এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব -১০+১১

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
সুন্দরবনের ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে গাছের গুড়ির উপর বসে আছে কিছু লোক। তাদের সাথে সুজন, পলাশরাও আছে। এই স্থানে সচরাচর বন্য প্রা’ণীদের আনাগোনা থাকলেও লোকগুলো আ*গু*ন জ্বালিয়ে বসেছে তাস খেলতে। এক লোক বলে ওঠে,

“মেজর মাশরিফকেও বন্ধি করতে হবে। কিন্তু ওর দুর্বলতা কি?”

আরেকজন বলে ওঠে,
“এর মা?”
“আরে মা তো সবারই দুর্বলতা থাকে। তাছাড়া মেজর মাশরিফ তার মাকে নিজের কাছে তখনি আনেন যখন সে ছুটিতে থাকে। কিন্তু এমনিতে মেজর মাশরিফের মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। অন্য উপার খুঁজতে হবে। যেমনটা মেজর রাহানের সাথে করা হয়েছে!”

সুজন নে*শাদ্রব্যে টান দিয়ে বলে,
“ওই মেজর রাহান আছিল একটা ব*ল*দ! ও বিশ্বাস করছে ওর বউ আমার লগে শু*ই*ছে! ওই মেজর মিশনে যাওয়ার দিনই তো তিতির বউভাতের পর বাপের বাড়ি আইছিল। তিতিরের বিয়া ঠিক হইছিল তা তো পরে জানছি। একটা মা*মলার লাইগ্যা পলায় আছিলাম। এলাকায় ফিরার পরেও জানতাম না তিতিরের বিয়ার কথা চলে। জানছি ওর বিয়ার দুইদিন আগে। ওর বিয়ার তিনদিন আগে এই মেজর রাহান এলাকায় আইয়া চায়ের দোকানে আমারে সামনেই জিগায়, ‘তিয়াস আহমেদের পরিবার কেমন? কোনো খারাপ রেকর্ড আছেনি? তার বোইনে কই পড়ে? চলাফেরা কেমুন?’ তহন ওই মেজর আর্মির পোশাকে আছিল বইল্যা মুই মুখে কুলুপ অ্যাইটা আছিলাম। আমার তো তহন অতোকিছু মাতায় আহে নাই। সবার থিকা ভালা শুইনা মেজর আমার পাশে বইসা চা খাইয়া গেছে। তহন যদি জানতাম তয় তহনি কথা লাগায় দিতাম। বিয়া করত না আমার ময়না পাখিডারে। এহন মেজর নাই, ময়না পাখিডারে খাঁচায় বন্ধি কইরাই ছাড়মু।”

টে*রো*রি*স্ট লোকগুলোর মধ্যে একজন বলল,
“তোমরা সাহায্য করাতেই মেজর রাহানকে জালে ফাঁসাতে পেরোছি। এখন মেজর মাশরিফেরটাও খুঁজে বের করো। এভাবে সদস্য কমতে থাকলে কেউ কাজে আগ্রহ পাবে না।”

পলাশ বলে,
“খুঁজতে হইব। মেজর মাশরিফ তো আমাগো এলাকার না
তয় লিংক খুঁজতে হইব। আর সপ্তাহ পর এলাকায় যামু। এহন গেলে ঝামেলায় পরমু। এলাকার এক ছোটোভাই কইল, পু*লিশ নাকি তিন-চার বার খুঁইজা গেছে। তিতির, হিয়াগো বাড়িতে নাকি নিরাপত্তার ব্যাবস্থা লাগায় রাখছে। যে খবর দেয় ওয়ও দিনের বেলা বাড়িততে বাইর হয় না। সন্ধ্যার পর চা-পানের লাইগ্যা দোকানে বইলে নাকি শুনছে।”

আরেকজন টে*রো*রি*স্ট বলল,
“ব্যাপারটা সন্দেহজনক। তিয়াসকে যখন গাড়ি চা*পা দিয়ে মা*র*লে তখনও পু*লি*শ এতোবার আসেনি।”

“এইডাই তো বুঝি না বা*। কেডা এমনে পিছে লাগছে?”

পলাশ কিছুক্ষণ অশ্রাব্য গালিগালাজ করে আবার নে*শা-দ্রব্য সেবনে মন দেয়।

___________

ময়মনসিংহতে তিতিরের থাকার জন্য হোস্টেলের ব্যাবস্থাও হয়ে গেছে। একদিনেই ব্যাবস্থা হওয়াতে তিতির দারুণ অবাকও হয়েছে। এদিকে বাড়ি বিক্রির প্রসেস প্রায় শেষ। তিতিরের একাউন্টে টাকাও ট্রান্সফার শেষ। তিতির ব্যাংকে গিয়ে মা ও হিয়ার একাউন্টে সমান করে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছে সাথে কিছু টাকা তুলেও নিয়েছে সামনের মাসে যে টিউশন থাকবে না তাই। বাড়ির যেসব জিনিসপত্র ময়মনসিংহ নিবে সেগুলোকে আর্মির ট্রাক দিয়েই সেনানিবাসের ভিতরে রাখা হয়েছে। বাসা ভাড়া পেলেই নিয়ে যাবে। কম তো না! তিনটা খাট, দুইটা আলমারি, সোকেস, ফ্রিজ, সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল, পুরোনো একটা টিভি, তিনটা ওয়ারড্রবের দুইটা নিবে আরেকটা ঘুণে খে’য়ে ফেলেছে তাই নিবে না। প্রয়োজনীয় হাঁড়ি-পাতিল ও ডিনার সেট নাজমা বেগম ও হিয়া সেদিনই নিয়ে গেছিল। বাকি যেসব নিবে সেসব তিতির নিজের লাগেজে কাপড়ে পেঁচিয়ে নিবে। তিনটা লাগের নিচ্ছে এর জন্য। অন্য শহরে পাড়ি জমাতে এতো ঝামেলা তা এই কদিনে ভালোই বুঝেছে।

আজ শুক্রবার। হাসিব, সাইফ, মৃদুলা, ইতি, রিক্তা সবাই তিতিরকে বিদায় দিতে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের কাছে এসেছে। সবার চোখে পানি। তিতির এই শহরে আর ফিরবে না। তিতির চারদিকে চোখ বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে সবটা দেখে নিলো। বন্ধুদের সাথে কতো মন খারাপ, দুষ্টুমি, আনন্দের স্মৃতি এই স্থানটায়। কপোল বেয়ে গড়ানো নোনাজলের ধারাকে দুই হস্তের তালুর দ্বারা অবরুদ্ধ করল। নাক টেনে কণ্ঠে সংক্রিয়তা এনে বলে,

“এই তোরা কাঁদছিস কেনো? আমি এই শহরে ফিরব না বলেছি কিন্তু তোদের সাথে দেখা করতে আসব না তাতো বলিনি। তোরা কেউই তো এই শহরে স্থায়ি না। একদিন এই মেডিকেল প্রাঙ্গণ তো ছাড়তেই হবে। আমি নাহয় একটু আগেই ছাড়লাম।”

ইতি তিতিরকে এসে জাপটে ধরে। মেয়েটা গতকাল রাত থেকেই কাঁদছে। একটু বেশিই আবেগী কী-না! ইতি ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
“অ্যাই উইল মিস ইউ।”
“মিস ইউ ঠু। তোর নাদুসনুদুস গালগুলো আবার কবে টানব এটা তো বিধাতাই জানেন।”

তিতিরের আহ্লাদী সংলাপে ইতি আরও আবেগী হয়ে পড়ে। সাইফ বলে,
“তোরাও কি সাথে বাসস্টপ পর্যন্ত যাবি?”
মৃদুলা চোখের কোণা মোছে ভাঙা কণ্ঠে বলে,
“হুম। আবার কবে দেখা হবে তা তো জানিনা। শেষ পর্যন্ত সাথে যেতে চাই।”

রিক্তা নিজের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে তিতিরের হাতে দিয়ে ঠোঁটকোলে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে,
“পড়াশোনার ব্যাস্ততা ও সংসার চালানোর জন্য হয়তো সবসময় কথা বলার সময় পাবি না। তাই নিজেকে একা লাগলে এই ছোটো ডায়েরিরটা দেখিস। আমাদের এই দুই বছরের অনেক স্মৃতি বন্ধি আছে। আমার খুব যত্নে গড়া। সামলে রাখিস কিন্তু।”

তিতির রিক্তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কান্না সংবরণ করতে পারে না। এই পাঁচজন দুই বছরের সবসময় তার পাশে ছিল। নতুন ক্যাম্পাসে গিয়ে কি এমন কাউকে পাবে? জানা নেই তিতিরের। ওরা বাসস্ট্যান্ডের জন্য রওনা হলো।
তিতিরকে বাসে উঠিয়ে বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই ছিল। বাস ছেড়ে দিলে তিতির বাসের সিটে গা এলিয়ে দেয়। গন্তব্য নতুন। সূচনা কেমন হবে তা নিয়ে সংশয়।

________

মাগরিবের নামাজ পড়ে সেনানিবাসের নিজেদের রুমে এসেছে মাশরিফ ও অভী। হঠাৎ মাশরিফের ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে মা মহিমা বেগমের নাম্বার দেখে মুচকি হাসে সে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,

“কেমন আছো মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমি সবসময় ভালো থাকি। তুই মিশন থেকে ফিরে দুইদিন আমার ফোন রিসিভ করিসনি তাই আমি তোকে চার দিন ফোনই করিনি। এখন দেখছি আমার ছেলে আমাকে ভুলতে বসেছে!”

মায়ের অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে মাশরিফ মুচকি হাসে। সে তো মায়ের কাছে গু*লি লাগার বিষয়টা লুকাতে কয়দিন ফোন রিসিভ করেনি। মা তার খুব চিন্তাপ্রিয় মানুষ! মাশরিফ বলে,
“আর তিনদিন পর হাজির হবো। দেখো শুধু। তুমি কি কোয়াটারে আছ তো?”

“তো আর কই থাকব? তুই না থাকলে আমাকে এই ক্যাডেট কলেজের কোয়াটারেই থাকতে হয়। তোর যে কেনো এতো ভয় বুঝি না।”

মহিমা বেগমের অভিমান এখনও কমেনি। মাশরিফ বলে,
“তোমার এতোগুলো ছেলে থাকতে আমার কথা মনে পড়ে? তোমার তো ওদের সারাদিনের এক্টিভিটি দেখতে দেখতেই দিন পেরিয়ে যাওয়ার কথা। বিকেলে বড়ো মাঠটার পাশের রাস্তা দিয়ে সবটা চক্কর দাও তো? তোমার সুগার লেভেল কেমন?”

মহিমা বেগম বলেন,
“দেই তো। কম বড়ো মাঠ ওটা? তুই যে একজনকে আমার উপর নজর রাখতে রেখে গেছিস, ওই ছেলে বিকেল হলেই নিজের খেলাধুলো রেখে আমাকে নিয়ে দুইবার করে মাঠে চক্কর দেয়। কিন্তু বাবু, আমি যে ছেলেদের খেলার মাঝে তোকে খুব করে মিস করি।”

মাশরিফের নিজেরও এবার খারাপ লাগছে। ছোটো থেকে এই ক্যাডেট কলেজের মাঠেই খেলাধুলো করে বেড়ে উঠা তার। মা ওখানকার শিক্ষিকা হওয়াতে আরও সুবিধা হয়েছে। তবে মায়ের চাকুরির আর তিন বছরের মতো আছে। নিজেও তো এই ক্যাডেট কলেজের ছাত্র! অভীর সাথে বন্ধুত্ব কলেজ থেকে। আগে খুব একটা কথা হতো না অভীর সাথে কিন্তু কলেজ থেকে ফুটবল টিমে দুজনের বন্ধুত্বের শুরু। আরও বন্ধুরা সবাই তো আর্মিতে জয়েন হয়নি।

মাশরিফ আদুরে কণ্ঠে বলল,
“অ্যাই মিস ইউ ঠু, মা। খুব শিঘ্রই দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্‌।”
“ইনশাআল্লাহ্।”

ফোন কে*টে দেওয়ার পর অভীর দিকে তাকালে দেখে অভী এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মাশরিফ ইশারাতে সুধালে অভী বলে,
“গু*লি লেগেছে এটা আন্টিকে তুই জানাতে না চাইলেও তুই বাসায় গেলে আন্টি এমনিতেই জানবে। ছুটির পর বাসায় গেলে আন্টি তোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে।”

মাশরিফের ভাবলেশহীন জবাব,
“করুক। সে যা করে শান্তি পায়। আমার সামনে চিন্তা করুক আমি সামলে নিব কিন্তু আমার আড়ালে চিন্তা করে বিপি হাই করে বসে থাকবে তারপর আমার চিন্তা দ্বিগুণ করবে।”

হুট করে অভী হেসে ফেলে মাশরিফও হাসে। অতঃপর দুইজনে ড্রেস বদলে ডাইনিংয়ে যায় সন্ধ্যার নাস্তার জন্য।
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
ময়মনসিংহতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। তিনটা লাগেজ অতি সাবধানে নামিয়ে এখন সিএনজি খুঁজছে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। একা মেয়ে দেখে সিএনজি ড্রাইভাররা অধিক ভাড়া দাবি করছে। প্রায় দশ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে রইল। অচেনা শহর, অচেনা রাস্তা। কোনদিকে কই যাবে কিচ্ছু বোধগম্য হচ্ছে না তিতিরের। সিএনজি ড্রাইভাররাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে মেয়েটা এই শহরের কিছু চিনে না। সিএনজি ড্রাইভাররা যতো ভাড়া চাচ্ছে ততোটা তার বাস ভাড়ার থেকেও অনেকটা বেশি। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এসে বলল,
“মা, কই যাইবা?”

তিতির হকচকিয়ে তাকায়। এই অচেনা শহরে এতো কোমল স্বরে তাকে ডাকার মানুষটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। রাস্তার স্বল্প আলোতে যেটুকু দেখা সম্ভব হলো তাতে তিতির বুঝল লোকটা অধীর আগ্রহে তিতিরের দিকে চেয়ে আছে। তিতির হালকা হেসে বলল,

“মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে যাব চাচা।”
“তয় লও আমার গাড়িতে। ভাড়া লইয়া চিন্তা কইরো না। মেডিকেল কলেজের ওইহানেই আমি থাকি। ন্যায্য ভাড়াই রাখমু। অনেকক্ষণ ধইরা খাড়ায় আছো। লও আমি পৌঁছায় দেই।”

তিতিরেরও আর দামাদামি করতে ইচ্ছে হলো না। লোকটাকে বিশ্বাস করতে মন সায় দিলো। লাগেজ গুলো বৃদ্ধ ড্রাইভারের সাহায্যে গাড়িতে তুলে নিলো। তারপর তিতির গাড়িতে বসলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। ড্রাইভার বলতে লাগে,

“আমি মেডিকেল কলেজের ওখানেই থাকি। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা আমারে খুব ভালো পায়। কিছু হইলেই আমারে ফোন কইরা কইব, ‘চাচা জলদি আসেন। এক জায়গায় যাইতে হইব।’ আমিও আর কী! যাই। সন্তান থাকতেও নিঃসন্তান আমি। ওরা পাশে আছে বইলা শান্তি লাগে। আমার ও আমার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচও ওরাই চালায়। এতো মানা করি শোনেই না।”

বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার কথা শুনে তিতিরের মুখে হাসি ফুটল। তিতির বলল,
“আজ থেকে তবে আপনি আরেকটা মেয়ে পেলেন। আমাকেও ওদের মতো রাখবেন?”

“রাখমু না ক্যান? অবশ্যই রাখমু।”

তিতির মুচকি হাসল। ক্লান্তিতে চুপ করে রইল। কিছু সময় পর গন্তব্যে পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে বলে,
“ধন্যবাদ চাচা। ভালো থাকবেন। আমার জন্যও দোয়া করবেন।”
“তুমিও ভালা থাইকো মা।”
তিতির লাগেজগুলো নিয়ে হোস্টেলের ভিতরে গেলো। তিতিরের প্রস্থানের পর বৃদ্ধ ড্রাইভার চাচার ফোনে কল আসে। তিনি ফোন রিসিভ করে সালামের জবাব দিয়ে বলে,

“হ বাবা। নামাইয়া দিয়া গেছি। মাইয়াটা একলা খাড়ায় আছিল। মাইয়াডা তোমার কিছু হয়?”
“আরে না চাচা। ফ্রেন্ডের কথায় এসব করছি।”
“ওহ। আমি ভাবলাম তোমার কিছু হয়। সমস্যা নাই।”
“আচ্ছা চাচা।”

অর্ক ফোন রেখে বলে,
“এই রাফি, মাশরিফরে মেসেজ করে জানা। আমি ওয়াশরুমে গেলাম।”

এই বলে অর্ক ওয়াশরুমে দৌঁড় দেয়। শুভ বলে,
” রাফি ফোন দে। নেটে নাই দেখলাম।”
“তুই দে। আমার ফোনে টাকা থাকলে তো চাচারে আমিই ফোন দিতাম। ব্যালেন্সের মেয়াদ শেষ। কালকে সকালে ব্যালেন্স নিতে হবে।”

রাফির কথায় শুভ মাশরিফকে ফোন লাগায়। মাশরিফ যেনো ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ফোন রিসিভ করে সরাসরি বলে,
“তিতির এসে পৌঁছেছে?”

শুভ বিরস কণ্ঠে বলে,
“ফোনটা ধরেই আমাদের কোনো খোঁজ-খবর না নিয়েই সরাসরি প্রেমিকার খবর জিগাস। যা তোরে কমু না।”

শুভ সাথে সাথে কল ডিসকানেক্ট করে দিল। রাফি অবাক হয়ে বলল,
“ফোন যখন দিছিস তো কথাটা বলেই কা’টতি।”
শুভ দাঁত বের করে হেসে বলে,
“এখন ও ফোন দিবে। দেখ খালি।”

সত্যি সত্যি মাশরিফ ফোন দিল। খুব আয়োজন করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেসা করে,
“কেমন আছিস তোরা? বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নাই।”

“হইছে থাম। আমরা সবাই ভালো আছি। তোর তিতিরপাখিও হোস্টেলে এসে পৌঁছে গেছে। শান্তি?”

মাশরিফ স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“থ্যাংকিউ রে। আমি আর দুইদিন পর টাংগাইল আসব। তারপর আম্মুকে মির্জাপুর থেকে বাসায় নিয়ে আসব। তোদের সাথেও দেখা করব।”

শুভ রম্যস্বরে বলে,
“আমাদের সাথে? নাকি…!”

মাশরিফ হালকা হেসে বলে,
“তোদের সাথেই দেখা করতে আসব যতোদিন থাকব। তার মধ্যে একটুখানি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম আরকি!”

“তুই মিয়া বহুত চালাক। তা আন্টিকে বলছিস?”

শুভর প্রশ্নের জবাবে মাশরিফ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে। হতাশ স্বরে বলে,
“নাহ্! অনেক কিছু মাকে জানানোর আছে। আগের হৃদপ্রিয়া তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করুক।”

রাফি, শুভ, অর্ক সমস্বরে বলে ওঠে,
“কবুল হোক।”

মাশরিফের সাথে বসে অভীও বলে,
“কবুল হোক।”

মাশরিফ হেসে ফেলে। বলে,
“একদিন রাতুল, রণিতকেও বল না রাজশাহী থেকে আসতে। সাত বন্ধুর একটা ছোটোখাটো গেট-টুগেদার হয়ে যাক।”

“হ্যাঁ বলব। ওরাও বলছিল।”
রাফির জবাবে মাশরিফ বলে,
“আচ্ছা থাক তবে। নামাজ পড়ে নেই।”
“বায়।”

বন্ধুদের কথা শেষ হলে মাশরিফ ও অভী নামাজ পড়তে যায়। নামাজের পর ডাইনিংয়ে যাবে ডিনারের জন্য।

_______

হোস্টেল সুপার তিতিরকে তিতিরের রুম দেখিয়ে দিল। রুমে আরও দুইজন আছে। হোস্টেল সুপার বললেন,

“শুনো তিতির, এখানে এরা ফরেন স্টুডেন্ট। অন্য রুমে তোমাকে দেওয়া হয়নি। মেয়েরা খুব ভালো। আশা করি মিলে চলতে পারবে।”

তিতির কৃতঙ্গতা প্রকাশ করে বলে,
“ধন্যবাদ মেম। আমি চেষ্টা করব ওদের সাথে বন্ধুত্ব করার।”

হোস্টেল সুপার চলে গেলে তিতির ব্যাগগুলো নিয়ে নিজের বেডে বসে। পাশের বেড থেকে এক মেয়ে বলল,
“হ্যালো। মাইসেল্ফ লিরা।”

“হ্যালো। মাইসেল্ফ তাহিয়া নূর তিতির।”

তিতিরের প্রত্যুত্তরে লিরা বলে,
“টোমার নামটা খুব বড়ো। ক্যান অ্যাই কল ইউ টিটির?”

তিতিরের বিষম লেগে যায়। তিতির বলে,
“টিটির না। তিতির। ইংলিশে টি হলেও বাংলাতে ত উচ্চারণ হয়।”

লিরা মিষ্টি হেসে বলে,
“সরি টিটির। অ্যাই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড বাংলা বাট সাম ওয়ার্ড..!”

তিতির হেসে বলে,
“ইটস অকে। ইউ ক্যান কল মি টিটির।”

“থ্যাংকস। ইট উইল টেক সাম টাইম টু প্রনাউন্স। ফার্স্ট টাইম বাঙালি রুমমেট। হেই টিটির, মিট মাই ফ্রেন্ড জুলিয়া। আমাদের বাংলাদেশ অনেক ভালো লাগে। দ্যাটস হোয়াই উই আর হেয়ার। ইউ নো? বোথ অফ আওয়ার প্যারেন্টস আর বাংলাদেশী। বাট দে আর নো মোর।”

তিতির মলিন হাসলো। এতো সুন্দর প্রাণোচ্ছল মেয়েগুলোকে দেখে মনেই হয় না ওরা পরিবারহীন। তিতির বলল,
“সরি।”
“নো নো। ইটস অকে। টুমি রেস্ট নাও।”

তিতির হালকা হেসে হাত-মুখ ধুঁতে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে মা ও হিয়াকে ফোন করে সব জানায়।

_______

নতুন ভোর। স্নিগ্ধতায় ভরপুর। নতুন শহরে প্রথম সকালটাতেই মন ভালো হয়ে গেলো তিতিরের। আজকে এখানে প্রথম ক্লাস করতে যাবে। একটু ভয় ভয় করলেও অন্যরকম উৎসাহ কাজ করছে। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ কফির মগ এগিয়ে দিলে তিতিরের ভ্রুঁ কুঁচকে আসে। পাশ ফিরে চাইলে দেখে লিরা। লিরা চমৎকার হেসে বলে,

“গুড মর্নিং।
তিতিরও হেসে বলে,
“গুড মর্নিং।”
কফি?”
তিতির লিরার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে বলল,
“থ্যাংকিউ।”

লিরা নিজে নিজেই তিতিরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেসা করা শুরু করে। তিতিরও ওর সাথে তাল মিলাচ্ছে। রুমমেট নিয়ে তিতির দারুণ খুশি কিন্তু বেশিদিন তো থাকতে পারবে না।

কফি শেষ করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। তিতির জানতে পারে লিরা ও জুলিয়া তিতিরের ব্যাচমেট। তিনজন একসাথে ক্লাসে যায়। প্রথমদিন হিসেবে দুইজন নতুন ফ্রেন্ড পেয়ে ভালোই লাগছে। ক্লাসে গিয়ে লিরা ওর অন্য ফ্রেন্ডদের সাথে তিতিরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

ক্লাস শেষে লিরা ও জুলিয়া তিতিরকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে। পথে ইন্টার্নের শেষের দিকে থাকা রাফি, অর্ক, শুভদের সাথেও দেখা হয়ে যায়। অর্ক নিজ থেকে এগিয়ে এসে একটু না জানার ভান করে তিতিরকে বলে,

“তুমি কে? নতুন দেখছি আজ। ফ্রেশারদের তো আসার এখনও সময় হয়নি।”

তিতির ভয়ে কাঁচুমাচু অবস্থা। র‍্যা*গিং এর শি*কার হবে কী-না ভয়ে আছে। স্বল্প শব্দে বলে,
“ভাইয়া আমি মাইগ্রেশন করে ফরিদপুর থেকে এখানে এসেছি।”

“ওহ আচ্ছা। তা লিরা, জুলিয়ার সাথে উঠেছ নাকি?”

লিরা অর্কের এমন অভিনয় দেখে মুখ কুঁচকে নেয়। পরশুদিনেই তো অর্ক ও শুভ এসে লিরা ও জুলিয়াকে তাদের নতুন রুমমেটের কথা জানিয়েছিল। অর্কের এই প্রশ্নের জবাব লিরা মুচকি হেসে দেয়,
“ইয়েস ব্রো। উই আর রুমমেট!”

অর্ক জোরপূর্বক হেসে বলে,
“আচ্ছা থাক তবে। পরে কথা হবে।”

জুলিয়া মুখে হাত দিয়ে হাসছে। অর্ক, রাফি, শুভ চলে গেলে ওরাও তিতিরকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। পরবর্তী ক্লাস শুরু হতে এখনও সময় বাকি।

________
সুজন, পলাশরা এলাকায় এসেছে ভোরে। এসেই তিতিরদের বাড়ির কাছে গেছে। উুঁকিঝুঁকি দিয়ে নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে। ওরা তো বুঝতেও পারল না। তিতিররা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here