এক_রক্তিম_ভোর পর্ব ১৯

#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৯

অয়ন আজ সারাদিন নাবিলাকে দোতলার রুমটায় বন্ধ রেখেছিলো। দুপুরের দিকে একবার কাজি নিয়ে এসেছিলো অয়ন। কোথা থেকে একজন মহিলাকে এনে নাবিলাকে জোর করিয়ে বিয়ের পোশাক পড়িয়েছে। নাবিলা পড়তে না চাইলে অয়ন হুমকি দিয়ে বলে,

‘ভালোয় ভালোয় পড়ে নাও। নাহলে আমি নিজে পড়িয়ে দেবো।’

অগত্যা নাবিলাকে আবার বেনারসিতে সাজতে হয়। কবুল বলার জন্য কাজি আসলে নাবিলা অতিরিক্ত কান্নায় শরীর খারাপ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই জ্ঞান ফেরে দেড় ঘন্টা পর। অয়ন নাবিলাকে সারাদিন পানি ব্যাতিত অন্য কোনো খাবার দেয়নি। বলেছে কবুল না বলা অবধি নাবিলা একটা দানাও পাবে না। নাবিলা তবুও কবুল বলেনি।

রাত ঘনিয়ে আসতেই অয়নের রাগ মাত্রা ছাড়ায়। নাবিলা খাটের এক কোনায় বসে ঝিমাচ্ছিলো। অয়ন তাকে খাট থেকে টান মেরে ফেলে দেয়। কোমড়ে বেশ ব্যথা পায় ও। তবুও হার মানতে নারাজ ছিলো। মনে মনে শুধু চাইছিলো আল্লাহ ওকে রক্ষা করতে প্রয়াসকে জলদি পাঠাক। অয়ন রেগে হিসহিসিয়ে বলেছে,

‘কবুল যখন বলছোই না তখন কবুল ব্যাতিত বাসর হবে। আশা করি তারপর কবুল বলায় আর আপত্তি থাকবে না তোমার।’

নাবিলা ঘৃণায় অয়নের মুখে থুথু ছোড়ে।
‘তোর মতো নোংরা মানুষ আমি আর দুটো দেখিনি। ছিঃ!’

অয়ন নাবিলার এমন কান্ডে সপাটে চড় বসায় নাবিলার গালে। শক্ত পুরুষালি হাতের চড় খেয়ে নাবিলা চোখে অন্ধকার দেখে। ফ্লোরে শরীর ছেড়ে দেওয়ার আগে শুধু অয়নের কয়েকটা কথা কানে আসে।

‘তাহলে আজ শুধু আমার নোংরামিই দেখবি তুই। থাক এখানে পড়ে। একটা দানাও পাবি না।’

অয়ন ফোনে কাউকে ফুলের ব্যবস্থা করতে বলছিলো এবং সেগুলো নিতে বাহিরে যাচ্ছিলো। আর কিছু মনে নেই। কতক্ষণ জ্ঞানহীন ছিলো জানা নেই নাবিলার। আবার যখন জ্ঞান ফেরে বাহিরে কারো শব্দ পেয়ে নাবিলা মনে করে অয়ন বুঝি আসছে আবার। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি জুগিয়ে দাড়িয়ে কাচের ফুলদানিটা নিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলে যেতেই দুর্বল হাতের শক্তিতে আঘাত বসায় লোকটার মাথায়। তারপরতো সেই আঘাত করা লোকটার বাহুডোরেই রয়েছে ও।

কিছুক্ষন আগে নাবিলাকে বিয়ের সাজে দেখে প্রয়াস এক প্রকার ধরেই নিয়েছিলো ওর যত্নে গড়া গোলাপ গাছের মালিকানা বুঝি অন্য কেউ পেয়ে গেলো। যদিও তাতে প্রয়াসের কিছু আসে যায়না। ও নাবিলাকে একবার পেলে অয়নের সাধ্য নেই কেড়ে নেওয়ার।

নাবিলার মুখে সব শুনে প্রয়াস পুনরায় ওকে বাহুডোরে নিয়েছে। গালটা এখনো লাল হয়ে আছে। প্রয়াস সেখানে আঙুল ছোয়ালো। শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্রোধ কিলবিল করে উঠলো। যেই মেয়েকে একটা ফুলের টোকা পর্যন্ত দেয়নি তার গালে অয়ন আঙুলের ছাপ বসিয়েছে! আজ নাবিলাকে না পেলে ঠিক কি ঘটে যেত ভাবতেই বুক কেপে উঠছে প্রয়াসের। অয়নকে হাতের কাছে পেলে জ্যান্ত কবর দিতো ওকে।

নাবিলা কিছুটা কাপছেও। বোধহয় খাবার না পেলে কিছুক্ষনের মধ্যে পড়ে যাবে। প্রয়াস রাগ ঝারা দিয়ে ঠেলে পরিবেশ ঠিক করতে চাইলো।

‘তোর মতো ফাটা কপাল কার আছে? দুই দুইবার বউ সাজলি কিন্তু কারো বউ হতে পারলি না। আ লাইফ উইথআউট জামাই। ইশশ!’

প্রয়াসের স্পষ্ট টিটকারি। নাবিলা মুখ বাকালো।
‘হ্যা অয়ন মাসে মাসে আমায় কিডন্যাপ করবে আর আমি বউ সাজবো। একদিন দেখবে ঠিক বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘বিয়ে তো হবেই। সেটাও খুব শীগ্রই।’ প্রয়াস নাবিলার লাল হয়ে থাকা গালে হাত বুলিয়ে বললো।

দিশা এবং জেসি কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ওদের খুনসুটি উপভোগ করছিলো। অয়নের সাথে আকদের তারিখ দেওয়ার দিন নাবিলা দিশাকে বলেছিলো প্রয়াসের গার্লফ্রেন্ড আছে। দিশা এখন ভালোই বুঝতে পারছে গার্লফ্রেন্ডটা কে।

দিশা এগিয়ে এসে নাবিলার হাত ধরে নতমস্তকে বললো,
‘তোমার সাথে কিভাবে কথা বলবো বুঝতে পারছি না। ভাইয়া যা করেছে তার জন্য আমি নিজেও ভাইয়াকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। ও এতোটা নিচ হয়ে গেছে ভাবতেও পারছিনা। তুমি…’

নাবিলা দিশার হাত ধরে বললো,
‘এতে তোমার দোষ নেই আপু। তুমি লজ্জিত হয়ো না। অয়নের পাপের শাস্তি ও নিশ্চয়ই পাবে। আল্লাহ সব দেখেছেন। তিনি ছেড়ে দেবেন না। ওকে শাস্তি পেতেই হবে।’

প্রয়াস যখন নাবিলাকে নিয়ে দোতলা বাড়িটা থেকে বের হলো তখন প্রায় এগারোটা বাজে। গেইটের পাশেই যে গার্ডটাকে বেধে রেখেছিলো সে গার্ডটার কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে বললো,

‘তোর বস এতোক্ষনে আমার খবর পেয়ে ঘাপটি মেরেছে জানি। আমি চলে যাওয়ার পর এখানে নিশ্চয়ই আসবে। তাকে বলে দিস, কোনো নারীকে জোর করে হাসির করাকে সাহসীকতা বলে না। সেটাকে বলে অন্যায়, ঔদ্ধত্য। এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে।’

নাবিলাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতেই এতক্ষণের খিদেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো সবার। তাছাড়া নাবিলাকে খাওয়ানোটা বেশি দরকার। ওরা তো সকালে খেয়েছিলো। কিন্তু নাবিলার কাল রাতের পর আর একটা দানাও জোটেনি। এবার পেছনে বসেছে জেসি, নাবিলা এবং প্রয়াস। সামনে দিশা। প্রয়াস নাবিলার মাথাটা নিজের কাধে রাখতেই গাড়ি সাই সাই করে ছুটে চললো।

জেসি বললো,
‘সামনে যেই হোটেল, রেস্টুরেন্ট অথবা খাবার দোকান পাবেন সেখানেই গাড়ি থামাবেন। পেট ভরে খেয়ে তারপর ধীরে সুস্থে বাড়ি ফেরা যাবে।’

প্রয়াস বাড়িতে ফোন করে দিয়েছে সে নাবিলাকে পেয়েছে। নয়নতারা বেগম জায়নামাজে পড়ে আছেন সকাল থেকে। নাবিলাকে পাওয়া গেছে শুনেও ওঠেননি। নাবিলাকে সামনে না দেখা অবধি উঠবেনও না। সায়মা বেগম সব অসুস্থতা, দুর্বলতা ভুলে ছুটেছেন রান্নাঘরে। মেয়ের জন্য আগে খাবার প্রস্তুত করতে হবে। কে জানে মেয়েটা খেয়েছে কিনা।

কিছুদূর পর একটা হোটেলে গাড়ি থামলে সবাই নেমে পড়ে খাবার খেতে। কিছুটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু পেট ভরাই এখন সবার মূল কথা। তাই সেদিকে সবাই কিছুটা ভ্রুক্ষেপহীন। রাতে বারোটার কাছাকাছি এসে একটা খাবার দোকান পাওয়া গেছে তাই বেশি। মূলত হোটেলটা রাতের বাস যাত্রীদের জন্য খোলা থাকে সারারাত। অনেক দুরপাল্লার বাস এখানে থামে, খাবার এবং আনুসাঙ্গিক কাজের জন্য। হোটেলে ভাত, রুটির ব্যবস্থা আছে। প্রয়াস সবাইকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি খাবে? ভাত নাকি রুটি?’

নাবিলা সবার আগে বললো,
‘আমি ভাত খাবো। গরম গরম ভাত সাথে যেকোনো তরকারি হলে চলবে।’

নাবিলার কথাটায় কি ছিলো কে জানে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে গেলো। কাউকে খাবারের গুরুত্ব বোঝেতে হলে এখন নাবিলাকে দেখালেই বোধহয় চলবে৷ প্রয়াসের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। পেটে খাবার না পড়লে খাবারের মর্ম বোঝা যায়।

খাবার আসতেই নাবিলা ভালো করে ভাত না মাখিয়েই খাওয়া শুরু করলো। বড় বড় দলা পাকিয়ে মুখের মধ্যে পুড়তে লাগলো শুধু। ভালো করে না চিবিয়েই পেটে চালান করে দিতে লাগলো। প্রয়াস নাবিলার হাত ধরে বললো,

‘আস্তে খা। বিষম খা…’

প্রয়াস কে কথাটা সম্পূর্ণ করতে হলো না। নাবিলা তার আগেই বিষম খেলো। প্রয়াস ওর দিকে পানি এগিয়ে দিলে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো পুরো গ্লাস পানি। প্রয়াস ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

‘এবার আস্তে আস্তে চিবিয়ে খা। খাবার পালিয়ে যাবে না।’

নাবিলা মাথা তুলে প্রয়াসের দিকে তাকালো। ওর চোখে জল থইথই করছে।

‘আমি আর কখনো খাবার নিয়ে মায়ের অবাদ্ধতা করবো না ভাইয়া।’

প্রয়াস বুড়ো আঙুল দিয়ে নাবিলার চোখের কোনে বেড়িয়ে আসা জলটুকু মুছে দিলো।

________

নাবিলার বাড়ির সামনে প্রয়াস, নাবিলা এবং জেসিকে নামিয়ে দিয়ে গেছে দিশা। ওরা গেইট দিয়ে ঢুকতেই দারোয়ান হাবিবুল মিয়া এগিয়ে এসে নাবিলার সামনে ঝরঝর করে কেদে ফেললো।

‘আমার ভুল হইয়া গেছে মা জননী। আমি আর কোনোদিন মাইনষের দেওয়া জিনিস খামু না। আমার ভুলে আপনের এতো বড় বিপদ হইছে। আমারে চাকরি ছাড়া করবেন না।’

প্রয়াস এগিয়ে গিয়ে হাবিবুল মিয়ার কাধে হাত রেখে বললো,

‘আপনাকে কি কেউ চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছে?’

‘আপনের আব্বা মানে শাহেদ স্যার একবার কইছিলো। নাবিলা মার খবর না পাইয়া কইছে আমারে পুলিশে দিবো।’

‘আচ্ছা। বাবার সাথে আমি কথা বলে নেবো। আপনি চিন্তা করবেন না। এতে আপনার বা মনিরুল্লাহ কারো কোনো দোষ নেই। আপনারা বিশ্বাস করে ঠকেছেন। পরেরবার আর অপরিচিত কারো থেকে খাবার নেবেন না।’

নাবিলা এগিয়ে এসে বললো,
‘একি চাচা! আপনি মেয়েদের মতো কাদছেন? আমি থাকতে আপনার চাকরি স্বয়ং দাদিও খেতে পারবে না বুঝলেন। এখন কান্না থামান।’

নাবিলার বাড়ির দরজাট খোলা। ওরা সবাই হয়তো পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে। প্রয়াস ভেতরে যাওয়ার আগে জেসিকে বললো ওদের বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। জেসি আজ সারাদিন প্রয়াসের সাথে থেকেছে তাই শরীরটা আর চলছে না বললেই চলে। মামা বাড়িও আর যাওয়া হলো না। তাই জেসি প্রয়াসের কথামতো চলে গেলো।

খাবার খাওয়ার পর নাবিলা কিছুটা চনমনে হয়ে গেছে। কথাবার্তায় আবার স্বতঃস্ফূর্ত ভাব ফিরে এসেছে। নাবিলা বাড়ির দিকে এক পা এগোতেই প্রয়াস প্রশ্ন করলো,

‘ এই তোর দায়িত্ব জ্ঞানের নমুনা! সারা সপ্তাহ বারান্দার দরজা বন্ধ রেখে কাল রাতে কেনো খুলে রেখেছিলি?’

নাবিলা থেমে গেলো। প্রয়াসকে কি উত্তর দেবে এবার! এখনোতো মনে কথা শিকার করেনি দুজন। নাবিলা আমতা আমতা করে বললো,

‘আসলে খুব গরম লাগছিলো। তাই…’

‘তাই আপনি দরজা খোলা রাখলেন।বাহ! ঘরের ফ্যানটা মরে গেছিলো নাকি?’

‘আসলে ভেবেছিলাম একটু প্রকৃতির হাওয়া খাবো।’

‘তাইতো না খেতে পেয়ে মরতে হচ্ছিলো। ইডিয়েট।’

‘এই শোনো ভাইয়া। তুমি কিন্তু আমায় কথায় কথায় ইডিয়েট, গাধা এইসব বলবে না। তখন জেসি আপু এবং দিশা আপুর সামনেও বলেছিলে কিছু বলিনি। তাই বলে এখনো চুপ থাকবো না আমি। আমার একটা মানসম্মান আছে।’

প্রয়াস এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

‘ আচ্ছা! কি করবি তুই? তোর সম্মান কতটুকু আছে আমাকেও দেখা।’

নাবিলা ভরকে গেলো।
‘ইয়ে না মানে…’

পিছিয়ে গিয়ে ছুট লাগালো ভেতরে। প্রয়াস পেছন থেকে চেচিয়ে উঠলো,
‘আস্তে যা। পড়ে যাবি।’

নাবিলা পড়লো ঠিক। কিন্তু বাবার বুকে। তারেক হোসেন মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। তার চোখের মনি ফেরত পেয়েছেন। নয়নতারা বেগম জায়নামাজ থেকে উঠে এলেন। সাথে সায়মা বেগমও। পরিবারের পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে নাবিলা বুঝলো আপন মানুষগুলোর কতটা জুড়ে আছে ও। চারজন একে অপরকে জরিয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। প্রয়াস দূরে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে দেখছিলো। সায়মা বেগম এগিয়ে গিয়ে প্রয়াসকেও জড়িয়ে ধরলো।

দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার জন্য একগাদা বকা, সাথে ভালোবাসা খেয়ে নাবিলা দাদির সাথে শুয়ে পড়লো। নয়নতারা বেগম নাবিলার রুম ওর জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অগত্যা নাবিলা দাদির সাথেই ঘুমাবে। দাদিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে নাবিলা ভাবতে থাকলো সেই মুহূর্তটুকু, যখন প্রয়াস কাদতে কাদতে ওর চুলে, কপালে ঠোঁট ছোয়ালো। তখন একটুও লজ্জা লাগেনি। আর এখন ভাবতেই লজ্জার দল পাল্লা দিয়ে ছুটে এলো নাবিলার চোখেমুখে। নাবিলা দাদিকে আরেকটু শক্ত করে ধরে মুখ লুকালো বালিসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here