এক মুঠো প্রেম পর্ব -০৮

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ০৮

-অসুস্থতার ভান করে কি কাজ-কর্ম সব ফাঁকি দেওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি তোমার? বেলা যে গড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল আছে? রান্নাবান্না না করলে দুপুরের খাবারের কী হবে শুনি!

সকালের দিকে জ্বরটা কমে এলেও শরীরের দূর্বলতা কোনো অংশে কমেনি স্পৃহার। জ্বরটাও সম্পূর্ণ ছাড়েনি। আদ্রও কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। সেই সুযোগে-ই শাশুড়ী এসে অনেকটা হুকুমের সুরে কথা গুলো বললেন।

মিসেস সামায়রার কর্তৃত্ববাদী কথাগুলো শুনে তার দিকে দূর্বল চোখে তাকালো স্পৃহা। হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে বললো,

-কী কী কাজ করতে হবে, মা?

স্পৃহা ভেঙে ভেঙে আসা দূর্বল কন্ঠ শুনে মিসেস সামায়রার ভাবভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। তিনি আগের মতোই বললেন,

-কী কাজ তুমি জানো না? প্রায় একমাস হয়ে এলো এ বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছো! রোজ যেই কাজ গুলো কর, আজও তা-ই করবে। রান্না থেকে শুরু করে কিচেনের সব কাজ বাড়ির বৌ-দেরই করার নিয়ম।

স্পৃহা শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ভেবেছিল অসুস্থতার কারণে তার কাজের পরিমাণটা কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু সেটা আর হলো না।
__________________________

কফিশপের এককোণে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে স্পন্দন। অপেক্ষা জিনিসটা বরাবরই তিক্ত। স্পন্দনের কাছেও এই তিন অক্ষরের শব্দটা প্রচন্ড অপছন্দের। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এখন মেজাজটা চরমভাবে বিগড়ে গেছে তার। আশেপাশে সব প্রেমযুগলদের ভীড়ে নিজে সিঙ্গেল বসে হা-হুতাশ করলে যে কারোরই বিরক্ত লাগা স্বাভাবিক। ঘড়ির কাটা তিনের ঘর ছুঁইছুঁই। অথচ আহিরের তার সাথে দেখা করার কথা ছিল দুপুর দুটোয়। টানা একটা ঘন্টা লেইট। ভাবা যায়!!!

ঠোঁট গোল করে একটা শ্বাস ফেলতেই কেউ একজন ঝড়ের গতিতে এসে স্পন্দনের অপজিটে চেয়ার টেনে বসলো। স্পন্দন চোখ তুলে তাকাতেই আহির দাঁত কেলিয়ে বললো,

-ইয়ে আসলে… কাজে ফেঁসে গিয়েছিলাম, দোস্ত। তাই …

স্পন্দন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-তাই এক ঘন্টা লেইট করে এলি! তোর কোনো আইডিয়া আছে আমার এখন কতটা রাগ হচ্ছে? একটা কল দিয়ে জানাতে তো পারতি!

আহির চোখের চশমাটা ভালো করে নাকের ডগায় বসালো। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

-আসলে ভাবিনি এতোটা টাইম লেগে যাবে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সময় কোন ফাঁকে চলে গেল, বুঝতেই পারিনি।

স্পন্দন রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। তার রাগ সম্পর্কে আহিরের বেশ ভালো ধারণা আছে। তাই ওকে শান্ত হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ সময় দিলো। পরিস্থিতি অনূকূলে আসার আগে কিছু বলে আগুনে ঘি ঢালার মতো বোকামি করাটা আপাতত উচিত বলে মনে করলো না আহির।

বেশ কিছুক্ষণের নীরবতার পর স্পন্দন থমথমে গলায় বললো,

-তা কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? আর আমায় হঠাৎ দেখা করার জন্য ডাকলি কেন?

আহির ম্লান হেসে বললো,

-এ্যাম্বেসিতে গিয়েছিলাম।

স্পন্দনের গম্ভীর মুখটা হঠাৎ বদলে গেল। গম্ভীর চোখজোড়ায় এসে ভর করলো একরাশ কাতরতা। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-সব কাগজপত্র রেডি? সত্যিই মাইগ্রেট করছিস তুই?

আহির নিঃশব্দে হেসে কৌতুকের সুরে বললো,

-না। মিথ্যে। মিথ্যে মাইগ্রেট করছি আমি।

স্পন্দন রাগত স্বরে বললো,

-আ’ম নট জোকিং উইথ ইউ। সিরিয়াসলি বলছি।

-আমার দেশ ছাড়ার কথা শোনার পর থেকে এ নিয়ে কতবার প্রশ্নটা করেছিস তুই? হিসেব আছে?

-যে আশায় করি, সেটা তো সত্যি হয় না! একবারও তো বলিস না যে, তুই দেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিস না।

-অযথা মিথ্যে বলে কী লাভ? যেতে তো হবেই!

স্পন্দন নরম সুরে বললো,

-না গেলে হয় না?

আহির মাথা নিচু করেই হাসলো। হালকা মাথা নেড়ে বোঝালো, ‘না, হয় না। যেতে হবেই।’

বেশ কিছু সময় নীরবেই কেটে গেল। স্পন্দন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতো কাছের এই বন্ধুটা হঠাৎ তাকে ছেড়ে অদূরে পাড়ি জমাবে ভাবতেই নিজেকে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। আহির এদিক সেদিক তাকিয়ে হাসফাস করছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। অনেকক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে নিজের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে মুখ খুললো সে,

-স্পন্দন!!!

স্পন্দন একটু নড়েচড়ে বসলো। যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে সে৷ উদাস ভঙ্গিতে বললো,

-হুম, বল!

আহির ইতস্তত করে বললো,

-স্পৃহা এখন কেমন আছে?

এমন প্রশ্নে স্পন্দনের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। আহিরের মুখে স্পৃহার নামটা শুনতে ওর বেশ লাগে। সে কেমন যেন অনেকটা আদুরে গলায় নামটা বলে। আবেগমিশ্রিত কন্ঠের ডাকটায় আলাদা একটা মাধুর্য আছে যেটা আর কারো কন্ঠে খুঁজে পাওয়া যায় না। ভেবেই ভ্রু কুঁচকে বললো,

-ওর ব্যাপারে জানার তো কোনো অধিকার তোর নেই!

আহির অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। কাতর স্বরে বললো,

-প্লিজ!

চশমা দিয়ে ঢাকা ভেজা চোখ দুটোর দিকে পলকহীন তাকিয়ে স্পন্দন বললো,

-এতো কেন ভালোবাসিস?

আহির বলার মতো কিছু পেল না। ওকে কিছু বলতে না দেখে স্পন্দন বললো,

-এখনও বুঝতে পারছি না কেমন আছে আমার বোন! বিয়ের পরের দিন ও কিছু বলতে চাইছিল আমাকে। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হয়েছিল, তোর কথা-ই বলবে। কিন্তু বলেনি। তবে আমি যতটুকু খোঁজ নিতে পেরোছি তাতে মনে হয় না, পিহু ভালে আছে।

শেষের কথাটা যেন তড়াক করে আহিরের মস্তিষ্কে আঘাত করলো। অবাক চোখে তাকালো সে। স্পন্দন আবার বললো,

-পিহু নিজে আমায় কিছু বলেনি। আর কখনো বলবেও না। তুই তো জানিস ও কেমন মেয়ে! ‘ভাঙবে তবে মচকাবে না’- টাইপ মানুষ ও। সবটা নিজের মধ্যে চেপে রেখে সহ্য করার বিরল ক্ষমতা আসে ওর।

-তুই ওকে কষ্ট পেতে দেখেও কিছু বলবি না?

স্পন্দন হেসে বললো,

-সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছি। তার আগে কিছু করাটা বোকামি হবে।

আহির কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কিছু পেল না। তার তো ধারণা এটাই ছিল যে, স্পৃহা আদ্রের সাথে ভালো আছে। সেদিন ওদের একসাথে দেখে তো এমনই মনে হয়েছিল! কিন্তু এখন সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। নীরবতা ভেঙে স্পন্দন বললো,

-বিয়েটা কেন করেছিস?

আহির ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ভাবলেশহীন ভাবে বললো,

-কারণটা তোর অজানা নয়।

স্পন্দন শক্ত কন্ঠে বললো,

-আমি বিশ্বাস করি না। শুধু ঐ একটা কারণের অজুহাত আমাকে দেখাতে আসবি না। আ’ম ড্যাম শিয়র, তোর এমন কাজের পেছনে বিরাট কোনো সত্য লুকিয়ে আছে যা তুই প্রকাশ করছিস না।

আহির হাসলো। বুকে জ্বালাধরানো সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে শতসহস্র কষ্ট, অভিযোগ আর হতাশা। কিন্তু সেটা প্রকাশ করার পরিধিও সীমিত। অনেক বেশি সীমিত।
____________________________

সন্ধ্যায় পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এসেছে অনেক আগেই। টেবিলে বসে গালে হাত দিয়ে কলম কামড়াচ্ছে স্পৃহা। মাঝে মাঝে পড়াশোনা করতে প্রচুর বিতৃষ্ণা লাগে। কিন্তু যখন বহুদিন পর বই নিয়ে বসলে গাদা গাদা পড়া মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন সেই বিতৃষ্ণাবোধটা ইনফিনিটি লেভেলে চলে যায়। আপাতত স্পৃহার অবস্থাটা ঠিক সেরকম-ই।

-গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে কি পড়া হবে, ম্যাডাম?

আচমকা এমন কথা শুনে অনেকটা চমকে উঠলো স্পৃহা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো আদ্র এসেছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল সে।

-আপনি? আজ এতো তাড়াতাড়ি!

আদ্র ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,

-ভালো লাগছিল না অফিসে। তাই চলে এলাম।

-ওহহ!

আদ্র কিছু একটা ভেবে ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,

-আজ একজন এমপ্লয়ি ছুটি নিয়েছে চারমাসের জন্য। ছুটির কারণ কী জানো?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিরুৎসাহি ভঙ্গিতে বললো,

-আমি কীভাবে জানবো? আপনিই বলুন!

-তার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। এ্যাপ্লিকেশন দেখে ফার্স্টে আমি ভেবেছিলাম, সে নিজেই প্রেগন্যান্ট। পরে ভালোভাবে পড়ে দেখলাম যে, না। তিনি তার ওয়াইফকে এই সময়টাতে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ছুটি নিচ্ছেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও কিছুক্ষণ গভীরভাবে ভাবার পর বুঝলাম, ইট’স রিয়লি আ ওয়ান্ডারফুল থট!

আদ্রের সহাস্যে বলা কথাগুলোর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না স্পৃহা। আদ্র আনমনে বললো,

-বাবা হওয়ার অনুভূতিটা পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা অনুভূতি, তাই না? ছোট ছোট হাতে আঙুল ধরে ছোট ছোট পা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন আধো আধো কন্ঠে ‘বাবা’ বলে ডাকবে, তখন ঠিক কেমন অনুভূতি হয়? আমিও কিন্তু আমার বউকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য পাক্কা দুই বছরের ছুটি নেব, ফর শিয়র!!!

প্রথম কথাগুলো ভালো লাগলেও শেষের কথাটা শুনে স্পৃহা চোখ বড়বড় করে আদ্রের দিকে তাকালো।

# চলবে……

(🎀কপি করা নিষেধ🎀)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here