এক মুঠো গোলাপ পর্ব ৮+৯

এক মুঠো গোলাপ
sinin tasnim sara
৮-৯

___
পুরো আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটা হলুদ শাড়িও পাইনি তারপরই মনে পড়েছে ওহ্ আচ্ছা আমি তো শাড়ি বেশি একটা পছন্দ করিনা। মা তো আমায় হাতে গোণা দু একটা শাড়ি কিনে দিয়েছেন তাও আবার জোর করে।
এক মুহুর্তের জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায়, ভাবি সে তো স্বপ্নে এসেছিল বাস্তবে নয়। বাস্তবে আমাকে ব্যাঙ বলার সাহস তো পাবেনা। কিন্তু পরক্ষণেই অন্য চিন্তা মাথায় আসে। কলিযুগ থেকেই শাড়ির ওপর মানুষের একটা দূর্বলতা আছে। শাড়ি পরে ফিটফাট হয়ে গেলে যতটা গুরুত্বটা পাওয়া যায় অন্য কাপড়ে ততটা পাওয়া যায় না। সিদ্ধান্ত নিই শাড়িই পরবো এবং প্রতিদিন শাড়ি পরেই যাবো ব্যাস।
কিন্তু শাড়িটা পরবো কার? আপুর আলমারি তো লক করা আর চাবি কোথায় আছে সে সম্পর্কে বিশেষ ধারণা নেই। মা ও বাসায় নেই। বেলা এগারোটার দিকে আর্জেন্ট কল আসায় বাপিসহ মেজো খালামণির বাসায় গিয়েছে, রাতের আগে তো ফিরবে না। তাহলে উপায়?
বসে বসে কতক্ষণ ভাবনা চিন্তা করতে করতে হুট করেই মনে পড়ে নবনীতার বড় বোন নতুন অনলাইন বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। সম্ভবত তারই গ্রুপ স্ক্রল করতে করতে সেদিন দেখলাম হাফ সিল্ক শাড়িও স্টকে আছে। দেরি না করে ফটাফট ডাটা অন করে ফেইসবুকে ঢুকে যাই। ভাগ্য আমার সহায় ছিল । সুলভমূল্যে একটা কাঁচা হলুদ রঙের হাফ সিল্ক শাড়ি পেয়ে যাই। যেহেতু আমাদের পাশের পাড়াতেই তাই আপু বলে বিকেলের মধ্যে শাড়ি পৌঁছে যাবে বাসায়।
তার কনফার্মড মেসেজ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ি আমি।
ফাইনালি নিদ্র সাহেবের হলুদ ব্যাঙ তার ঘাড়ে চাপতে যাচ্ছে ।
আচ্ছা তার যে ঘাড়ে চাপবো, সেটা লাফিয়ে নাকি সুরসুর করে?
নিজের লেইম জোক্সে নিজেরই হাসি পায়না। নিদ্র নামক স্বপ্নে বিভোর হয়ে কখন যে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাই বুঝতেই পারিনা৷
,
ঘুম ভাঙে ফোনের শব্দে। আননোউন নাম্বার দেখে রিসিভ করতে ইচ্ছে হয়না। ভুল করেই যেন চাপ লেগে রিসিভ হয়ে যায় আর অজান্তেই কন্ঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসে ছোট্টো একটা শব্দ, “হ্যালো”
ওপাশ থেকে নবনীর ফ্যাচফ্যাচে কন্ঠ ভেসে আসে_
— দোস্ত দরজা খোল আমি তোর বাসার সামনে।
আমি ভ্রু কুঁচকে না বোঝার মত প্রশ্ন করি_
— আমার বাসার সামনে তুই কি করবি?
— আরে বাবা তোর শাড়ি নিয়ে এসেছি। ব্যালকনিতে এসে দ্যাখ আমি নিচে দাঁড়িয়ে তোদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে আছি।
শাড়ির কথা শুনতেই আমার ঘুম উবে যায়। তড়িঘড়ি করে উঠে বাপিদের ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি ঠিকই ও নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করতে বলে ঘর থেকে চাবি নিয়ে পুনরায় ব্যালকনিতে গিয়ে গ্রীল দিয়ে ছুঁড়ে দেই চাবিটা।
ও মুখ ঝামটে বলে_ ছিঃ বান্ধবীকে রিসিভ করতে দোতলা বেয়ে নামতে পারলি না। অলস কোথাকার।
— তুই খুব কর্মঠ। জলদি তালাটা খুলে উপরে আয়।
ও আসতে আসতে চোখে মুখে পানি দিয়ে দরজা খুলে রাখি।
নবনী আসায় ভালোই হয়েছে। শাড়ি তো একা একা পরতে পারিনা। এবার ও ই হেল্প করবে।
,
আমাদের ব্যাচে সবচাইতে বাঁচাল মেয়েটা হলো নবনী। পুরো শহরের খোঁজ ওর কাছে। ওর এই নিউজ কালেক্ট করার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখেই আমরা ওকে “বিবিসি চ্যানেল” উপাধি দিয়েছি। ওর অবশ্যি নামটা বেশ পছন্দ , স্বীকারও করেছে।
,
আধ ঘন্টা বকবক করে আমার মাথা খারাপ করে দিলো নবনী৷ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ওকে বসিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেলাম।
ও ঘরে বসে বসেই চিল্লিয়ে টন্ট করতে শুরু করলো আমাকে।
ওর জ্বালায় অস্থির হয়ে কতবার ধমকও দিলাম কিন্তু নাহ্ ওর কথা থামে না।
এই নিদ্রর জন্য কি কিই না সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে। উফফফ….
____
আসরের আজানের একটু পর নবনী সহ একসাথেই বেরুলাম। রিকশায় উঠে বাপিকে জানাতে ভুললাম না যে আমি প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছি। বাপি মনে হয় ভীষণ ব্যস্ত,বেশি একটা কথাই বলতে পারলেন না।
ভালোই হলো। সওয়াল জবাব যত কম সুবিধা আমার ততই বেশি।
,
আভাদের বাসার গলিতে ঢোকার পর আমার হার্টবিট হুট করেই বেড়ে গেলো। নবনীও মাঝরাস্তায় নেমে গিয়েছে ওর জরুরি কাজ থাকায়।
একা আমি রিকশায় বসে বসে অতি উৎসাহে থর থর কাঁপছি।
রিকশা যখন বাসার সামনে থামলো তখন আমার কাঁপুনি আরো বেড়ে গেল যেন!
কাঁপা হাতে ভাড়া মিটিয়ে আভাকে কল করলাম।
আভা আমায় দেখে বিষম খেলো একটু।
চোখ বড় বড় করে বললো _
— মাই গড তোকে তো হলুদের প্রোগ্রাম থেকে পালানো হলুদ বউ মনে হচ্ছে ।
ওর কথায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
— হলুদের প্রোগ্রামে গাঢ় হলুদ শাড়ি পরানো হয়।
— হ্যাঁ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোকে কাঁচা হলুদ পরানো হবে। এই কালারটা স্যুট করে তোকে।
— আজাইরা কথা বাদ দিয়ে বল তো কেমন লাগছে আমাকে?
— আরে আসলেই হলুদ বউ লাগছে। খুব সুন্দর , ভেরিইই বিউটিফুললল..
শেষ শব্দ দুটো একটু বেশীই টেনে বললো আভা।
ওর হাতে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বললাম_
— চল ভেতরে চল?
ও হাসতে হাসতে বললো_
— সুপ্ত এই বিশ শতকে তুই কি প্রথম স্টুডেন্ট যে বরের থেকে ব্যাঙ উপাধি পাওয়া স্বপ্ন দেখে ড্যাং ড্যাং করে হলুদ শাড়ি পরে আসলি?
— হ্যাঁ আমিই প্রথম। গিনেজ বুকে হলুদ কালি দিয়ে লিখে দিস হয়েছে!
— মাই গড সুপ্ত। তোর তো দেখি লাজ লজ্জা সব হলুদ বাজারে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। নির্লজ্জের মত স্বীকারও করছিস।
— হ্যাঁ করছি। তোহ্?
— আই আ্যাম প্রাউড অফ ইউ।
ঠোঁট চেপে হাসতে শুরু করলো আভা।
কিছুই বললাম না আর বলবো ও না। বুঝেই তো গিয়েছি এই নিদ্রর সাথে থাকতে গেলে আরো কত কিছু সহ্য করতে হবে আমাকে।
আভার সাথে রাগ করে একা একা সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে গেলাম। দরজা টা খোলাই ছিলো এবং চৌকাঠে দাঁড়িয়েই দেখা যাচ্ছিল সোফায় কালো গেঞ্জি-প্যান্ট পরে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে মোবাইল চাপছে নিদ্র।
প্রথমে এসেই যে ওকে দেখতে পারবো এরকম কিছু কল্পনা করিনি আমি।
এতদিন বাদে চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেয়ে কেমন করে উঠলো ভেতরটা। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমতে শুরু করলো। সন্তপর্ণে টিস্যু চেপে চোখের পানি মুছে নেয়া মাত্র আন্টির ডাক পড়লো।
মাথা তুলে দেখি জলদি জলদি পা ফেলে আমার দিকেই আসছেন আন্টি। আমি স্বাভাবিক হয়ে ওনাকে সালাম দিলাম।
সালামের জবাব দিয়ে উনি আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। চোখে মুখে বিস্ময়ভাব ফুটিয়ে বললেন_
— ও’মা সুপ্ত তোকে শাড়িতে কি দারুণ লাগে রে। একদম হলুদ বউ হলুদ বউ মনে হচ্ছে ।
তা হুট করে শাড়ি পরলি যে? কোথাও যাবি?
— এইতো তোমাদের বাসায় এলাম।
— ইশশ খুব ভালো করেছিস। কি মিষ্টি লাগছে তোকে।
গাল টেনে চুমু খেয়ে বসলেন আন্টি। আমি আন্টির সাথে কথা বলার ফাঁকে চোরা চোখে নিদ্রর দিকে তাকাচ্ছি। সে মাথা উঁচু করে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনের দিকে তাকালো, দু সেকেন্ড পর আবারও তার দৃষ্টি আমাকেই আকর্ষণ করলো। সে এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে।
আমিও মুখ ঘোরালে তার চোখে চোখ পড়ে গেলো।
সব কিছু ভুলে আমি বেহায়ার মত তাকিয়ে রইলাম তার চোখের দিকে।
একবার মনে হলো আন্টি আমায় বসতে বললেন। আমি মাথা নেড়ে নিদ্রর অপজিট সোফায় বসে পড়লাম।
বসা মাত্র আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো নিদ্র।
পুনরায় মোবাইলে মননিবেশ করে ছাড়া ছাড়া গলায় প্রশ্ন করলো_
— কই যাও সুপ্ত?
— কই আবার এখানেই এলাম। আপনার সাথে দেখা করতে৷
— আমার সাথে দেখা করতে?
— আরে আপনি তো আমাদের আইসিটি টিচার।
ঐ দেখা করতে মানে পড়তে এসেছি।
— পড়তে এসেছো এই লুকে? তোমাকে তো হলুদের আসর থেকে পলাতক বউ মনে হচ্ছে ।
নিদ্রর মুখেও সেম কথা। উফফ..
আমি গরম চোখে তাকালাম তার দিকে।
সেও পুনরায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অদ্ভুত এই ছেলের ভ্রু কোঁচকানো রোগ আছে নাকি?
— দেখুন আপনারা সবাই কিন্তু ভুলভাল কথা বলছেন। হলুদের প্রোগ্রামে বউদের এত সিম্পল সাজ দেয়া হয়না কখনোই ।
— এটা সিম্পল সাজ?
— ইয়েস অফকোর্স।
— আয়নায় নিজেকে দেখেছো একবার?
— হোয়াট ড্যু ইউ মিন! আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন।
— উঁহু সত্যি বলছি বিশ্বাস না হলে ঘরে যাও আয়নায় দেখো। কত ভারী সাজ দিয়ে এসেছো।
— সাজগোজের আপনি কি বোঝেন হ্যাঁহ? আমি এভাবেই সাজি আর সাজবো। প্রতিদিন এভাবেই শাড়ি পরে সাজুগুজু করে আসবো হুহ্
— তুমি এত ঝগড়ুটে কেন সুপ্ত৷ আমি কিন্তু তোমায় ভালো কথা বলছি।
— ভালো খারাপ বুঝি আমি।
মুখ বাঁকিয়ে বললাম।
আমি মোটেই বউদের মত সাজুগুজু করে আসিনি। শুধু পাউডার মেখে টিপ পরে এসেছি আর হালকা লিপস্টিক দিয়েছি। তাতেই কি বউয়ের সাজ হয়ে গেলো! এদের কথা শুনে রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে আমার।
ফুঁসতে ফুঁসতে বিড়বিড় করে নিদ্রকে গালাগাল দিতে দিতে হঠাৎ আমার মনে হলো কোমরের কাছে থেকে শাড়িটা সরে গেছে, ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে আর সেফটি পিনের চাপ বাড়ছে। হাত পেছনে দিয়ে দেখলাম ঠিকই তো। এখন কি হবে?
আভাটা কোথায় গেলো!
আশেপাশে আভাকে খুঁজছি কিন্তু সে নেই।
আমার অস্থিরতা দেখে নিদ্রর দৃষ্টি প্রখর হলো। আমি ওর দিকে না তাকিয়েই মনে মনে বললাম_
“তোমার হলুদ ব্যাঙ বস্ত্র বিহীন দিগম্বরী হতে চলেছে। চোখটা বন্ধ করে নাও নইলে ঝলসে যাবা”

এক মুঠো গোলাপ

____
নিদ্র শিক্ষক হিসেবে ভীষণ স্ট্রিক্ট এবং রুড।
স্বপ্নে দেখা বাঁশের সেই এক হাত লম্বা কঞ্চিটা নিয়ে পড়তে বসায়। এক ভুল দু’বার করলে সপাং করে মার পড়ে হাতের ওপর। অবশ্যি আমি এখনও পড়ায় ফাঁকি দিয়ে মার খাইনি, বেচারি আভা অনেক খেয়েছে সেই প্রথমদিন থেকে।
মারের ভয়ে ও পড়ার টেবিলে বসতেই চায়না। জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে বসাতে হয়। নিদ্র বই খুলতে বললেই ওর কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। পুরো সময়টা আমি দর্শকের ভূমিকায়। নিদ্র আভাকে ধমকায়, আমাকে ধমকায়। আভা কাঁদে আর আমি বিমুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। মানুষটা রাগলে তার পুতুলের মত চোখজোড়ার পিঙ্গলাভ মণির রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। দেখতে দারুণ লাগে।
আমি এমন হা করে তাকিয়ে থাকলে সে আলতো করে কঞ্চির বাড়ি দেয় হাতের ওপর। আমার কাছে কঞ্চির বাড়িও ফুলের টোকা মনে হয়। আমি লজ্জা পেয়ে খাতায় মুখ গুঁজি।
ঘসঘস কলম চালিয়ে সুন্দরভাবে মনের কথা লিখি। প্রাইভেট শেষে আরক্ত মুখে খাতাটা তার হাতে ধরিয়ে বেরিয়ে যাই। সে ঐ মুহুর্তে তো কিছু বলেনা কিন্তু পরদিন এর শাস্তিস্বরূপ একগাদা অংক করতে দেয়। অংক কমপ্লিট না হলে বাসায় বলে দিবে এমন ভয় দেখায়। আমি ভয় পাইনা কিন্তু অভিনয় করি ভীষণ ভয় পাচ্ছি।
ভয় পেয়ে সব অংক করে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম না। আমার কিশোরী মন এমন অবস্থায় যে, সে আমার বড় আকাঙ্ক্ষার মানুষ। ভালোবাসা নামক বিশাল সাম্রাজ্যের একমাত্র অধিপতি। আমি তার সব কথা শুনতে বাধ্য। ভালো খারাপ যা-ই হোক না কেন আমি শুনবো এবং অবশ্যই শুনবো।
এভাবেই দিনগুলো যাচ্ছিল আমাদের৷
আমার প্রপোজাল পেয়ে সে হ্যাঁ না কিছুই বলতো না, একদম নিস্তব্ধ থাকতো। মাঝেমধ্যে আমি অস্থির বোধ করতাম। কিছু তো একটা বলুক?
সে কি না বলবে? উঁহু চান্সই নেই। আমার মত সুন্দরী, ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে আর পাবে নাকি একটাও!সে হয়তো এইচএসসি পরীক্ষা কমপ্লিট হওয়ার জন্য ওয়েট করছে। পরীক্ষা শেষ হলেই আমাকে এক্সেপ্ট করে নিবে। এরকম কনফিডেন্স নিয়ে আমি চলাফেরা করি।
,
বিকেল বেলা প্রাইভেটে গিয়ে দেখি আভার ভীষণ জ্বর। এক মুঠো ঔষধ খেয়ে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে সে। আন্টি আমায় ওর পাশে একটু বসতে বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন। চোখ মুখের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছিলাম আভার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি বেচারির ।
ঘরটাও ঠিকঠাক গোছানো নেই। ব্যাগটা এক সাইডে রেখে টুক টুক করে ঘরটা গুছিয়ে দিলাম। মনটা তো নিদ্র নিদ্র করছে কিন্তু কোন বাহানায় যাবো তার কাছে?
এই সময় বাসায় আমি আন্টি আর আভা ছাড়া কেউ নেই কিন্তু ওপর তলায় তো ঠিকই নিদ্রর বাবা-মা আছেন?
নিদ্রর বাবা গম্ভীর মানুষ । দেখলেই ভয় লাগে। এ যাবৎ আমার সাথে দেখা হয়েছে সম্ভবত তিন চারবার। সালাম দেয়া ছাড়া বাড়তি কোনো কথা হয়নি ওনার সাথে। সালামটাই যে কঠিন গলায় নেন অন্য কথা বলার সুযোগ কই!
— কখন এসেছিস সুপ্ত?
আভার কথায় আমার চিন্তার রেশ কাটে।
বিছানায় ওর পাশে বসে বলি_
— আধ ঘন্টা হবে। তুই এত জলদি উঠে গেলি!
— ঘুমটা ভেঙে গেলো হুট করে।
— জ্বর বাঁধালি কীভাবে?
— কাল রাতে শাওয়ার নিয়েছিলাম রাতে। আবার বাবা ঢাকা থেকে ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ে এসেছিল । একা বসে সাবাড় করে দিয়েছি।
আজ ফলাফল তোর সামনে।
— মানে বডির ওপর কোনো অত্যাচারটা বাকি রাখিস নি!
আভা মাথা দুলিয়ে হাসলো।
— আঙ্কেল আবার ঢাকায় গেলেন কবে?
— পরশু রাতের গাড়িতে।
— অফিশিয়াল কাজে?
— উঁহু তোর সতীন আনতে।
— মানেহ্?
— মানে…
আধশোয়া হয়ে বসলো আভা। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো_
— তোকে তো বলাই হয়নি। তোর সংসারটা মনে হয় তৈরি হওয়ার আগেই ভেঙে যাবে।
আমি বিরক্ত হলাম। ওর চোখ মুখের এক্সপ্রেশন পছন্দ হচ্ছে না আমার। বিরক্তমাখা কণ্ঠে বললাম_
— ঝেড়ে কাশ তো।
— কথা হচ্ছে নিদ্র ভাইয়ার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। পাত্রী হলো ওর মামাতো বোন নুহা। তোকে তো বলেছিলাম চাচ্চুর সাথে ডিভোর্সের পর চাচি তার ভাইয়ের বাসায় উঠে যান৷ নিদ্র ভাইয়া আর নুহা আপু সমবয়সী। অনেক ছোটো থেকেই নুহা আপু ভাইয়াকে ভালোবাসেন কিন্তু কখনো বলতে পারেননি। যখন ভাবলো বলবে তখন নিদ্র ভাইয়া তার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে। ভাইয়ার সুখের কথা চিন্তা করে বেচারি আর এগোয়নি। কিন্তু এই কয়েকমাস আগে সামহাউ ভাইয়ার রিলেশন টা ভেঙে যায়। ভেতর থেকে ভাইয়াও খুব ভেঙে পড়ে। ভাইয়াকে এমন কষ্টে দেখে নুহা আপু চিন্তা করে তার দায়িত্ব নিবে।
এজন্যই প্রস্তাব পাঠায়। ভাইয়া অবশ্য শুরুতেই না করে দিয়েছিল। শুনেছি চাচি নাকি খুব রাগারাগি করেছে ভাইয়ার সাথে। ভাইয়া না বলেই আমাদের বাসায় চলে এসেছিলো।
কিন্তু মা কে ছাড়া কতদিন থাকবে? ভাইয়া কিন্তু চাচিকে ভীষণ ভালোবাসে।
চাচিও তার ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেন না৷
মান অভিমান শেষ হলে ভাইয়া আবারও ব্যাক করে ঢাকায়। দ্বিতীয়বার রংপুরে আসার কথা ছিলো না। আমি জোর করায় এসেছে।
— সৃষ্টিকর্তাই তাকে নিয়ে এসেছে আমার জন্য।
শোন ঐসব বিয়েশাদি ক্যান্সেল। আমাকে ছাড়া অন্য কারো চিন্তা মাথায় আনলেও ওকে খুন করবো আমি।
— প্রেমের চক্করে এবার খুনি হয়ে যাবি?
— হ্যাঁ দরকার হলে তাই হবো।
— তবে বিয়ের কথাবার্তা কিন্তু শক্তপোক্ত ভাবেই উঠেছে বুঝলি?
— আমি বুঝে কি করবো? তুই বোঝ যাতে ভাঙতে সুবিধা হয়। তুই যদি কিছু করতে না পারিস, আমি যদি ওকে না পাই তাহলে কিন্তু গলায় দড়ি দিবো বললাম। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম আমি।
— পাগল হয়ে গেলি নাকি তুই? কান্নাকাটি করিস না। দেখি কি করা যায়!
— দেখি না কর..
— সুপ্ত?
আমার কথার মাঝেই আন্টির ডাক পড়লো।
আমি “জ্বী” বলে উঠে দাঁড়ালে আন্টি বললেন_
— তোর নিদ্র ভাইয়া এক্ষুণি তোকে ডাকছে। কি যেন ইম্পর্ট্যান্ট নোট দিবে।
— কোথায় আছেন উনি?
— আশিকের ঘরে আছে।
— উনি এখানেই আছেন?
— হ্যাঁ। এখানেই তো থাকে। যা তো শুনে আয় ওর কথা।
— আচ্ছা যাচ্ছি ।
আভার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ও চোখের ইশারায় বললো আমি যাতে মনের কথাটা জানিয়ে দিই নিদ্রকে। এদিকে ও তো জানেনা সেই কাজ আমি অনেক আগেই করে ফেলেছি চিরকুটের মাধ্যমে।
____
মেঝেতে বইখাতা ছড়িয়ে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে নিদ্র।
এত এত বই দেখে মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ বিদ্যাসাগর। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মনযোগ ল্যাপটপে!
ভ্রু কুঁচকে আমি দরজায় নক করলাম। মনিটরে চোখ রেখেই সে হাতের ইশারায় ভেতরে ডাকলো।
আমি গিয়ে একটা সোফায় বসলাম।
— ডেকেছিলেন স্যার?
আমার সম্বোধনে সে মাথা তুলে তাকালো। চোখ বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে থাকলো মুখের দিকে।
এমন এক্সপ্রেশনের অবশ্য কারণ আছে।
পড়া শুরু হয়েছে থেকে এ অবধি আমি ওনাকে কোনো সম্বোধনেই ডাকিনি। প্রয়োজনে “শুনুন না” বলে ডেকেছি হয়তো।
আজ হুট করে স্যার বলায় স্বভাবতই ঝটকা খেয়েছে ।
তবে বেশিক্ষণ মুখভঙ্গি একরকম থাকলো না। ।
দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে খু খু করে একটু কাশলো।
বললো_
— সুপ্ত আই নিড ইওর হেল্প।
— আমি কোনো হেল্প করতে পারবো না।
সাথেসাথেই জবাব দিলাম আমি।
পুনরায় ওনার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো।
— কেন পারবা না?
— আমি আপনাকে হেল্প করবো কেন?
— এতে কিন্তু তোমারও লাভ আছে।
— আপনাকে হেল্প করার মধ্যে আমার লাভ থাকতে যাবে কেন!
— আগে শুনে তো নাও।
— শুনে,না শুনে কোনো পরিস্থিতিতেই হেল্প করবো না৷
— ভেবেচিন্তে বলছো তো?
— ইয়েস অফকোর্স। আমি আপনাকে হেল্প ক র তে পা র বোও নাআআ…
— ওকে তাহলে যাও।
যাও শুনেও আমি বসে রইলাম। হুট করে আমার মনে হচ্ছে যদি বিয়েটা ক্যান্সেলের ব্যাপারে হেল্প চায়?
উশখুশ করে বললাম_
— আচ্ছা কি হেল্প?
— তুমি না বললে হেল্প করতে চাও না?
— মন চেঞ্জ করেছি। করবো হেল্প।
সে একটু হাসলো।
— এখানে আসো তিনটা ফর্ম আছে ফিলাপ করে দাও।
খাতায় সব ডিটেইলস লেখা আছে ফর্মে হুবহু তুলে দিবা।
আমি মাথা নেড়ে ওনার পাশে গিয়ে বসলাম।
ওনার সহ আরো দু’টো ছেলের ইনফরমেশন লেখা। এগুলো দিয়ে কি করবে ব্যাটা!
প্রশ্ন করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম।
একটা ফর্ম লেখার পর কলম নাচাতে নাচাতে প্রশ্ন করলাম_
— আপনার নাকি বিয়ে?
— আমিও শুনলাম।
— কি শুনলেন?
— আমার নাকি বিয়ে।
— মানে আপনার বিয়ে আপনি জানেন না!
— এতদিন জানতাম না। কাল রাতে জানতে পেরেছি।
— আপনি বিয়েতে রাজি?
— ফ্যামিলি রাজি , পাত্রী ভালো। আমার রাজি না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।
–ফ্যামিলি বললো আর আপনি ড্যাং ড্যাং করে রাজি হয়ে যাবেন! আপনার নিজস্ব কোনো মতামত নেই? আপনি কি মাম্মাবয়!
— মাম্মাবয় হতে যাবো কেন! বড়রা আমার লাইফ সেটেল করে দেয়ার কথা ভাবছেন। তাদের মতামতকে আমি প্রাধান্য দিবো না?
— অদ্ভুত আপনি বড় হয়েছেন। আপনার লাইফের ডিসিশন এখনো ফ্যামিলি নিবে কেন?
— ফ্যামিলি তো আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি। আমার মতামত জানতে চেয়েছে।
— আপনি কি রিপ্লাই দিয়েছেন?
— এখনো কিছু বলিনি।
— কি বলবেন?
— তুমি কি ধারণা করছো?
— আমি ধারণা করছি না। বলছি আপনি সোজা না করে দিবেন।
— কেন?
— কেন মানে! আপনি জানেন না কেন?
— কি জানবো?
জবাবে আগুনঝরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে।
আমার তরফ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে চাইলো। এমন ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো_
— কি?
— আমি করবো না আপনার হেল্প। যান বিয়েশাদি করে বউয়ের থেকে হেল্প নেন।
খাতা কলম আছড়ে ফেলে আমি উঠে পড়লাম। ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার।
ধপধপ পা ফেলে বেরোনোর পায়তারা করছি। দরজার মুখে আসতেই পিছু ডাক_
— সুপ্ত?
আমি ঘুরে তাকালাম না কিন্তু ঠিকই দাঁড়ালাম।
উনি চাপা হাসির সাথে বললেন_
— আমার কিন্তু এখন বিয়ে-শাদির প্ল্যান নেই।
— নেই কেন? বয়স হয়েছে না আপনার। বিয়ে করবেন না কেন! অবশ্যই করবেন। এখন বিয়ে না করলে আজীবন বিয়ে হবে না।
মাথা ঘুরিয়ে এতটুকু কথা বলে বেরিয়ে আসলাম।
অসভ্য ছেলেটা বিনিময়ে একটা গা জ্বালানো চাপা হাসি দিয়ে উঠলো।
আরো একবার বোধহয় আমার সম্পর্ক হতে হতে ভেঙে গেলো!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here