#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_২০
‘এতো সেজেছিস কেনো? বিয়ে কি তোর নাকি তানজিলার?’
‘বিয়েতে বউয়ের ওপর নজর থাকে শুধু প্রতিবেশি আন্টি এবং বরপক্ষের। আর সবার নজর থাকে আশে পাশের মেয়েদের ওপর বুঝলে। আমাকেও তো সুন্দর লাগতে হবে নাকি!’
প্রয়াস কটমট করে তাকালো। মেয়েটা আজকাল ওকে পাত্তা তো দিচ্ছেই না। আবার কথাও শুনছে না।
‘কেনো লাগতে হবে শুনি? ওখানে কি তুই সুন্দরী প্রতিযোগিতা করতে যাচ্ছিস?’
নাবিলা হালকা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
‘বা..রে! তুমি জানো না? একজনের বিয়েতে আরেকজনের টা ঠিক হয়। আমারো হতে পারে। বলাতো যায়না।’
প্রয়াসের ওষ্ঠদ্বয় আপন শক্তিতে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেলো। এই মেয়ে এমন অকপটে বিয়ের কথা বলে যাচ্ছে! নাবিলার এতো পরিবর্তন এলো কিভাবে? দাত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে প্রয়াস কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো নাবিলার দিকে। নাবিলে প্রয়াসের চাহনি উপেক্ষা করে পেছন থেকে অর্ধভাগ চুল সামনে এনে তাতে আঙুল চালাতে লাগলো। ঠোঁটে লেগে আছে দুষ্টু হাসি।
নাবিলার কিডন্যাপের পর বাড়ির কেউ ওকে আর বাহিরে যেতে দেয়নি। বাড়িতে পুরো একমাস শুয়ে, বসে, বই পড়ে কাটিয়েছে নাবিলা। প্রয়াস নিত্য নতুন বই এনে নাবিলার ঘরে ছোটখাটো একটা বুকশেলফ ভর্তি করে ফেলেছে। এতে নাবিলার সময়টা বেশ ভালোই কাটছে। রাতে দাদির সাথে শুতে হচ্ছে। যদিও অনেকবার অনুরোধ করেছে আগের রুমে ফেরত যেতে কিন্তু নয়নতারা বেগম মানতে নারাজ।
দুজনের এমন দ্বন্দ্বের মুখে তারেক হোসেন পুরো বাড়ির চারপাশে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তিতে খুব একটা বিশ্বাসী নন নয়নতারা বেগম। তাই নাবিলাকে মোটেও চোখের আড়াল করবেন না তিনি। অন্যদিকে, অয়নের এখনো খোজ পাওয়া যায়নি। সেদিন নাবিলাকে বাড়ি ফিরিয়ে প্রয়াস পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু পুলিশ ওকে ধরার জন্য উদ্যোগ গ্রহনের আগেই অয়ন আউট অফ কান্ট্রি হয়ে গেছে। দীর্ঘ এক মাসে পুলিশও এখন ওকে ধরার আশা ছেড়েই দিয়েছে প্রায়। নিত্য নতুন কেইসে ব্যস্ত তারা।
এতসবের মাঝে নাবিলার জন্য খুশির সংবাদ হলো তানজিলার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। সেটা আজই। সেখানেই যাচ্ছে সে। যদিও নয়নতারা বেগম যেতে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু প্রয়াস নিয়ে যাবে বিধায় তার আর কোনো চিন্তা রইলো না।
নাবিলা নীল শাড়িতে সেজেছে আজ। খোলা চুলে, চোখে চশমা থাকলেও সাজের কোনো কমতি রাখেনি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। তানজিলা পইপই করে বলে দিয়েছে দুপুরের আগে উপস্থিত থাকতে। অথচ প্রয়াস গাড়ির দরজা আটকে ধরে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করে যাচ্ছে।
‘দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া। এরপর তো ফটোশুটও করতে পারবো না।’
‘তারমানে তুই সাজ কমাবি না?’ প্রয়াস ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো।
‘একদম না।’ নাবিলার ড্যাম কেয়ার ভাব।
‘ফাইন।’
প্রয়াস ড্রাইভিং সিটে বসে বেশ জোরেশোরে দরজা আটকালো। নাবিলা কেপে উঠলো। আস্তে করে নিজেও পাশের সিটে বসে পড়লো। গাড়ি ছুটে যেতে লাগলো তানজিলার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
নাবিলা বাহিরে তাকিয়ে মুখ ভার করলো। মনে মনে ভাবলো কি এমন হয় মনের কথাটা জানিয়ে দিলে? এতো ভাব ধরেতো একে একে দিনগুলো চলে যাচ্ছে। প্রেম করার স্বপ্ন এখনো অধরাই রয়েছে।
নাবিলা প্রতিক্ষনে অপেক্ষা করছে প্রয়াস কখন মুখ খুলবে। মনের ভেতরের জমানো সমস্ত আবেগ, ভালোবাসার সাথে নাবিলার সাক্ষাৎ করাবে। কিন্তু প্রয়াস এমন কিছু করবে বলে মনেই হচ্ছে না। সেই আগের মতোই রয়েছে। যদিও এখন জেসি মামা বাড়িতে বলে জেলাস করানোর উপায় বন্ধ। মনের কথা শিকার কেনো করছে না নাবিলা তাই বুঝছে না। বাধ্য হয়ে ভিন্ন পন্থা বেছে নিয়েছে নাবিলা। তাইতো এতো সাজ।
চারিদিকে রঙ বেরঙের আলোর ঝলকানি। বিভিন্ন বয়সের মানুষের আনাগোনায় পরিবেশ মুখরিত। তানজিলা সবার মধ্যমনি। ভারী সাজে অপরুপ লাগছে তাকে। নাবিলাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সব চেয়ে সুন্দর মেয়েটা হলো তানজিলা। কতশত প্রপোজাল পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ওর মন ছিলো শুধু ওর কাজিন নাফিজের ওপর। যে বর্তমানে ওর স্বামী হতে চলেছে কয়েক ঘন্টার মাঝে।
নাফিজ যে আহামরি সুন্দর তা কিন্তু নয়। শ্যামলা বরনের এই লোকটার প্রতি কেনো যে এতো টান অনুভূত হয় সেটা তানজিলা আজও বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু জানে, মানুষটাকে ওর ভালো লাগে এবং তার সাথে অনায়াসেই জীবন পার করা যায়।
নাফিজও তানজিলাকে পছন্দ করতো। কিন্তু ওর মাঝে সবসময় একটা হীনমন্যতা কাজ করতো। ভাবতো তানজিলা আরো ভালো কাউকে হয়তো ডিজার্ভ করে। কিন্তু দুই পরিবার যখন সামনে এগোলো নাফিজের তখন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা। দুইজনের ঠোঁটের কোনে আজ এক প্রাপ্তির হাসি।
নাবিলা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে প্রয়াসের দিকে তাকালো। কল্পনা করতে চাইলো ওদের দুজনকে কেমন লাগবে বিয়েতে৷ নিশ্চয়ই দুজনের চোখে অপার সুখের হাতছানি থাকবে। প্রয়াস ভাইয়াকে তখন কি বলে ডাকবে ও! প্রয়াস? নাহ প্রয়াস ভাইয়াতো বয়সে বেশ বড়। তাহলে? ওগো.. ওগো শুনছো! নিজের ভাবনায় নিজেই মুষড়ে পড়তে লাগলো নাবিলা।
নাবিলাকে এমন লজ্জায় লাল হতে দেখে প্রয়াস ভ্রু বাকালো। এই লজ্জাতো সেই আগের, ওর কিশোরী নাবিলা পেতো। যখনই সেজেগুজে প্রয়াসের সামনে এসে দাড়াতো একদম লাল হয়ে যেতো গাল। প্রয়াস মনে মনে উপভোগ করলেও মুখে এক প্রকার কঠোরতা ধরে রাখার চেষ্টা চলতো। কিন্তু এখনতো নাবিলার মাঝে সেই লজ্জার ‘ল’ ও দেখা যায়না। তাহলে?
প্রয়াস তানজিলা এবং নাফিজের দিকে তাকালো৷ সুখীযুগল বসে আছে। তারপর আবার নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলা কি কোনোভাবে তানজিলার যায়গায় নিজেকে কল্পনা করছে? সেটাইতো স্বাভাবিক। প্রতিটা মেয়েরই নিজের বিয়ে নিয়ে কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকে। কিন্তু লজ্জায় নতজানু হয়ে পড়াটা কিসের? নাবিলা প্রয়াসের চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। নিজেকে লুকায়ে চাইছে প্রয়াসের থেকে।
প্রয়াস আরো কিছুক্ষন নাবিলাকে পর্যপেক্ষণ করলো। ওকি নিজের পাশে প্রয়াসকে ভাবছে স্বামী হিসেবে? প্রয়াসের মন আনন্দে নেচে উঠলো। তারমানে ওর নাবিলার মনে ওর জন্য অনুভূতি একটুও মলিন হয়নি। এখনো ভালোবাসে নাবিলা। প্রয়াসতো এটাই বুঝতে চাইছিলো এতোদিন ধরে। প্রয়াসের ঠোঁটের কোনে হাসির ঝলক দেখা দিলো।
তবে সেই হাসি বেশিক্ষন টিকলো না। নাবিলা টিকতে দিলো না।
‘হেই নাবিলা?’
কারো গলার স্বরে পেছনে ফিরে তাকালো নাবিলা।
‘ওয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! কতদিন পর দেখা হলো তোমার সাথে।’
‘রোহান স্যার! কেমন আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার খবর বলো? সেই যে কোচিং-এ শেষ দেখেছিলাম তারপর হুট করে আর এলেই না। তোমায় অনেক খুজেছিলাম।’
নাবিলা হাসার চেষ্টা করলো। আড়চোখে প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আসলে ওখানে আমার কিছু অসুবিধা হচ্ছিলো, তাই বাবা ছাড়িয়ে দিয়েছিলো। আপনি আমায় খুজেছেন শুনে খুশি হলাম।’
প্রয়াস বাদিকে মাথাটা হালকা বাকিয়ে দুজনকে দেখতে লাগলো। রোহান নাবিলার কোচিং সেন্টারের একজন টিচার ছিলো। তখন নাবিলা ইন্টারে পড়ে। প্রতিদিন ছুটির পর দুই ঘন্টা কোচিং করতো। আর কোচিং থেকে ফেরার পথে প্রায় মাঝ রাস্তা অবধি রোহান ওকে এগিয়ে দিতো। প্রয়াস যখন ব্যাপারটা টের পায় ততক্ষনে রোহান নাবিলাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলো। তার পর থেকেই নাবিলা আর সেই কোচিং এ যেতে পারেনি। প্রয়াস দেয়নি।
এতোদিন পর হুট করে আবার দেখা হয়ে যাবে নাবিলাও ভাবতে পারেনি। তবে নাবিলার জন্য ভালোই হলো। এমন একটা সুযোগই খুজছিলো সে। প্রয়াসকে জ্বালানোর উপায়। এই উপায়টা তানজিলা ওকে বলে দিয়েছে। এছাড়া প্রয়াসকে মনের কথা স্বীকার করানোর উপায় পাচ্ছে না নাবিলা।
‘তুমি কোন পক্ষ?’ রোহানের প্রশ্ন।
‘কনে পক্ষ। আপনি নিশ্চয়ই বর পক্ষ থেকে এসেছেন?’
‘হ্যা। আমি বরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলতে পারো। তোমায় খুব সুন্দর লাগছে দেখতে।’
নাবিলা মাথা নিচু করে হাসলো। ওকে লজ্জা পেতে দেখে প্রয়াসের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। যার তার কথায় লজ্জা পেতে হবে কেনো?
নাবিলা বললো,
‘আপনিও আগের থেকে আরো হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন স্যার।’
‘আর আমি?আমাকে তো কোনোদিন বললি না যে আমি হ্যান্ডসাম হয়েছি। একটু প্রশংসাও তো করিসনি কোনোদিন।’
বিড়বিড় করে বললো প্রয়াস। সাহস খুব বেড়ে গেছে মেয়েটার। ওর উপস্থিতি গ্রাহ্যই করছে না। এগিয়ে গিয়ে নাবিলার হাত ধরে দাড়ালো।
রোহান প্রয়াসকে চিনতে না পেরে বললো,
‘আপনি?’
‘উনি প্রয়াস ভাইয়া। আমার বড় ভাই।’
নাবিলা তরিঘরি করে উত্তর দিলো। প্রয়াসের হাতের বাধন আরেকটু শক্ত হলো। যার মানে উত্তরটা পছন্দ হয়নি প্রয়াসের।
‘ওহহ।’ রোহান বললো। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো প্রয়াসের দিকে।
‘আমি রোহান। একসময় নাবিলার কোচিং টিচার ছিলাম বর্তমানে একটি কলেজের ইংরেজি প্রভাষক।’
‘সেটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু একটু আগে আপনি বলছিলেন নাবিলা কোচিং ছেড়ে দেওয়ার পর আপনি ওকে খুজছিলেন। কেনো খুজছিলেন?’
প্রয়াসের প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রোহান। কি বলা ঠিক হবে বুঝতে পারলো না। নাবিলা নিজে থেকেই বললো,
‘আসলে আমি স্যারের প্রিয় ছাত্রী ছিলাম তো সেজন্য। তাই না স্যার?’
রোহান মাথা দুলিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।
‘আচ্ছা! প্রিয় ছাত্রী!’
প্রয়াসের হাতের বাধন আরেকটু শক্ত হতে যাচ্ছিলো। তার আগেই নাবিলা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রোহানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘চলুন স্যার। আমার ফটোশুট বাকি তানজিলার সাথে।’
প্রয়াসকে কিছু না বলেই নাবিলা চলে গেলো তানজিলার কাছে। বেশ কয়েকভাবে ছবি তুললো সবাই। সাথে রোহানও। গেলো না শুধু প্রয়াস। ও সবার থেকে দূরে, এক কোনায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে নাবিলার প্রতিটা কর্মকাণ্ড খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো।
ছবি তোলা শেষে নাবিলা যখন নেমে এলো তখন ওর চোখাচোখি হলো প্রয়াসের সাথে। একটি শান্ত অথচ ধারালো দৃষ্টিতে দেখছে ও নাবিলাকে। সেই চাহনির অর্থ,
‘আজ তোর খবর আছে।’
বিনিময়ে নাবিলাও একটা হাসি ছুড়ে দিলো। যেনো বোঝাতে চাইলো,
‘সময় থাকতে যদি মনের কথা স্বীকার না করতে পারো তাহলে এভাবেই অন্য কেউ এসে নিয়ে যাবে। তখন তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।’
রোহান পাশ থেকে বললো,
‘চলো বসি একসাথে।’
‘চলুন।’
‘তোমার ভাইয়া কিছু মনে করবে নাতো?’
‘না ভাইয়া কি মনে করবে? ভাইয়া খুব ভালো।’
বলে নাবিলা প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি উপহার দিলো।
চলবে…