্টে যখন বুক ভার হয় তখনই ডায়েরি লেখে। সেদিনের পরে তো ডায়েরিটাও পুড়িয়ে দিয়েছে সে।নিজের কষ্ট নিজের মাঝে রাখতে চায়।ভালোবাসার আর মানুষ পেলো না। কথাটা বহুবার নিজেকে করা হয়েগেছে। কিন্তু ভালোবাসা তো হুট করেই হয়।এতে কারো হাত থাকে না।ঘটা করে তো প্রেম করা যায় কিন্তু ভালোবাসা যায় না।
__________________________
নিভ্র রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। অন্ধকার আকাশ।চারদিকে রাস্তার লাইট জ্বলছে।নিভ্র কিছুসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আবার কিছু সময় রাস্তার লাইট গুলোর দিকে।তার জীবনটা আকাশের মত হয়ে আছে।অন্ধকার।কিন্তু একসময় একঝাঁক আলো,আনন্দ, খুশি নিয়ে এসেছিলো সাফা।জোনাকি পোকা যেমন নিজের সাথে আলো নিয়ে চলে যায় সাফাও ঠিক একুই ভাবে আলো গুলো তার জীবন থেকে নিয়ে গেছে।রাস্তার পাশে হাওয়াই মিঠাইওয়ালার থেকে নিভ্র অনেক গুলো হাওয়াই মিঠাই কিনে নিলো।সাদা রং এরগুলো সাফার খুব প্রিয় ছিলো।হালকা গোলাপি গুলো তার ভালো লাগে না।সাদাটাই তার ভালো লাগতো।মিষ্টি মিষ্টি কিউট মেঘ বলে ডাকতো এদের।সাদা সাদা মেঘের মত দেখতে।নিভ্র পেকেট গুলোর দিকে তাকিয়ে হাঁসে। বুকে ব্যথা হয় ভয়ংকর ভাবে।মনে হচ্ছে সব পুড়ে ছাই হয়েগেছে। আসলেই সব পুড়ে ছাই হয়েগেছে এতদিনে।আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তার মাঝে।তার নিজেকে মানুষ মনে হয় না এখন আর।কেমন যানি তার নিজেকে প্রানহীন বস্তু মনে হয়।মন ভালো তো দুনিয়া ভালো।মনে শান্তি নেই তো দুনিয়াটা বিষন্ন লাগে।সব এলোমেলো লাগে। নিভ্র রাস্তায় বসে পরে।অভ্র পাশেই লুকিয়ে ছিলো।নিভ্রর শারীরিক অবস্থা ভালো না।এভাবে তাকে একা ছাড়াও ঠিক না তাই তো লুকিয়ে নিভ্রর পিছনে পিছনে এসেছে সে।নিভ্রকে এভাবে বসতে দেখে অভ্র একটু দৌড়েই সামনে এসে দাঁড়ায়। নিভ্র মাথা তুলে তাকায়।আবার মাথা নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” আবার চলে আসলি??তোর আর কোনো কাজ নাই আমি ছাড়া??”
অভ্র নিভ্রর পাশেই ফুটপাতে বসে।নিভ্রর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” তুই বাচ্চাদের মত এগুলো কবে থেকে খাছ??”
নিভ্র হাতের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললো,
—” আগে যেটা প্রশ্ন করলাম সেটার উত্তর দে!তোর আর কোনো কাজ নেই নাকি??”
—” না। তুই আমার সবচাইতে বড় কাজ।তুই ড্রাংক??”
অভ্রর কঠিন গলা।
নিভ্র ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
—” হুম তো।”
অভ্র কিছু বললো না।নিভ্র নিজেই বললো,
—” এগুলো সাফার খুব প্রিয় ছিলো।যানছ ওর সাথে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটেছিলাম।কত দূর হাটাঁইছে কি বলবো।কিন্তু আমার একটুও বিরক্ত লাগে নাই।উল্টা এত ভালো লাগছে কি বলবো।বেস্ট টাইম গুলোর মধ্যে ওটাও একটা রাত ছিলো।রাত বললে ভুল হবে গোধূলি লগ্ন ছিলো।সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেঁ দৌড়ে পালিয়ে ছিলাম।ওর হাত ধরে।
নিভ্র শব্দ করে হেঁসে ফেলে।অভ্র প্রতিবারের মত অপলক তাকিয়ে থাকে সে হাঁসির দিকে।অভ্র নিভ্রর হাত টেনে ধরে। টানতে টানতেই বলে,
—” তোর কি গাড়ির অভাব??না তো। তাহলে হাটাঁর কি প্রয়োজন। প্রায় একরাস্তায় হাঁটছ।”
নিভ্র হাত ছাড়িয়ে বলে,
—” এই রাস্তা, রিক্সা,নদীর পাড়,বাগান এগুলো আমাকে সাফার উপস্থিতির জানান দেয়।যানোছ রাস্তা দিয়ে যখন হাটি মনে হয় আমার বাঁ পাশে সাফাই থাকে।হাতটা ধরে আপন মনে হাঁটে সে।নিজে নিজে বকবক করে।একটা সময় না চাইতেও শুনতে হতো
আর এখন মনে প্রানে চাই ওর একটু কথা শুনতে কিন্তু কি কপাল পারি না। রিক্সার বাম পাশটাও ওর জন্য রাখি।এখন আর গাড়ি ভালো লাগে না।রিক্সা ভালো লাগে।বাগানের পিছনের দেয়ালটা ভালো লাগে।সেই কদঁম গাছ, সাদা গোলাপ, ফুল এগুলো ভালো লাগে।মনে হয় সাফা আশেপাশে আছে।আমার তো হসপিটালের সেই সিট টাও ভালো লাগে।নিজের এ্যাফ্রোনটাও ভালো লাগে।গায়ে জড়িয়ে ছিলো সে।”

অভ্র বসে পারে আবার।বুঝতে পেরেছে আজ বেশি খেয়ে ফেলেছে।এখন তার সব জুড়ে সাফা আর সাফার স্মৃতি থাকবে।শুধুই সাফাময় নিভ্র।নিভ্র বকবক করেই চলেছে অভ্র শুধু শুনে।সাফার প্রতি তার ভালোবাসা থাকলেও নিভ্রর কাছে তা কিছুই না।কত ভালোবাসে নিভ্র সাফাকে।সব উজাড় করে ভালোবাসে।এতটা ভালো সে নিজেও বাসতে পারতো না।এতটা উম্মাদ কেউ হতেও পারবে না নিভ্রর মত।এতটা কেয়ার এতটা আবেগ অনুভুতি নিভ্র ছাড়া আর কারো নেই বলেই অভ্রর মনে হয়।অভ্র আকাশের দিকে তাকায়।শুদ্ধ মনে দোয়া করে। নিভ্রর সাফারানী যাতে তার কাছে ফিরে আসে।আর না আসলে…. অভ্র কিছুক্ষণ থেমে শব্দ করেই বলে,
—” না আসলে আপনি মিলিয়ে দেন।কাছে নিয়ে আসেন।তাহলেই তো হয়।”

নিভ্রর এদিকে মনযোগ নেই সে তার চিন্তা ভাবনা কথা সব শুধু সাফার সাথে কাটানো স্মৃতিতে বেধে রেখেছে।তার অস্তিত্বেও সাফা লুকিয়ে।নিস্তব্ধ রাস্তায় দুইভাইয়ের দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা।দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে নিভ্রর অস্পষ্ট ভালোবাসার কথা।কত আবেগ আর অনুভুতির আর্তনাদ।
____________________
সময় প্রবাহ মান।দিন যায় মাস যায়।নিজ গতীতে সব নিজের মত যায়।সকাল বিকাল রাতের মতই গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা যায়, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, পেরিয়ে আবার গ্রীষ্ম, বর্ষার আগম ঘটে।সব কিছুর পরিবর্তন হয়ে যায়।সময়, মাস, ঋতু।কিন্তু মন নামক বস্তুর কোনো পরিবর্তন হয় না।বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সাফাকে হারিয়ে চৌধুরী বাড়ি আসলেই ইটপাথরের বাড়ি হয়েগেছে। এতে প্রান নেই।নিভ্র নিজের খাটে উপুত হয়ে শুয়ে আছে।আজ দুই বছর পাঁচ মাস সাফাকে খুঁজেছে সে।নিভ্র অংকে অনেক ভালো কথাটা ভেবেই তার ভালো লাগে।সে প্রতি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার হিসাব রাখতে পারে। সাফা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সে সব হিসাব করে রেখেছে।পেলেই শোধ নিবে।কথাটা নিভ্রর অবাদ্ধ মন বলে।ক্লান্ত তার শরীর কিন্তু মন প্রতি সকালের মতই সতেজ হয়ে উঠে নতুন সূর্যের সাথে নতুন ভাবে সাফাকে খুঁজার জন্য।বৃষ্টির মাত্রা বাড়ে প্রবল।বৃষ্টির ছাপ্টানি এসে জানালা দিয়ে নিভ্রর খালি গায়ের উপড় পরে।খালি গায়ে ট্রাউজার করে শুয়ে আছে সে।ভিঁজে গেছে পিঠ।বিছানা।এতেও তার ভাবান্তর হলো না।সে নিজের মত শুয়ে আছে।আজ দুই দিন পরে তার ঘুম হয়েছে।বিছানার পাশেই মুইয়ে যাওয়া সিগারেটের অর্ধেক পরে আছে সাথে ছাই।অগোছালো রুম। ছবি রং,প্যান্টিং সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কেউ আসে না এই রুমে।নিভ্রর ছন্নছাড়া জীবনে সে কাউকেই দেখতে চায় না।আসলেই বের করে দেয় সে।হুমায়ূন আহমেদের সব বই নিভ্র দু’বার করে পড়ে ফেলেছে।সাফার কেনো এত প্রিয় ছিল তিনি সেটা খুঁজার জন্য। হার্ট আগের তুলনায় আরো দূর্বল হয়ে পড়েছে তার।এখন এক দুই ঘন্টায় তার ক্লান্ত লাগে।খাবার খায় না।মদ সিগারেট একবার খাবে না বলেও খায়।মাতাল হয়ে পড়ে থাকতে তার ভালো লাগে।মনে হয় কষ্ট একটু কমেছে।কিন্তু সাফাকে ভুলে না সে।এক সেকেন্ডের জন্যেও না।অভ্রও নিভ্রর পাশে বসে সব দেখে।বাধা দেয়।কিন্তু নিভ্র নিভ্রর মতই চলে।

বিছানার পাশের ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে।নিভ্র ঝিমঝিমে চোখে একবার উঠতে চেয়েও উঠে না।হাত পা সব কেমন ব্যথা হয়ে আছে।সব ভার ভার লাগছে।শরীর ইদানীং কাজ করতে চায় না।কেমন ক্লান্ত ক্লান্ত সব।নিভ্র পিছন থেকে সামনে মুড়ে শোয়।বৃষ্টির অবাদ্ধ ফোটা তার চোখে মুখে পড়ে।বৃষ্টি হচ্ছে?? কথাটা ভেবেই নিভ্র সর্বশক্তি কাজে লাগিয়ে উঠে বসে।সে ভিজঁবে।সাফার খুব প্রিয় বৃষ্টি। কদঁম তলায় যাবে।একগুচ্ছ কদঁম হাতে আবার সাফার অপেক্ষা করবে।বলবে…..
—–“একগুচ্ছ কদঁম হাতে,”
——–“ভিজাঁতে চাই তোমার সাথে।”
বসা অবস্থায় বুকে হাত দেয়।ব্যথা খুব বুকে।আজ কাল ব্যথাটা অনেকটাই বেশি।নিভ্র বিছানা থেকে নামতে যাবে তার আগেই ফোনটা আবার বেজে উঠে।নিভ্র ফোনটা রিসিভ করে।যানে আজও নিরাশ হবে তবুও ধরে।যদি কোনো দিন ভালো খবর আসে??সে আশায় সে আজও বেচেঁ আছে।নিভ্র দূর্বল গলায় বললো,
—” হ্যালো কে??”
ও পাশ থেকে কেউ উত্তেজিত হয়ে বললো,
—” আপনি নিভ্রনীল?? ”
নিভ্র আগের মতই বললো,
—” কার ফোনে কল দিয়েছেন জানেন না??আর না জানলে দেন কা??আপনাদের রং তামাশা দেখার জন্য সবার সময় হয় না।ডিজগাস্টিং।
নিভ্র বিরক্তি নিয়ে কল কাটঁতে যাবে তার আগেই লোকটা চেঁচিয়ে বললো,
—” আরে ভাই রাগেন কেনো??কথাটা গুরুত্বপূর্ন্য।কত কষ্ট করে আপনার নাম্বার জোগাড় করছি জানেন??কত খুজে খুজে বের করতে হয়েছে।এটা খুঁজতে আমার কত মাস লেগেছে জানেন??আপনি জানবেন কেমনে?? আমিই বলি।আচ্ছা থাক আগে আসল কথাটা বলি।”
নিভ্র রাগ মাখা গলায় বলে,
—” হ্যা আজাইরা কথা না বলে আসলটাই বলেন।আমার অত সময় নাই।বৃষ্টি যে কোনো সময় থেমে যাবে।যদি আপনার কথা শেষ হতে হতে বৃষ্টি থেমে যায় আপনারে কি করবো আমি নিজেও জানি না।যেখানেই থাকেন খুজে এনে তারপর বুঝাবো আমি কে।”

ভারী অবাক হওয়া গলায় বিপরিত পাশে লোকটা বললো,
—” বাপরে আপনি বহুত ডেঞ্জারাস মানুষ ।থাক আগে বলে ফেলি। অনেক দিন আগে আপনি হারানো বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।সাথে একটা ছবি টাইপ কিছু??”

নিভ্র চমকে উঠে।মুহূর্তেই সব ক্লান্তির অবসান ঘটে। বুকের ব্যাথা গায়েব হয়ে যায়।সাথে হৃৎপিন্ডের শব্দের গতি বাড়ে।নিভ্র কাঁপা গলায় বললো,
—” অনেক বিজ্ঞাপন তো দিয়েছি।এখন আপনি কোনটার কথা বলছেন।আচ্ছা সে সব রাখেন যাকে খুঁজ ছিলাম না মানে বিজ্ঞাপনে যার নাম ছিলো না…

নিভ্র আর বলতে পারলো না।গলা কাঁপছে তার প্রচন্ড।এতগুলো দিনে এই প্রথম কেউ বিজ্ঞাপনের কথা বলে এভাবে কল দিয়েছে।নিভ্রর সারা শরীর রিতিমত কাঁপছে।লোকটারও কেমন অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। এভাবে কারোর গলা কাঁপতে ফোনের মধ্যেই তার অনুভব হয় নাই।তাই সেও একটু অবাক হয়ে নিভ্রর চাপা কন্ঠ শুনছে।নিভ্র আবার বললো,
—” কি হয়েছে বলেন ভাই??”
লোকটা হতবাক। লোকটার গলা এত সুন্দর!!কিন্তু প্রথমে কেমন ঝাঁঝালো শুনাচ্ছিল।লোকটা নিজেকে সামলে বললো,
—” সাফা নামের কোনো মেয়ের কথা বলা হয়েছিলো সেখানে রাইট??!”
নিভ্র দ্রুতই বললো,
—” হুম।”
—” মেয়েটার খোঁজ দিতে পারবো।মানে তাকে আমি দেখেছি।সে এখন কোথায় থাকে তাও বলতে পারবো।আপনি কি এখনো তাকে খুঁজছেন??তাহলে তো ভালোই।মেয়েটাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি।এবং তার বাড়ির ঠিকানাও জানি।”

নিভ্রর সম্পূর্ন শরীর ঝঙ্কার লাগার মত কেঁপে উঠে।হাত পা ঠান্ডা হয়ে উঠে।কলিজায় শীতল বাতাস প্রবাহ হয়।তাহলে কি এত দিনে সে খুঁজে পাবে তার সাফারানীকে।কথাটা ভাবতেই তার দুনিয়া আবার আগের মত খুশিতে থৌই থৌই করে উঠে।নিভ্রর চোখ দিয়ে খুশিতেই অশ্রু গড়িয়ে পরে।নিভ্রর হৃৎপিন্ডের সব রগ যেনো শিরশির করে উঠে।পাঁজরে পাঁজরে বারি খায়। রঞ্জে রঞ্জে শিহরণ বয়ে যায়।উত্তেজনায়, আবেগে,খুশিতে সে কিছুই বলতে পারে না।কি করবে সে ভেবেই পাচ্ছে না।যদি ছুটে এখনি যাওয়া যায়।নিভ্র আবেগে শব্দ করে কেঁদে উঠে।বিপরিত পান্তের লোক মহা অবাক।একটা লোক এভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে তার জানা ছিলো না।এতটা মরিয়া হয়ে যে উঠতে পারে তার অনুভুতি আবেগ ভালোবাসা কতটু ভাবতেই সে মনে মনে ঠিক করে এই ব্যক্তিকে সরাসরি দেখবে।এবং যাকে মরিয়া হয়ে খুঁজছে তার সাথেই দেখবে।মিলিয়ে দিবে এদের।ইনশাআল্লাহ্‌ সে এটা করবেই।ফোন সামান্য মোবাইলে যার আবেগ এভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তার বাস্তব, রিয়েলিটি কেমন হবে লোকটি ভেবে পায় না।অনেক সময় পরে নিভ্র নিজেকে সামলে আঁটকে আশা গলায় বললো,
—” কোথায় আমার সাফারানী??”
লোকটা যেনো আরো একবার ঝাটকা খায়।এত সুন্দর করে কেউ ডাকতে পারে তার জানা ছিলো না।তাই দ্রুত গতিতে বললো,
—” কক্সবাজারে।”
.
.
#চলবে_______________________🍁

ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন _______🍂

®হাফসা_________________

#একঝাঁক~জোনাকির~আলো🍁
#writer~হাফসা~আলম 🍂
.
.
৪৬.
___________________
—” আমি আপনাকে বাড়ির ঠিকানা ম্যাসেজে দিচ্ছি।”

নিভ্রর প্রান অত্না থেমে গেছে।উত্তেজিত গলায় সে বললো,
—” প্লিজজ তাড়াতাড়ি দেন।আর আপনার যা চাই বলেন।কত টাকা চাই তাও বলেন আমি দিবো।যা চাই তাই দিবো।”
লোকটা এবার হাসলো।নিভ্রর উত্তেজিত গলা শুনে তার অদ্ভুত ভাবে আগ্রহের মাত্রা বাড়ছে।লোকটা আবার হেসে বললো,
—” আমার কিছুই লাগবে না।তবে আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রবল আর ”
নিভ্র বাকি টুকু বলতে না দিয়ে নিজেই বলে উঠে,
—” অবশ্যই ভাই।আপনি যা চাইবেন তাই দিবো।এখন রাখি।আমার বের হতে হবে।”

নিভ্র ফোন রেখে দিলো।খালি গায়েই উঠে দৌড়ে ছাদে চলে গেলো।সারা শরীর ভিঁজে চুপচুপ হয়েগেছে। পিঠ বুক সব ভিঁজে গেছে।মুখে একটানা হাসি লেগেই আছে।নিভ্র দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দুই তিনবার হোচট খায়।পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল হালকা ছিঁড়ে যায়। রক্তও পড়ে টিপ টিপ করে।কিন্তু সে দিকে তার বিন্দু মাত্র চিন্তা নেই।সে এই মুহূর্তেই কক্সবাজার যাবে।তার মাথা কাজই করছে না।পরনে কালো ট্রাউজার।এটা পড়েই সে নেমে এসেছে।বাড়ির সবাই নিচে বসে ছিলো।আজ কেউই কাজে যায় নাই।সবার আলোচনার নাম নিভ্র।ইফতেখার চায়ের কাপ মাহবুব চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিতেই ধাপধাপ পায়ের শব্দে তিনি পিছনে তাকায়।নিভ্র উম্মাদের মত ছুটে নামছে।ইফতেখার ছেলেকে এভাবে দেখেই চায়ের কাপটা হাত থেকে পড়ে যায়।শব্দ হয় ঠাসসস।কিন্তু সে দিকে কারো মনোযোগ নেই।সবাই চোখ উঠিয়ে নিভ্রকে দেখে।খালি গায়ে, খালি পায়ে নিভ্র এভাবে কোথায় যাচ্ছে?? নিভ্র দ্রুত হেঁসে দরজার দিকে যেতেই অভ্র দৌড়ে আসে।নিভ্রকে টেনে ধরে।নিভ্রর মুখে চিরচেনা সেই হাসি দেখে সবাই একবেলা ঝাটকা খায়।অভ্র উদ্বেগের সাথে বললো,
—” কোথায় যাচ্ছিস নিভ্র??তাও এভাবে।জামা কই,জুতা কই,এলোমেলো কেনো তুই??কি হয়েছে বলবি??”
নিভ্র হেঁসে ফেলে।শব্দ করে হেঁসে অভ্রর কাধ চাপড়ে বললো,
—” সাফা…”
উত্তেজনায় নিভ্রর কথা আঁটকে আছে বারবার।সাফার নাম শুনে সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে প্রায়।নিভ্র চোখবুজে শ্বাস নেয়।চেঁচিয়ে বলে,
—” আমার সাফা কক্সবাজারে ভাই।ওকে পেয়ে গেছি।ওকে পেয়েছি।”
অভ্র সহ বাড়ির সবাই বাক রূদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।সবার মুখে হাঁসির রেখা।নিভ্র এই অবস্থায় আবার বেরিয়ে যেতে নেয়।অভ্র হাত টেনে বলে,
—” ভাই আমিও যাবো।তার আগে তোর জামা ঠিক কর।খালি গায়ে রাস্তায় বের হলে জনগন পাগল বলবে আর তা না হলে ছেলেমেয়েরা নতুন স্টাইল বলে নিজেদের গুলোও খুলে ফেলবে।যা উপড়ে।আগে রেডি হ।আমি বিমানের টিকেট কাটি।”
নিভ্র সাথে সাথেই জবাব দেয়,
—” না বাসে করে যাবো।”
সবার নিভ্রর দিকে এগিয়ে আসে।অভ্র বুঝতে পেরেছে নিভ্রর এখন যা মন চায় তাই করবে।তাই অভ্র রাজি হয়ে যায়।নিভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
—” ঠিক আছে তাই হবে।উপড়ে যা।জামা পড়ে আয়।গোসল করিছ।যা। ”
নিভ্রর একটা মিনিটও অপচয় করতে ইচ্ছে করছে না।সে যেতেও চাইছে না।তবুও যেতে হবে।এভাবে তো আর সাফার কাছে যাওয়া যাবে না।নিভ্র মুখে হাসি ঝুঁলিয়ে উপড়ে উঠে যায়।অভ্র নিচের সবাইকে বুঝিয়ে আলাদা ভাবে যেতে বলে।

আরিফ কল করেছে নিভ্রকে।আরিফকে সব বলতেই সেও যাবে বলে বায়না ধরে।সে যাবেই।তাই তাকেও সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। তবে অভ্রকে আসতে নিশেষ করা হয়েছে বাকিদের নিয়ে সে যাবে।

বাস এস্টেনে এসে আরিফ দুটো টিকেট নিয়েছে।কিন্তু নিভ্র আবার একটা নিয়েছে।আরিফ মহা অবাক নিভ্রর কান্ডে।হা করে তাকিয়ে আছে নিভ্রর দিকে।নিভ্র কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে,
—” কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো??”
আরিফ বাসের দিকে যেতে যেতেই বলে,
—” স্যার আমরা তো দুজন কিন্তু টিকেট কেনো তিনটে??”
—” তুমি আলাদা বসবে।আমার বাম পাশ খালি থাকবে।সাফার সাথে লাস্টবার বাসে করে যখন সিলেট গিয়েছিলাম তখন ও আমার বাম পাশেই বসেছে। ওর জায়গা কাউকেই দেওয়া যাবে না।”

আরিফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।সাফা উপস্থিত না থেকেও তার পাওনা জায়গা গুলো সে দখল করে আছে।আরিফ মনে মনে ভাবে।যানি না সাফা কতটুকু বদলেছে কিন্তু যা রেখে গেছে যেভাবে রেখে গেছে সব আগের মতই রেখেছে নিভ্র।তবে পরিবর্তন করেছে নিজেকে। আগে যতটুকু ভালোবাসতো এখন এর চেয়ে হাজার গুন বেশি ভালোবাসে।আরিফের গভীর থেকে কিছু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

বাসের দুই পাশের একপাশে আরিফ অপর পাশে নিভ্র।নিভ্রর বাম পাশটা খালি।নিভ্র সেদিকেই তাকিয়ে আছে।মনে হয় সাফার ছায়াঁ তার পাশেই।নিভ্রর সব কিছু যেনো অদ্ভুত ভাবে পাল্টে গেছে।কাল পর্যন্তও যেখানে তার সব ধোয়াঁশা ছিলো,ছন্নছাড়া জীবন ছিলো,এলোমেলো দুনিয়া ছিলো সব হঠাৎ করেই ফুটন্ত তাঁজা গোলাপের মত সতেজ সুন্দর আর আনন্দময় হয়ে উঠেছে।নিভ্র নিজের বাম হাত বাড়িয়ে সিট ছুঁয়ে দেয়।মনে হয় সাফার অস্তিত্ব রয়েছে এখানে।এই বুঝি সাফা ঘুমের মাঝে তার বাহুতে নিজের জায়গা করে নিবে।এই বুঝি তার বুকে ঝুঁকে পড়বে।নিভ্র কথা গুলো ভেবেই আনমনে হাঁসে।নিভ্র সিটের পিছনে মাথা রাখে।হেলান দিয়ে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয়।আরিফের মহা বিপদ।পাশে বসেছে এক মেয়ে।নীলা যানতে পারলে তাকে কিভাবে কুঁচি করবে তা ভেবেই আরিফের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।আজ একটুও বাসের সিটে হেলান দিতে পারবে না।হেলান দিলেই যদি এই মেয়ের কাধে পড়ে তাহলে জীবন শেষ।মেয়েটা বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে।একটু এগিয়ে এসেও পাশ ঘেঁষছে।আরিফের একদম কাছে আসতেই আরিফ হালকা কাঠিন গলায় বলে,
—” আমার বউয়ের নাম নীলা।অনেক সুন্দরী।আপনার মত তার একজন বোন আছে।আমারো এখন ছোট বোন সে।দেখতে একদম এক।আপনি চাইলে আমাকে ভাইয়া ডাকতে পারেন!!”

মেয়ের আশ্চর্যজনক ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আরিফের দিকে।তারপর সরে গিয়ে জায়গা খালি করে।আরিফ তো মহা খুশি।মনে মনে নিজের গুনগার গাওয়া শুরু করে।কত বুদ্ধি তার আহ কি বুদ্ধি। মুখ বাকিয়ে নিভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখে সে গভীর ভাবে চোখের উপর ফোন ধরে রেখেছে।মানে সাফার ছবি দেখছে।আরিফও নিজের ফোন বের করে পাশের মেয়েটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে নীলার সাথে কথা বলা শুরু করে।
_____________________
সাফা তুলির সামনে বসে আছে।তুলি সাফার স্টুডেন্ট।পড়াতে এসেছে।তুলি ক্লাস ফাইভে পড়ে।চঞ্চল আর অতি পটু একটা মেয়ে তুলি।সারা দিন বক বক করে।আর এত চকলেট খায় সাফার তো তুলিকে চকলেটের দোকান মনে হয়।এত চকলেট খায় তবুও ওর দাঁত কেমন চকচকে।দেখলে কেউ বলবেই না ও এত চকলেট খায়।সাফা টেবিলে ঝুঁকে খাতায় লিখে দিচ্ছে। তুলি কিছুক্ষণ পর পর উঁকিঝুঁকি দিয়ে আবার চকলেটের পেকেটে মনোযোগ দিচ্ছে। সাফাকে তার খুব পছন্দ।তুলি নরমালি পড়তে চায় না। কিন্তু সাফার কাছে সে অধীক মনোযোগী। তুলি উঠে ছোট ছোট পা ফেলে নিজের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ এনে সাফার সামনে ধরে।সাফা ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে থাকে সে কাগজের দিকে।নীল রং এর কাগজের ভাঁজে সাদা একটা কাগজ।সাফা উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে,
—” এটা কি তুলি??”
তুলি চকলেট খেয়ে কাগজটা টেবিলে রেখে ওয়াসরুমে থেকে হাত ধুয়ে এসে বলে,
—” লাভ লেটার।”
সাফা ভয়াত্নক চোখে তাকিয়ে বলে,
—” কি???কে দিয়েছে??আর তুমি কিভাবে পেলে??মানে তোমাকে কে দিয়েছে??”

তুলি চেয়ারে উঠে বসতে বসতে বলে,
—” আমাদের স্কুলের ফার্স্ট বয় তোমাকে পছন্দ করে তাই দিয়েছে।ওর নাম রোমিজ।খুব সুন্দর তবে আমার নিভ্রর চাইতে বেশি না।”

সাফা হা করে তাকিয়ে আছে।ক্লাস ফাইভের ছেলে তাকে লাভ লেটার দিচ্ছে?? কি যুগ পড়েছে আল্লাহ!!তুলির সাথে দুই একবার ছেলেটাকে সাফা দেখেছে।কি বলছে এ মেয়ে??আর নিভ্র!!নিভ্রর নাম শুনতেই তার টনক নড়ে।সব কথা বাদ দিয়ে অতি আগ্রহের সাথে সাফা বলে,
—” নিভ্রকে কিভাবে চিনো তুমি??”
—” আরে ও তো আমার জান।ওকে কেনো চিনবো না।ওর চুলগুলো কি সুন্দর, নাক গাল সব লাল লাল আর চোখগুলো তো আরো সুন্দর সবুজ সবুজ।কত কিউট।আর সুন্দর। আমার কাছে ছবি আছে দেখবে??”
সাফা হুট করেই নিভ্রকে দেখতে ইচ্ছে করছে তাই বললো,
—” দেখাও।”

তুলি লাফিয়ে নিজের বিছানার পাশের টেবিল থেকে নিভ্রর ছবি নিয়ে আসে।সাফার হাতে দেয়।আকাশি শার্ট পড়ে নিভ্র গাছের গুটির উপড় পা ভাঁজ করে বসে আছে।সত্যি মারাত্মক তার এটেটিউড। সাফা গভীর ভাবে তা দেখে।চোখ ভিঁজে আসে তার।সব সময় দেখে তবুও ভালো লাগে দেখতে।যত দেখে মন ভরে না টাইপের অবস্থা। তুলি টেনে ছবি নিয়ে নেয়।সাফা প্রশ্ন করে,
—” কোথায় পেলে ছবিটা??”
তুলি ছবি দেখতে দেখতেই বলে,
—” রোমিজের মামার রুমে।মামা বলেছে এনার নাম নিভ্রনীল। আর রোমিজ এটার বদলে আমাকে বলেছে লাভ লেটার দিতে।তাই দিলাম।আর ও আমাকে এই ছবি দিলো।”

সাফা হেঁসে দেয়।তুলি অবাক হয়ে সে হাসি দেখে।সাফাকে এই একমাসে কখনোই হাঁসতে দেখেনি সে।কত সুন্দর লাগে হাসলে।কথাটা ভেবেই তুলির মুখ হালকা হা হয়ে যায়।সাফা আগ্রহের সাথে বলে,
—” ওকে বলে দিও ওর লাভ লেটার আমি নিয়েছি ।সাথে এই চকলেটও দিও।তবে ওর মামা কে??মানে উনার নাম কি??”
তুলি অনেক্ষন চিন্তা করে।তারপর বলে,
—” স দিয়ে। স দিয়ে সিফাত।উনার নাম সিফাত।”

সাফা প্রথমে সাধারন মনে করে আবার পড়ায় মন দিতে বলে।হুট করেই তার মাথায় আসে সিফাত তার বাবার ক্লাইন্ড না??সাফা হুরমুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। পাইচারি করতে করতে ভাবে লোকটা নিভ্রকে চিনি। মানে নিভ্রর সাথে তার পরিচায় আছে আর না থাকলেও নিভ্র তার প্রিয় কেউ হবে তা না হলে ছবি কেনো রাখবে??সাফা অবাক হয়ে সব মিলাতে থাকে।তাদের বাসার সেই সিফাত যদি হয় তাহলে কি হবে??নিভ্র তো যেনে যাবে সে কোথায় থাকে??যদি আসে??সাফা হাঁসফাঁস করে।ঘাম হচ্ছে তার কপালে।লোকটা কি সেজন্যই তাদের বাসায় এসে এভাবে তাকিয়ে ছিলো??সাফার মাথা ভার হয়ে আসছে।সত্য যদি নিভ্র তার সামনে হয় কি জবাব দিবে সে??সাফার বুক কাঁপে ভয়ংকর মাত্রায়।সব এলোমেলো লাগছে তার।সাথে ভয়।ভয় নামক বস্তু তাকে গ্রাস করছে।নিভ্রকে তো সে ধোকা দিয়েছে বিয়ে করবে বলে পালিয়ে এসেছে। নিভ্র যদি যানে সে এখানে তাহলে কি হবে??তাকে নিভ্র কি প্রশ্ন করবে??কেনো চলে এসেছে জিজ্ঞেস করলে নিভ্রকে কি বলবে??সাফা আকাশপাতাল ভাবে।বিছানায় বসে পরে।তুলি পানির বোতল এগিয়ে দেয় তার দিকে।সাফা সম্পূর্ন বোতল শেষ করে ফেলে।মাথায় হাত দিয়ে ঝুঁকে বসে থাকে সে।পরক্ষনেই ভাবে এক নামের হাজারো মানুষ হয়।এটাও তেমনই কিছু হবে।সাফা তবুও নিজেকে সামলাতে পারে না।চিন্তা তার মাথা চেপে আছে।
__________________________
সাফাকে ফিড়ে পাবে ভেবেই চৌধুরী বাড়ি খুশিতে রমরম হয়েগেছে। সবার মাঝেই এক অদৃশ্য আনন্দ কাজ করছে।সবাই সাফাকে আনতে যাবে।সেই আনন্দ মেতে আছে বাড়িময়।কিন্তু রাফা খুব চিন্তায় আছে।সাফা কেনো গেছে তা যদি তার ধারনার সাথে মিলে তবে কি হবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে??অন্যদিকে অভ্র অধীক টেনশনে আছে।কেনো যে নিভ্রর সাথে গেলো না।নিভ্রর চিন্তায় তার কিছুই ভালো লাগছে না।না জানি নিভ্র কিভাবে আছে।সে বাদে কেউ তো তাকে সামলাতে পারে না।যদি সাফাকে এবার না পায়?? কথাটা ভেবেই তার বুক কেঁপে উঠে।তার ভাই প্রচন্ড দূর্বল হার্টের রোগী এখন যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয় ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে।মনের মাঝে তার ভয়েরা হানা দিচ্ছে। তার ভাইয়ের কিছু যাতে না হয়।আর আল্লাহ যাতে এই যাত্রায় সাফাকে ফিড়িয়ে দেয় সেটাই দোয়া করছে অভ্র।কিছুক্ষণ পর পর আরিফকে কল করে নিভ্রর খবর নিচ্ছে সে।ভয় লাগছে তার।
_____________________
নিভ্র কক্সবাজারের মাটিতে পা রাখতেই কেঁপে উঠে।মনের মাঝের সব আবেগ অনুভুতি যানান দেয় সে এখানে।প্রকৃতির মাতাল হাওয়া নিভ্রকে মাতাল না করলেও প্রান খুঁজে পাওয়ার সন্ধানে নিভ্র সেই হাওয়া গায়ে মাখায়।নিভ্র আরিফকে প্রশ্ন করে,
—” সাফা এত দিনে বড় হয়েগেছে না আরিফ??”
আরিফ হা করে নিভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
—” দুইবছরের বেশি সময় স্যার।এতদিনে বড় হবে এটাই স্বাভাবিক না??”
নিভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—” কত গুলো সময় আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে আরিফ।শুধু দুইবছর না দুইবছর, পাঁচ মাস, তিন দিন,পাচঁ ঘন্টা, পঁচিশ মিনিট,চার সেকেন্ড পেরিয়ে পাচঁ হয়েছে।”

আরিফ শুধু তাকিয়ে আছে।সে আর অবাক হতে পারছে না।নিভ্র যে প্রতি সেকেন্ড কিভাবে পার করে এটা তাদের চাইতে ভালো কে আর যানবে। সাফাকে পেলেই সে চুল টেনে নিভ্রর সাথে বেধে দিবে।সাফার চুল সে দেখেছে বিশাল চুল।এই চুল দিয়েই নিভ্রর সাথে তাকে বেধে দিবে বলে ঠিক করেছে আরিফ।মনে মনে আরিফ সাফাকে অনেক বকে।কিন্তু সামনে বোকতে পারে না।সামনে কিছু বললেই নিভ্র তার গালে ঠাটিয়ে কয়েকটা বসিয়ে দিবে।যা ভয়ংকর ব্যাপার হবে।তার চেয়ে সে চুপ থাকা ভালো মনে করে।

নিভ্র সারা রাস্তা এটাই চিন্তা করতে করতে এসেছে সাফার থেকে কিভাবে প্রতিশোধ নিবে।কিভাবে শাস্তি দিবে।কি কি প্রশ্ন করবে।সব ভেবে নিয়েছে সে।সাফাকে ছাড়বে না।আবার ভাবে ছাড়ার তো প্রশ্নই আসে না।বেঁধে রাখবে।নিভ্রর খুশি দেখে কে??আরিফ তো শুধু তাকিয়েই আছে।এত খুশি নিভ্রকে অনেক আগে দেখেছে তারপরে সাফা হারিয়ে যাওয়ার পরে তো আর এত খুশি দেখেই নি।আরিফের কি হলো কে জানে।হুট করে প্রশ্ন করে,
—” স্যার সাফা যদি বিবাহিত হয়??না মানে যদি এত দিনে ওর বিয়ে বা বাচ্চা হয় তখন কি হবে??”

নিভ্রর বুক ধড়াস করে উঠে।ভয়াত্নক চোখে আরিফের দিকে তাকায়।নিভ্রর সব হাসি বিলিন হয়।আরিফ নিজের মাথায় নিজে বাড়ি মারে।কেনো যে বলতে গেলো??আহাম্মক তাকে নীলা এমনে এমনে বলে না।আসলেই সে একটা আহাম্মক। নিভ্র চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে বাহিরের দিকে।ভয়ে তার আত্ন শুকিয়ে গেছে।এতটা ভয় তো আগে লাগে নাই।কিন্তু এখন সাফাকে পেয়েও সে হারাবে??ভেবেই নিভ্রর সব শক্তি ক্লান্তিতে রূপ নেয়।নিভ্রর মনে হচ্ছে সে সত্য আর বাচবে না।বুকের ব্যাথা প্রবল হারে বাড়ে।আরিফ উত্তেজিত হয়ে বলে,
—” না ও তো হতে পারে স্যার।বিবাহিত হলে ওই লোক আপনাকে জানাতো না??”

নিভ্র কাঁপছে।ভয়, হারানোর ভয় তাকে আবার আক্রমণ করেছে।এক জীবনে সে সাফার সাথে আর কাউকে সজ্য করতে পারবে না।কাউকেই না।আরিফ নিভ্রর হাত ধরে বলে,
—” শান্ত হন স্যার।এমনটা হবে না ইনশাআল্লাহ্।
—” এটা হলে আমি কি নিয়ে বাচবো আরিফ??”

আরিফের প্রচন্ড খারাপ লাগছে।নিভ্র এমনেই খুব দূর্বল তার উপড় এমন আজেবাজে কথা সে নিজেই বলছে।অভ্র অনেক করে নিশেষ করেছে যাতে এমন কোনো কথা না বলে যেগুলো নিভ্রকে কষ্ট দেয়।নিভ্র অনেক অসুস্থ। এটা তার মাথায় রাখা উঁচিত ছিলো।কিন্ত সে……

চারতলা বিশিষ্ট বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে নিভ্র আর আরিফ।উত্তেজনা,ভয়,অদ্ভুত অনুভুতিতে নিভ্র জমে গেছে।আরিফর মাঝেও এক অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। নিভ্রর বুকের ব্যথা আরো বেড়েছে।আজ সারা দিন সে ঔষুধ খায় নি।শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। সব মিলিয়ে দম বন্ধ অবস্থা।নিভ্র থামা থামা গলায় দারোয়ানকে বললো,
—” সাফারানীর বাসা কথায়??”
দারোয়ান মোটা সোটা গোল গাল মানুষ।পেটের বেল্ট উপড়ে টানতে টানতে বলে,
—” কেডা আপনে??”
—” যাকে খুঁজা হচ্ছে তার কথা বলেন না।আমরা কে যেনে কি করবেন??”আরিফ বিরক্তির সাথে বলে উঠে।
দারোয়ান ভারী অবাক হওয়া গলায় পান চিবাতে চিবাতে বলে,
—” পরিচায় না দিলে কমু কা??পরিচায় তো চোরও হইতে ফারে।পরে দেখা যাইবো চোর ডুইকা গেছে।সবাই তহন আমার চাকরি খাইবো।এডা কি জানেন আপনে??”
আরিফ কথা বাড়ায় না।তার নিভ্রকে নিয়ে টেনশন হচ্ছে তাই টাকা দিতে চায়।দারোয়ান রেগে মেগে বলে,
—” আল্লাহ আমারে টেকা দেখান হুম??আমি এসব নি না।টেকা দিয়া সবাইরে কিতে পারলেও এই মুজিবরে পারবেন না সাহেব।সত্য কথা কন তো কি চান??”
নিভ্র এতসময় পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো সামনে এগিয়ে এসে বললো,
—” সাফাকে চাই। শুনতে পাচ্ছেন না সাফাকে।ভিতরে ডুকতে দেন তা না হলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না।”
মুজিব নিভ্রর সবুজ চোখ লাল লাল হতে দেখেই ভয় পায়।কিন্তু হুট করেই চিন্তে পারা ভঙ্গিতে বললো,
—” আরে ডাক্তার আপনে??নিভ্র সাহেব যে??”
নিভ্র অবাক হয়।মুজিব এগিয়ে এসে বলে,
—” আমার মায়ের হাডের অপারেশন করছেন আপনে আমার মনে আছে।টেকা ছিলো না।আপনি টেকা ছাড়াই করছেন।নিজে টেকা দিয়া।মনে নাই??”

নিভ্র কিছুক্ষণ চিন্তা করে।কিন্তু তার মনে পড়ে না।এমন অনেকেই সে চিকিৎসা দিয়েছে বিনা টাকায়।এখন এনি কে তা তার মাথায় আসছে না।নিভ্র বিনোয়ের সুরে বলে,
—” চিনতে পারলে তো ভালোই। আমি চোর না বুঝতে পেরেছেন সো প্লিজজ সাফাকে ডাকেন ওকে দেখবো।কত দিন, বছর, ঘন্টা আমি ওকে দেখি না।ভাই প্লিজজ আমার এই উপকার করেন। সাফাকে ডাকেন।”

আরিফ বাকরুদ্দ। এই প্রথম নিভ্র এতটা বিনোয়ের সাথে কাউকে রিকুয়েস্ট করছে।এটা তো তার নীতি বিরোধি।তাও সে করছে সব ভালোবাসার জন্য।এতটা কষ্ট বিরহে??সে মনে মনে দোয়া করে নীলা যাতে তার কাছ থেকে কখনোই না যায়।এত বিরহ সজ্য করার মত না।নিভ্রকে দেখেই তার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার না জানি কি অবস্থা। আরিফ দীর্ঘশ্বাস নেয়।দারোয়ান তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে খাতা চেক করে আসে।নিভ্রর বুকের ব্যাথা আরো বাড়ে।কষ্টে দম খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে সে।একটা নজর সাফাকে দেখবে বলে।সাফাকে দেখে সে মরতেও রাজি।তবুও একবার দেখবে।

দারোয়ান হতাশ মুখে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
—” স্যার এই নামের কেহ নাই এডে।”

নিভ্রর দম আঁটকে আসে।তাহলে কি সেই লোক ভুল ঠিকানা দিয়েছে।সাফা কি তাহলে নেই এখানে??কখনোই পাবে না তাকে??এক নজর দেখাও হবে না??আরিফ দ্রুত নিভ্রকে ধরে।নিভ্র বুকে হাত দিয়ে আছে।দাঁত খিঁচে আছে।আরিফ দ্রুত গাড়ি ঘুড়াতে বলে।নিভ্রকে পাশের একটা হসপিটালে দ্রুত নিয়ে যায়।নিভ্র সম্পূর্ন কথাটাও শুনতে পারলো না তার আগেই এমন একটা ঘটনা হয়েগেছে। আরিফ অভ্রদের সবাইকে সেই হসপিটালে ঠিকানা দিয়ে দেয়।নিভ্রকে হসপিটালে জরুরী বিভাগে রাখা হয়।

সবাই মুখ কালো করে বসে আছে।কান্নার আর কিছু নেই।কষ্টগুলো আর কান্না হয়ে আসে না তাদের চোখে।এতটা কষ্ট তারা আর নিতে পারছে না।এতটা কষ্ট কিভাবে হয় তাও তারা বুঝতে পারছে না।অভ্র গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে।নিভ্র আজ একদিন সেন্সলেস। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত চাপ নিতে না পারায় নিভ্রর হার্ট অ্যাট হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।কিন্তু ঠিক সময়ে নিয়ে আসায় সে যাত্রায় বেঁচেগেছে।কিন্তু এবার একটা ছোট আঘাতেও নিভ্রর হার্টঅ্যাক হবে এটা তারা নিশ্চিত। নিভ্রর অলরেডি একটা ছোট অ্যাটাক হয়েছে একদিকে অ্যাট ধরা হয় না আবার ধরাও হয়।কিন্তু এভাবে যদি আরো ছোট অ্যাটা হয় তবে নিভ্রর বড় অ্যাট যে কোনো সময় হতে পারে।পরিবারের সবাই হতাশ, নিরাশ হয়ে বসে আছে হসপিটালের করিডরে। কি করবে তারা কিছুই বুঝতে পারছে না।নিভ্রর সেন্স ফিড়লেই সে সাফাকে খুঁজবে। তখন কি করবে বা বলবে তাই ভেবে পাচ্ছে না তারা।

পাঁচটা ছুঁই ছুঁই।বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। নিভ্রর মাত্র সেন্স ফিরেছে।উঠে বসে চারদিকে তাকিয়ে নিভ্র তার পায়ের কাছে মাথা দিয়ে অভ্রকে শুয়ে থাকতে দেখে।সোফায় আরিফ আর তার বাবা সাখাওত বসে বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ঘুমচ্ছে। নিভ্র নিজের দিকে একবার তাকায়।আজ কয় দিন পড়ে তার সেন্স ফিরেছে সে জানে না।গায়ের নীল রং এর হসপিটালের জামা।হঠাৎ করেই নিভ্রর কিছু মনে পড়ে।দ্রুত নিজের সেলাইন, রক্তের নল সব খুলে নিভ্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।অভ্রর পাশ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে সে সাবধানে রুম ত্যাগ করে।পায়ে জুতাটাও পরেনি সে।হসপিটালের বাহিরে এসে সাইনবোর্ড দেখেই একটা সস্তির শ্বাস নেয়।মানে সে কক্সবাজারেই আছে।নিভ্র গাড়ি খুজে নিজেই ড্রাইভ করে সাফার বাড়ির সামনে এসে থামে।বৃষ্টিতে নিভ্র ভিঁজে গেছে।ভিঁজা পায়ে হেঁটে দারোয়ানের কাছে যায় সে।দারোয়ান মহা অবাক।হা করে কিছুক্ষণ নিভ্রকে দেখে সে।নিভ্র ভণিতা না করে প্রশ্ন করে,
—” সাফ্রিনার বাসা এখানে কিনা চেক করো??ফার্স্ট।
দারোয়ান তাকিয়েই আছে।যা দেখে নিভ্র ধমকের সুরে বলে,
—” কি প্রশ্ন করেছি??তার জবাব দেও?”

দারোয়ান দ্রুত খাতা খুলে।ঘন্টা খানেক আগেই সাফ্রিনা বের হয়েছে এটাই খাতায় উল্লেখ আছে।নিভ্রর দিকে কাপাঁ হাতে খাতা এগিয়ে দিতেই সে সব গুলো পেইজ উল্টেপাল্টে দেখে।সারিক,ঝুমা এই নাম গুলো দেখেই নিভ্র হেঁসে ফেলে।শব্দ করেই বলে,
—” অনেক হয়েছে লুকুচুরি। এবার সামনা সামনি খেলা হবে।খুব খেলার সখ না। এবার দেখো নিভ্রনীল কি সাফারানী।এবার কোথায় যাবে?”

দারোয়ান কিছুই বুঝলো না।নিভ্র গেটের বাইরে গাড়ির উপড় উঠে বসে।ভালোবাসার সব পরীক্ষা সে দিয়েছে।এবার রেজাল্টের পালা।দারোয়ান কয়েক বার ভিতরে বসতে বলেছে কিন্তু নিভ্র যায় নি।সে অপেক্ষায় আছে সাফার।অনেক অপেক্ষা করেছে আর না।এবার সরাসরি কথা হবে।চোখের দিকে তাকিয়ে কথা হবে।সামনাসামনি কথা হবে।নিভ্র প্রচন্ড রেগে আছে।কারন এই ভাবে এই নাম ইউজ করার মানে হচ্ছে সাফা লুকিয়ে থাকতে চায়।এটা কেনো??সেটা নিভ্র সরাসরি প্রশ্ন করবে।এত কষ্ট কি তার প্রাপ্য ছিলো?? এতটা কষ্ট কেনো দিলো??নিভ্র কথাগুলো ভাবলেও তার মন সাফাকে একনজর দেখার জন্য মরিয়া হয়ে আছে।আজ সে খুব স্ট্রং হয়ে আছে।সাফাকে সে শাস্তি দিবে।
_______________________
সাফা ভিঁজে চুপচুপ হয়ে রাস্তা দিয়ে আসছে।আজ ছাতা নেয়নি।এটা যে কত বড় ভুল তা সে হারে হারে বুঝে গেছে।গায়ের জামা হেজাব সব ভিঁজে গেছে।সাফা ব্যাগ কাধে পানি ঝাড়ঁতে ঝাড়ঁতে নিজে নিজে বকবক করতে করতে আসছে।চোখ তার নিচের দিকে।জুতাটাও কাঁদায় পা দিতে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে।হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। সাফা এখনো বকবক করছে আর নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। দমকা হাওয়া বয়ে যায় হঠাৎ করেই।সাফার জামা হেজাব হঠাৎই উড়তে লাগে।সাফা এক হাতে জামা আর এক হাতে হেজাবের একটা অংশ ধরে গেটের সামনে এগিয়ে আসতেই থমকে দাড়ায়।খুব চেনা।খুব কাছের একটা ঘ্রাণ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। সাফা ঘুড়ে তাকায়।নিভ্র মাত্র মাথা উঁচু করে পাশে তাকায়।সাফা স্তব্ধ। দম বন্ধ হয়ে গেছে মুহূর্তেই।এটা কি?? নিভ্র এখানে??নিভ্র নিজেও স্তব্ধ। চারিপাশের বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়েগেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে।নিভ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়েই সাফার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিভ্রর দম বন্ধ।কথা বন্ধ।চোখ স্থির।এই কি সে??যাকে মরিয়া হয়ে পাগলের মত খুঁজেছে??নাকি স্বপ্ন??প্রতিবারের মত এবারো কি ধোকা দিয়ে ছেঁড়ে যাবে???সাফার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।হাতের মুঠো খুলে যায়।সারা শরীর কম্পিত হয়।নিভ্র আর একটু এগিয়ে আসে।অস্পষ্ট স্বরে বলে,
—” সাফা!!!!”

#চলবে________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here