এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -৫৯+৬০+৬১+৬২

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৯

আরাবের বিছানায় স্তব্ধ হয়ে বসে তৌফিকা। ওর দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। বিছানার উপরই কিছু কাগজপত্র,ফাইল,ছবি এলোমেলোভাবে পরে আছে। খোলা কাবার্ডের গোপন লকারটাও খোলা। টুইঙ্কেল গিয়ে লকারে ঝুলানো চাবির গোছাটা নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাজাতে লাগলো। ঝুমঝুম শব্দ করছে চাবিগুলো একসাথে এতে বেশ মজা লাগছে ওর। কয়েকবার চাবি বাজিয়ে মায়ের দিকে এগোলো টুইঙ্কেল। মায়ের সামনে তুলে ধরে আবারো বাজিয়ে বললো,

-দেখো আম্মু? চাবিগুলো কতো সুন্দর বাজে! আরাব মামা তো বলে উইশমামের চুড়ি আর ঝুমকোই সবচেয়ে সুন্দর বাজে! এটাও কতো জোরে বাজে দেখো? দেখো আম্মু?

তৌফিকা চুপ। টুইঙ্কেল বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো,

-উইশমাম আসার পর থেকে আরাব মামা আর ঘর এলোমেলো করে না বলে তুমি সব এলেমেলো করে দিলে আম্মু?

তৌফিকা তখনও চুপ। টুইঙ্কেল চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বিছানায় উঠলো। দুবার লাফিয়ে নাচের ভঙিমাও করলো চাবির শব্দে। এরমাঝে পায়ের নিচে থাকা ছবিটা চোখে পরলে ওটা তুলে হাতে নিলো ও। ঠিকঠাকমতো দেখে তৌফিকার গলা পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো। ছবিটা তৌফিকার সামনে তুলে বললো,

-আম্মু? আব্বুর সাথে এই আঙ্কেলটা কে?

ছবিটা সামনে আসতেই চোখ ফেটে জল গরিয়ে পরলো তৌফিকার। ছবিতে সজল,সুমন দুই জনের হাসোজ্জ্বল চেহারা। এই ক্রিমিনালটার মতো ওর বরও একটা ক্রিমিনাল,ওরা দুই ভাই,সত্যিটা আরেকবার আঘাত করলো অচল নিউরনে।
আরাব বায়োমেডিতে গিয়েছে। হুট করে তৌফিক ওয়াহিদ দোয়াকে অফিসে ডেকেছেন বলে দোয়াও বেরিয়েছে তাড়াহুড়ো করে। হসপিটাল থেকে টুইঙ্কেলকে নিতে এসেছিলো তৌফিকা। মায়ের সাথে ড্রয়িংরুমে কথা বলে হাসিমুখে এপ্রোনটা হাতে ঝুলিয়ে টুইঙ্কেলকে খুজতে খুজতে উপরে চলে আসলো তৌফিকা। আরাবের ঘরে ঢুকে দেখে ওদের কাবার্ড পুরোটা খোলা আর টুইঙ্কেল বসেবসে পেন্সিলে কোনো এক ফাইলে দাগাচ্ছে। হন্তদন্ত হয়ে ফাইলটা কেড়ে নেয় তৌফিকা। ও জানে টুইঙ্কেল খোলেনি কাবার্ড। কোনোভাবে দোয়া চাবি নিতে ভুলে গেছে আর টুইঙ্কেল এসে ওইটাই খেলনা বানিয়েছে। কিন্তু ওর হাতে থাকা সুমন,মুফতাহিরের জয়েন্ট একাউন্টের ফাইলটা দেখে নিজেকে সংবরন করতে পারলো না তৌফিকা। নিজে থেকেই আরাবের লকার খুলেছে। আর ওখান থেকে সব কাগজ,প্রমান বেরিয়ে এসেছে। যেগুলো উচ্চস্বরে বলছে,মুফতাহির সুমনের ভাই,মুফতাহির ওকে শুধু সম্পত্তির জন্য বিয়ে করেছে,মুফতাহির ঠকিয়েছে ওকে। ঠকিয়েছে!

-আম্মু? কাদছো কেনো তুমি?

-ও আম্মু? কাদছো কেনো?

….

-আজকেও আব্বু হসপিটাল থেকে এসে তোমাকে হাইপাপ্পি দেয়নি বুঝি?

-কেউ আব্বু হয়না তোমার টুইঙ্কেল! কোনো আব্বু নেই তোমার! বুঝেছো? তোমার কোনো আব্বু নেই! কোনো ঠকবাজ তোমার আব্বু হতে পারে না! কোনো যোগ্যতা নেই ওর তোমার আব্বু হওয়ার! কোনো যোগ্যতা নেই! বুঝেছো তুমি টুইঙ্কেল? আজ থেকে তোমার আব্বু নেই! বুঝেছো তুমি?

কাদতে কাদতে চেচিয়ে উঠলো তৌফিকা। টুইঙ্কেলের ছোট্ট হাতদুটো শক্ত করে ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কথাগুলো বলে ছেড়ে দিলো ওকে। মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে কাদতে লাগলো ও। আতকে উঠে বসেবসেই অনেকটা পিছিয়ে গেলো টুইঙ্কেল। সিড়ি বেয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওঠার সময় তৌফিকার চিৎকার কানে আসলো দোয়ার। একটু থেমে ছুট লাগালো রুমে ও। রুমে চোখ বুলিয়ে থমকে যায় দোয়া। মুফতাহির সুমনের একসাথে ছবি,দুজনের বিভিন্ন সার্টিফিকেটসসহ ওরা দুই ভাই যে এন্টিডোড কেলেংকারিতে সমভাবে জড়িত সবকরমের প্রমান,ফাইল বিছানায় ছন্নছাড়া হয়ে আছে। মুহুর্তেই আতংকে চোখ ভরে উঠলো দোয়ার। তৌফিকাকে কিছু বলার আগেই টুইঙ্কেল একছুটে এসে কোমড় জরিয়ে ধরলো দোয়ার। আজ পর্যন্ত কোনোদিনই তৌফিকা এমন ব্যবহার করেনি ওর সাথে। এতো উচুস্বরে কথা বলেনি ওর সাথে। আর আজ মায়ের এক অন্যরুপ দেখেছে ও। টুইঙ্কেল ভয়েভয়ে ফুপাতে ফুপাতে বললো,

-উ্…উইশ্…উইশমাম্…উইশমাম…আম্মু…

ওর অবস্থা দেখে মেঝেতে বসে টুইঙ্কেলেকে জাপটে জরিয়ে ধরলো দোয়া। দোয়ার কাধে মুখ গুজে ফুপাতে লাগলো টুইঙ্কেল। ওকে শান্ত করবে বলে দোয়া বড়বড় শ্বাস ফেলে বললো,

-শান্ত হও টুইঙ্কেল। শান্ত হও? এইযে উইশমাম আছে তোমার কাছে। এইতো উইশমাম! আম্মুকে বকে দেবে উইশমাম! শান্ত হও আমার লিটল স্টার? আম্মুর ব্যাড এন্জেলকে উইশমাম বকে দেবে তো? টুইঙ্কেল?

টুইঙ্কেল ঢলে পরলো দোয়ার কোলে। দোয়া জমে গেছে যেনো। সামনে আনতেই দেখে জ্ঞান হারিয়েছে টুইঙ্কেল। ছোট্ট হাতদুটোতে বিভৎস্যভাবে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে ওর। টুইঙ্কেল বলে চেচিয়ে উঠলো দোয়া। তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরলো তৌফিকা। দোয়া টুইঙ্কেলকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে ডাকছে আর কাদছে। তৌফিকা বিমুঢ়। দোয়ার কান্না শুনে এবার তৌফিক ওয়াহিদ আর তার মিসেস ছুটে আসলেন রুমে। টুইঙ্কেলকে অজ্ঞান দেখেই কাদতে লাগলেন মিসেস ওয়াহিদ। তৌফিক ওয়াহিদ নিজেও স্তব্ধ। তৌফিকার দিকে এগোতেই দোয়া চেচিয়ে বললো,

-আপু টুইঙ্কেল সেন্সলেস হয়ে গেছে!

হুশ ফিরলো যেনো তৌফিকার। দিশেহারার মতো এদিকওদিক তাকিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে ছুটলো ও। মেয়েকে জরিয়ে দুবার চোখেমুখে পানির ছিটা দিলো। কয়েকবার ডাকার পর আস্তেধীরে চোখ মেললো টুইঙ্কেল। কিন্তু স্বাভাবিক হলো না। কম্পিত ক্ষুদ্র শরীরটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো মায়ের কাছ থেকে। জাপটে জরিয়ে ধরে মুখ লুকালো দোয়ার কোলে। ফাকা কোল আর বিশ্বাসভাঙা মন নিয়ে তৌফিকা নিঃস্বর মতো তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। দোয়া কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তৌফিকাকে শান্তনা দেবে,নাকি টুইঙ্কেলকে সামলাবে,বুঝে উঠতে পারছে না ও। ভেতরটা থেকে অবুঝের মতো কেউ চেচিয়ে বলছে,সত্যের তান্ডব বড্ড ভয়ানক! বড্ড ভয়ানক!

ঘরে বসে মায়ের শাড়ি গয়না বের করে দেখছে স্বস্তিক। অরুনাভ মুখার্জী ফেরেননি এখনো। মেসের ছেলেগুলোও নেই। ফাকা নিচতলায় একাকী ঘরে শুধু স্বস্তিক। শাড়িটা হাতে নিয়ে ভাবছে স্বস্তিক,এই লাল বেনারসীটা রেজেস্ট্রির দিন পরতে বলবে ও তন্নিকে। তন্নি ধর্ম না বদলালেও,ওকে মানা করবে না। এটা ওর দৃঢ় বিশ্বাস। ওকে ছাড়বে না তন্নি। মুচকি হেসে গয়নাগুলো বাক্সে ঢুকাতে লাগলো ও। এরমাঝেই দরজায় নখের টোকা পরলো। চোখ তুলে তাকালো স্বস্তিক। হাতে একবাটি পায়েস নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ও। হাসি প্রসারিত হলো স্বস্তিকের চেহারায়। বললো,

-এসো ভেতরে?

-চাচীমা বললো আপনাকে দিয়ে যেতে। কাকাবাবুকে দিতে বারন করেছে।

স্বস্তিক এগিয়ে গেলো। বাটিটা ওর হাত থেকে নিয়ে বললো,

-এসো তন্নি? আমার ঘরে?

-আমি আপনার ঘরে কোনোদিনও আসবো না স্বস্তিক।

স্বস্তিক নিচদিক তাকিয়ে আরেকটু হাসলো। তন্নির ভালো লাগেনি ওই হাসি। আর আড়াল রাখতে চায়না ও কোনো। নিজেকে শক্ত করে বললো,

-আপনার যুক্তিগুলো আমাদের দুজনকে এক করার জন্য যথেষ্ট নয় স্বস্তিক।

মাথা তুললো স্বস্তিক। তন্নি বললো,

-হ্যাঁ,আপনাকে ভালো লাগতে শুরু করেছিলো আমার। আস্তেআস্তে আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছিলাম। কিন্তু কাল আপনার কথাতেই সেটা শেষ হয়ে গেছে স্বস্তিক।

স্বস্তিক বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। তন্নি স্বাভাবিক গলায় বললো,

-আপনার ভালোবাসি বলাতে আমি কতোটা কষ্টে ছিলাম,সেটা শুধু আমিই জানি স্বস্তিক। আমারো মনে হচ্ছিলো,আপনি ঠিকই বলেছিলেন। কাদছিলাম কারন ভালোবাসি বলাটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আর না সম্ভব ছিলো ভালোবাসি না বলা। কষ্টটা বেশি ছিলো,ভালোবেসেও বলতে পারছি না ভালোবাসি। কতো বাধা! কতোবড় বাস্তবতা! আমরা দুজন আলাদা ধর্মের দুটো আলাদা মানুষ!

-কিন্তু নিমিষেই আপনি আমার কষ্টটা গায়েব করে দিলেন স্বস্তিক। এটা বলে,আমি পিতৃপরিচয়ে মুসলিম নই। আর তবুও আপনি আমাকে মুসলিম মানেন। আমার ধর্মকে মানেন। আমার ধর্মসহ আমাকে আপন করতে চান।

স্বস্তিক মুখে জোরপুর্বক হাসি টানলো একটা। তন্নি চোয়াল শক্ত করে একপা এগোলো ওর দিকে। বললো,

-আপনি শেষ কথাগুলো হয়তো আমাকে ভালোবেসে বলেছিলেন স্বস্তিক। কিন্তু প্রথমে আমাকে আমার অনাথ পরিচয় মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যটা আলাদা ছিলো আপনার। আর তাতে আমার ক্ষনিকের ভালোলাগার সাথে কথিত ভালোবাসি না বলার কষ্টটাও গায়েব হয়ে গেছে স্বস্তিক। থ্যাংকস্ টু ইউ।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো স্বস্তিক। কোনোমতে বললো,

-ক্ কি বলছো তুমি এসব তন্নি?

-ভুল বললাম? সত্যি করে বলুন তো স্বস্তিক? আপনার প্রথমে আমার পরিচয় বলার কারন কি ছিলো স্বস্তিক? আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া,আমার নওমুসলিম হওয়ার সম্ভবনা আছে। আর সেটা মনে করে,আপনাকে ভালোবেসে আমি যেনো শুরুতেই ধর্মান্তরিত হতে রাজি হয়ে যাই। তাই নয় কি স্বস্তিক?

-না তন্নি! কি বলছো কি তুমি এসব?

-ক্ষমা করবেন। আমি তো এখানে আপনার ভুল ধরিয়ে দিতে এসেছি। কি বলুনতো? আপনি চেয়েছিলেন আগে আমি স্বীকারোক্তি দেই,আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসার জন্য আগে বিপরীত মানুষটাকে সম্মান করতে শিখতে হয়। কিন্তু আপনার কথায় আমার আপনার প্রতি সম্মানটা শেষ হয়ে গেছে স্বস্তিক। সেখানে আর যাই হোক,ভালোবাসা সম্ভব নয়। ভালোবাসি না আপনাকে। তাই রেজেস্ট্রি কেনো,আপনিও যদি ধর্মান্তরিত হয়ে আমার জীবনে আসতে চান,আপনাকে আমি কোনোদিনও স্বীকার করবো না। প্লিজ ভবিষ্যতে আর আমার সামনে আসবেন না। আপনার মনমানসিকতা জানতে পেরে গেছি তো,ঘেন্না করে চোখের সামনে আপনার মতো নিচ মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের চেহারা দেখলে। এতোটা নিচ আপনি? ছিহ্!

একছুটে বেরিয়ে গেলো তন্নি। ধপ করে মেঝেতে হাটুতে বসে পরলো স্বস্তিক। কি বলে গেলো মেয়েটা এসব? ও কখনো চায়নি তন্নি ওর ধর্মকে ছাড়ুক। কখনো চায়নি তন্নি ধর্মান্তরিত হয়ে ওর বউ হোক। কখনো ভাবেই নি ও এসব। টপটপ করে জল গড়াতে লাগলো ওর চোখ দিয়ে। হুট করেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো ওর ঠোটে। চোখের জল গরাচ্ছেই। তবুও হাসছে স্বস্তিক। তাচ্ছিল্যে হেসে তন্নির সবগুলো জবাবকে মস্তিষ্কে বসিয়ে নিলো ও। ওর বুঝতে বাকি নেই সবটাই অজুহাত ছিলো তন্নির। ও যেমন পারবে না নিজের ধর্মকে ছাড়তে,তেমনি চায়না আলাদা ধর্মের একটা মানুষকে নিজের জীবনে জড়াতে।
বিয়েটা যেভাবেই হোক,বিয়ের পর একদিন না একদিন,দুটো মানুষের কাউকে না কাউকে তো মানিয়ে নিতে হতোই। যেটা ও পারতো না,চায়নি স্বস্তিক সেটা করুক। তাই এসব অজুহাতে একেবারে দুরে সরিয়ে দিয়ে গেলো ও স্বস্তিককে। আর কিছুই নয়।
একসময় অট্টোহাসিতে ফেটে পরে বুকে হাত গুজে আবারো চিৎকার করে কাদতে লাগলো স্বস্তিক। ভালোবাসার দাবি নিয়ে আর যাবে না ও তন্নির কাছে। কোনোদিনও যাবে না। শুধু আফসোস একটাই। ধর্ম তো সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত্ব। আর ভালোবাসাও তারই দেওয়া এক পবিত্র উপহার। অন্যধর্মের কাউকে ভালোবাসাটা যদি এতোটা যন্ত্রনারই হবে,তবে সৃষ্টিকর্তা কেনো অন্যধর্মের কারো প্রতি এই পবিত্র অনুভবের উদ্ভব ঘটালো? কেনো?
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৬০+৬১

বাইক গ্যারেজে পার্ক করে টাইটা ঢিলে করে শার্টের হাতা টানতে টানতে বাসায় ঢুকলো আরাব। বাসায় ঢুকে ড্রয়িংরুমে মুফতাহির আর টুইঙ্কেল ছাড়া সবাইকে খুজে পেলো ও। তৌফিকা মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে। দোয়া অসহায়ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে। তৌফিক ওয়াহিদ নিজে শক্ত হয়ে বসে আছেন। মিসেস ওয়াহিদ আচল মুখে ফুপাচ্ছেন। আরাবকে আসতে দেখেই এগিয়ে আসছিলেন মিসেস ওয়াহিদ। তার আগেই উঠে দাড়ালো তৌফিকা। আরাব বেশ বুঝতে পারলো কিছু ঘটেছে বাসায়। বোনের দিকে এগোতে এগোতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-কি হয়েছে মা? সবাই এভাবে…

-আ্ আরাব…

-আমি বলছি।

তৌফিকা থামিয়ে দিলো ওর মা কে। উঠে দাড়ালো এবার ও। ওর হাতে থাকা পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজ দেখে কপাল কুচকালো আরাব। ওগুলো বাসায় পৌছে দিয়ে গেছে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না ও। এরমধ্যেই তৌফিকা দেখলো আরাবের পেছনে মুফতাহির এপ্রোন স্থেটোস্কোপ হাতে ভেতরে ঢুকছে মুফতাহির। শক্তভাবে পাসপোর্টটা একহাতে মুঠো করে নিলো ও। চোখ বেয়ে টুপটাপ দুফোটা জল বেরিয়ে আসলো ওর। বোনের চোখে জল দেখেই মাথা ফাকা হয়ে গেলো আরাবের। পেছন ফিরে মুফতাহিরকে দেখে চোখমুখে তীব্র রাগ ফুটে উঠলো। হাত মুঠো করে আবারো সামনে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোর চোখে পানি কেনো আপু?

….

-আপু কাদছিস কেনো বল!

-কাদছিস কেনো? কে কাদিয়েছে তোকে?

চেচিয়ে বললো আরাব। তৎক্ষনাৎ সশব্দে চড় পরলো ওর গালে। থমকে গেছে পুরো রংধনু। দোয়া আতকে উঠে কেদে দিলো। তৌফিক ওয়াহিদ তার কান্নারত মিসেসকে আটকালেন। গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রয়েছে আরাব। তৌফিকা কাদতে কাদতে বললো,

-তুই কাদিয়েছিস আমাকে! তুই ঠকিয়েছিস আমাকে! তুই আরাব! তুই!

আস্তেধীরে মাথা তুললো আরাব। দোয়া একপা এগিয়ে কম্পিতকন্ঠে বললো,

-আপু…

হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো আরাব। আঙুল নাড়িয়ে না বুঝালো ওকে। তৌফিকা বললো,

-একটা এতোটা নিকৃষ্ট মানুষের সাথে দিনের পর দিন সংসার করেছি। এতোগুলো দিন যাবত ভালো না বেসে শুধু টাকার জন্য আমাকে ঠকিয়ে এসেছে সে লোকটা। ভালোমানুষির মুখোশ পরে থেকেছে আমাদের সবার সামনে। আর তুই সেটা জেনেও আমাকে জানতে দিস নি আরাব!

….

-তার চেয়েও বড় কথা,সেই মানুষটা দোয়ার বাবার এন্টিডোড কেলেংকারীর জন্য দায়ী। ওই‌ লোকটার জন্য আট আটটে নিষ্পাপ শিশু মারা গেছে। ওই লোকটার জন্য দোয়া আজ পিতৃহীন। দোয়ার মা বিধবা। ওদের পুরো পরিবার এতো কষ্টে থেকেছে এতোগুলো দিন। ডক্টর সুমনের মতো সেই মানুষটাও চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। এই সবটা জানা তোর আরাব। আর সবটা জেনে তুই তাকে আইনের হাতে তুলে না দিয়ে এতোগুলো দিন আইনের হাত থেকে বাচিয়ে এসেছিস তুই আরাব! আইনকে ফাকি দিয়েছিস তুই! অপরাধ করেছিস তুই!

….

-দোয়া না হয় আমাকে ভালোবাসে,তোকে ভালোবাসে,টুইঙ্কেলকে ভালোবাসে,নিজের ভাইকে ভালোবাসে। তাই নিজের ভাইয়ের জীবন বাচানো লোকটাকে বাচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তুই কেনো লুকিয়ে গেলি আরাব? কেনো? শুধু বোনকে ভালোবাসিস বলে? বোনের সংসার বাচাবি বলে? এজন্য তুই এই জঘন্য লোকটার বিশ্বাসঘাতকতাকে মেনে নিলি? ওর অপরাধকে লুকিয়ে গেলি? ওর শাস্তিকে বাচিয়ে দিলি? বল আরাব? বল?

তৌফিক ওয়াহিদ বললেন,

-এতোবড় অন্যায় তোমার কাছ থেকে আশা করিনি আরাব। এতোগুলো দিন সত্যিটা লুকিয়ে তুমি আমাদের আরো বেশি দুর্বল করে দিয়েছো। আগে বললে…

আরাব মাথা নিচু করে বললো,

-আমি ওকে শাস্তি দিতাম বাবা। আপু দেশের বাইরে গেলেই আমি…

-কেনো? কেনো এতোদিন অপেক্ষা করবি তুই? যাতে আমি কষ্ট না পাই এজন্য? এতে আমাকে ঠকানো হলো না আরাব? ওই‌ লোকটা যদি মিথ্যে বলে আমাকে ঠকিয়ে থাকে,তুইও আমার কাছ থেকে সত্যিটা লুকিয়ে আমাকে ঠকিয়েছিস আরাব!

বোনের কথাগুলো শুনে আরাবের চারপাশে অদৃশ্য এক ঝড় বইতে লাগলো যেনো। দোয়া কাদছিলো। বলে উঠলো,

-আপু আরাব তো তোমার জন্যই…

-একটাও কথা নয় দোয়া। একটাও কথা নয়!

কড়া গলায় দ্বিতীয়বারের মতো দোয়াকে থামিয়ে দিলো আরাব। তৌফিকা দোয়ার দিকে তাকালো। ওর ভাই ওর জন্য দোয়ার সাথেও এভাবে কথা বলছে। দোয়ার দিকে এগিয়ে হাতজোড় করে বললো,

-আমাকে ক্ষমা করে দিস বোন। ক্ষমা করে দিস। আমার জন্য তুই ন্যায় পাসনি আজও। আমার জন্য তোর বাবা আজও‌ ন্যায় পায়নি। সবকিছুর জন্য আমার প্রতি আরাবের স্বজনপ্রীতি দায়ী! সবকিছুর জন্য আমি দায়ী! আমার জন্যই…

দোয়া ওর হাত জরিয়ে ধরলো। কেদেকেদে বললো,

-ওভাবে বলো না আপু। বলো না প্লিজ!

তৌফিকা এবার মুফতাহিরের দিকে তাকালো। মুফতাহির সবধরনের পরিবেশের জন্য প্রস্তুত এমন এক ভঙিমায় দাড়িয়ে শান্তভাবে তৌফিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর সামনে গিয়ে তৌফিকা দাতে দাত চেপে বললো,

-তোমাকে অপমান করতেও আমার রুচিতে বাধছে মুফতাহির। আমার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান জায়গাটায় বসিয়েছিলাম তোমাকে। বিনিময়ে এতোবড় মুল্য চুকাতে হলো আমাকে। ভালোবাসার বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতার বিষাক্ত ছুড়িকাঘাত…হাহ্! মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হয়,আমার ধারনার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানুষটা তার উদাহরন হয়ে গেলো।

-আমি যা করেছি,ক্ষমা প্রাপ্য না আমার। শাস্তি প্রাপ্য। শাস্তিই চেয়েছিলাম আরাবের কাছ থেকে। কিন্তু তুমি আর টুইঙ্কেল…

-টুইঙ্কেলের নাম নেবে না তুমি! নেবে না তুমি টুইঙ্কেলের নাম! আমার লাইফটা শেষ করে দিয়েছো তুমি! আমার মেয়ের জীবনে তোমার কুৎসিত ছায়াও চাইনা আমি! গট ইট?

উত্তেজিত হয়ে পরলো তৌফিকা। তৌফিক ওয়াহিদ গিয়ে জরিয়ে ধরলেন ওকে। কয়েকজন পুলিশ ভেতরে ঢুকলো তখনই। আরাব চুপচাপ দেখছে শুধু। তৌফিকা প্রমান পেয়ে পুলিশকেও ডেকেছে। আঙুল তুলে মুফতাহিরের দিকে তাক করে তৌফিকা বললো,

-এই ব্লাডি কার্লপ্রিটকে এখান থেকে নিয়ে যান এখনি অফিসার! এর সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করুন! এমনভাবে শাস্তি দেবেন একে, কাউকে ঠকানোর শাস্তি কতোটা ভয়ানক,তার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে যেনো! নিয়ে যান একে! নিয়ে যান!

কাদতে কাদতে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো তৌফিকা। দোয়া ছুটে গিয়ে জরিয়ে ধরলো ওকে। মুফতাহিরকে হাতকড়া পরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেলো পুলিশ। উপরের ঘরের দিকে তাকিয়ে ধুকতে ধুকতে চললো মুফতাহির। শেষবারের মতো টুইঙ্কেলকে দেখার ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর প্রচন্ড। কিন্তু তৌফিকার প্রতিক্রিয়ার জন্য কিছুই বলে উঠতে পারলো না। অনেকক্ষন চিৎকার করে কাদলো তৌফিকা। আস্তেধীরে আরাব বোনের কাছে হাটু গেরে বসলো। তৌফিকা সরে গেলো সাথেসাথে। চোখ মুছে,নাক টেনে দোয়াকে বললো,

-আমাকে একটা কথা দিবি দোয়া?

আরাব অসহায়ের চোখে তাকালো বোনের দিকে। আজ ওর বোন ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যাকে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে,সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আস্তেকরে বললো,

-আপু?

-একদম কাছে আসবি না আমার! কোনো আপু নেই তোর! আপু বলে ডাকবি না তুই আমাকে! তোর মতো এক অন্যায়ের প্রশ্রয়কারীর মুখে আপু ডাক শুনতে চাইনা আমি! শুনতে চাইনা! মরে গেছে তোর আপু! মরে গেছে!

চেচিয়ে বললো তৌফিকা। পাগলের মতো মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে উঠে দাড়ালো আরাব। এরইমাঝে টুইঙ্কেলের আওয়াজ আসায় সবাই উপরে তাকালো একবার। তৌফিকা দোয়ার দিলে ফিরে বললো,

-আজ তোর কাছে কিছু চাইবো দোয়া। আর তোকে তা দিতেই হবে!

দোয়ার চোখ দিয়ে জল গরাচ্ছিলো। শ্বাস আটকে বসে রইলো ও। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো,তৌফিকার এই একটা কথায় ওর সবটা বদলে যেতে চলেছে। সবটা! ভয়ে স্তব্ধ শরীরের অসাড় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর জমে যাওয়া রক্তসঞ্চালনেও দুচোখ তার দায়িত্ব পালন করেই চলেছে। সিক্ত নয়নযুগলে অশ্রু নির্বাধ!

রাতের গভীরতা বেড়েছে। সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিতে ভিজছে রাতের শহরের পিচঢালা পথ। হয়তো বাগানের ফোটা ফুলগুলোর গায়ে বৃষ্টির ফোটা পরে অসম্ভব সুন্দর কম্পন তুলে দিচ্ছে। আপাতত সে সৌন্দর্য র‌ধনুর কারো চোখে পরার নয়। ল্যাপটপের কিবোর্ডে অনবরত আঙুল চালাচ্ছে দোয়া। মাঝেমধ্যে ল্যাপটপের স্ক্রিন আর পাশের উন্মুক্ত ফাইলের পৃষ্ঠা উল্টে কিছু মিলিয়ে দেখছে। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটায় স্ক্রিনের উজ্জল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশেই টেডিবেয়ার জরিয়ে ঘুমোচ্ছে টুইঙ্কেল। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে চাদরটা আরো ভালোমতন গায়ে জরিয়ে দিলো দোয়া। আবেশে আরো ভালোভাবে শুয়ে পরলো টুইঙ্কেল। মুচকি হেসে চশমাটা চোখে ঠেলে দিয়ে আবারো কাজে মনোযোগ দিলো দোয়া। এরই মাঝে মিসেস ওয়াহিদ রুমে ঢুকলেন। টুইঙ্কেলকে ঘুমোতে দেখে দোয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

-ঘুমাবি না?

দোয়া মাথা তুলে তাকালো। মুখে হাসি ফুটিয়ে চশমাটা খুলে ফেললো ও। কোল থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে বললো,

-মা? ঘুমোও নি তুমি এখনো?

-যেখানে মায়ের সন্তান রাতের পর রাত নির্ঘুম থেকে কাটিয়ে দিচ্ছে,মা কি করে ঘুমোয় রে মা?

দোয়া মাথা নামিয়ে নিলো। আবারো চেহারায় হাসি ফুটিয়ে বললো,

-তাজীনের ছেলে হয়েছে মা। নিরব ভাইয়া টেক্সট করেছিলো।

মিসেস ওয়াহিদ ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলেন দোয়ার দিকে। দোয়া মুখ লুকোবে বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো,

-কিছুক্ষন আগে। ব্ বলছিলাম যাই,ওরা মানা করলো। এতো রাতে যেতে হবে না।

-আব্…তোমার ও্ ওষুধটা খেয়েছো? বাবা খেয়েছে ওষুধ?

-জানো মা? আজকে অফিসে কিছু ক্লায়েন্টস্…

-এভাবে আর কতোদিন দোয়া? আর কতোদিন এভাবে মরে মরে বাচবি তুই?

দোয়া আটকে গেলো। ও বেশ বুঝতে পারছে,মিসেস ওয়াহিদ আবারো সেই একই কথা বুঝাতে এসেছেন ওকে। ধীর গলায় বললো,

-চলো ঘরে পৌছে দিচ্ছি তোমাকে।

-আমার কোনো ঘর নেই!

-কি বলছো মা? এটাই তো তোমার ঘর,তোমার সংসার!

-আর তোর ঘর? তোর সংসার? তা কবে জুড়বি তুই দোয়া?

দোয়া উঠে দাড়ালো এবার। নিজের হাতজোড়া শক্তভাবে একত্র করে বললো,

-এসব কি বলছো তুমি মা? এ্ এটা তো আমারও ঘর।

-এটাকে ঘর বলে না দোয়া। না একে সংসার বলে। শুধু চার দেয়ালে আটকানো এক প্রকোষ্ঠ বলে। যে প্রকোষ্ঠে,একবিন্দু ভালোবাসা,একবিন্দু শান্তি তোর জন্য অবশিষ্ট নেই। তুইই শুধু আছিস। দায়িত্বের বোঝা বয়ে বেরাবি বলে। তোকে এভাবে আমি আর দেখতে পারছি না দোয়া! আর পারছি না!

মিসেস ওয়াহিদ কাদতে লাগলেন। দোয়া এসে কাধে হাত রাখলো তার। নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,

-দায়িত্বপালন কেনো মা? আমি যা করছি,ভালোবেসে করছি। জানো তো তুমি।

-কিন্তু যাকে ভালোবেসে করছিস,সে তো…এভাবে কতোদিন দোয়া? কতোদিন বলতে পারিস? আর কতোদিন চোখের সামনে তোকে একা একা টুইঙ্কেল,অফিস,রংধনু,আমরাদের সামলাতে দেখবো বলতে পারিস? যাদের জন্য তোর জীবনটা এলোমেলো,তাদের জন্যই‌ কেনো নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছিস তুই? ভুলে যা না সবটা! একটা নতুন করে শুরু কর? আমি কথা দিচ্ছি,আমি আর তোর বাবা তোর পাশে আছি। আজীবন থাকবো। আমরা জানবো,আমাদের একটাই মেয়ে। দোয়া। তুই আবার ব্…

-ঘরে যাও মা। চলে যাও এখান থেকে।

-কিন্তু দোয়া…

-প্লিজ মা! প্লিজ! আমি চাইনা টুইঙ্কেলকে নিয়ে,এতো রাতে,এই বৃষ্টিতে এ বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!

চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন মিসেস ওয়াহিদ। পারলেন না। আঁচলে মুখ ঢেকে কাদতে কাদতে উনি বেরিয়ে গেলেন দোয়ার রুম থেকে। এতোক্ষনে দোয়ার চোখের জল বেরিয়ে এলো। মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়লো ও। দম বন্ধ করে এভাবেই কান্না আটকে রাখা অভ্যেস হয়ে গেছে ওর এ আটমাসে। বিছানায় বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যালকনির দিকে তাকালো ও।ফুলগাছগুলোতে ফুল ফুটেছিলো। ঝড়ে গেছে। আগে ব্যালকনির ওই গাছের ফুল গোনা থাকতো দোয়ার কাছে। আর এখন শুধু দায়িত্বপালনে,গাছে পানি দিতে ব্যালকনিতে যায় ও। জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বসন্ত ওর অগোচরে পার হয়ে গেছে। সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া উপেক্ষিত হয়ে গেছে। কাঙ্ক্ষিত কৃষ্ণচুড়ার লাল,শ্রাবনের দক্ষিনা বাতাস সবকিছুর উপস্থিতি ফিকে পরে গেছে ওর কাছে। বাইরের বৃষ্টিটা দেখে ওর মনে পরলো,বৃষ্টিটা সেই শীতের অসময়ী বৃষ্টি নয়,সেই কাঙ্ক্ষিত কদমফোটা বর্ষারও বৃষ্টি নয় এটা। এ বৃষ্টি তো সেপ্টেম্বরের কোনো জমকালো অন্ধকার রাতের বৃষ্টি। যা নিরলসভাবে স্মৃতিচারনের চেষ্টারত। চোখ বন্ধ করে নিলো দোয়া। চোখের কোনা বেয়ে জল গরাচ্ছে ওর। বৃষ্টিপরা শব্দে দোয়ার নিশব্দ অশ্রুপ্রবাহ যেনো তাল মিলিয়ে বলে উঠলো,

‘ আমি আপনাকে অনুভব করতে পারছি আরাব। অনুভব করতে পারছি। আপনি যেখানেই আছেন,আমাকেই অনুভব করছেন তাইনা? ওইযে বলেছিলাম না? চোখ বন্ধ করলেই আপনাকে খুজে পাই আমার কাছে। খুব কাছে। ইচ্ছে তো করে চিরতরে চোখ বন্ধ করে নেই। যাতে এভাবেই আপনার সান্নিধ্য রয়ে যায় আমার কাছে। সবসময় শুধু আপনার অবয়বেই ডুবে থাকি আমি। কিন্তু কি করবো বলুন? অর্ধাঙ্গীনীর পরিবর্তে আপনার বলা সর্বাঙ্গীনীর পরিচয়ের জন্য এই দায়িত্বগুলো যে আমাকে চিরতরে ঘুমানোর অনুমতি দেয়ই না।
কেনো এমনটা করলেন আরাব? না চাইতেও আমাকে সবকিছু দিয়ে আপনি পরিপুর্ন করেছিলেন। আর যেইনা আমি কিছু চেয়ে বসলাম,আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন? কিই বা বেশি চেয়েছিলাম আমি বলুনতো? কি বেশি চেয়েছিলাম? শুধু আজীবন পাশে চেয়েছিলাম আপনাকে। সবসময় কাছে চেয়েছিলাম আপনাকে। সবকিছু দিলেও আমার একমাত্র চাওয়াকে রাখেন নি আপনি আরাব। রাখেন নি! আমার জীবনকে রাঙিয়ে,আবারো আপনার অনুপস্থিতি নামক অন্ধকার অতলে রেখে গেছেন আমাকে আপনি। আপনার অনুপস্থিতিতে আমার সবে রাঙা মনমাঝার আজ গুমরে মরছে আরাব,অন্ধকারাচ্ছন্ন,আধারে ডোবা কোনো *এক বেরঙ চিলেকোঠায়*…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৬২

লন্ডন! ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলো ইলশেগুড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত। ইট পাথরের বড়বড় দালানগুলোতে শেষ বিকেলের এ সময়ে প্রত্যেকেরই কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায় যেনো বহুগুনে। সবাই ছুটতে ব্যস্ত। যার যার গন্তব্য খুজে বেরাতে ব্যস্ত। মৃদ্যু বৃষ্টিপাত একদমই আটকে দিতে পারেনি সে গতিকে। সময়ের কাছ থেকে লাভের হিসেবটা বুঝে নিতে জানে এখানকার সবাই। এখানকার হাজারটা গাড়ি,মানুষজনের ভীড়ে,তাদের মতো ছুটতে অভ্যস্ত হয়ে যায় অচেনা মানুষগুলোও। আটমাস! সময়ের এক অতিদীর্ঘ লম্ফ!

ক্যাব থেকে নেমে রেইনকোটটা ঠিকমতো মাথায় টেনে দিয়ে বাসার দিকে ছুট লাগালো তৌফিকা। ব্যাগসহ দৌড়ে দরজায় পৌছে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়লো ও। রেইনকোট খুলে ছাড়া চুল,জামা ঝাড়তে লাগলো। সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিটায় আলাদা একটা শীতের আমেজ আছে। আগমনী শীতের শীতলতা মেশানো থাকে এই বৃষ্টির বাতাসে। ব্যাগ থেকে চাবিটা বের করে বাসার ভেতরে ঢুকলো তৌফিকা। ভেজা রেইনকোট,জুতাটা দরজার পাশে রাখতেই ফোন বেজে উঠলো ওর। কানের হেডফোনে কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

-টৌফিকা? আর ইউ হোম?

-ইয়েস ন্যানি? তুমি কোথায়? আর বলো না! ক্লাস শেষে এই বৃষ্টির জন্যই এভাবে…

ওপাশের ভদ্রমহিলা ইংরেজীতে বলে উঠলো,

-হ্যাঁ জানতাম! দু ঘন্টা যাবত তোমার প্রতিবেশীর বাসায় এসে বসে আছি। তোমার দেখা নেই। একটা কল করে জানাতে পারতে!

তৌফিকা জামার উপর থাকা কোট খুলতে ব্যস্ত ছিলো। প্রতিবেশী শুনেই ওর মুখে হাসি ফুটলো। নিজের কাজ করতে করতে বললো,

-ওহ্! জনের বাসায়?

-হ্যাঁ। আর কোথায় যাবো?

-তাহলে তো বেশ আপ্যায়নেই আছো! যাইহোক,এবার তো আমি চলে এসেছি। এখন চলে আসো এ বাসায়।

হুম শব্দে ভদ্রমহিলা ফোন কাটলেন। চেন্জ করে মাথার চুলগুলো উচুতে বেধে নিলো তৌফিকা। গেন্জি আর ল্যাগিংস পরে সোজা কিচেনে ঢুকলো ও। আপাতত এককাপ কফি হলেই চলবে ওর। তারপর ন্যানিকে নিয়ে শপিংয়ে বেরোবে। কিছু বই কিনতে হবে। রাতের রান্নাটা আজকে নাইবা করলো ভদ্রমহিলা। আটমাসে অনেক করেছে। আজকেও না হয় বাইরে থেকে খাবার আনাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই কফি বানানো শেষ করলো তৌফিকা। ডোরবেল শুনে কফির মগ হাতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো ও। ন্যানি ফর্সা গরনের এক সুস্বাস্থ্যবান মহিলা। খুবই মিশুক মহিলা ইনি। তৌফিকা মুচকি হেসে বললো,

-সারপ্রাইজ আছে আজ। কাম!

জোরপুর্বক হেসে ন্যানি ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু দরজা লাগালো না। তৌফিকা পেছন ফিরে দেখে দরজায় আরো একজন দাড়িয়ে। হাফ প্যান্ট,টিশার্ট পরিহিত গৌরবর্নের পুরুষটিকে দেখে মুখের প্রসারিত করে এগিয়ে গিয়ে ইংরেজীতে বললো,

-এই বৃষ্টিতে তুমি আসতে গেলে কেনো?

জন ইতস্তত করতে করতে বললো,

-এ্ একচুয়ালি,আইরাত…আব্…আই…আই হ্যাভ সামথিং ফর ইউ।

তৌফিকা কপাল কুচকে তাকালো। পাশে রাখা বইয়ের বান্ডিলটা তৌফিকার ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো। ইংরেজীতে বললো,

-বইগুলো কাজে দেবে তোমার। আসছি।

একমুহুর্ত দাড়ায় নি জন। চলে গেছে। তৌফিকা কিছু বলার সুযোগই পেলো না। বইগুলো খুলে দেখলো,যেগুলো ওর কিনতে যাওয়ার কথা ছিলো,ঠিক সেই‌ বইগুলোই দেওয়া ওতে। একটা ছোট শ্বাস ফেললো তৌফিকা। কিংস্টনের টপার এই ছেলে। লন্ডন এসে পিএইচডি শুরুর পর,গত আটমাসে ওর কাছ থেকে কতোরকমের সাহায্য পেয়েছে,তা শুধু ওই জানে। এই ভীনদেশে এসে,হাজারো অচেনা মানুষের ভীড়ে,এমন একটা বন্ধু না থাকলে হয়তো এতোদুর আসতেই পারতো না ও। ন্যানি বললো,

-ছেলেটা অনেক ভাবে তোমাকে নিয়ে।

তৌফিকা মৃদ্যু হেসে বললো,

-হুম।

-এখানে নতুন করে সবটা শুরু করা যায় না টৌফিকা?

-এসব কেনো বলছো ন্যানি?

-আমার মনে হয় জন পছন্দ করে তোমাকে।

ন্যানির দিকে তাকালো তৌফিকা। নিমিষেই ভরে উঠলো ওর চোখ। মুখে মুচকি হাসি রেখে বললো,

-আমি জানি তা ন্যানি। ওকে বলেওছি সবটা। একজনকে একাধারে এগারোটা বছর ভালোবেসেছি। সে যাই কিছু করে থাক না কেনো,আমি তো তাকে ভালোবেসেছিলাম। আর আমার সে ভালোবাসার এক ফুটফুটে পরিনতিও আছে। জনকে কেনো,কাউকেই নিয়ে নতুন করে শুরুর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আড়ালে থেকে,দুরে থেকেই টুইঙ্কেলকে হাসিখুশি দেখে আমি বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারবো। কোনো নতুন শুরুর প্রয়োজন নেই আমার! জন সবটা জেনেই শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে চেয়েছে আমার পাশে। ফিরিয়ে দিতে পারিনি।

-শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে পারবে টৌফিকা?

-জনের চেহারাটা দেখেছো?

ন্যানি চুপ রইলো। জনকে কতোটা কড়াকথায় বুঝিয়েছে তৌফিকা,আন্দাজে আছে ওর। বললো,

-পিছুটানেই যদি থেমে থাকবে,তাহলে কেনো সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে এসেছো? কেনো কাউকে জানতে দাওনি তুমি কোথায় আছো? কেনো তোমার সে ফুটফুটে পরিনতির কাছে নিজেকে মৃত বলে আখ্যা দিয়েছো টোফিকা? নিজের মেয়েকে আড়ালে থেকে কেনো দেখবে তুমি? কেনো নিজে হাতে আদর করবে না ওকে? হুয়াই?

….

-তুমিও জানো,তোমার একটা সিদ্ধান্তে কতোগুলো জীবন কষ্ট পাচ্ছে টৌফিকা। তুমি চাইলেই সবার সাথে থেকে,একটা হাসিখুশি,সুন্দর জীবনযাপন করতে পারতে। যে মানুষটা তোমার জীবন নষ্ট করেছে,তাকে ভুলতে তোমার সবটা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি তৌফিকা। হিট অফ দ্যা মোমেন্টে এতোবড় একটা সিন্ধান্ত নিয়ে ঠিক করো নি তুমি! একদমই ঠিক করো নি!

তৌফিকা মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ন্যানি ঠিকই বলেছে। হ্যাঁ ও ভুল করেছে। নিজের দায়িত্বগুলো থেকে পালিয়ে এসে চরম ভীতু প্রমান করেছে নিজেকে। তবুও টুইঙ্কেলকে নিয়ে নয়,ওর চিন্তাটা শুধু দোয়াকে ঘিরে। মেয়েটার সাথে এতোবড় অন্যায়টা না করলেও পারতো। কিন্তু ওই বা কি করবে? নিরুপায় ছিলো যে! ওই মুহুর্তে স্বার্থপর হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না ওর। কোনো উপায় ছিলো না!

সময়ের সাথে ব্যস্ততায় তাল মিলিয়ে চলছে চিলেকোঠার সবার জীবনযাত্রা। মেসের কেউকেউ চাকরি ছেড়েছে,সাথে চিলেকোঠাও। কেউকেউ আবার নতুন করে চাকরিতে ঢুকে চিলেকোঠায় এসেছে। তিনতলায় সদ্য বিয়ে হয়ে আসা দম্পতিটা,নতুননতুন বউ শহরে এসেছিলো ছেলেটা। ওরাও চলে গেছে কিছুদিন আগে। ওখানে এখন আরো একটা পরিবার থাকে। দুসন্তানের মা। মানুষগুলোর বদল ঘটলেও,ভালোবাসায় বদল আসেনি এ চিলেকোঠায়। আগের মতো সেভাবেই মিলেমিশে বেশ আছে সব। সদর দরজার সামনে গাড়ি থেকে নামলো দোয়া। আজ অনেকগুলো দিন পর আবারো এসেছে ও চিলেকোঠায়। চোখ তুলে প্রানভরে দেখে নিলো দালানটাকে। ভেতরে ঢুকে নিচ থেকেই ডাক লাগালো,

-মা?

দিয়ান ছুটে এসে বারান্দায় দাড়ালো। দোয়াকে দেখে তৎক্ষনাৎ বড়সর হাসি ফুটলো ওর চেহারায়। দৌড়ে নিচে নামলো ও। বোনকে জরিয়ে ধরে বললো,

-আপুনি? এসেছিস তুই?

ভাইয়ের কপালে চুমো দিলো দোয়া। কপাল কিঞ্চিত কুচকে বললো,

-হুম। আচ্ছা ছোটু? এখানেই যে দৌড়টা দিলি তুই,ওখানে গিয়ে দুষ্টুমি করছিস না তো?

-একদমই না। আমি কি দুষ্টুমি জানি নাকি?

-তাই না? আমি কিন্তু খোজ নেই তোর! যদি এতুটুকোও অব্জেকশন শুনেছি ছোটু,একেবারে নিয়ে আসবো ওখান থেকে কিন্তু!

-ঠিকাছে নিয়ে আসিস। আমারও আর মাকে ছাড়া,তোকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না আপুনি! দেখনা,মাত্র এক সপ্তাহের ছুটি দিয়েছে!

এটুকো বলেই দিয়ান গাল ফুলালো। মুচকি হেসে ওর গাল টেনে দিলো দোয়া। ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে এলো সকলে। দোয়ার পেছন থেকে তৌফিক ওয়াহিদ বললেন,

-কেমন আছো দিয়ান?

দিয়ান সালাম দিলো তাকে। হাসিমুখে বললো ভালো আছি। অরুনাভ মুখার্জী এগিয়ে আসলেন। ততক্ষনে টুইঙ্কেল ছুটে এসে বললো,

-এইযে গোপাল ভাড়! আমিও এসে গেছি!

-তোমাকেই তো আগে দরকার ঝিকিমিকি! তুমি আসলে তবেই না আমার চিলেকোঠা উজ্জ্বল হবে!

অরুনাভ মুখার্জীর কাছে গিয়ে দাড়ালো টুইঙ্কেল। দোয়া এগিয়ে বললো,

-কেমন আছেন কাকাবাবু?

-এইতো রে মা।

-কাকাবাবু?স্বস্তিক?

মাথা নিচু করে নিলেন অরুনাভ মুখার্জী।নিচতলার এক ঘর থেকে লাল শাড়ী পরিহিত মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক অল্পবয়সী মেয়ে বেরিয়ে আসলো। অল্পবয়সী মানে একেবারেই অল্পবয়সী। বয়স এই চৌদ্দ পনেরোর ঘরে হবে হয়তো। নাম,অনিন্দা। সত্যিই অনিন্দা ও। রুপে,গুনে,সহ্যশক্তিতে সত্যিই অনিন্দা। নিন্দার যোগ্য নয়। সিথি ভর্তি টকটকে সিদুর,হাতে শাখা,চোখে গাঢ় করে কাজল,কপালে লাল টিপ,পায়ে আলতা। দোয়াকে দেখে এগিয়ে এসে অনিন্দা মিষ্টিস্বরে বললো,

-কেমন আছেন দিদি?

দোয়া এগিয়ে গিয়ে ওর গালে হাত রাখলো। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। একে দেখলেও চাপা কষ্ট হয় ওর। এইতো কিছুদিন আগে। চিলেকোঠার পাশের এক গরিব হিন্দুঘরের মেয়ের বিয়ে ছিলো। মেয়ের বাবা ছেলেপক্ষের কোন এক দাবী মেটাতে না পারায় একেবারে বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যায় বরযাত্রী। মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা হতে দেখে মেয়ের বাবার আহাজারি সহ্য হয়নি অরুনাভ মুখার্জীর। আগে জানলে এই অল্প বয়সে মেয়েটার বিয়েই হতে দিতেন না উনি। শেষ মুহুর্তে পৌছে এই মেয়েকে ছেলের বউ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ন্তর দেখেননি উনি। ওনার একবাক্যে চুপচাপ রাজি হয়ে যায় স্বস্তিক। অনিন্দাকে বিয়ে করে চিলেকোঠায় নিয়ে আসে। আর পরপরই চাকরির কথা বলে রায়নগর ছাড়ে। তবুও অনিন্দা হাসিমুখে বউমাধর্ম পালন করে চলেছে। স্ত্রীধর্ম হয়তো বয়সের দোষে বুঝেই ওঠেনি। নয়তো স্বস্তিক বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়েছে ওকে। দোয়া বললো,

-ভালো আছি অনিন্দা। তুমি কেমন আছো?

-ভালো দিদি।

ওর অমায়িক হাসিটার দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। কতো নিষ্পাপ হাসিটা। কোনো অভিযোগ নেই ওই হাসিতে। এরইমাঝে সালমা বেগম বেরিয়ে আসলেন। তৌফিক ওয়াহিদের সাথে কুশন বিনিময় শেষে দোয়ার দিকে এগোলেন তিনি। মেয়ের দিকে তাকাতেই ভেতরটা খামচে ধরলো তার। বুকজুড়ে কতো কষ্ট! তবুও ঠোটে কতো সুন্দর সাজানো হাসি। ভেতরে সবসময় বয়ে চলা ঘুর্নিঝড় আর বাইরে কতো স্নিগ্ধ,মায়াময় চেহারা। একটা শুকনো ঢোক গিলে দোয়া বললো,

-কেমন আছো মা?

-ভালো।

দোয়া মুচকি হেসে মাকে জরিয়ে ধরতে যাচ্ছিলো। সালমা বেগম বলে উঠলেন,

-ভালো নেই এটা বলে বা তুই ভালো আছিস কিনা সেটা জিজ্ঞেস করে তোর এই কৃত্রিম হাসিটাকেও নষ্ট করে দিতে চাইনা দোয়া। এজন্য আমি ভালো আছি।

দোয়ার বুক ভারী হয়ে আসতে লাগলো। পাশে করুন চোখে তাকিয়ে থাকা তৃষাকে দেখে নিজেকে সামলে বললো,

-শুনলাম কল সেন্টারে পার্টটাইম চাকরি করছিস?

ও শুধু মাথা উপরেনিচে দুলালো। দোয়া বললো,

-তন্নি ফেরেনি?

-উহুম। এতিমখানায় সেই যে ওর জমানো টাকাগুলো দিতে গেলো,এখনও ফেরেনি। ফোন করেছিলাম। বললো থাকবে আরো কিছুদিন।

দোয়া আর কিছুই বললো না। এতোগুলো দিনে অনেককিছু বদলেছে। আর বাকিসবের সাথে হয়তো এ চিলেকোঠারও অনেককিছু অগোচরে রয়ে গেছে ওর। নিজেকে দোষারোপ করেও শান্তি মেলে না ওর। আদৌও কি ওর দোষ ছিলো? একাকী,আরাবকে ছাড়া কোনোদিন পেরেছে ও সবদিক সামাল দিতে? পারতো? নাকি এখন পারছে? দাতে দাত চেপে শক্ত হয়ে রইলো দোয়া। পাশে টুইঙ্কেল অরুনাভ মুখার্জীকে বলে চলেছে,

-জানো গোপাল ভাড়? আমি এখন পুরোটা সময় উইশমামের কাছেই থাকি। তুমি বিয়ের সময় বলেছিলে না উইশমামকে দেখে রাখতে? আমি কিন্তু দেখে রাখছি উইশমামকে। মেয়েটা খুব জেদি জানোতো! আমাকে জোর করে খাইয়ে দেয়,কিন্তু নিজেকে খাওয়াতে গেলে প্রতিবার বলে খিদে নেই। আমাকে সাজিয়ে দেয়,কিন্তু ওর কার্লি হেয়ারগুলোর একটুও যত্ম নেয়না। পড়া শেষে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়,কিন্তু নিজে একগাদা ফাইলের কাজ নিয়ে বসে যায়। ঘুমোয়ই না। আমি স্কুল থেকে আসলে আমাকে রেস্ট নিতে বলে। কিন্তু নিজে অফিস থেকে এসে আবারো কাজ নিয়ে বসে যায়। নানুভাইও কাজ কমিয়ে দিয়েছে এজন্য। আর দেখো উইশমামের চেহারার হাল! এমন হলে আরাব মামা এসে আমাকেই তো বকবে বলো?

দোয়া ছলছল চোখে ওর দিকে তাকালো। সবাই দোয়ার দিকেই তাকিয়ে। একটা শুকনো ঢোক গিলে চুপচাপ অরুনাভ মুখার্জীর ঘরের দিকে একপা দু পা করে এগোতে লাগলো দোয়া। খোলা দরজা দিয়ে ও ঘরের সেই বড় জানালাটা দেখা যায়। যেখানে প্রথমবার আরাব দেখেছিলো ওকে। যেখান থেকে এই চিলেকোঠায় রঙ লাগতে শুরু হয়েছিলো। যেখানকার মরিচাধরা লোহা আকড়ে থাকা দোয়ার হাত দেখে আরাব ভালোবাসা অনুভব করেছিলো।
আজ সে জানালা সুসজ্জিত,রঙিন। তবুও দোয়ার মনে হচ্ছে সবটা জমকালো আধারে ঢাকা। চারপাশে চরম শুন্যতা আঁকা। দোয়া শক্তভাবে মুঠো করে নিলো জানালার রড। একটা একটা মুহুর্ত ওর কাছে এখন কয়েকসহস্র যুগ বলে মনে হয়। মনে হয়,এ শুন্যতা খুব তাড়াতাড়ি ওকে শেষ করে দিতে চলেছে। খুব তাড়াতাড়ি!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here