এক_রক্তিম_ভোর পর্ব শেষ

#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৩০(অন্তিমপর্ব)

চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। রাতের আধার ঠেলে কৃত্তিম আলোয় চারপাশ মুখোরিত। বাড়ির প্রতিটা মানুষ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ছোটাছুটিতে ব্যাস্ত। রাত গভীর হওয়ার আগে কাজ গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রকৃতিতে শীতের বরন হয়ে গেছে অনেকদিন। এখন প্রায় বিদায়ী পথে। শীতল সমীরণ কাপিয়ে তুলছে নাবিলার শরীর ও মন। চাদরটা আরেকটু প্যাচিয়ে নিলো গায়ে। ফুলে সজ্জিত রুমে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো। ফুলের সাথে মোমবাতির আলোয় মুড়ে রয়েছে ঘরটা। প্রয়াসের রুচি যে কতটা উন্নত তার প্রমান ওর প্রতিটা কাজেই পাওয়া যায়। রুমের প্রতিটা জিনিসই সাধারনের মাঝে সৌখিন। বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়ির চেহারা বদলে দিয়েছে সে। নতুন জীবনের সাথে বাড়ির আনাচে কানাচেও নতুন জিনিসপত্র ঠাই পেয়েছে। নাবিলা হঠাৎই লজ্জায় নুইয়ে গেলো।ওর আজ সবই অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।

নাবিলা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বাড়ি ফিরেছে প্রায় তিনমাস হতে চললো। পায়ের আঘাতও সেড়ে গেছে। তাই তারেক হোসেন এবং শাহেদ সাহেব তাদের অপূর্ণ কাজটা আজ সম্পূর্ণ করে দিলো। নাবিলা এবং প্রয়াসের পুনরায় বিয়ে হলো আজ। শুধু তাই নয়, ওরা এখন বাবা-মা। অলিভারের বাবা-মা। অলিভার এখন প্রয়াসকে বাবা এবং নাবিলাকে মা বলে ডাকে।

নাবিলার সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এখন অলিভারের বসবাস। জন্ম না দিয়েও মা হওয়ার এক অমোঘ আনন্দ পেয়েছে সে। ছোট্ট অলিভার নিত্যনতুন বাংলা শিখছে প্রতিদিন। আধো আধো কন্ঠে যখন মা মা বলে নাবিলার পেছনে ছোটে তখন ওর নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, পরিতৃপ্ত মনে হয়। ব্যথা পেলে যখন কেদে ভাসায় তখন নাবিলা আপনা আপনি হাজারটা আদুরে ভাষায় ওকে আগলে নেয়। কখনো শাসন করে। আবার আদর করে গল্প শোনায়। বুকে নিয়ে ঘুম পারায়। যেমনটা এখন রেখেছে।

নাবিলা ওর বুকে লেপ্টে থাকা ঘুমন্ত অলিভারকে একবার দেখে নিলো। কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে চাদরটা মুড়িয়ে দিলো আরো কিছুটা। রুমের মধ্যে চোখ বুলিয়ে আপন মনে হেসে ফেললো নাবিলা। অলিভার ইতিমধ্যেই ঘুমানোর আগে একবার তান্ডব চালিয়ে ফেলেছে ঘরটায়। ওকে বিয়ের সাজে দেখে অলিভার ভেবেছিলো মা চলে যাচ্ছে কোথাও।

বিয়ে হওয়া মানে নিজের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়া বিষয়টা কিভাবে বুঝেছে কে জানে। সমানে কেদেই গেছে নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে। কাউকে কাছে পর্যন্ত আসতে দেয়নি। ওর পাগলামি শান্ত করেছিলো প্রয়াস। কিন্তু তবুও নাবিলা চলে যেতে পারে ভেবে ওর শাড়ির আচল নিজের হাতের ঘড়ির সাথে বেধে রেখেছিলো। অলিভারের এমন কান্ডে উপস্থিত সবাই হেসে কুটিকুটি। ও শুধু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখেছে। যেন বলতে চেয়েছে,
‘মা কে একবার আমার থেকে আলাদা করে দেখো! তোমাদের খবর আছে।’

ছিটকিনির আওয়াজে ঘুরে দাড়ালো নাবিলা। প্রয়াস এসেছে। সাদা পাঞ্জাবীতে এক আলাদা শোভা ফুটে উঠেছে ওর গায়ে। রুমের দিকে চোখ বুলিয়ে আপন মনে হেসে ফেললো। বুঝতে বাকি নেই একজন এত ফুল একসাথে দেখে খুশিতে গড়াগড়ি খেয়েছে। ধীরপায়ে নাবিলার কাছে এসে ঘুমন্ত অলিভারকে ওর কোল থেকে নিয়ে নিলো সন্তর্পনে। দরজার সামনে গিয়ে নয়নতারা বেগমের কোলে দিয়ে দিলো ওকে। অলিভারের আরেকজন পছন্দের মানুষ নয়নতারা বেগম। দুজন দুজনের ভাষা কম বুঝলেও কথা বলে চলে অনবরত। নয়নতারা বেগম অলিভারকে নিয়ে চলে যেতেই প্রয়াস দরজা আটকে ফিরে আসলো।

নাবিলা বললো,
‘পাঠিয়ে দিলে কেনো? ঘুম ভেঙে গেলে আবার কেদে কেটে অস্থির হয়ে পড়বে।’

‘কিছুই করবে না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই আবার নিয়ে আসবো।’

নাবিলা চুপ করে গেলো। কি কথা বলবে ভেবে পেলো না। প্রয়াস ওর হাত ধরে খাটে বসিয়ে দিলো। তারপর হাটু গেড়ে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো মেঝেতে বসে পড়লো। নাবিলা বাধা দিতে চাইলে বললো,

‘দেখতে দে আগে।’

লাল পাড়ের সাদা বেনারসি শাড়িতে বাঙালি নববধুর রুপ হাজারগুনে বেড়ে যায়। প্রয়াসের প্রথম অনুভূতির সাক্ষী ছিলো লাল-সাদা শাড়ি। তাই বিয়েতেও সেটাই পড়েছে নাবিলা। লাল টকটকে লিপস্টিক, কাজল কালো চোখে খুন হতেও দ্বিধা করবে না প্রয়াস। প্রয়াস নাবিলার খোপায় হাত দিতে গেলে ও না বুঝে সড়ে গেলো।

‘এতো ছটফট করছিস কেনো? চুপচাপ বসে থাক।’

নাবিলা থেমে গিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। প্রয়াস কি করতে চাইছে ও বুঝতে পারছে না। তবে ওর বুকের বা পাশে যে হারে বাদ্যযন্ত্র বেজে চলেছে সেটা পাছে প্রয়াস টের পেয়ে যায় সেই ভয়ে দূরে থাকতে চাইছে।
প্রয়াস ওর খোপার ফুল এবং ক্লিপ খুলতে খুলতে বললো,

‘বাজতে থাক। মন্দ লাগছে না শুনতে।’

নাবিলার থুতনি বুকের সাথে লেগে গেলো। লোকটা ওকে লজ্জায় ফেলতে পারলে খুশি হয় যেন। চুলের প্রতিটা ক্লিপ খুলে ওর কোকড়ানো চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দিতে প্রয়াসের ঘাম ছুটে গেছে।

‘উফফ! এতো কিছু লাগিয়ে চুল বাধতে হয়?’

নাবিলা হেসে আচল উঠিয়ে একবার প্রয়াসের কপাল মুছিয়ে দিলো। যদিও ঘাম নেই কপালে। প্রয়াস ওর চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বললো,

‘তোকে সেবার জেসির সাথে শাড়ি পড়ার পর বলেছিলাম না একটা জিনিস মিসিং ছিলো?’

‘হ্যা। কিন্তু আমি কোনো কিছুই মিসিং পাইনি।’

‘ছিলো। আমার প্রথম অনুভূতির সেই সুর্য দ্বয়ের রক্তিম ভোরে খোলা চুলে, সদ্য যৌবনে প্রস্ফুটিত এক রমনী পায়ে আলতা দিতে ব্যস্ত ছিলো। সেই আলতা পড়া রক্তিম দৃশ্যটাই আমার মাথায় গেথে গেছিলো সারাজীবনের জন্য। অথচ জেসির সাথে শাড়ি পড়ে আসল জিনিসটাই দিসনি। আমি অবশ্য আলতাটা এনেছিলাম কিন্তু দেওয়ার ইচ্ছা হয়নি। আমি চেয়েছি দ্বিতীয়বার তোকে আলতা টা নাহয় আমিই পড়িয়ে দেবো। আজ আমার সেই ইচ্ছাটা পূরন করতে চাই।’

প্রয়াস কাবার্ড থেকে একটা প্যাকেট বের করলো। তাতে আলতা। মেঝেতে বসে সযত্নে নাবিলার পায়ে আলতার টান আঁকতে লাগলো সে। নাবিলা বিমোহিত অক্ষিযুগলে মানুষটাকে দেখে গেলো। এত সযত্নে কিভাবে ভালোবাসে মানুষটা?
আলতা পড়িয়ে নাবিলাকে দাড় করিয়ে ভালো মতো দেখে বললো,

‘অপূর্ব! আমার স্বপ্নে সাজানো যত্নে রাখা বউটা আজ আমার সামনে।’ বলে নাবিলার কপালে ঠোঁট ছোয়ালো।

‘এতো ভালো কিভাবে বাসো তুমি? আমি যে মাঝে মাঝে ভয় পাই। আদৌ তোমাকে তোমার মতো ভালোবাসতে পারবো কিনা।’

‘পারতে হবে না। শুধু তোর উপস্থিতিতে আমায় ঘিরে রাখিস। আমার সবটা ভালোবাসা নিজের মধ্যে ধরে রাখিস। তোর ভালোবাসাটা আমি আমার মতো নিয়ে নেবো।’

নাবিলা আলতো করে প্রয়াসের বুকে মাথা রাখলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো প্রয়াসকে ওর জীবনের সাথে জুড়ে দেওয়ার জন্য। প্রয়াসের স্পর্শ খানিক গভীর হতেই দরজায় ধুম ধাম শব্দ হতে লাগলো। প্রয়াস নাবিলা দুজনের চমকে উঠলো। প্রয়াস এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই অলিভারের কান্না মাখা ঘুম জড়ানো মুখটা নজরে এলো। নাবিলা সেটা দেখেই দ্রুত পায়ে হেটে ওকে কোলে তুলে নিলো। অলিভার কান্না জড়ানো কন্ঠে অভিযোগ করলো কেনো ওকে ছেড়ে বাবা মা এই সুন্দর ঘরে ঘুমাবে।

নাবিলা ওকে ফুলের মাঝে বসাতেই কান্না থেমে গেলো। নাবিলার গলা ছেড়ে বিছানায় হুটোপুটি শুরু করলো। প্রয়াস আফসোসের নিঃশ্বাস ফেলে দরজা লাগিয়ে দিলো। অলিভারকে কিছুক্ষন দলাই মলাই করে নাবিলা যখন উঠে দাড়ালো অলিভারের নজর গেলো আলতার কৌটার দিকে। প্রয়াসের কাছে জানতে চাইলে সে নাবিলার পায়ের দিকে দেখিয়ে বললো,

‘এটা পায়ে দেয়। দেখো তোমার মায়ের পায়ে দিয়েছি।’

অলিভার খুশি হয়ে বললো,
‘পেইন্টিং?’

‘হুম পেইন্টিং।’

অলিভার নিজের পা এগিয়ে দিয়ে মায়ের মতো পেইন্টিং করে দিতে বললো। প্রয়াস দাত মুখ খিচিয়ে একবার নাবিলাকে দেখে নিলো। ও মিটমিট করে হাসছে। প্রয়াসের ইচ্ছে করলো আলতা নিজের মাথায় ঢালতে। ছেলে কিনা মায়ের মতো আলতা পড়বে। পাঞ্জাবির হাতা উপরে তুলে লেগে পড়লো ছেলের পায়ে আলতা লাগাতে। বিড়বিড় করে বললো,

‘প্রথম বাসর গেলো হাসপাতালে, দ্বিতীয়টা গেলো ছেলের পেছনে। তোর কপালে বউয়ের সান্নিধ্যে নেই রে প্রয়াস। মা বোধহয় আগেই জানতো তার ছেলেকে সারাজীবন সবকিছুতে প্রয়াস করেই কাটাতে হবে। তাইতো নামটাও রেখেছে তাই। উফফ!’

নাবিলা ওর কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো। ওর হাসি দেখে কিছু না বুঝেই অলিভারও হাসিতে যোগ দিলো।

____________

ছোট্ট সংসারে হেসে খেলে তিন বছর পার হয়ে গেছে। অলিভারের এখন ছয় বছর বয়স। বাংলা ভাষায় একদমই দক্ষ হয়ে উঠেছে সে। পড়তে কিংবা লিখতেও অসুবিধা নেই। অলিভারের যখন চার বছর বয়স তখন হুট করেই অয়নের বাবা মায়ের তাদের নাতির প্রতি ভালোবাসা গলে গলে পড়তে শুরু করে। অয়ন জেলে থাকায় ছেলের একমাত্র স্মৃতিকে তারা নিজের করে নিতে চায়। এতে করে দুই পরিবারে রীতিমতো সংঘর্ষ লেগে যায়৷ অয়ন পরে নিজেই জানায় তার ছেলের প্রতি ওর কোনো দাবি নেই।এবং ওর বাবা মাকেও অলিভারের ধারে কাছে যেতে নিষেধ করে দেয়। সময় থাকতে যে ভালোবাসা অলিভারকে দিতে পারেনি এখন সেই ভালোবাসা উতলে পড়লেও অলিভারের আশা করে না অয়ন।ওর সারাজীবন দখল করে থাকবে অনুসূচনা। এর মাঝে দিশার সাথে অলিভারের একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দিশা সময় পেলেই অলিভারের সাথে সময় কাটাতে চলে আসে।

অয়নের সূত্রে অলিভারের চেহারায় বাঙালি আদল থাকলেও গায়ের রঙ এবং নামের জন্য অনেক অপরিচিত মানুষজন জিজ্ঞেস করতো অলিভার বিদেশি কিনা। সেই বিড়ম্বনা কাটাতে নাবিলা ওর নাম রেখেছে আদ্র। অলিভার আদ্র। এখন আর তেমন সমস্যায় পড়তে হয় না। আদ্র জানে নাবিলা ছাড়াও তার আরেকটা মাম্মা আছে আকাশে। এমিলির একটা বড় ছবি ওর ঘরে টানানো রয়েছে। প্রয়াস নিজেই চায়নি আদ্র ওর আসল মাকে ভুলে যাক। যদিও অয়নকে আদ্র পুরোপুরি ভুলে গেছে। সে জানে তার বাবা প্রয়াস। এবং মা নাবিলা। এমিলি হচ্ছে ওর অ্যাঞ্জেল মাম্মা। যিনি আকাশে থাকেন। প্রতিবছর তার মৃত্যু বার্ষিকী পালন করে ওরা।

নাবিলা এখন পুরোপুরি সংসারী হয়ে উঠেছে। ছেলে এবং সংসার দুটোই সামলে যাচ্ছে। প্রয়াসের ভালোবাসা এবং ভরসায় নাবিলা এখন একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ নারী, স্ত্রী এবং মা। ওর বিয়ের বছর ঘুরতেই নয়নতারা বেগম পৃথিবী ত্যাগ করেন। সেই শোকে দুই পরিবারের সবাই মুষড়ে পড়ে। বিশেষ করে নাবিলা। তার পর থেকেই দুই পরিবার একসাথেই থাকে।

________

ইদানীং নাবিলা এবং প্রয়াসের একটা মতবিরোধ চলছে। বিষয়টি হলো নাবিলা মা হতে চায় এবং প্রয়াস তাতে কিছুতেই রাজি নয়। প্রয়াস চায় আদ্রকে নিয়েই বাকি জীবন পার করে দিতে। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার তর্ক হয়ে গেছে দুজনের। নাবিলা রাগ করে দুই সপ্তাহ কথা বলা এমনকি এক ঘরে থাকাও বন্ধ করে দেয়। তাতেও প্রয়াস বাচ্চা নিতে নারাজ। নাবিলা বাচ্চার ব্যাপারে কারো সাথে কথা বলতে গেলেই এড়িয়ে যায় সবাই। বিষয়টি খটকা লাগে ওর। যেই প্রয়াস বাচ্চা এতো ভালোবাসে সে কিনা নিজের একটা সন্তান চাইছে না ভাবতেই অবাক হচ্ছে নাবিলা।

এক্সিডেন্টের সময়কার পুরোনো সব মেডিকেল রিপোর্ট বের করে চেক করে নাবিলা। কিন্তু তেমন কিছুই বোঝে না। তাই কাগজগুলো একজন গাইনাকোলজিস্ট কে দেখালে তিনি জানান এক্সিডেন্টে নাবিলার জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মা হওয়ার সুযোগ প্রায় অনেকটাই কম। যদিও কনসিভ করে তাহলে মা কিংবা বাচ্চা দুজনেরই লাইফ রিস্ক থাকতে পারে। কথাগুলো শুনে নাবিলা থমকে যায়। ওর পুরো পরিবার জানতো এইটা শুধু ওকেই জানানো হয়নি। তাইতো প্রয়াস বাচ্চা নিতে চায়না। নাবিলা এর পর থেকে নিজেকে শক্ত করে নিলো। হয়তো ওর সন্তান ধারন ক্ষমতা নেই বলেই আদ্র ওর জীবনে এসেছে, ওকে মাতৃত্বের স্বাদ দিতে।

এরপর আরো এক বছর কেটে গেলো। নাবিলা আর বাচ্চার জন্য জেদ করেনি। বরং আদ্রকে নিয়েই ওর সারাটাদিন ভালোভাবে কেটে যায়। ইদানীং ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। প্রয়াস তা দেখে ওকে ডাক্তারের কাছে নিলে জানতে পারে নাবিলা কনসিভ করেছে। খবরটাতে নাবিলা এবং আদ্র খুশি হলেও বাকি সবার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো। প্রয়াসের নিজের ওপর রাগ হলো। ওর ভুলেই ঘটনা টা ঘটেছে।

ডাক্তার জানিয়েছে নাবিলা মোটামুটি সুস্থ। তবে বাচ্চা পেটের মধ্যে যত বড় হবে, কমপ্লিকেশন তত বাড়বে। ডেলিভারি টাইমে একটা বড় ঝুকি থাকছেই। আতঙ্কে প্রয়াসের শরীর হিম হয়ে যায়। কি করবে বুঝতে পারে না। অন্যদিকে, নাবিলা বাচ্চাটা নিয়ে একটু বেশিই এক্সাইটেড হয়ে গেলো। দিন যত যেতে লাগলো প্রয়াসের দুশ্চিন্তা এবং নাবিলার খুশি দুটোই বাড়তে লাগলো। এবোরশন করানোর কথাও প্রয়াস ভাবতে পারে না। কারন ওরা তিন মাস পার হওয়ার পর জানতে পেরেছে প্রেগ্ন্যাসির ব্যাপারে। আর করানোর সুযোগ থাকলেও প্রয়াস সেটাকে সাপোর্ট করে না। এতে নাবিলা ভেঙে পড়বে। প্রয়াস দিশেহারা হয়ে পড়ে। ওর চিন্তা নাবিলা বোঝে। প্রতিদিন রাতে প্রয়াসের বুকে মাথা রেখে একটা কথাই বলে,

‘আমি ঠিক আছি। কিছু হবে না দেখো।’

অন্যদিকে আদ্র নিজের ঘরেই একপাশ ছেড়ে দিয়ে নতুন বাবুর খেলার ঘর বানিয়ে ফেলেছে। মায়ের সবদিকে খেয়ালও রাখছে ছেলেটা।

________

প্রেগ্ন্যাসির পাঁচ মাস হওয়ার পর নাবিলার অনুরোধে জেসি বাংলাদেশে আসে। নাবিলা হসপিটালে জেসির সাথে খারাপ ব্যবহার করায় অনুতপ্ত। জেসির তখন একেই ভগ্ন হৃদয়। তারওপর নাবিলার ওইরুপ ব্যবহার নিতে না পেরে মনঃকষ্ট নিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। এর পর নাবিলা অনেকবার আসতে বলেছে ওকে। জেসিই এড়িয়ে গেছে। নাবিলার প্রেগ্ন্যাসি এবং সেটার জটিলতা শুনেই জেসি আবার বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। পরের মাসেই চলে আসে সে। জেসি মুভ অন করার চেষ্টা করছে অনেকদিন যাবত। সব ঠিক থাকলে পরের বছর সে বিয়ে করবে ওর এক কলিগ কে।

দেখতে দেখতে নাবিলার নয়মাস হয়ে এসেছে। জেসি, আদ্র এবং প্রয়াস সারাদিনই ওর পাশে থাকে। মাঝে মাঝে দিশাও এসে যোগ দেয়। তবে শরীরটা ইদানীং একটু বেশিই খারাপ করে নাবিলার। হাটাচলা করাও কষ্টকর মনে হয়। প্রয়াস নিজে নাবিলাকে ধরে ধরে সব যায়গায় নিয়ে যায়। আট বছর বয়সী আদ্রও যথেষ্ট ম্যাচিওর হয়ে উঠেছে মায়ের ব্যাপারে। যদিও সে জানে না তার মায়ের প্রেগ্ন্যাসি কমপ্লিকেশন রয়েছে।

আজ খুব ভোরে নাবিলার শরীর খারাপ হয়। প্রয়াস ঘুমের মাঝেই গোঙানির আওয়াজ পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে পরে। নাবিলাকে নীল হয়ে যেতে দেখে ভয় পেয়ে যায়। জেসিকে আদ্রকে দেখে রাখতে বলে প্রয়াস ছোটে নাবিলাকে নিয়ে। কনসিভ করার পর থেকে ওর শ্বাস কষ্টের একটা সমস্যাও দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে নিতেই ডাক্তাররা ওকে এডমিট করে নেয়। জানায় আগে ওর কমপ্লিকেশন গুলো বুঝে, শ্বাসকষ্ট কমলে তারপর অপারেশন করা হবে। প্রয়াস পাথরের মতো হয়ে গেলো। নাবিলা জ্ঞান হারাবার আগে শুধু কয়েকটা কথা হলো দুজনের মাঝে।

‘আমার বাচ্চাটাকে যে কোনো পরিস্থিতিতে বাঁচাতে বলবে প্লিজ। আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি ওদের খেয়াল রেখো।’

‘আমিই তোকে মেরে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবো যদি আরেকবার এইসব কথা বলেছিস তো। আমার জীবনটাও বাবার মতো করে দিতে চাস তুই?’

‘নাহ। কখনোই না। তুমি কখনোই আঙ্কেলের মতো ভেঙে পড়বে না। সবসময় শক্ত থাকবে।’

প্রয়াস হাউমাউ করে কেদে ফেললো। বললো,
‘আমাকে এতো কষ্ট দিয়ে কি পাস তুই। যেদিন থেকে ভালোবেসেছি শুধু যন্ত্রনাই দিয়ে গেছিস। এবার আমায় শান্তি দে। নাহলে নিজের সাথে আমাকেও নিয়ে যা। তোকে ছাড়া এই পৃথিবী আমার কাছে অর্থহীন। তুইবিহীন আমি এই পৃথিবীতে থাকতে চাইনা। আমার আদ্রও বাঁচবে না রে। ওকে আর মা হারা করিস না। আমাদের দুজনের কথা ভেবে তোকে ফিরে আসতে হবে। আসতেই হবে। আল্লাহ এতো নিষ্ঠুর হবেন না আমাদের প্রতি।’

নাবিলা জ্ঞান হারানোর পূর্বে বিড়বিড় করে কিছু বললো। প্রয়াস কানের কাছে মুখ নিতে শুনতে পেলো,

‘ভালোবাসি। তোমাকে এই জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমি চাই তুমি সবসময় সুখে থাকো।’

‘তোকে ছাড়া আমার জগৎ যে সুখ বিহীন মরুভূমি।’

___________

জেসি অলিভারকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছিলো। দুপুর হতেই বাড়ি ফিরে দেখে দিশা আন্টি এসেছে। বাহিরে থেকেই দিশার ফোনে কথা বলা শুনতে পায় আদ্র। জানতে পারে ওর মা জীবন ঝুকি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। অথচ সে জানতোই না মায়ের এমন কোনো ঝুকি রয়েছে। জেসি ওকে খাবার খাওয়াতে আসলে ও মানা করে দেয়। কাদতে কাদতে ড্রাইভারকে অনুরোধ করে হাসপাতালে যায় সে। গিয়ে দেখে প্রয়াস প্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় বসে আছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষন কাদে ছেলেটা। প্রয়াসের কাছে একটাই শান্তনার বানী। ‘বাবা আছিতো।’

নাবিলার সিজার অপারেশন শুরু হলো দুপুরের পর। প্রয়াস এবং নাবিলার পরিবারের রুদ্ধশ্বাস এক সময় অতিবাহিত হয় অপারেশন শেষ হওয়া অবধি। হঠাৎ একটা বাচ্চার কান্না শুনে ওর হৃত স্পন্দ দ্রুত হয়ে যায় প্রয়াসের। নার্স একটা বাচ্চাকে তোলায়ে প্যাচিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে। বলে মেয়ে হয়েছে।

প্রয়াস হন্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার নাবিলা কেমন আছে?’

‘নিশ্চিন্তে থাকুন। উনি বিপদমুক্ত। তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে।’

প্রয়াস জেসির কোল থেকে বাচ্চাটা নিয়ে শব্দ করে কেদে ফেললো। ওর সাথে যুক্ত হয়ে আদ্র। জেসি দূর থেকে দুচোখ ভরে ওদের ভালোবাসার কান্না দেখলো।

নাবিলার সুস্থ হতে দিন সাতেক সময় লাগলো। প্রয়াস নাবিলা এবং নতুন সদস্যকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই উৎসব শুরু হয়ে গেলো। আদ্র বোনের নাম রাখলো অলিভিয়া অদ্রিতা। নামটা নাবিলা এবং আদ্র মিলে ঠিক করেছে। আদ্র নিজের বোনকে কোল ছাড়া করতেই চাইছে না। একটা পুতুল সোনাকে পেয়ে ওর মধ্যে বড় ভাইয়ের মতো দায়িত্ববোধ আসতে শুরু করেছে।

উৎসব প্রায় একটা গেট টুগেদারে পরিনত হলো। মাহি এবং সোহান তাদের তিন বছরের ছেলে মিহানকে সাথে নিয়ে এসেছে। ওদের বিয়ে হয়েছিলো নাবিলার বিয়ের এক বছর পর। তানজিলা এবং নাফিজের দুইটা মেয়ে। দিশা এখনো বিয়ে কিংবা সম্পর্কে জড়ায়নি। আর জেসি জড়ানোর প্রচেষ্টায়। খাবার টেবিলে সবাই মিলে হইহই পড়ে গেলো। পুরোনো কথা স্মৃতিচারন করে সকলে মেতে উঠলো।

রাতে মায়ের সাথে গল্প করে রুমে আসতেই দেখলো আদ্র এবং প্রয়াস মিলে অদ্রিতাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। নাবিলা নিঃশব্দে হেসে ফেললো। অদ্রিতা ঘুমানোর বদলে বাবা ভাইয়ের কান্ড দেখতে লাগলো ড্যাবড্যাব করে। নাবিলা এসে আদ্রকে জোর করে ঘুমাতে পাঠালো। আদ্র বোনের কপালে চুমু খেয়ে ঘুমাতে গেলো। অদ্রিতা ঘুমালে আদ্রকে একবার দেখে এসে নাবিলা প্রয়াসের পাশে বসলো। প্রয়াস ওকে জড়িয়ে নিতেই কাধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে।
প্রয়াস নাবিলাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।

‘বাবুর আম্মু এতো জলদি টায়ার্ড হলে চলে? আমার আরো একধাপ নির্ঘুম রাতের সমাপ্তি ঘটলো। এবার একটা শান্তির ঘুম দিতে চাই। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দে।’

‘পারবোনা।’ নাবিলা গাল ফুলিয়ে বললো, ‘তোমার দুই বাচ্চার মা হয়ে গেলাম এখনো আমায় তুমি করে বললে না।’

প্রয়াস ওর গাল টেনে বললো,
‘আর বলবোও না। আমার জীবনে তোর উপস্থিতি, ভালোবাসা তুইময় হয়েই থাকবে। বুঝলি আমার গলুমলু।’

‘তুমি কি আমার ওপর বিরক্ত হওনা? এতো কষ্ট দেই, তবুও সহ্য করো কিভাবে আমাকে?’

‘আমার ভালোবাসায় বিরক্তি বলে কিছু নেই। শুধু আছে আমার পুতুল বাচ্চাদের এবং তাদের পুতুল আম্মুর জন্য এক আকাশ ভালোবাসা।’

‘ভালোবাসি।’

‘ওসব বলে কাজ হবে না। আমায় শান্তির ঘুম দরকার। ঘুম পাড়িয়ে দে।’

এমন সময় অদ্রিতা ঘুম ভেঙে কেদে উঠলো। নাবিলা তড়িঘড়ি করে উঠে গেলো ওর কাছে। প্রয়াস আফসোসের সুরে বললো,
‘সারাবেলা ভালো থেকে বাবা-মাকে একসাথে দেখলেই তোদের শুরু হয়? আমাদের একান্ত ভালোবাসায় আরো একজন এলাচি যুক্ত হলো।’

_________সমাপ্ত_______

(আসসালামু আলাইকুম পাঠকগন। পড়াশোনার চাপে একটু তাড়াহুড়ো করেই #এক_রক্তিম_ভোর গল্পটি শেষ করতে হলো। যারা এতোদিন যাবত গল্পটিকে ভালোবাসা দিয়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ❤️। আজ গল্পটা নিয়ে দুই লাইন রিভিউ দিয়ে যাবেন প্লিজ। আমার লেখা নিয়ে কোনো সাজেশন থাকলেও বলতে পারেন। আমি সেদিকে খেয়াল রাখবো। নতুন গল্প শুরু করবো একটা লম্বা গ্যাপের পর ইনশাআল্লাহ। ততদিন সবাই ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।❤

প্রতিদিন আরো অনেক গুলো গল্প পোস্ট করা হবে গল্পের ঠিকানা ওয়েবসাইটে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here