এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -৫৬+৫৭+৫৮

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৬

জেলের ভিতরে উন্মাদের মতো বসে থাকা সুমনের দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে মুফতাহির। কয়েকবার ডেকেছে ও সুমনকে,শোনেই নি। নিজেকে দোষারোপ করতে করতে ক্লান্ত মুফতাহির। ভাইয়ের এই দশার জন্য ও নিজেও দায়ী। সুমন যখন সাফাত রওশনের এন্টিডোডের ফর্মুলা চুরি করার কথা বলেছিলো,বড় ভাই হিসেবে ওর উচিত ছিলো তখনই ওকে থামিয়ে দেওয়া। কিন্তু না! টাকার লোভে অন্ধ হয়ে ও নিজেও জড়িয়ে গেলো এই কুৎসিৎ অপকর্মে,ঠকাতে শুরু করলো সবাইকে। আর তার পরিনতি হিসেবে আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে ওকে। কিন্তু শাস্তি শুধু সুমন কেনো পাবে? শাস্তি তো ওরও প্রাপ্য। অবশ্য ও কি শাস্তি পাচ্ছে না? বোনের সুখের কথা ভেবে আইন থেকে তো ওকে আড়াল করেছে আরাব,কিন্তু সুমনের এই অবস্থায় যে ওর মৃত্যুযন্ত্রনাই হচ্ছে,সেটাও জানে আরাব। ওর বিরুদ্ধে সব প্রমান সরিয়ে এভাবেই ওর শাস্তি ভেবে রেখেছে আরাব। যাতে ও নিজেকে আইনের কাছে সমর্পন করতে না পারে। আর তৌফিকার প্রতি ওর যে দুর্বলতাটা তৈরী হয়েছে,তাতে তৌফিকাও বলার সাহস রাখে না মুফতাহির। সামনাসামনি বেচে তো থাকবে,কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভাইয়ের জন্য মরমে মরতে হবে ওকে।

-ডক্টর মুফতাহির?

চোখের কোনের জল লুকিয়ে মুছে ফেললো মুফতাহির। পাশেই ইন্সপেক্টর এসে দাড়িয়েছে। মুফতাহির নাক টেনে মাথা নিচু রেখে বললো,

-ইয়েস ইন্সপেক্টর।

-আপনি চেনেন ডক্টর সুমনকে?

-নো ইন্সপেক্টর।

-তাহলে…

-এমনি দেখার ছিলো কি স্টেটে আছে। ওকে কি ডক্টর দেখানো হয়েছে কোনো?

-জ্বী। গতকাল রাতেই একজন সাইকোলজিস্ট দেখে গেছে ওকে।

-কি বলেছে?

-ওর মানসিক ভারসাম্য নষ্টের উদ্দেশ্যে বেশ অনেকদিন যাবত ওকে ইন্জেক্ট করা হয়েছে ডক্টর। রিকভারি পসিবল হলেও সময় লাগবে।

-কতোদিন?

-ডিপেন্ডস্ অন হিজ রেসপন্স। ডক্টর বলেছে মিনিমাম ছ মাস ওকে অভজার্ভেশনে রাখতেই হবে। তার পর যদি…

চোখ তুলে তাকালো মুফতাহির। আরেকবার সুমনের দিকে তাকালো। টুকরো ইট দিয়ে দেয়ালে রিয়জেন্টের বোতল একে চলেছে। মাঝেমধ্যে মাথা চুলকে ছবিগুলোর নিচে রসায়নের দু একটা বিক্রিয়াও লিখে দিচ্ছে। আর সহ্য হলো না মুফতাহিরের। বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে।

সোফায় বসে প্রচন্ড বিরক্তিতে এক কাপ চাল,এক কাপ ডালের মিশ্রন থেকে চাল ডাল আলাদা করছিলো তাজীন। রান্নাঘর থেকে প্রেশার কুকারের সিটি শুনে একপলক তাকালো সেদিকে। কিন্তু চোখে পরলো নিরবকে। নিরব সামনেই বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে। তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো ও। নিরব বললো,

-কি বলেছিলাম?

-চাল ডাল আলাদা করতে।

-আপনি কি করছিলেন?

-রান্নাঘরের দিকে তাকিয়েছি।

-শাস্তিটা কি ছিলো?

তাজীন চোখ বন্ধ করে হতাশার শ্বাস ছাড়লো। ওর প্রেগনেন্সির বিষয়ে নিরবকে কিভাবে জানাবে,এ নিয়ে হাজারো চিন্তাভাবনা করেছে। নিজের কর্মকান্ডে কয়েকবার চেষ্টাও করেছে নিরবকে বোঝানোর। ও বোঝে নি। আর তাজীনও বলে উঠতে পারে নি। কিন্তু দোয়াকে জানানোর পর আরাব কনগ্রাটস্ জানিয়ে নিরবকে বলে দিয়েছে সবটা। আর সাথে ওর আর নিরবের মাঝের কোল্ড ওয়ারকে ওয়ার্ল্ড ওয়ার বানিয়ে দিয়ে গেছে। ঘটনায় যুক্তির পাল্লা নিরবের দিকেই ভারি। বাবা হচ্ছি কথাটা আমার অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হলো এই এক কথাতেই তাজীনকে চুপ করিয়ে দিয়েছে ও। এ কয়দিনে নিরবের এক অন্যরুপ দেখেছে তাজীন। যাকে কড়া গলায় ও শাষাতো,সেই লোক ওকে ধমকে ধমকে বসিয়ে রাখে। এতোবড় সুখবরটা না দেওয়ার শাস্তি হিসেবে ওর সাথে কতোরকমের অন্যায় ঘটে চলেছে,তা ওই জানে। তাজীন আমতা আমতা করতে করতে বললো,

-শাস্তিটা ছিলো,ক্ কোনো কাজ করা যাবে না। র্ রান্নাঘরে য্ যাওয়া তো দুর,ও্ ওদিকে ত্ তাকানোও যাবে না।

-এন্ড তুমি তাকিয়েছো।

কোলের উপর থাকা বাটিটা সরিয়ে উঠে দাড়ালো তাজীন। বাচ্চাদের মতো কাদোকাদো গলায় বললো,

-কি করবো? এই চালডাল বাছতে গিয়ে অসাড় হয়ে যাচ্ছি।

-যাও। সমস্যা নেই। তোমার কোনো কাজ নেইতো! অসাড় হয়েই বসে থাকো।

-বাবা দেশের বাড়ি থেকে ফিরুক। আমি বলবো বাবাকে! তোমার ছেলে খুব জ্বালিয়েছে আমায়!

-আমিও বলবো বাবাকে। আমি যে বাবা হচ্ছি সে খবরটা আমাকে অফিসের বসের কাছ থেকে জানতে হয়েছে।

-সরি বলেছি তো কতোবার।

-তোমার সরিতে আমার কষ্টটা মেটে নি তাজ। বাবা হচ্ছি,এই খবরটা জানার এতোবড় সুখ থেকে এতোগুলো দিন আমাকে বঞ্চিত করার অধিকার তোমার নেই।

এতোক্ষন খুনশুটিতে কথা বললেও এবার নিরবের গম্ভীর কন্ঠ। তাজীন গাল ফুলিয়ে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে। বুকে মাথা রেখে ওর টিশার্টে আকিবুকি করতে করতে বললো,

-সত্যিই অন্যায় করেছি। আসলে আমি ভাবছিলাম কিছুটা ইউনিক উপায়ে জানাবো তোমাকে। সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি এসবে তুমি…যাইহোক, এবারের মতো মাফ করে দাও এংরি বার্ড? পরেরবারগুলোতে আমি জানার আগে তোমাকেই জানাবো। পাক্কা!

পরেরবারগুলোতে কথাটা শুনে কপাল কুচকে বুকের মাঝে মিশে থাকা তাজীনের দিকে তাকালো নিরব। তাজীন মাথা তুলে বললো,

-কি? ইচ্ছা নেই ক্রিকেটটিমের?

হেসে দিলো নিরব। দুহাতে জরিয়ে ধরলো তাজীনকে। পুরো ঘরটাতে চোখ বুলালো একপলক। সবটা যেনো পরিপুর্ন লাগে ইদানিং। ওর ছোট্ট পৃথিবীতে আরেকটা ছোট্ট সত্ত্বা আসতে চলেছে যে!

তন্নি টিউশনি থেকে ফিরছিলো। আসার পথে জুতোটা হঠাৎ করেই ছিড়ে গেলো ওর। অস্বস্তিতে আশেপাশে তাকালো তন্নি। কিন্তু পাশে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো ওর। পাশের মন্দিরে চোখ বন্ধ করে হাতজোড় করে বাবু হয়ে বসে স্বস্তিক। সাদা পান্জাবী,পায়জামা পরনে। মুখার্জীবাড়িতে দু একসময় অরুনাভ মুখার্জীকে তুলসীতলায় দাড়াতে দেখলে ওর মনে হয়,একঘর হিন্দু আছে চিলেকোঠায়। নয়তো বাবা ছেলে কাউকে দেখে কেউ বলবেই না,এরা হিন্দু। আর এই মুহুর্তে স্বস্তিককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে,ও কতোটা মন থেকে প্রার্থনায় বসেছে। জুতোটা ঠেলতে ঠেলতে খুড়িয়ে হাটা লাগালো তন্নি। কিছুদুর আসতেই দেখতে পেলো বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। অনেকেই আছে রাস্তাটায়। এখানে এভাবে হাটলে আরো বাজে দেখাবে। ঠিক করলো জুতো খুলেই তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাবে রাস্তাটুকো। জুতো খুলবে বলে সবে নিচু হয়েছে,ওর সামনে পুজোর থালা শব্দ করে এসে পরলো একদম।

পিচঢালা পথে লাল আবির,মিষ্টান্ন,ফুল পরে আছে এলোমেলোভাবে। মাথা তুলে তাকালো তন্নি। কিছুটা পাশে স্বস্তিককে দেখে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো ও। একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো স্বস্তিক। পুজো শেষ করে ও তন্নির পিছুপিছুই আসছিলো। পেছন থেকে হঠাৎই ক্রিকেটবল এসে ওর পুজোর থালাতে লেগেছে। থালা গিয়ে একদম সামনে পরেছে তন্নির। আর নিচু হয়ে থাকায় থালাতে থাকা সিদুরকোটোর সবটুকো সিদুর গিয়ে তন্নির মাথায় পরেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছে ও। তন্নির মাথার দিকে হাত উচিয়ে বললো,

-ত্ তোমার সিথিতে…

মাথায় হাত ছোয়ালো তন্নি। হাতে লেগে যাওয়া রক্তিম সিদুর দেখে আরেকপলক তাকালো স্বস্তিকের দিকে। স্বস্তিক বুঝে উঠছে না কি বলবে বা কি করবে। চুপচাপ ছেড়া জুতাটা হাতে নিলো তন্নি। আরেকহাতে চুল থেকে সিদুর ঝাড়তে ঝারতে চলে আসলো ওখান থেকে। এক্সিডেন্টলি যা ঘটার ঘটেছে। এসবের কোনো মানে নেই ওর কাছে।
মুখার্জীবাড়িতে ফিরে দেখলো দোয়া আরাব এসেছে ওখানে। ওরা হাসিমুখে কুশল বিনিময় করছে সবার সাথে। দিয়ানকে এখনো ছাড়েনি। বৌভাত দেরি হবে আরো কিছুদিন। দোয়া আর টুইঙ্কেলকে নিয়ে আরেকবার তাই চিলেকোঠায় ঘুরতে এসেছে আরাব। দোয়া মেরুন রঙের একটা শাড়ি পরেছে। আরাবের গায়েও একই রঙের শার্ট। টুইঙ্কেলও বাদ যায়নি। ওর গায়ের জামাটাও মেরুন রঙের। মুগ্ধ হয়ে ওদেরকে দেখতে লাগলো সবাই। তন্নিকে দেখে দোয়া এগোলো ওর দিকে। জরিয়ে ধরে বললো,

-কেমন আছিস তন্নি?

-এইতো ভালো দোয়াপু। তুমি?

-ভালো।

দোয়া দেখলো সদরদরজা দিয়ে স্বস্তিকও ঢুকছে ভেতরে। ওর হাতে পুজোর থালা। তন্নিকে ছেড়ে এগোলো ও স্বস্তিকের দিকে। আরাব সালমা বেগমের সাথে কথা বলছিলো। এরমাঝে টুইঙ্কেল বলে উঠলো,

-তন্নি আপু চুলে কালার করেছে। দেখো উইশ‌মাম!

সবাই তন্নির দিকে তাকালো। সালমা বেগম হেসে বললেন,

-কিরে তন্নি? চুলে ওভাবে আবির লাগলো কিভাবে?

তন্নি শান্তদৃষ্টিতে তাকালো স্বস্তিকের দিকে। স্বস্তিকের চেহারায় একপ্রকার অসহায়ত্ব। তন্নি বললো,

-রাস্তায় এক কোচিং সেন্টারের বাচ্চাকাচ্চারা বিদায় অনুষ্ঠান করছিলো। ওখানকারই রঙ ছিটে এসে লেগেছে আমার চুলেও।

আর কোনো কথা হয়নি এসব নিয়ে। বেশ অনেকটা সময় মায়ের সাথে কাটিয়ে আরাবের সাথে রংধনুতে ফিরে আসলো দোয়া। ততক্ষনে রাত হয়ে গেছে। বাসায় ঢুকতেই তৌফিক ওয়াহিদ ওকে একটা ফাইল ধরিয়ে দিলেন। হাসিমুখে বললেন,

-এগুলো এন্টিডোডের রেট নিয়ে মুফতাহিরের এনালাইজেশন দোয়া। তুই একটু দেখে নিয়ে ডিসিশন নিস।

দোয়া সোফায় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকা মুফতাহিরের দিকে তাকালো। মুফতাহির দেরি না করে উঠে দাড়িয়ে চলে গেলো ওখান থেকে। দোয়াও কোনোদিক না তাকিয়ে রুমে চলে আসলো চুপচাপ। ফাইলটা বিছানায় রেখে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো ওটার দিকে। পেছন থেকে কেউ ওকে জরিয়ে কাধে থুতনি ঠেকালো। দোয়া আস্তেকরে বললো,

-আমি পারবো তো আরাব?

পেছন থেকেই দোয়ার গালে চুমো একে দিকে আরাব। আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললো,

-শুধু তুমিই পারবে।

চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেললো দোয়া। মাথা ঠেকালো আরাবের বুকে। সামনে তাকালে ব্যালকনি দিয়ে জোৎসা গলা আলোকে কাঠগোলাপের সৌন্দর্য বাড়াতে দেখা যায়। ওই দৃশ্যে শান্তিতে মনপ্রান ভরে যাবে যে কারো। সেটা উপেক্ষা করে আবারো চোখ বন্ধ করে নিলো দোয়া। এতোটা স্নিগ্ধতা,এতোটা স্বস্তি শুধু এই মানুষটার বুকেই মিলবে ওর। অন্য কোথাও,অন্য কোনো কিছুতে নয়!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৭

পাতাঝরা শীত বিদায় নিচ্ছে। দুপুরের উজ্জ্বল রোদ বসন্তের আগমনকে মনে করিয়ে দেয়। এখন আর উত্তরের হিমশীতল বাতাস বয় না। পুবালী বায়ু শরীর ছুইয়ে ব্যস্ততার মাঝে স্বস্তি একে দেয়। জীবন সময়ের তালে ছন্দ মেলাতে ব্যস্ত। অতীতের কালো অধ্যায় আর উত্থানপতনকে ভুলে বর্তমানের সুখকে আকড়ে বাচতে চায় সবাই। ব্যতিক্রম হয়নি দোয়ারাবের সাথেও। আজ বিয়ের পুরো একমাস পর ওদের বৌভাত। যার সবটা আপাতদৃষ্টিতে দিয়ানের অসুস্থ্যতার জন্য আটকে থাকলেও,আড়ালে দোয়ারাবের জন্য সবটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য ছিলো। একমাসে দিয়ান সুস্থ্য অনেকটাই,দোয়া ওর বাবার ফর্মুলার এন্টিডোড সর্বনিম্ন দরে বাজারে ছাড়তে সক্ষম। শশুড়বাড়ি,মা ভাইয়ের দায়িত্ব সামলে রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসের সফল এমডি ও। কারন আরাব ছিলো ওর পাশে। বায়োমেডির সবকাজ শেষ করে দিনশেষে নিজে পাশে বসে দোয়াকে হাতে কলমে ওই বুঝিয়েছে সবটা। পরিশ্রুতিতে,রংধনুর সফলতা,দোয়ার সফলতা।

রুমে গাঢ় লাল খয়েরি কারুকাজ খচিত ভারি লেহেঙ্গাটা পরে ঘাড় ঘুরিয়ে নিচদিকটা দেখে সামলানোর চেষ্টা করে চলেছে দোয়া। টুইঙ্কেল বিছানায় থাকা গয়নাগুলো এলোমেলো করে দেখছে একটা একটা করে। অনেকগুলো লিপস্টিকের মধ্যে থেকে একদম লাল শেডের লিপস্টিকটা তুলে ধরে বললো,

-উইশমাম? এই কালারের লিপস্টিক দাও। এইটা বেশি মানাবে।

দোয়া মুচকি হেসে ফিরলো ওর দিকে। সাজগোজের অভ্যাস নেই ওর। তবুও টুইঙ্কেলকে তো খুশি করতেই হবে! তাই এগিয়ে গিয়ে টুইঙ্কেলের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে বললো,

-তুমি দিয়ে দাও?

টুইঙ্কেল নিজের মতো করে লিপস্টিক দিয়ে দিলো দোয়াকে। আরাব সুটের হাতের দিকটা ঠিক করতে করতে রুমে ঢুকছিলো। খয়েরী লেহেঙ্গা,খোলা চুলে সাদা পাথরের ব্যান্ড,বা হাত ভর্তি চুড়ি,কপালজুড়ে পরে থাকা বড় টিকলিটা,সবমিলিয়ে এক অন্য দোয়া। লিপস্টিক পরানো শেষে টুইঙ্কেল বললো,

-হয়ে গেছে!

ধ্যান ভাঙলো আরাবের। দোয়া সোজা হয়ে দাড়িয়ে পেছন ফিরলো। দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকা মানুষটার পরনে সাদা শার্টের উপর একেবারে গাঢ় খয়েরি ব্লেজার,কালো প্যান্ট। ফর্সাবর্নের মানুষটাকে একটু বেশিই মানিয়েছে এই গাঢ় রংগুলো। টুইঙ্কেল ছুটে আরাবের কাছে এসে বললো,

-একদম হিরোর মতো দেখাচ্ছে মামাকে। তাইনা উইশমাম?

মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নিলো দোয়া। আরাব দোয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোমাকেও অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।

-কিন্তু আমি তো এখনো সাজিই নি!

হচকিয়ে গিয়ে টুইঙ্কেলের দিকে তাকালো আরাব। সত্যিই সাজেনি টুইঙ্কেল। গলা ঝেরে বললো,

-কি করেছো কি তুমি টুইঙ্কেল? সাজো নি কেনো এখনো? যাও! এখনি গিয়ে সাজ কম্প্লিট করো! সবাই কিন্তু এসে গেছে গার্ডেনে! জলদি যাও!

-ওকে মামা।

ছুটে বেরিয়ে গেলো টুইঙ্কেল। দোয়া আয়নার দিকে এগোলো। কানের দুল পরতে যাচ্ছিলো ও। আরাব হঠাৎই ওর ডান হাতে দোয়ার কোমড়ের ডানদিক পেচিয়ে ঘুরিয়ে নিজের দিক ফেরালো। খানিকটা চমকে উঠে একহাত আরাবের কাধে চলে গেছে দোয়ার। কান থেকে আরেক হাত নামালো ও। দ্বিতীবারের মতো বা হাতে দোয়ার কোমড় জরিয়ে ধরলো আরাব। ডানহাতে আলতোভাবে দোয়ার ঠোটের কিঞ্চিত উপরে,নিচে স্লাইড করিয়ে বললো,

-একটু বেশিই হয়ে গেছে মিসেস আরাব।

-শুধু লিপস্টিকের কথা বোঝাননি আপনি রাইট?

-জ্বী। আপনাকে সাধারনবেশে দেখলেই তোলপাড় হয় ম্যাডাম। এভাবে সাজলে তো…

দোয়া নিজের হাতেই নিজের ঠোটের কিনারায় স্লাইড করালো আলতোভাবে। আরাব চোখ সরিয়ে ঠোট কামড়ে হাসলো। তারপর দোয়ার দিকে ফিরে ওকে আরেকটু কাছে টেনে বললো,

-জান লোগে কেয়া?

ফিক করে হেসে দিলো দোয়া। মৃদ্যু ধাক্কায় আরাবকে সরিয়ে দিয়ে বললো,

-যা দিয়েছেন,সেটুকোতেই নিজেকে উজাড় করে দেবো এইটা বুঝিয়েছি সাইকো সাইন্টিস্ট!

দুষ্টু হেসে আরাব এগোচ্ছিলো দোয়ার দিকে। তখনই তৌফিকা টুইঙ্কেলের দুটো জামা হাতে নিয়ে ওদের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

-দোয়া দেখো তো? কোনটা পড়াবো টুইঙ্কেলকে? ও তো…

আরাবকে ঘরে দেখে থেমে গেলো তৌফিকা। দোয়া থম মেরে গেছে। তৌফিকা ঠোট টিপে হেসে বললো,

-সরি ফর ইন্ট্রাপশন। ইউ মে ক্যারি অন।

তৌফিকা চলে যাচ্ছিলো। দোয়া একপ্রকার ছুটে এসে থামালো ওকে। হাত ধরে ভেতরে এনে ওর হাতের একটা জামা দেখিয়ে বললো,

-আপু এ্ এইটা বেশি মানাবে টুইঙ্কেলকে!

-ওকে। এটাই পরাচ্ছি। তুইও রেডি হয়ে নিচে আয়। ওয়েট করছে সবাই।

-আ্ আমি রেডি আপু। চলো চলো! তোমার সাথেই…

-তুই মেবি ফুললি রেডি না। তাইনা আরাব?

-নিয়ে যা। বিয়ে করে দোয়াকে রংধনুতে এনে দিয়েছি তো তোদের জন্যই। তোরা আম দুধ থাক একসাথে,আমি আটি হয়েই গরাগরি দেই না হয়!

আরাবের কথায় অতিকষ্টে হাসি আটকালো তোফিকা। বললো,

-ওকে। নিয়ে গেলাম দোয়াকে।

-দয়া মায়া না থাকলে নিয়ে যা। দোয়ার সাথে ভাইয়ের বদদোয়াও নিয়ে যা!

এবার শব্দ করে হেসে দিলো তৌফিকা। দোয়া চোখ খিচে বন্ধ করে আছে। তৌফিকা বললো,

-এর মান ভাঙিয়ে এসো। আসছি আমি।

তৌফিকা চলে গেলো। দোয়া এসে কোমড়ে হাত রেখে দাড়ালো আরাবের সামনে। সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,

-আপুকে ওভাবে বললেন কেনো?

-কজ তোমার সাজ এখনো হয়নি।

এটুকো বলেই দোয়ার হাত ধরে ওকে আয়নার সামনে দাড় করালো আরাব। কানের দুলটা পরিয়ে দিয়ে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

-শুনছো ঝুমকো? আরাবের হাতে দোয়ার কানে উঠেছো বলে গর্ব না করে আরাবের হাতেই খুলবে বলে তৈরী হও। আরাব খুব বেশিক্ষন দোয়ার সৌন্দর্যে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দেবে না কিন্তু!

লজ্জার রক্তিমতা ছেয়ে গেলো দোয়ার চেহারায়। উষ্ণতা বিচরন করছে ওর কানে,গালে। দোয়ার টিকলিটা তুলে দিয়ে সেখানে ঠোটের স্পর্শ একে দিলো আরাব। একপা পিছিয়ে দাড়িয়ে বললো,

-পার্ফেক্ট।

মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো দোয়া। ড্রেসিং টেবিল থেকে ঘড়িটা নিয়ে হাতে পরতে পরতে বেরিয়ে আসছিলো আরাবও। করিডরে এসে মুফতাহিরকে দেখে থেমে যায় ও। সুটবুট পরে বাইরে থেকে তো ঝকমকে সাজে আছে ও,কিন্তু ভেতরটা বিদ্ধস্ত মুফতাহিরের। এটা আর কেউ না জানলে,আরাব ঠিকই জানে। কোনো কিছু না বলে মুফতাহির নেমে যাচ্ছিলো। আরাব ডাক লাগিয়ে বললো,

-আপু নিচে চলে গেছে?

সিড়িতেই থামলো মুফতাহির। সামনে তাকিয়ে বললো,

-হুম।

-তোমাকে বলেছিলাম স্বাভাবিক থাকতে।

মুফতাহির পেছন ফিরলো। দুইসিড়ি উপরে দাড়ানো আরাবের দিকে মাথা উচু করে তাকিয়ে বললো,

-স্বাভাবিকই তো আছি আরাব। স্বাভাবিকই তো আছি। শুধু অস্বাভাবিক হয়ে আছে আমার ভাইটা। অস্বাভাবিক হয়ে আছে আমার আর তৌফিকার সম্পর্কটা। জেলে যাওয়ার আগেও অসহনীয় যন্ত্রনার মাঝে বাচতে হয়েছে সুমনকে। আজ এতোগুলো দিন হলো ও জেলে। এদিকে ওর জন্য,নিজের কাজের জন্য,না আমি শান্তিতে আছি,না তৌফিকাকে শান্তি দিতে পারছি। অন্যায় করেছে বলে না সুমনকে সামলানোর চেষ্টা করতে পারছি,অন্যায় করেছি বলে না তৌফিকাকে ঠকানোটা মানতে পারছি। কোনদিকে যাবো আমি আরাব? বলতে পারো?
কোনদিকে যাবো?

আরাব একধাপ নামলো সিড়ির। কিছু বলতে যাচ্ছিলো ও। তখনই তৌফিকা আসলো টুইঙ্কেলকে নিয়ে। মুফতাহির তাকালো তৌফিকার দিকে। কালো খয়েরি জমকালো কুর্তা পরেছে তৌফিকা,হাতভর্তি চুড়ি,সেজেছেও অল্পবিস্তর। টুইঙ্কেলকে একদম পুতুলের মতো লাগছে দেখতে। টুইঙ্কেল বাবার কোলে উঠে বললো,

-আম্মুকে কেমন লাগছে আব্বু?

তৌফিকা ঠোট টিপে হাসি আটকে চেহারায় গম্ভীরতা এনে বললো,

-উহুম! বলতে হয় আমাকে মানে টুইঙ্কেলকে কেমন লাগছে!

-আব্বু তো আমার দিকে তাকালোই না! বলবে কিভাবে? তোমার দিকে তাকিয়ে আছে,তাই তোমার কথাই জিজ্ঞাসা করলাম।

টুইঙ্কেলের গাল টিপে দিলো তৌফিকা। বললো,

-বড্ড বেশি পেকেছো তুমি! এসো আব্বুকে নিয়ে গার্ডেনে! আরাব? চল? দোয়া ওয়েট করছে নিচে।

আরাব চলে আসলো তৌফিকার সাথে। গার্ডেনে চিলেকোঠার সবাই এসেছে। নিরব,তাজীনসহ আরাবের কিছু কলিগ,তৌফিক ওয়াহিদের পরিচিত মানুষজনও এসেছে। রিসেপশনে সবার সাথে দোয়া আর চিলেকোঠার সবার আলাপ পরিচয় শেষ করলো তৌফিক ওয়াহিদ। খানিকটা দুরে দাড়িয়ে দোয়াকে নিয়ে রংধনুর সবার ব্যবহার দেখে শুধু তৃপ্তির হাসি হেসেছে আরাব। একসময় তাজীন দোয়াকে টেনে মাঝখানে দাড় করিয়ে দিলো। অবাক হয়ে তাকালো দোয়া। তাজীন হাতে তালি বাজিয়ে বললো,

-এটেনশন এভরিওয়ান! তৌফিক আঙ্কেল তো তার বউমার পরিচয় দিয়েই দিয়েছেন। তো এখন আমি সবাইকে আমার বান্ধবীর পরিচয় দিতে চাই। আমরা সবাই দোয়াকে চুপচাপই চিনি তাইনা? তো আজকে না হয় এই লাজুকলতার অন্যরুপ দেখি সবাই?

সবাই কৌতুহলে তাকালো। দোয়া নিজেও অবাকচোখে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললো,

-ক্ কি বলছো কি তাজ?

-ঠিকই বলছি। সো এভরিওয়ান? আজকে দোয়া আমাদেরকে গান শোনাবে! লেটস্ হেয়ার ইট ফর দোয়া!

সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। দোয়া প্রচন্ডরকম অস্বস্তিতে পরে গেছে। বারবার তাজীনকে বলতে লাগলো,হাত ছাড়তে,গান জানে না ও। তাজীন শোনেনি। তৌফিকা বললো,

-কিরে দোয়া? গাইবি না?

দোয়া কিছু বলার আগেই আরাব একপাশ থেকে বলে উঠলো,

-গাইবে।

শান্ত হলো দোয়া। তৌফিকা স্বস্তিককে বললো বাসার ভেতর থেকে গিটারটা নিয়ে আসতে। ও করলোও তাই। তাজীন মাঝখানে একটা চেয়ার নিয়ে দোয়াকে বসিয়ে দিলো। আরাব নিজে হাতে গিটারটা কোলে তুলে দিলো দোয়ার। গিটারটায় হাত বুলালো দোয়া। এতোগুলো বছর পর গিটার। এমনিতেও আগেও ততোটা পারতো না ও গিটার বাজাতে। আরাব বললো,

-এটা আমার গিটার। তুমি কিছু না বাজালেও তোমার গানে ও সুর এটে দেবে। ট্রাই ইট।

মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে গিটারে সুর তুললো দোয়া। গাইতে লাগলো,

কিছু কথার পিঠে কথা
তুমি ছুয়ে দিলেই মুখরতা,
হাসি বিনিময় চোখে চোখে
মনে মনে রয়,ব্যাকুলতা…

সুর কেটে গেছে গিটারের। দোয়া চোখ মেললো তৎক্ষনাৎ। আরাব শব্দহীন হেসে ওর হাত ধরে ওকে দাড় করালো। পেছন থেকে দোয়াকে জরিয়ে দোয়ার হাতে থাকা অবস্থাতেই গিটারটায় সুর তুলে গাইতে লাগলো,

-আমায় ডেকো একা বিকেলে
কখনো কোনো ব্যথা পেলে…

ঘাড় ঘুরিয়ে নিস্পলকভাবে আরাবের দিকে তাকিয়ে থেকে দোয়া গাইলো,

-আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে
যখনি মন কেমন করে…
কোনো এক রুপ কথার জগতে
তুমি তো এসেছো আমারি হতে
কোনো এক রুপ কথার জগতে…
তুমি চিরসাথী আমার জীবনের,এই পথে…

গলা মেলালো আরাবও। দুজনে গানটা শেষ করলো একসাথেই। গান শেষে সবাই হাততালি দিলো। দোয়া তখনও ঘাড় ঘুরিয়ে আরাবের দিকেই তাকিয়ে। আরাব ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-এই ঢেউখেলানো চুলের অধিকারীনীকে বলে দিও,এতোক্ষন যাবত তার এই চুলের ঘ্রানের জন্য ঠিকঠাকমতো গানে কনসেনট্রেট করতে পারিনি। তার আড় চাওনি একদম বুকে গিয়ে বেধেছে আমার। এ সময়টুকোতে তার চোখের পাপড়ির ওঠানামায় প্রতিবার খুন হয়েছি। তাহসানুল আরাবের এটেনশন গান থেকে কাড়ার দায়ে,এই চোখজোড়া দিয়েই খুন করার দায়ে দায়ের করা শাস্তিটা সুদসমেত তোলা আছে। অতীব আদুরে শাস্তির জন্য তৈরী থাকতে বলে দিও ওই চোখজোড়ার অধিকারীনীকে। আদুরে শাস্তি।

নিমিষেই নুইয়ে গেলো দোয়া। সরে দাড়ালো আরাবকে ছেড়ে। বাকিসব আরাবের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। এককোনে দাড়িয়ে দোয়া আস্তেধীরে ডানহাত নিজের গালে ছোয়ালো। এতো উষ্ণতা কিসের? আরাবের উষ্ণ নিশ্বাসের? নাকি লজ্জার?#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৮

-আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তন্নি। শত চেষ্টা সত্ত্বেও পারলাম না তোমায় ভালোবাসা থেকে নিজেকে আটকাতে। পারলাম এই সত্যিটা তোমার থেকে লুকিয়ে বেড়াতে। পারলাম না এই কথাটা অস্বীকার করে নিজেকে কঠোর প্রমান করে। আর নাই বা পারলাম তোমার মতো এ অনুভুতিকে এড়িয়ে যেতে! পারলাম না!

অশ্রুভরা দৃষ্টি তন্নির দিকে নিবদ্ধ রেখে একশ্বাসে কথাগুলো বললো স্বস্তিক। তন্নি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে। সবগুলো কথা যেনো মাথার উপর দিয়ে গেছে ওর। বিকেল গরিয়েছে। সুর্য হেলতে শুরু করেছে পশ্চিমাকাশে। মুখার্জীবাড়ির পশ্চিমে থাকা নারিকেল গাছটার জন্য ডুবতে থাকা সূর্যের কিরন বাধা পরলো স্বস্তিকের মুখশ্রী থেকে। তন্নি ছাদে এসেছিলো মেলে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে। কখন স্বস্তিক এসে দাড়িয়েছে,টেরই পায়নি ও। হাতের জামাকাপড়গুলো শক্তভাবে ধরে বললো,

-এ্ এসব কি বলছেন কি আপনি?

স্বস্তিক আরেকপা এগোলো। বুকভরে শ্বাস নিয়ে বললো,

-তোমাকে ভালোবাসি তন্নি। রাগারাগি,ঝগড়া,খুনশুটি,যাই থাকুক না কেনো,তোমার সাথে কথা বলাটা ভালো লাগে আমার। তোমাকে আশেপাশে পেলেও ভালো লাগে। গত কয়েকদিনে অজানা কারনে আমার প্রতি তোমার ইগ্নোরেন্সটা আমার ভালো লাগেনি তন্নি। একদমই ভালো লাগেনি। তাই কনফার্ম হয়ে গেলাম। ভেতরটা কি চায় আমার। শুনবে কি চায়?

-আ্ আপনি…

-উপেক্ষা নয়,বাকি জীবনটা এই বিলেতি কদু তোমার সাথেই কাটাতে চায় তন্নি। তোমাকে চায় নিজের পাশে। নিজের কাছে। থাকবে তন্নি? থাকবে আমার পাশে?

জলে ভরে উঠলো তন্নির চোখ। এই লোকটার প্রতি যে ওরও দুর্বলতা তৈরী হয়নি,তা নয়। কিন্তু ওর সে দুর্বলতার স্বীকৃতি যে অসম্ভব। বাস্তবতা জানে ও। তাইতো সেদিন পুকুরপাড়ের ঘটনার পর থেকে স্বস্তিককে সবরকমভাবে উপেক্ষা করে এসেছে ও। সামনে পরলেও পাশ কাটিয়ে চলে আসতো। কথা বলা তো অনেকদুরের বিষয়। একটা শুকনো ঢোক গিলে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো ও। স্বস্তিক ওর হাত ধরে ফেলে। হাত মুচড়ামুচড়ি করতে করতে তন্নি কেদে দিলো। স্বস্তিককের হেরফের নেই। ও‌ আবারো তন্নির সামনে এসে বললো,

-কেউ কাউকে ভালোবাসি বললে তার উত্তর দু রকম হয়। হ্যাঁ অথবা না। তুমি তো কোনোটাই‌ বললে না তন্নি। উল্টো কাদছো। এর মানে জানো?

-ছাড়ুন আমার হাত!

-এর মানে তুমি ভয় পাও। ভালোবাসো বলতে ভয় পাও। ভালোবাসো না বলতে বলতে ভয় পাও। আমি জানি,এর উল্টোটা হলে তুমি কি করতে এখন। তাই প্লিজ তন্নি,প্লিজ অস্বীকার করো না আমাকে। প্লিজ!

-ছাড়ুন আমাকে!

-সাথে আরেকটা জিনিসকে ভয় পাচ্ছো তুমি। আমাদের ধর্মের ভিন্নতাকে। তাইনা?

তন্নি এবার হার মানলো। শব্দ করে কেদে দিয়ে বললো,

-সবই যখন জানেন তাহলে কেনো যেতে দিচ্ছেন না আমায়? কেনো?

ওর দুহাত মুঠো করে নিলো স্বস্তিক। দুহাতে চুমো দিয়ে বললো,

-পারবো না তন্নি। বলেছিলাম তো সেদিন তোমায়,আমার যদি মনে হয় এই হাত ধরে রাখা আবশ্যক,আমি ধরেই রাখবো। তুমি আমার জন্য আবশ্যক হয়ে গেছো। বুঝতে কেনো চাইছো না তুমি?

নিজেকে ছাড়িয়ে পিছিয়ে গেলো তন্নি। হাতের পিঠে চোখমুখ মুছে বললো,

-কি চান আপনি?

-তোমাকে।

-আপনি জানেন তা সম্ভব না।

-কেনো সম্ভব না তন্নি? তুমি তো পিতৃপরিচয়ে মুসলিম নও! তুমি তো অনাথআশ্রমে বড় হয়েছিলে।

তন্নির দৃষ্টি পরিবর্তন হলো। এতোক্ষন যে চাওনিতে দুর্বলতা ছিলো,তা বিস্ময়,কিঞ্চিত ঘৃনায় পরিনত হয়েছে। স্বস্তিকের অনাথ শব্দটাতে ওর কিছু যায় আসে না। কিন্তু পিতৃপরিচয় ছাড়াও এতোদিন যে ধর্মকে ‌মেনে এসেছে ও,তাকে অসম্মান করলো স্বস্তিক,এমনটা মনে হলো ওর। মুচকি হাসলো স্বস্তিক। আবারো এগিয়ে বললো,

-তবুও তুমি মুসলিম। আমি মানি তুমি মুসলিম। আমি তোমাকে মানি তন্নি। আর তোমার ধর্মকেও।

….

-তোমাকে তোমার ধর্ম ছাড়তে হবে না তন্নি। ঘরে তুমি নামাজে তোমার আল্লাহ্কে ডেকো,আমি মন্দিরে গিয়ে আমার ভগবানকে ডেকে আসবো। তুমি রোজা রেখে দোয়া করো,আমিও উপোষ করে প্রার্থনায় বসবো। তুমি ঈদের চাঁদ দেখে আনন্দে মেতো,আমি না হয় পাড়ার পুজোমন্ডপে গিয়ে ধুনুচি নেচে আসবো। কিন্তু দিনশেষে মানুষ পরিচয়ে,দুটো মনের ভালোবাসা দিয়ে ঘর বাধবো আমরা।

….

-বাবাকে তো চেনো তুমি। বাবা কখনোই অমত করবে না,এটাও জানো। দুটো আলাদা ধর্মের মানুষের পরিবর্তে দুটো একই মনের মানুষ হিসেবে এক হবো আমরা। রেজেস্ট্রি ম্যারেজ। আমি বিদেশে ফিরতে চাইনা তন্নি। বাবাকে নিয়ে,তোমাকে নিয়ে,তোমাদের সবাইকে নিয়ে এই চিলেকোঠাতেই থাকতে চাই। আজীবন। তুমি চাইলে…তুমি‌ চাইলে আজই‌ বাবাকে বলবো আমি তন্নি। আজই!

-স্বস্তিক?

নিচতলা থেকে বাবার গলা শুনে একপলক তন্নির দিকে তাকালো স্বস্তিক। তন্নি হ্যাঁ সুচক উত্তরের প্রতিক্ষায় মুচকি হেসে চলে গেলো ও। তন্নির চোখ বেয়ে অনবরত জল গরাচ্ছে। অতঃপর শেষ বিকেলের নিবুনিবু রোদ্দুরটাও ডুব দিলো। দুর দালানগুলোর আড়ালে। নতুন ভোরের আলো হয়ে ফিরবে বলে।

থাইগ্লাস ভেদ করে চোখে বাইরের আলো এসে পরায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় আরাবের। নড়েচড়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেলো ও। ওর উন্মুক্ত বুকের মাঝে দোয়া গভীর ঘুমে আছন্ন। চাদর দিয়ে ঠিকঠাকমতো জরিয়ে নিলো দোয়াকে ও। ঘুমের ঘোরে আরো আস্টেপৃষ্টে আরাবকে জরিয়ে ধরলো দোয়া। দোয়ার চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে শান্তভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো আরাব। পর্দা বারবার উড়ে ওঠায়,জানালা দিয়ে আসা আবছা আলোছায়া খেলা করছে রুমজুড়ে। তাতে একবার স্পষ্টতর হচ্ছে দোয়ার চেহারা,তো একবার অস্পষ্ট। দোয়া চোখ বন্ধ রেখে ঘুমোঘুমো কন্ঠে বললো,

-আমাকে দেখে রাত কাটিয়ে দেওয়ার প্লান আছে নাকি জনাবের?

আরাব হাসলো। দোয়ার চুলগুলো মুঠো করে নিয়ে নাকে নাক ডলে দিয়ে বললো,

-এতো অল্পেই কেনো ঘুম ভেঙে যায় তোমার বলতো?

চোখ মেললো দোয়া। আরাবের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললো,

-কি করবো বলুন? চোখ বন্ধ করলেই দেখি আপনি এভাবেই আমাকে জরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

-তাই নাকি? তো ভালো তো। যখন কাছে থাকবো না,এভাবেই চোখ বন্ধ করে…

আরাব শেষ করার আগেই ওর ঠোটে আঙুল দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো দোয়া। চোখের কোনা বেয়ে জল‌ গরালো ওর। আরাব অবাকচোখে তাকিয়ে। দোয়া ধরা গলায় বললো,

-আপনাকে কাছছাড়া করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না আরাব।

আরাব হেসে ওর আঙুলেই চুমো দিলো। দোয়াকে ঠিকঠাকমতো বালিশে শুইয়ে দিয়ে একাধারে ওর কপাল,দুচোখ,নাক অতঃপর ঠোটে আলতোভাবে ঠোট ছোয়ালো। চোখ বন্ধ করে রইলো দোয়া। ওর মুখের উপর ঝুকে থেকেই আরাব বললো,

-আরাবের স্পর্শের মতো আরাবও তো তোমার সবটাতে মিশে আছে। জানো তুমি সেটা। যতই‌ দুরুত্ব আসুক,তোমার হৃদস্পন্দন,অনুভবে,আমি আছি তো!

দোয়া চোখ মেললো। ওর চোখে তখনও‌ কাতরতা। আরাব দ্বিতীয়বারের মতো ওর কপালে চুমো দিয়ে বললো,

-তোমাকে ছাড়া আমিও যে থাকতে পারি না কোথাও,বোঝো না তুমি এটা? পাগলামি কেনো করছো?

দোয়া আর কিছুই বললো না। আরাবকে জরিয়ে আস্তেধীরে মুখ গুজলো ওর বুকে। শুনশান চারপাশের আড়ালে বাইরে কোথাও রাতজাগা পেচার ডাক শোনা যায়। ডাক বললে ভুল হবে। ওটা যেনো কিছু হারানোর আর্তনাত। বিচ্ছেদের আহাজারি। আরো শক্ত করে আরাবকে জরিয়ে ধরলো দোয়া। পর্দার ওপারে দেখা যাওয়া জোৎসার আলো আজও বেশ উজ্জল। কিন্তু হৃদমন প্রসন্নে সক্ষম সে জোৎসায় আজ বুকভারি কেনো লাগছে? প্রনয়ী পায়রাগুলোর হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ কেনো শোনা যায়? সাদাকালো আলোছায়ার খেলা বুঝি রংধনুর রঙ কাড়তে চলেছে। দোয়ার কানে যেনো এমনই দীর্ঘশ্বাস স্পষ্টভাবে বাজলো।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here