এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব -০৩+৪

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
“তিতিরপাখি,
সুখপাখি হয়ে এই নীড়হারা তিতিরপাখিকে নিজের নীড়ের সম্রাজ্ঞী করতেও প্রস্তুত। উপমাতে হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন! থাক সেসব বাদ দিন। আপনার নতুন গন্তব্য আপনাকে হাতছানি দিচ্ছে। ছেড়েদিন এই ফরিদপুর শহর। চলে আসুন ময়মনসিংহতে। আপনার মেডিকেলে মাইগ্রেট করাও সম্ভব। ময়মনসিংহ মেডিকেলেই তো চান্স পেয়েছিলেন। আপনি এই অসুস্থ সমাজের সাথে লড়তে লড়তে আরও হতাশ হবেন।
ইতি
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।”
তিতির হতবাক হয়ে চেয়ে আছে চিঠিটির দিকে। হুট করে তার শুভাকাঙ্ক্ষী কোথা থেকে উদয় হলো? তিতিরের কুঞ্চিত ভ্রুঁ দেখে নাজমা বেগম ও হিয়া একে অপরের দিকে কিছু না বুঝে তাকায়। হিয়া জিজ্ঞেসা করে,

“কী হয়েছে? কী লেখা কাগজে?”
তিতির কাগজটা হিয়ার হাতে দেয়। হিয়া লেখাগুলো পড়ে বলে,
“কে হতে পারে?”
“জানিনা।”
“আচ্ছা তুই টেনশন করিস না। খেতে বস। পরে দেখা যাবে।”
তিতির কাগজটা রেখে খেতে বসে।

______
সকালে ঘুম থেকে উঠে তিতির রাতের বানানো রুটি ছেঁকে ও সবজি গরম করে বক্সে ভরে দৌঁড় দিয়েছে। সকাল আটটায় ক্লাস! আজ তার কিছুটা দেরি হয়ে গেছে দূরত্ব অনুযায়ী। বড়ো রাস্তায় এসে বাসের জন্যও অপেক্ষা করে। এদিকে হাতে আর আধঘণ্টার মতো আছে। বাস পেয়ে উঠে পরে। প্রায় পঁচিশ মিনিট পর গন্তব্যে পৌঁছে হড়বড়িয়ে রোড ক্রস করতে নিবে তখনি একটা গাড়ির সামনে পরতে বাঁচে। ভাগ্যিস জিপ গাড়িটির ড্রাইভার হার্ডব্রেক করেছিল। লোকটি হাত দিয়ে যেতে ইশারা করলে তিতির দৌঁড়ে চলে যায়।
তিতির যাওয়ার পর লোকটি গাড়ি রাস্তার সাইডে নিয়ে দাঁড়া করায়। মেডিকেল ভবনের গেইটের দিকে চেয়ে স্বগতোক্তি করে,

“আপনাকে চাওয়ার এই অন্যায় মনবাসনা নিয়ে নিজের মনেই কুঁড়ে কুঁড়ে ম*রি। অন্যের স্ত্রী জানা স্বত্বেও ছয় মাস আগে আপনাকে এক ঝলক দেখে নিজের দৃষ্টি সংযত করাও দায় হয়ে পরেছিল। অতঃপর খুব দ্রুত আপনার শহর ছেড়েছিলাম। আবারও আপনার শহরে আপনার সাথে দেখা। জানিনা অদৃষ্টে কী আছে! যদি এই কায়নাতের মালিক চায় তবে….”

লোকটি গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলে নেয়। যাওয়ার আগে আরেকবার মেডিকেল কলেজের গেইটের দিতে দৃষ্টি বুলিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে চলে যায়।
______

টানা দুই ঘণ্টা ক্লাস শেষে সময় হয়েছে নাস্তা খাওয়ার। নাস্তা খাওয়ার মাঝে মৃদুলা ও ইতি এসে হাজির। ইতি বলে,
“আজ তুই এখন নাস্তা করছিস? তুই তো সকালে নাস্তা না করে আসিস না।”
“আজ দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই সকালে নাস্তা খেয়ে আসতে পারিনি।”
মৃদুলা বলে,
“শুনলাম তোর শ্বশুর পরশুদিন সকালে হসপিটালে নিয়ে আসার পর মা*রা গেছে? সবার কী অবস্থা এখন?”

তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণে জমে উঠা অশ্রুবিন্দু বৃদ্ধাঙ্গুলির দ্বারা মুছে নিয়ে বলে,
“মৃ*ত বাড়িতে যেমন থাকে তেমনি আছে হয়তো।”
“তোকে আজ আসতে দিলো? না মানে কাল তো আসিসনি। তাছাড়া তোর শাশুড়ি তো তোকে এখন আর ভালো নজরে দেখেন না। তোর শ্বশুরই তোর পক্ষে সবসময় ছিলেন।”

তিতির মলিন কণ্ঠে বলে,
“আমি ওই বাড়ি থেকে সারাজীবনের জন্য চলে এসেছি। যদি নিয়তি আমায় সেখানে নেওয়াও তবে সেটা নিয়তির উপরেই ছেড়ে দিলাম।”

মৃদুলা ও ইতি অবাক হয়ে সমস্বরে বলে,
“কী বলিস চলে এসেছিস? হুট করে চলে আসলি ওরা কিছু বলেছে?”
“নাহ্। ওরা কেউ কিছু বলেনি। আমারই মন টানছিল না। বাবা জীবিত থাকা অবধি তার সম্মান রক্ষার্থে বাড়ি ছাড়িনি কিন্তু এখন যখন তিনি নেই আর তাদের ছেলেরও কোনো খোঁজ নেই তখন আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই। আমার মা, ভাবীর সাথে থাকতে চাই। আমরা তিনজনই তিনজনের আপন এখন। কয়দিন পর পুচকু আসবে। ওকে সুন্দর ভাবে বড়ো করতে হবে। ভাইয়ের শেষ চিহ্ন। ওদের আমি সব বিপদ থেকে বাঁচাতে চাই। আল্লাহ আমাকে সেই তৌফিক দিক।”

“আমিন।”
মৃদুলা ও ইতির একসাথে বলাতে তিতির মুচকি হাসে। তারপর কিছুক্ষণ একসাথে পরের ক্লাসের পড়া পড়ে ক্লাসের জন্য যায়।

______
রোকেয়া বেগমকে তার বড়ো মেয়ে ওহি বলছে,
“তিতির যে বাবার মৃ*ত্যুর পরেরদিন চলে গেল তা নিয়ে প্রতিবেশিরা কানাঘুষা করছে। কেউ বলছে, আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি। কেউ বলছে, আমরা অ*ত্যাচা*র করতাম। আবার বলছে, নতুন কাউকে জুটিয়েছে তাই চলে গেছে।”

“বলুক না। যার গুনগান গায় তারই ব*দনাম করতে এদের সময় লাগে না। আমার কানে তো কম ব*দনাম করেনি! আমিও তখন দিশেহারা হয়ে কি করেছি বুঝি নাই। স্বামী, সন্তান সব তো গেলো।”

রোকেয়া বেগমের পরিবর্তন দেখে ওহি বলে,
“মা! তুমি তিতিরের হয়ে কথা বলছ? আমি শিউর তোমার বড়ো ছেলের বউ পছন্দ হয়নি বলে বাড়ি ফিরছে না। নাহলে রাহানের মতো চৌকস আর্মি অফিসার গায়েব হয় নাকি!”
“থাম ওহি। আমার আর ভালো লাগছে না।”
ওহি মাকে অন্যমনা দেখে ছেলের পিছনে উঠে চলে গেল। রোকেয়া বেগম ভাবলেশহীন বসে রইলেন।

ক্লাস শেষ হলে তিতির ওর মাকে ফোন করেন। হিয়াকে চেকআপের জন্য। তিতির ফোন করে বলে,
“তোমরা কতোদূর? আমার তো লাঞ্চটাইম চলছে।”
“আরে সিএনজি পাচ্ছিলাম না। তোর কথা ঠিক মতো বুঝতেছি না। আমরা পথেই আছি। বেশিক্ষণ লাগবে না।”

এই বলে নাজমা বেগম ফোন কেটে দি*লেন। তিতির আগেই ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে রেখেছে। এখন ওরা ঠিক মতো এসে পৌঁছালেই দেখিয়ে নিবে।
_______
ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে তিতির ও হিয়া। নাজমা বেগম বাহিরে বসে আছেন। ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড করে বলেন,
“বেবি ঠিক আছে আর জরায়ুতে ফ্লুইডও মোটামুটি ভালোই। যেকোনো দিন ডেলিভারি হতে পারে। আগে থেকে সি*জার করে ফেললে রিস্ক থাকবে না।”
“আমরা ভেবে দেখি ম্যাম।”

তিতির এই বলে হিয়াকে নিয়ে উঠে আসে। হিয়া সি*জার করতে ভয় পায় তা তিতির জানে। বাহিরে এসে হিয়া ভীতু কণ্ঠে বলে,
“ম*রে গেলে যাব কিন্তু সি*জার করব না প্লিজ। ডাক্তাররা তো কিছু হলেই সি*জার করতে বলে।”

তিতির ওকে শান্ত করতে বলে,
“দেখ, বাসায় কোনো ছেলেমানুষ নাই। আমি ক্লাসে থাকি। মা আর তুই। লেবার পেইন উঠলে মা তো দিশেহারা হয়ে পরবে।”
“হলে হোক। সি*জার করব না।”
“আচ্ছা থাম। বাসায় যা। এক সপ্তাহ দেখি।”

নাজমা বেগমকে নিয়ে হিয়া বাড়ি ফিরে গেল। তিতিরের বিকেলে ক্লাস আছে। ক্লাস শেষে একটা টিউশন করে ফিরবে। সপ্তাহে চারদিন করে দুইটা টিউশন করায়।

_____

রাতের আটটার দিকে তিতির বাড়ির রাস্তায় এসেছে।
ফেরার পথে এক বিশ্বস্ত সিএনজি ড্রাইভারকে বলে এসেছে যেনো যেকোনো সময় ফোন দিলে পাওয়া যায় সাথে কিছু বাজারও করেছে। হঠাৎ মনে পরে ঘরে ডিম শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই মোড়ের দোকানে গেলো ডিম কিনতে। আকাশের অবস্থাও ভালো না। মনে হচ্ছে ঝুম বৃষ্টি নামবে। তাড়াতাড়ি করে ডিম কিনে পেছোনে ঘুরা মাত্রই দেখে সুজন কেমন বিশ্রি দৃষ্টিতে তিতিরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ ঘুরাচ্ছে। টুথপিক দিয়ে তার পান খাওয়া দাঁত খোঁচাচ্ছে। তিতির ভয়ে ওড়নাটা আরেকটু টেনে নিয়ে পাশ দিয়ে চলে যেতে নিলে সুজন হাঁক ছাড়ে,

“কই যাও টিয়াপাখি? একটু বসো চা-পান খাও। এহন তো আর ভা*তারের বাড়িতে থাকো না। অবশ্য তোমার ভা*তার তো বিয়ার দুইদিন না হইতেই ফুড়ুত!”

রাগে দাঁত খিঁচে নিল তিতির। ওড়না খা*মচে ধরে আছে। এদের মুখের উপর বাক্য দ্বারা জবাব দিলে আরও পার পেয়ে যাবে। তিতিরের মা আগেই তিতিরকে এদের সাথে মুখ লাগতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এমনিতেই এদের উৎপাতে ভয়ের শেষ নেই। তাই কোনো প্রত্যুত্তর না করে সোজা দ্রুত হেঁটে চলে এসেছে। বাড়ি ফেরা মাত্রই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। টেবিলের উপর সব রেখে ফ্রেশ হতে গেল। মা রান্না করছে এবং তা শেষের পথে। তিতির ফ্রেশ হয়ে হিয়ার সাথে বসে একটু পড়া পড়ে। হিয়াও পড়ছিল। অলস বসে থাকার চেয়ে পুরোনো পড়া পড়াও ভালো।
রাত নয়টার দিকে এই মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে কলিংবেল বেজে ওঠে। এবার তিতির সহ সবাই ভয় পেয়ে ওঠে। রাস্তার ঘটনাটা মনে পরে যায়। বৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাট নিরব। সুজন, পলাশরা কি সেই সুযোগে এসেছে? নাজমা বেগম ভয়ে দোয়া-দুরুদ পড়তে শুরু করেছেন। প্রথমবার কলিংবেল বাজার মিনিট দুয়েক পর আবার বেজে ওঠে। তিতির রান্নাঘরে গিয়ে ব**টি তুলে দরজার দিকে যায়। দরজা খুলে সিঁড়িরঘরের বাতি জ্বা*লিয়ে কেচিগেইটের কাছে যায়। একজনের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। কেচিগেইটের কাছে কোনায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিতির ঢোক গিলে বলে,

“কে? কে ওখানে?”
“আমি। মাশরিফ ইকবাল।”
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
তিতির ভ্রুঁকুঞ্চন করে উুঁকিঝুঁকি দিলো তবুও লোকটির মুখদর্শন হলো না। ঝড়বৃষ্টির রাত। মনে ভয় ভীতি যেনো ঝেঁকে বসেছে। তারউপর পুরুষালী কণ্ঠস্বর! সিঁড়ির ঘরের বাতিটাও টিমটিম করে জ্বলছে। বোঝাই যাচ্ছে, যেকোনো সময় ফিউজ হয়ে যেতে পারে। তিতিরের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে আসছে। মনে কিঞ্চিত সাহস সঞ্চার করে নিভে যাওয়া কণ্ঠস্বরকে হালকা জোড়ালো করল,
“মাশরিফ ইকবাল কে?”

অপরপক্ষ থেকে জবাব এলো,
“ম্যাম আমি বিপদে পরেছি। আমার জিপটার ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। কাছেই ম্যাকানিকের কাছে দিয়ে এসেছি। এখন এই ঝুম বৃষ্টিতে পুরোদস্তুর ভিজে গেছি। প্লিজ যদি একটু সাহায্য করতেন।”

তিতির ভাবনায় পরে গেলো। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বৃষ্টি প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত লাগাতার হচ্ছে। লোকটা ভিজে গেছে বুঝতে পারছে কিন্তু এক অচেনা লোককে বাড়িতে কিভাবে আশ্রয় দিবে? যেখানে বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই! তিতিরের ভাবনার মাঝেই লোকটা পরপর দুইবার হাঁচি দিয়ে ফেলেছে। লোকটা জড়ানো স্বরে বলে ওঠে,

“ঠিক আছে ম্যাম সমস্যা নেই। আমি গেইটের কাছে এখানেই বৃষ্টি থামা অবধি দাঁড়াই। এখানে বৃষ্টির ছাঁট কম লাগছে।”
তিতির কিছুক্ষণ নিরব থাকে। লোকটার কথাবার্তায় ভদ্রতা পরিলক্ষিত। তাই কিছুটা মায়া লাগল। তিতির বলল,
“আপনি গেইটের ভিতরে এসে অপেক্ষা করতে পারেন। বৃষ্টির তেজ খুব তীব্র। আমি চাবি নিয়ে আসছি।”

তিতির বাড়ির ভিতরে ঢোকে ফ্রিজের উপর থেকে চাবি নিয়ে যাওয়া ধরলে ওর মা জিজ্ঞেসা করেন,
“কে এসেছে? তুই চাবি নিয়ে কই যাচ্ছিস?”
“একজন লোক বৃষ্টিতে ভিজে একটু আশ্রয় চাইছে। তাকে সিঁড়ির ওখানে চেয়ার নিয়ে দিবো। বৃষ্টি থামলে চলে যাবেন।”

নাজমা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
“পা*গল হইছিস তুই? বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নাই আর তুই এক লোককে বাড়িতে আনতে চাইছিস?”
তিতির ওর মাকে বোঝাতে চাইলেন,
“মা বোঝার চেষ্টা করো। উনি ভিজে চুবচুবে পুরো। বাহিরেই তো বসবেন। একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে উনি যাতে অসুস্থ না হয় সেদিকটা দেখাও আমার দায়িত্ব।”

“তুই আছিস তোর দায়িত্ব নিয়ে। সে তোর প্যাশেন্ট না।”
“উফ মা থামো। অতো চিন্তা করো না। বাহিরেই বসাব। দরজা লাগানো থাকবে। লোকটা সাহায্য চেয়েছেন এখন সামান্য আশ্রয় না দিলে কেমন দেখায়।”
“যা মন চায় কর।”

নাজমা বেগম আবার রান্নাঘরের দিকে গেলেন। তিতির কেচিগেইটের তালা খুলে লোকটাকে ভেতরে ঢোকার জন্য বলতেই সিঁড়ির ঘরের বাতিটা ফিউজ হয়ে গেল! আলো আঁধারিতে মুখোমুখি দুইজন। তিতির অপ্রস্তুত হয়। ধীর কণ্ঠে বলল,
“আমি একটা চেয়ার আর মোমবাতি এনে দিচ্ছি। আপনি অপেক্ষা করুন।”

মাশরিফ এই অন্ধকারেই মৌন সম্মতি দেয়। তিতির বাড়ির ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ার দিয়ে যায় সাথে ছোট কাঠের চৌকি। মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে আসে অতঃপর কাঠের ছোট চৌকিতে রেখে বলে,
“আর কিছু লাগলে জানাবেন।”
মাশরিফের কণ্ঠ এমনিতেও রুদ্ধ হয়ে গেছে। ভদ্রতা সূচক জবাব দেয়,
“জি।”
তিতির বাড়ির ভিতরে চলে এসে দরজাটা হালকা ফাঁকা করে রাখে। তিতিরের মা রাতের খাবারের জন্য ডাক দিলে তিতির মাকে আস্তে করে বলে,
“মা দেখো, বাহিরের লোকটাকে কিছু খাবার দিলে ভালো হতো। আমরা খাচ্ছি সে খাচ্ছে না। কেমন দেখা যায়। অতিথির মতো তো।”

নাজমা বেগম ব্যাপারটায় ভাবলেন অতঃপর বললেন,
“মাছ তো আমি তিন পিসই রান্না করেছি। এখন দিবো কিভাবে?”

“আচ্ছা। আমার পিসটা দিয়ে দেই। আমি নাহয় তরকারি দিয়ে খেয়ে নিবো।”

তিতিরের কথা শুনে ওর মা বলে,
“না। আমারটা দে। তোর প্রোটিনের দরকার আছে।”
“না। আমার এমনিতেও রাতেরবেলা মাছ খেতে ভালো লাগে না। আমারটাই দেই।”

তিতির মাশরিফকে ডাক দিয়ে বলে,
“আপনি ভিতরে এসে কিছু খেয়ে নিন।”
“না না। আমি কিছু খাব না। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।”

তিতির এবার ওর মাকে পাঠায়। নিজে গিয়ে হিয়ার রুমে হিয়ার কাছে বসে। নাজমা বেগম বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে তারপর রাতের খাবার খাইয়ে নিজেও চেয়ার নিয়ে মাশরিফের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। সাথে বৃষ্টির মধ্যে রংচাও করে নিয়েছে। নাজমা বেগমের স্বভাবই মিশুক প্রকৃতির। তিনি মাশরিফের সাথে জমজমাট আড্ডা বসিয়েছেন। কথা বলার মধ্যে মাশরিফ বলে,

“আন্টি আপনি বললেন, আপনার মেয়ে মেডিকেলে পড়ে। ময়মনসিংহতে চান্স পেয়েছিল। ভর্তির আগেই এখানে ট্রান্সফার হয়েছে। তাছাড়া এখানে কিছু মা*স্তানদের উৎপাতের কথাও বললেন। তাহলে আপনারা সবাই ময়মনসিংহতে চলে গেলেই পারেন। কিছু মনে করবেন না। তিনজন মেয়ে মানুষ একা থাকেন আবার মা*স্তা*নদের নজর পরেছে। আমার মনে হয় আপনাদের সব বিক্রি করে চলে যাওয়া উচিত।”

তিতিরের মা অবাক হয়ে ভাবলেন। তারপর চিন্তিত সুরে বললেন,
“কিন্তু বাবা, এই জায়গা জমি কে কিনবে বলো? আমরা অতো কিছু বুঝিও না। এই সুজন, পলাশদের জন্য সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকি। ছেলেটাও বেঁচে নাই। বউটার কয়দিন পর বাচ্চা হবে। বুঝতেই পারছ কিসের মধ্যে আছি।”

“জি আন্টি। আমার পরিচিত একজন আছে। যে এলাকায় খুব একটা জানাজানি না করেই সব মিটিয়ে ফেলতে পারবে। তার আগে আপনাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমি এই এলাকায় আগামীকালই শেষ। এসেছিলাম একটা কাজে। ফরিদপুর ক্যান্টনমেন্টে আমার পরিচিত আছে। আপনি আপনার মেয়ে-বউয়ের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। আমি আমার নাম্বার দিয়ে যাচ্ছি। যোগাযোগ করলে আমি যথাসম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করব।”

“আচ্ছা বাবা। আমরা ভেবে দেখি। তুমি ভিতরে এসে বসো নাহয়।”
“না আন্টি। এখানেই ভালো আছি। আমার পকেটে মেডিসিন ছিল, খেয়ে নিয়েছি। তাছাড়া বৃষ্টিও কমে এসেছে। ম্যাকানিকের থেকে জিপটা নিয়েই চলে যাব।”
“যতক্ষণ আছে ভেতরে এসে বসতে।”

নাজমা বেগমের কথায় হাস্যজ্জল প্রত্যুত্তরে বলে,
“না আন্টি। আপনাদের ঝামেলাও আমি বুঝি। আপনারা যে আমায় একটু আশ্রয় দিয়েছেন তাতেই আমি কৃতঙ্গ।”

নাজমা বেগম আর জোড় করেন না। বৃষ্টি প্রায় থেমে গেলে মাশরিফ চলে যায়। নাজমা বেগম বাড়ির ভেতরে এসে হিয়া ও তিতিরকে খাওয়ার জন্য ডাকে। সুযোগ বুঝে পরে মাইগ্রেশনের কথা বলবে।

_________

পরেরদিন সকালে তিতির মেডিকেলে যাওয়ার জন্য একটু জলদিই বের হয়। বাড়ির বাউন্ডারির কাছে এসে দেখে ভেজা ঘাষের উপর একটা খাম পরে আছে। তিতির আশেপাশে কৌতুহলী হয়ে চেয়ে দেখল কেউ নেই অতঃপর কালক্ষেপণ না করে খামটা তুলে নিয়ে রওনা করে।
বাসে উঠে ব্যাগ থেকে খামটা বের করে পড়তে থাকে,
“কেমন আছেন তিতিরপাখি? আমি যে ভালো নেই! আপনি নামক এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আমি প্রচণ্ড রকমের আক্রান্ত। আমার চাওয়াটা অযৌক্তিক জেনেও অবচেতন মন তো মানে না। মনকে নিজের বশে রাখার চেষ্টাতে ব্যার্থ হয়ে আবারও তোমার শহরে এসেছি আপনাকে এক ঝলক দেখতে। আবার কাজের ব্যাস্ততায় চলে যাব। নিজেকে প্রচুর ব্যাস্ত রাখতে হবে যাতে আপনায় নিয়ে অন্যায় ইচ্ছা মনে না আসে। ভালো থেকো তিতিরপাখি।”

তিতির চিঠিটা পড়ে নির্নিমেষ চেয়ে আছে। কোনো অনুভূতি বুঝতে পারছে না। সে যে বিবাহিতা। এসব ভেবে নিজ মনে অন্যায় অনুভূতির জন্ম দিতে চায় না। এই বয়সে স্বাভাবিক এসবে আপ্লুত হওয়ার কিন্তু নিজের জীবনে যা ঘটে গেছে তাতে সে সবকিছুকে নজর-আন্দাজ করতেও প্রস্তুত।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here