১.
যাকে এতোদিন নিজের বোনের স্বামীর নজরে দেখতাম তাকে কখনো নিজের স্বামীর নজরে দেখতে হবে সেটা কল্পনাই করিনি।বধূ বেশে বসে আছি ঠিকই কিন্তু ভয় লাগছে আরশ ভাইয়ার কথা ভেবে।এটা যে ইমোশনালফুল সত্যি সত্যি সুইসাইড না করে নেয়। ভাবতেই মাথাটা চক্কোর দিয়ে উঠলো।
হঠাৎ চারদিকে হইচই পড়ে গেল স্মৃতি আপু পালিয়ে গেছে।এটা শুনার পর আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম কারণ আমাদের প্লানিংয়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো কথাই ছিল না। তাহলে আপু পালালো কেনো?আমার এখনও মনে পড়ে যেদিন বিয়ে ভাঙার জন্য শেষবার আরশ ভাইয়ার সাথে দেখা করেছিলাম,
“কি হলো শালীসাহেবা কিছু তো বলো?আমি কিন্তু এখন টেনশনে হার্ট এট্যাক করব। ”
“ভাবছি।”
আমি এখনও নিজের চিন্তায় বিভোর ছিলাম আর টেনশনে নখ কামড়াচ্ছিলাম।আরশ ভাইয়া আবার বললো,
“আর কতক্ষণ? ”
এইবার মাথাটা চটে গেল তাই চিৎকার করেই বলে উঠলাম,
“এতো যদি পারো তাহলে তুমি ভাবো না আমাকে কেনো ডেকেছো। একেই নিজের চিন্তায় নিজে মরছি তার উপর তোমাদের ঝামেলা। ”
আরশ ভাইয়া এইবার নরম গলায় বললো,
“আহা আমার লক্ষ্মী বোনু এতো রাগ করতে আছে আমার বিষয়টাও একটু বোঝার চেষ্টা করো। ”
“হুম বুঝছি বলেই বসে আছি তোমাদের সাথে।আমাকে ভাবার সময় দেও। ”
কিছুক্ষন ভাবার পরই আমি চিৎকার করে উঠলাম,
“ইয়েস আইডিয়া পেয়েছি।”
আপু আর আরশ ভাইয়া একসাথেই বলে উঠল,
“কি?”
“পরিবারের সবাইকে সবটা বলে দি তারপর যা হবার হবে। ”
আরশ ভাইয়া বললো,
“নো ওয়ে সোহা। স্মৃতি আর আমার সম্পর্কের কথা জানলে কেউ মানবে না কারণ সবাই স্মৃতিকে ভাইয়ার জন্য চয়েজ করেছে সেখানে আমি কিভাবে বলব?”
আরশ ভাইয়ার সুর টেনে আপুও বললো,
“আরশ ঠিক বলেছে। তাছাড়া আব্বুকে তো চিনিসই। আব্বু কখনো প্রেম সমর্থন করে না। এটা জানলে হয়তো আমি আর আরশকে কখনো পাবোই না অন্যকিছু ভাব। ”
এদের দুজনের কথা শুনে আমি হতাশ হয়ে গেলাম আর বিরক্তির সাথেই বললাম,
“তাহলে তোমরাই ভালো কিছু ভেবে বের করো। তবে হ্যাঁ এতে যেন দুই পরিবারের সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে সেটাও মাথায় রেখো।কি আছে কোনো প্লান? ”
আরশ ভাইয়া আর স্মৃতি আপু একে অপরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুজনেই এক সাথে “না ” সূচক মাথা নাড়ালো।
“বেশ তাহলে আমি যেটা বললাম সেটাই হবে। ”
“কি হবে জানি না। তবে আমি যদি স্মৃতিকে না পাই তাহলে আমি সুইসাইড করব। ”
★
ব্যাস কথা এতটুকুই হয়েছিল। তাহলে আজ কেন এমন করল? এসব ভাবতে ভাবতেই আবার খবর পেলাম আমার বর পালিয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আপু আর আরশ ভাইয়া একই সাথে পালিয়েছে। এজন্যই আপু সকাল থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গোছগাছ করছিলো।আর আমি জিজ্ঞেস করতেই বলেছিল ঐ বাড়ি যাবে তাই সব গুছিয়ে নিচ্ছে। তখন আপুকে এতো স্বাভাবিক দেখে খটকা লেগেছিল।তারপর সাজার জন্য আমি যেই পার্লারে গেলাম সেটাতে না গিয়ে অন্য পার্লারে গিয়েছিলো যাতে তার পালাতে সুবিধা হয়।উফ ভাবতেই পারছি না যেই মানুষটা তাদের প্রেমে এতো হেল্প করল তাকে একবার জানালোও না যে তারা পালাচ্ছে। তখনই আমার মোবাইলের মেসেজ টোনটা বেজে উঠল। ফোন হাতে নিতেই স্ক্রিনে এলো,
“আমাকে মাফ করে দিস সোহা কোনো উপায় না পেয়ে পালাতে বাধ্য হলাম। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম বাবাকে সব কথা খুলে বলার কিন্তু যখনই কিছু বলতে যাই আমার গলা শুকিয়ে যায়। তুই তো জানিস বাবার রাগ। আর আরশকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। তাই চললাম।আমি ঠিক জানি আজকে হয়তো বাবা আমার উপর রাগ করে থাকবে তবে একদিন না একদিন ঠিকই মেনে নেবে। বাসার সবার দিকে খেয়াল রাখিস। আমি জানি তুই পারবি। লাভ ইউ সোনা। ”
মেসেজটা পড়েই আমার লুঙ্গী ডান্স দিতে ইচ্ছা করছিল। কারণ এই জবরদস্তির সম্পর্ক থেকে তো রেহাই পেলাম।নাহলে চারটা জীবন নষ্ট হতো। অন্যদিকে পরিবারের কথা ভেবে খারাপও লাগছিলো।এমনটা না করে সত্যিটা সবাইকে বলে দিলেই ভালো হতো। আমি নিচে নেমে এলাম। বিয়ে বাড়ির সব সানাই বন্ধ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের কানাকানি শুরু হয়ে গেছে। আমাকে দেখেই বাবা আমার দিকে ছলছল চোখে তাকালো। বাবার এমন চেহারা দেখে আমার হৃদয়ে ধক করে উঠল। আমার বাবা অনেক রাগি আর শক্ত মানুষ। উনাকে কখনো আমি এমন রূপে দেখি নি তাই আমার এতক্ষনের খুশিটা চোখের পানিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। নিজেদের ভালো করতে পরিবারকে কষ্ট দিয়ে দিলাম না তো?
তখনই ইমতিয়াজ আঙ্কেল বলে উঠলেন,
“দেখ ভাই যা হওয়ার হয়ে গেছে আমাদের দুই পরিবারের সম্মানই নষ্ট হয়েছে। আর বাকি যে সম্মানটা আছে সেটা বাঁচাতে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
আমার বাবা অবাক হয়ে বললেন,
“কি সিদ্ধান্ত? ”
“সোহাকে আমি শানের বউ করে নিতে চাই। ”
কথাটা শুনে বাবা কি করবেন জানি না তবে আমার দম আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা। শেষ পর্যন্ত এই অহংকারী, বদমেজাজি, উল্লুককে আমায় বিয়ে করতে হবে। ঠিক শুনলাম তো কানে?এই হনুমানকে বিয়ে করা আর নিজের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলানো দুইটাই সেম কাজ।
তখন আমার বাবা জনাব নজরুল ইসলাম আমার মতামতের কথা একবারও জিজ্ঞেস না করে নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্য আমার শ্বশুর মশাইয়ের কথায় সাঁই দিলেন। উপস্থিত একটা মানুষও আমার কথাটা জানতে চায়নি যে আমি কি চাই? সবাই সবার সম্মানের কথাটাই ভাবল। এখন তো মনে হয় স্মৃতি আপুই ঠিক করেছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। অবশেষে বাড়ির সবার সম্মানের কথা চিন্তা করেই আমি কবুল বলেই ফেললাম আর সবাই “আলহামদুলিল্লাহ” বললো।
বিদায়ের সময় সবাইকে ধরেই অনেক কাঁদলাম। কেন জানি আজ খুব কষ্ট হচ্ছে। আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“একদম ওই বাড়িতে গিয়ে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকিস। কেউ যেনো কখনো তোর ব্যবহারে আমাদের উপর আঙ্গুল তুলতে না পারে। ওই বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলবি। ”
তারপর শান ভাইয়ার হাতে আব্বু আমার হাত দিয়ে বললো,
“শান আমার ছোট মেয়েটা আমার অনেক আদরের। অনেক সময় অনেক কিছুই বুঝতে পারে না ওকে তুমি তোমার মতো করে গড়ে নিও। ওর খেয়াল রেখো। ”
শান ভাইয়াও বাবার হাতের উপর অন্য হাত রেখে আশ্বস্ত করলেন।অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম তখনই ওনার চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলাম। এরপর আমাদের গাড়ি চললো আমার নতুন গন্তব্যে।
অবশেষে সব ঝামেলা শেষ করে বসে আছি বাসরঘর নামক বাঘের খাঁচায়।এখানে বসিয়েই সব ভাবীরা আমাকে জ্ঞান দিতে আরম্ভ করল।ভুমিকা ভাবী শানের বড় ভাবী বললো,
“শোনো সোহা আমার দেবর কিন্তু একটু আনরোমান্টিক টাইপের তাই আজকে রাতে সব তোমাকেই করতে হবে। ”
আমি তুতলিয়ে বললাম,
“মমমানে।কি করব? ”
আমার কথা শুনে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল,
“মানে বুঝনা। মেয়ে দেখি একেবারেই বাচ্চা। আরে কেউ ওকে বুঝা। ”
বলে সবাই আবারও হাসতে লাগল আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি তখন ভূমিকা আপু আমার কানে কানে একটা কথা বলতেই লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। ছি ছি! কি বলে এসব এরা। এতক্ষন এমনিতে ভয়ে মরছিলাম। এখন আরো ভয় করছে। না না শান ভাইয়া কখনো আমার সাথে এসব করবে না। এরপর সবাই আমার সাথে আরো কিছুক্ষন দুষ্টমি করে চলে গেল।
তখন থেকে অপেক্ষা করছি কখন শান ভাইয়া আসবে আর আমার গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলবে। এমনিতে এতক্ষন তারা যা বললো তার উপরে কালকে বিকালের ঘটনাটা মনে পড়লে আরো বেশী ভয় করছে। কালকে বিকালেই ঐ হনুমানটাকে আমি ঠেলে পানিতে ফেলে দিয়েছিলাম। এখন যদি সে তখনের প্রতিশোধ নেয়। ভাবতেই গা কাঁটা দিয়ে উঠল। আরিয়ান আরেফিন শান যে কি জিনিস সেটা এই কয়দিনে আমি হারে হারে টের পেয়েছি।
আমি সুরাইয়া নাজিফা সোহা বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান।যতো রকমের ফাজলামি,বাঁদরামি, শয়তানি আছে সব কিছুই আমার সাথে যায়। একদম উড়নচণ্ডী যাকে বলে। আর স্মৃতি আপু ছিলো একদম নম্র,ভদ্র,লক্ষ্মী একটা মেয়ে। আমার আর আপু স্বভাব ছিলো একদম উত্তর আর দক্ষিণের মতো। সবসময় আমি কোনো দোষ করলেই স্মৃতি আপুর একমাত্র ফরজ কাজ ছিল আমার দোষ ত্রুটি গুলো ডেকে আমাকে বাঁচানো। সেখানে আপুই আমাকে এভাবে সাগরে ফেলে চলে যাবে সেটা ভাবতেও পারিনি।
শান আর আরশ,আর সাম্য ভাইয়া হলো তিন ভাই।সাম্য ভাইয়া সবার বড় উনার বউয়ের নাম ভূমিকা । শান ভাইয়ার বাবা আর আমার বাবা দুজনেই খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।আরশ ভাইয়া ছিলো আমার বড় বোনের বয়ফ্রেন্ড।তাদের প্রেমের একমাত্র স্বাক্ষী ছিলাম আমি। তাদের দেখা করানো, প্রেমপত্র আদান-প্রদান, কথা বলিয়ে দেওয়া সবই আমি করতাম।কারন আমার পরিবারে প্রেম সমর্থন করত না। তবে তাদের সাহায্যর জন্য অবশ্য ঘুষ ও নিতাম। বেশ ভালোই চলছিলো। কিন্তু কিছুদিন আগেই হঠাৎ বাবা এসে বললেন তিনি আমাদের দুই বোনের জন্যই বিয়ে ঠিক করেছেন। যদিও আমার সমস্যা ছিল না। কিন্তু আপুর মাথায় বাজ ঠিকই পড়ল।কারণ আপু আরশ ভাইয়াকে ভালোবাসত। কিন্তু একই বাজ যে আমার মাথায় পড়বে সেটা ভাবতে পারিনি। যখন জানতে পারলাম আরশ ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে।শান ভাইয়ার আব্বু ইমতিয়াজ আক্কেল আর আমার বাবা তাদের বন্ধুত্ব অটুট রাখতে তাদের দুই ছেলের জন্য আমাদের দুই বোনকে পছন্দ করেছে। মানে বড় জনের জন্য বড় মেয়ে আর ছোট জনের জন্য ছোট মেয়ে।
★
হঠাৎ ক্যাঁচক্যাঁচ করে দরজা খোলার আওয়াজ হতেই আমি আরেকটু জড়ো-সড়ো হয়ে বসলাম। এক হাত দিয়ে শাড়ী চেঁপে ধরলাম অন্যহাত দিয়ে নিজের নখ কামড়াতে লাগলাম। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আর আকাশ -পাতাল ভাবনা ভাবতে থাকলাম। ভাবনার মাঝখানে পাশে থাকা ফুলদানিটা ভাঙ্গার আওয়াজ কানে এলো। আমি তখনই সেদিকে তাকালাম। ফুলদানিটা দুইটুকরা হয়ে পড়ে আছে। শান ভাইয়া আমার দিকে তেড়ে এসে আমার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে আমাকে মেঝেতে ছুড়ে মারল।আমার হাতটা ভাঙা ফুলদানির কাঁচের সাথে লেগে কিছুটা কেঁটে গেল। শান ভাইয়া আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“লিসেন তোমার জায়গাটা এখানেই যেখানে এখন তুমি আছো। কোনো দিনও আমার বেডে আসার চেষ্টাও করবে না। কারণ সেই অধিকারটা তুমি কখনোই পাবে না। তোমাকে শুধু বাবার কথা রাখতে বিয়ে করেছি। তোমাকে বিয়ে করেছি এজন্য তোমার দায়িত্ব আমি নেবো। এর বেশী আশা তুমি কখনো আমার থেকে করো না।তাছাড়া আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। ”
শান ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে শুনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অসস্তি হলো। যতোই হোক হাজবেন্ড তো। কিন্তু মনের অনুভুতিটা পাত্তা না দিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“শুনুন মিষ্টার আরিয়ান আরেফিন শান আপনার কি মনে হয় আমি আপনার কাছ থেকে কিছু আশা করি?আমিও শুধু পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে বিয়েটা করেছি।আর আমারও বয়ফ্রেন্ড আছে। ”
আমার কথা শুনে শান ভাইয়া একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“গায়ে হলুদের দিন যে হাতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে ওইটাই না তোমার সো কলড বয়ফ্রেন্ড। ”
শান ভাইয়া কথাটা বলতেই আমি চমকে উঠলাম” উনি জানল কেমনে। ”
“আই নো দ্যাট।
সেদিন কি প্লান করছিলে পালিয়ে যাওয়ার কথা? তাহলে কেন যাওনি। তুমিও চলে যেতে নিজের বোনের মতো তাহলে তোমার মতো একটা নাটকবাজ মেয়েকে আমায় বিয়ে করতো হতো না।”
শান ভাইয়ার কথাটা শুনে আমার ইগোতে লাগলো। কি ভাবেন উনি নিজেকে? আমি রেগে বললাম,
“এই শুভ কাজটা তো আপনিও করতে পারতেন।আমি নাহলে আমার কথা বলতে পারিনি বাবাকে আপনি বলে দিতে আপনার কথা। তখন বলেন নি কেন?এখন আমি খারাপ আর আপনি ভালো তাই না? আপনি যদি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে থাকতেন তাহলে আজকে আমাকেও আপনার মতো বদমেজাজি, খচ্চর,অহংকারী,অসহ্যকর লোককে বিয়ে করতে হতো না। ”
কথাগুলো বলেই আমি জিভ কাটলাম সর্বনাশ কার সামনে কি বলে দিলাম। মনের কথাগুলো মুখে আশাটা কি খুব জরুরী ছিল। এখন তোর কি হবে সোহা। আমি এমনই রাগ উঠলে আর সামনে পিছনের কোনো কথাই ভাবি না যা মনে আসে বলে দি।শান ভাইয়া আমার কাঁটা হাতটাই শক্ত করে ধরে আমাকে তার একদম কাছে টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললো ,
“কি বললে তুমি?তোমাদের দুই বোনের জন্য না কম সাফার করছি না তারপরও আমার সম্পর্কে এমন কথা বলার সাহস পাও কি করে?”
কাঁটা হাতের যন্ত্রণায় না চাইতেও মুখ থেকে “উফ” শব্দটা বের হয়েই গেল। আমার চোখ থেকে পানি গড়াতে দেখেই শান ভাইয়া একবার আমার হাতের দিকে তাকালো সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। তাই উনি আমার হাতটা ছেড়ে দিলো। আর আমার থেকে একটু দূরে সরে বললো,
“এই অসহ্যকর লোককেই এখন থেকে সারাজীবন তোমায় সহ্য করতে হবে তার জন্য তৈরী হয়ে যাও। ওয়েলকাম টু হেল মিস নো নো মিসেস সোহা। ”
কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন। উনার কথা আমি বিন্দু মাত্রও অবাক হইনি কারণ এটা আমি আগেই জানতাম উনার সাথে বিয়ে হওয়া মানে আমার জীবন নরকের চেয়ে কিছু কম হবে না।
কিছুক্ষন পরেই আমার পায়ের কাছে একটা ফার্স্ট এইড বক্স এসে পড়ল,
“যেখানে কেটেছে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে নিও।আর আমি মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে দিয়েছি ইচ্ছা হলে বেডের ওপাশে এসে সুতে পারো। ”
কথাটা বলেই বেডের একপাশে শুয়ে পড়ল। আর আমি গিয়ে সোফায় বসলাম।হাতের দিকে একবার তাকালাম অনেকটা ক্ষত হয়ে গেছে তবে মনে মনে বললাম,
“লাগাবো না হাতে কোনো ব্যান্ডেজ। দেখি কি হয়। হনুমান একটা নিজে ব্যাথা দিয়ে এখন উনার ভালোবাসা উতলে পড়ছে। যতোসব আলগা পিরিত। ”
.#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_২
#সুরাইয়া_নাজিফা
” আমার সাথে এমন নোংরা কাজটা করতে আপনার একটুও বিবেকে বাঁধেনি তাই না?”
শান ভাইয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
“উহুম, একদম না। ”
“কেন করলেন আপনি এটা। আমি কালকে রাতে কতটা ক্লান্ত ছিলাম তার কোনো আইডিয়া আছে আপনার? ”
“তোমার যা কিছু হোক আই ডোন্ট কেয়ার।এখানে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারছি না আর তুমি শান্তিতে ঘুমাচ্ছো এটা তো আমি হতে দিতে পারি না। ”
“অদ্ভুত তো আপনি ঘুমাতে পারছেন না সেটা আপনার সমস্যা আমি কি করতে পারি এতে?”
“তুমিই পারো নিজের শান্তি হারাম করে আমার মনে শান্তি এনে দিতে।”
বলেই আরাম করে সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে পড়ল। রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে ব্যাটা খচ্চর। সকাল সকাল আমার গায়ে এক জগ ঠান্ডা পানি ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে এমন হওয়াতে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। তাই তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে সোফা থেকে ধাম করে পড়ে গেলাম।কালকে সোফায় বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম জানি না। একদিকে শীত করছে অন্যদিকে ব্যাথায় আমার কোমর ফেঁটে যাচ্ছে আর সেখানে উনি বসে বসে সকাল সকাল আমাকে কীর্তন শোনাচ্ছে। এই ভেজা ড্রেস নিয়ে আর বসে থাকা যাচ্ছে না তাই ফ্রেস হওয়ার জন্য উঠতে যাবো তখনই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
“ও মাগো। ”
আমার গোঙ্গানি শুনেই শান ভাইয়া এগিয়ে এসে বললো,
“হোয়াট হ্যাপেন?”
আমি শান ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বললাম,
“নাথিং।”
“কিছু না হলে এমন বাজে আওয়াজ করছ কেন? বাহির থেকে মানুষ শুনলে কি ভাববে? ”
“কি ভাববে? ”
“তোমার মাথা স্টুপিড। ”
কথাটা বলেই উনি আমার পাশ থেকে উঠে আবার আগের মতো বসে পড়ল। উনি হঠাৎ আমাকে স্টুপিড কেনো বললো? এখন কি ব্যাথা পেলে প্রকাশও করব না? হনুমান একটা। আমি সোফাটা ধরে উঠে দাঁড়ালাম তারপর শরীরটা একবার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিলাম। সারারাত সোফায় শুয়ে পুরো শরীরটা একদম ব্যাথা হয়ে আছে।
“আচ্ছা তুমি এতো টেনশন ফ্রী আছো কি করে বলোতো?”
শান ভাইয়ার হঠাৎ বলা কথাটা বুঝতে না পেরে আমি উনার দিক পিটপিট করে তাকালাম।শান ভাইয়া আমার তাকানোর মানে হয়তো বুঝতে পেরেছে তাই উনি আবার বললো,
“আমি কালকে রাত থেকে এটা ভেবেই ঘুমাতে পারছি না যে আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে কি বলবো?সেখানে তুমি এতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছো কিভাবে?তুমি কি বলবে তোমার সো কলড বয়ফ্রেন্ডকে?”
শান ভাইয়ার কথা শুনেই বিরবির করে বললাম,
“বয়ফ্রেন্ড থাকলে তো ভাববো।”
“কি বিরবির করছো বলোতো?”
“হ্যাঁ।”
উফ ভ্যাগিস বুঝতে পারেনি।
“কিসব বলছো বলোতো? কি হ্যাঁ?”
তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললাম,
“না। কিছু না।”
“কিছুতো বলেছো।সত্যি করে বলো নাহলে ?”
“নাহলে কি? ”
“সেটা পরেই দেখতে পারবে আগে বলো?”
শান ভাইয়াকে আমার দিকে এগোতে দেখেই আমি একটু পিছিয়ে গেলাম তারপর বললাম,
“বলেছি আমার বয়ফ্রেন্ডেকে কি বলবো সেটা আমার ব্যাপার আপনাকে ভাবতে হবে না। ”
বলেই ঘটঘট করে হেঁটে চলে গেলাম
“উফ বাবা যেভাবে ধরেছিল ঠিক উগলেই নিতো। ”
আমার ট্রলি ব্যাগের কাছে গেলাম জামা বের করব বলে। হঠাৎ আমার হাতের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলাম। কালকে রাতেই তো এই হাতটা কেঁটে গেছিলো। আমি তো কালকে ব্যান্ডেজ করিনি। তাহলে হাতটা এতো সুন্দর করে ব্যান্ডেজ কে করল? আমি কিছুক্ষন বিষ্ময় নিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তাহলে কি শান ভাইয়া? কিন্তু হঠাৎ আমার উপর এতো দয়ার কারণ কি? আমি যতটুকু জানি আমার কিছু হোউক বা না হোউক তাতে ওনার কিছু যায় আসে না? তাহলে এটা কি শুধু দায়িত্ববোধ না মনুষ্যত্ব। গিয়ে কি জিজ্ঞেস করব? না থাক সে কখনোই সোজা উত্তর দিবে না। কখনো সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করে নেবো ভেবে একটা শাড়ী নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
★
★
★
কোনো রকম একটু শাওয়ার নিয়ে তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে গেলাম। একটা সবুজ রঙের জর্জেটের শাড়ি পড়লাম। শরীরটা ভালো করে না মুছাতে শাড়ীটা বেশ ভালো ভাবেই শরীরে বসে গেছে। আম্মুও আমাকে এরজন্য সবসময় বকতো যে এতো বড় হয়েছি তারপরও কেন ভালো ভাবে শরীর মুছতে পারি না। যাইহোক মাথা মুছতে মুছতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
শান বিছানায় বসে ল্যাপটপে অফিসের একটা কাজ করছিলো। হঠাৎ ড্রেসিংটেবিলের দিকে তাকাতেই শানের চোখ আটকে গেল। চুলের পানিতে কোমরের দিকে অনেকাংশেই ভিজে গেছে আর শাড়ীটাও হালকা সরে গেছে। যার ফলে সোহার শরীর স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।শানের বুক ধুকধুক করছে। শান তাড়াহুড়া করে নিজের চোখ সরিয়ে নিলো।
নিজেই নিজেকে বললো,
“নো শান আর যাই করিস না কেন এই মেয়ের চক্কোরে পড়িস না। জাস্ট ফোকাস অন ইউর ওয়ার্ক।”
শান আবার নিজের কাজে মন দিলো।
ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় খুব ভালো ভাবেই বুঝা যাচ্ছে শান ভাইয়া বারবার আড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু আমি ফিরলেই দেখি সে কাজ করতে ব্যস্ত। তাহলে কি আয়নায় ভুল দেখলাম। তাই হবে নাহলে ওই হনুমানটা নিজের গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে আমাকে কেন দেখবে?
“লিসেন শাড়ী পড়তে হলে পড়ার মতো পড়ো না হলে যেই শাড়ী দিয়ে সবাইকে নিজের শরীর দেখানো যায় তেমন শাড়ী না পড়াই ভালো। ”
হঠাৎ কথাটা কানে আসতেই দেখলাম শান ভাইয়া আমার পিছনে অনেকটা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে শান ভাইয়ার দিকে ঘুরে তুতলিয়ে বললাম,
“মমমানে?”
“শাড়ী না শুকানো পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবে না। এমনিতেই ঘর ভর্তি মানুষ আছে। সো যেটা বললাম মনে থাকে যেন। ”
“কেন? ”
“যা বললাম তাই করবে। আর কোনো প্রশ্ন নয়। ”
মনে মনে বললাম,
“উফ সবসময় এতো রাগ নিয়ে থাকে
কিভাবে কে জানে। ”
শান ভাইয়া আমার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ পা পিছলে এসে আমার গায়ের উপরেই পড়লেন আর আমিও তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়লাম শানকে নিয়ে মেঝেতে। ভয়ে আমি প্রচন্ড শক্ত করে শান ভাইয়ার শার্টের কলার চেঁপে ধরলাম। আমার খুব কাছে শান ভাইয়ার নিঃশ্বাস আমার মুখের উপর এসে পড়ছে।
শান অপলক তাকিয়ে আছে সোহার মুখের দিকে। এমন বাচ্চাদের মতো চোখ মুখ খিঁচে থাকা,শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি সব কিছুর মধ্যেই যেন স্নিগ্ধতা খুজে পাচ্ছে শান। আলতো করে সোহার মুখের উপরে যে চুল গুলো পড়ে ছিল শান সেটা সরিয়ে দিলো তখনই সোহা বলে উঠল,
“কি করছেন আপনি?”
সোহার কথায় শানের ঘোর কাটল,
“কই কি করব? কিছু না। ”
“তাহলে এখনও আমার উপরে পড়ে আছেন কেন? উঠেন তাড়াতাড়ি। ”
শান কিছুক্ষন সোহার দিকে তাকিয়ে থেকে দুপাশে ভড় দিয়ে উঠতে যাবে তখনই হাত পিছলে আবার সোহার উপরেই পড়ল। শান পড়তেই আমি নিজের মুখটা সরিয়ে নিলাম। উফ আরেকটু দেরী হলেই শানের ঠোঁট এসে আমার ঠোঁটে লাগত। আমার বুকটা ধুকধুক করছে।
“আপনি বারবার পড়ার জন্য কি আমার মতো নিরিহ মেয়ের শরীরটাই পেলেন। ”
“অদ্ভুত তো তুমি দেখলে না আমি স্লিপ করে পড়ে গেলাম তাও তোমার জন্য। ”
“অমনি নিজের দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন না। আমি কি করেছি?”
“মেঝেতে এতো পানি ফেলে রেখেছো কেন? চুল গুলোও মুছতে জানো না যে কেউই পড়ে হাত পা ভাঙত। ”
“কানা নাকি দেখে চলতে পারেন না। চোখ কই থাকে। ”
আচমকা শান ভাইয়া আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললেন,
“জাস্ট স্টপ আর একটাও বাজে কথা শুনতে চাইছি না। ”
আমি উনার হাতটা আমার ঠোঁট থেকে সরিয়ে বললাম,
“আমি বলতেও ইচ্ছুক নই। এইবার দয়া করে আমার উপর থেকে উঠুন।নাহলে আমি আলুভর্তা হয়ে যাবো।”
আমি বলার পর শান ভাইয়া আর কিছু বলতে যাবে তখনই একটা মেয়েলি কন্ঠো কানে এলো,
“স্যরি স্যরি আমি কিছু দেখি নি তোমরা কন্টিনিউ করো। ”
কথাটা শুনে শান ভাইয়া তাড়াতাড়ি আমার উপর থেকে উঠে দাঁড়ালো সাথে আমিও। দরজায় ভূমিকা ভাবি দাঁড়ানো ছিল। শান দ্রুত ভূমিকা ভাবিকে বললো,
“আরে না তুমি যা ভাবছো সেটা একদমই নয়।”
শানকে পুরা কথা বলতে না দিয়ে ভুমিকা ভাবি বললো,
“আরে দেবর জি এতো ইতস্তত করার কিছু নেই আমারই নক করে আসা উচিত ছিল। দরজা খোলা দেখে আমি ভেবেছি তোমরা রেডি। কিন্তু তোমাদের ফুলসজ্জার আমেজটা যে এখনো কাটেনি সেটা বুঝতে পারিনি। ”
বলেই মুচকি মুচকি হাসছে। লজ্জায় আমার মাথা কাঁটা যাচ্ছে। ইশ কি ভাবছে ভাবী। এই লোকটাও না কখন থেকে উঠতে বলছি কিন্তু উনি তো উনিই সেখানেই প্রশ্নের ভান্ডার খুলে বসছে আছে। এখন লজ্জায় পড়তে হচ্ছে আমাকে। আমি শানের দিকে কটমট করে তাকালাম। শানও অসহায় হয়ে মাথায় হাত দিলো। আসলে শান সকালের দিকে একটু বাহিরে গেছিল। আর অন্যদিনের মতো নিজেকে সিঙ্গেল ভেবে রুমের দরজা আটকাতেই ভুলে গেছে তাতেই এই কান্ড। তখনই ভূমিকা তুড়ি বাজিয়ে বললো,
“কি হলো তোমরা দুজনেই এমন সাইলেন্ট মুডে চলে গেলে কেন? সোহা তাড়াতাড়ি নিচে চলো সবাই তোমাকে দেখবে বলে অধীর আগ্রহে বসে আছে। চলো। ”
বলেই আমার হাত ধরে তার সাথে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুটা গিয়ে আবার পিছন ফিরে বললো,
“দেবর জি তুমিও চলে এসো। বাকি যেইটুকু ফুলসজ্জা বাকি আছে সেটা রাতে করো কেমন।আর এইবার একটু দরজা লাগিয়ে। ”
বলেই আমাকে নিয়ে চলে গেল। লজ্জায় মনে হচ্ছে মাটি ফাঁক হোক আর আমি তার মধ্যে চলে যাই।
★
★
★
সব আত্মীয়-স্বজনরা সহ বাড়ির সব সদস্য উপস্থিত ছিল শুধু পুরুষরা বাদে। বাড়ির পরিবেশটা একটু থমথমে। কারণ কালকেই আরশ ভাইয়া যে কান্ডটা করেছে কারো মন ভালো থাকার কথা না।না জানি আমার কপালে কি আছে।তখন শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“ঐ তো সোহা এসে গেছে।”
শ্বাশুড়ী মা আমার কাছে এগিয়ে এলেন। এসে আমার হাত ধরতেই আমি “আহ ” করে উঠলাম।
“কি হয়েছে সোহা? ”
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি বললেন,
“একি হাতটা এতোখানি কাঁটলো কিভাবে?”
আমি কি বলবো বুঝতেছি না। আমার হাতটার এই দশা তো আপনার আদরের পুত্রই করেছে। কিন্তু মুখে বললাম,
“ওয়াসরুমে পড়ে গেছিলাম। ”
“উফ কি যে করো না। একটু দেখে শুনে চলবে তো। মেডিসিন নিয়েছো ?হাতে ব্যান্ডেজ কে করেছে?শান?”
আমি কি বলবো বুঝতেছি না ব্যান্ডেজ কে করেছে আমি তো নিজেই জানি না তারপরও মাথা নাড়িয়ে ওনার কথায় সম্মতি দিলাম।
শ্বাশুড়ী মা কিছু বলবে তার আগেই শানের ফুফি বলে উঠল,
“বাবা বিয়ে হতে না হতেই শানকে দেখছি আঁচলে বেঁধে নিয়েছো। ”
উনার কথাটা শুনে খুবই খারাপ লাগল।কেউ কাউকে সাহায্য করলে সেটাকে কি আঁচলে বাঁধা বলে?
তখনই আরেকটা মেয়ে বললো,
“উফ মা ওর স্বামী ওর খেয়াল রাখবে না তো কে রাখবে? আমি তো এটা ভেবে খুশি যে শান ভাইয়ার বউ পছন্দ হয়েছে। আর আমিও একটা মিষ্টি ভাবী পেয়েছি। ”
বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমিও ধরলাম। এটা সম্ভবত শান ভাইয়ার ফুফাতো বোন সারা।
শানের চাচী বললো,
“যাইহোক মেয়ে কিন্তু মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর একদম শানের সাথে মানিয়ে গেছে।আমাদের রাজপুত্রের সাথে রাজকন্যা। কখনো শানকে কষ্ট দিও না। ”
আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ালাম।
উনি আমার হাতে একটা উপহারের বাক্স ধরিয়ে দিলেন প্রথমে আমি নিতে না চাইলেও শ্বাশুড়ী মা বলায় নিতে বাধ্য হলাম। একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আমাকে। সবাই এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আমাকে যে মনে হয় আমি কোনো ভিন্ন গ্রহের প্রাণী।
হঠাৎ একজন বলে উঠল,
“আচ্ছা তোমার বোন পালালো কেন?কোথাও কোনো চক্কোর আছে নাকি? বলা যায় না বর্তমানের ছেলে মেয়ে।”
কথাটা শুনে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম কি বলবো বুঝতেছি না।
তখনই শানের বড় খালা বললো,
“বারবার ওর বোন পালিয়েছে বলিস কেন আমাদের ছেলেও তো পালিয়েছে। আমার মাথায় তো এটাই আসে না এমন একটা মিষ্টি মেয়েকে ফেলে আরশ পালালো কেমনে? ”
“যাই বলো আপু আমার কাছে কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধার লাগছে না একই বিয়ে থেকে বরের ভাই আর বউয়ের বোন উদাও হয়ে গেল এর মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই তো। ”
কথাটা বলতেই আমি বিষম খেয়ে গেলাম। উফ এই টপিক নিয়ে আর ঘাটালে নির্ঘাত সবাই বুঝে যাবে যে এরা দুজন একসাথেই পালিয়েছে যেটা মোটেও সুখকর হবে না। তাই যেভাবে হোক বিষয়টা আটকাতে হবে কিন্তু কিভাবে?
তখনই প্রচন্ড জোরে হামি এলো আর ঘুমও পাচ্ছে।ঘুমেরও বা দোষ কি। কালকে রাতে সোফায় ভালো ভাবে তো ঘুমাতেই পারলাম না। তখনই একজন ভাবী বললো,
“নতুন বউয়ের খুব ঘুম পাচ্ছে বুঝি? কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি তাই না? ”
আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলে দিলাম,
“হুম। ”
তখনই সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল আরেকজন বললো,
“আরে ঘুমাবে কি করে শান তো কাল রাতে ঘুমাতেই দেয়নি। বেচারি বাচ্চা মেয়েটার উপরে কত অত্যাচার করেছে একটুও দয়া মায়া নেই। ”
আবার সবাই হাসতে লাগল। আল্লাহ এটা আমি কি করলাম একেই বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। ঘুমের তাড়ণায় কি বলে ফেললাম।এখন মনে হচ্ছে এখান থেকে একছুটে পালিয়ে যাই।
তখনই আমার শ্বাশুড়ী মা বলে উঠলেন,
“উফ তোরা সব কি শুরু করেছিস। আমরা এখানে বড়রাও আছি সেটা কি ভুলে গেছিস। ”
শ্বাশুড়ী মায়ের ধমক শুনে সবাই মোটামুটি চুপ। আর আমিও এই অস্বস্তি থেকে রেহাই পেলাম ।
“সোহা চলো আমার সাথে। ”
বলেই আমার শ্বাশুড়ী মা ওনার সাথে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে।রান্নাঘরটা অনেক সুন্দর করে গোছানো। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম তখনই শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“আজকে তোমার রান্নার কথা ছিল। তবে হাতের যে অবস্থা মনে হয় না তুমি পারবে। তারচেয়ে আমি রান্না করছি তুমি এটা ওটা এগিয়ে দেও। ”
“না। সমস্যা নেই আমি পারব। ”
“একদম পাকা পাকা কথা বলো না কি পারবে না পারবে যেটা আমি বুঝব যেটা বললাম সেটা করো। ”
বলেই উনি একটা মুচকি হাসি দিলেন আর আমিও হাসলাম।
তারপর উনি রান্না করছিলেন আর আমি সব এগিয়ে দিচ্ছিলাম। তখনই ওনাদের বাড়ির কাজের মেয়ে কমলা এসে বললো,
“ভাবী এই লন আফনের ফোন। বসার ঘরে ফালাইয়া আইছেন। কেডা জানি ফোন দেয় বারবার। ”
আমি কমলার হাত থেকে ফোনটা নিলাম দেখলাম আননোন নাম্বার। একটু খটকা লাগতেই শ্বাশুড়ী মাকে বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আড়ালে চলে গেলাম।
★
★
★
“হ্যালো সোহা। কেমন আছিস? ঐদিকের খবর কি?”
আমি অভিমানি কন্ঠে বললাম,
“তোমাদের সাথে কোনো কথা নেই। তোমরা আমার সাথে এটা কেমনে করতে পারলা?”
“কি হয়েছে শালীসাহেবা এত রেগে আছো কেন? আমরা কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এমন করেছি তুমি তো সেটা জানো?”
“হুম জানি। আর তোমরা যাওয়ার পর যে এখানে কতো কিছু হয়ে গেছে সেটা কি তোমরা জানো?”
“কি হয়েছে।”
তারপর আমি আপু আর আরশ ভাইয়াকে কালকের সবকিছু বললাম,
স্মৃতি আপু আর আরশ ভাইয়া দুজনেই চেঁচিয়ে বললো,
“হোয়াট?”
“হুম।”
“ভাইয়া আর তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। আই কান্ট বিলিভ দিস।”
“আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছি না তোমাকে কি বলবো।”
“স্যরিরে বোনু আমার জন্য তোর সাথে এমনটা হলো।”
আপু কান্না করে দিলো। তখনই আরশ ভাইয়া বললো,
“তুমি কেন কান্না করছ স্মৃতি। আমার ভাইয়া তোমার বোনের জন্য পারফেক্ট একজন মানুষ। অনেক খেয়াল রাখবে সোহার দেখো। ”
আমি আরশ ভাইয়ার কথায় বললাম,
“হ্যাঁ আপু তুই মন খারাপ করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
“তুই খুশি এই বিয়েতে?”
আপুর কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম।কি বলবো?এই বিয়ের পরিণতি কি সেটাই তো জানি না। এখন যদি না বলি নির্ঘাত আবার কান্নাকাটি করবে। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বে বললাম,
“হুম। ”
“তবে যাই বলো না কেন শালীসাহেবা আমি কিন্তু অনেক খুশি। তবে এখন তোমাকে কি ডাকব শালী না ভাবী। ”
আরশ ভাইয়া হাসতে লাগল।আমি রেগে বললাম,
“এটা মজা করার সময় না ভাইয়া তোমার ভাইয়ের সাথে আমি একমিনিটও থাকতে চাই না। বদ্ধ পাগল একটা। ”
কথাটা বলে পিছনে ঘুরতেই আমার চোখ চড়কগাছ। শান ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই মনে হচ্ছে রেগে আছে। কিন্তু শান ভাইয়া এখানে কেমনে?কখন আসলো? কিছু শুনে ফেলেনি তো?
আমি ফোনে বিরবির করে বললাম,
“আপু ফোন রাখ সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
.
.
চলবে
.
চলবে
#এক_শহর_ভালোবাসা
#সুরাইয়া_নাজিফা
#সূচনা_পর্ব