#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৬
বাড়ি ফিরে প্রয়াস আগে নাবিলাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো হাতটা লাল হয়ে গেছে। আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। প্রয়াস কিছুক্ষন হাতের দিকে তাকিয়ে রাগ সংবরন করতে চেষ্টা করলো। নাবিলাকে সোফায় বসিয়ে ভেতরে চলে গেলো। নাবিলা নিরবে সব দেখলো। ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ও অয়নের সাথে এভাবে কথা বলেছে। নিজের পরিবর্তনে নিজেরই খুশি লাগছে সাথে এর পরিনতি ভেবে ভয়ও করছে।
নাবিলার এইটুকু পরিবর্তনে প্রয়াস নিজেও কিছুটা খুশি। একটা বক্স নিয়ে ফিরে এসে নাবিলার হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলো। একটা কথাও বললো না কেউ।
বাড়ি ফিরে শুরু হলো নাবিলার নতুন চিন্তা। অয়ন যদি ফোন দিয়ে সব বলে দেয় তবে নাবিলার কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সারা বিকাল স্থির হয়ে কিছুই করতে পারলো না। দাদি আশেপাশে দিয়ে হাটা চলা করলেও বুক কাপছিলো নাবিলার। বেশ কয়েকবার লুকিয়ে দাদির ফোন চেক করলো নাবিলা। নাহ! এখনো ফোন দেয়নি।
মাথায় একটা বুদ্ধি আসতেই আবার চুপিচুপি দাদির ঘরে গেলো সে। বিকেলে নয়নতারা বেগম রাস্তায় হাটতে বের হয়। প্রতিবেশীদের সাথে গল্পে মেতে থাকে তাই নাবিলার জন্য সুবিধা হলো। সে বেডসাইড টেবিল থেকে দাদির ফোনটা পেলো। সিমফোনির বাটন মোবাইল। সেটা নিয়ে অয়নের নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিলো নাবিলা।
পুনরায় ঘরে ফিরে আরাম করে বসতেই ভাবলো দাদিকে না পেলে তো মাকেও ফোন দিতে পারে কিংবা অয়নের পরিবার থেকেও ফোন আসতে পারে। ভাবতেই আবার অস্থির হয়ে উঠলো নাবিলা। পাশের বারান্দা থেকে প্রয়াসের গলা ভেসে আসলো। নাবিলা ওড়না গায়ে জড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে বারান্দায় গেলো। প্রয়াস ওকেই ডাকছে।
‘ প্রতিদিন এই সময় তোকে আমায় কফি দেওয়ার কথা ছিলো। ভুলে খেয়েছিস দেখছি।’
নাবিলা অবাক চোখে তাকালো। সে ভয়ে থিতিয়ে যাচ্ছে আর উনি কিনা কফির চিন্তা করছে। নাবিলাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রয়াস আবার বললো,
‘তুই এসে বানাবি নাকি আমি তোর বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবো কোনটা?’
‘আসছি।’
বিরক্তি নিয়ে চলে যেতে নিলে প্রয়াস পিছু ডেকে বললো,
‘ শোন!’
‘কি?’
‘ওইসব লেন্স ফেন্স খুলে চশমা পড়ে আসবি।’
মেঘহীন পশ্চিম আকাশে সূর্য এখনো বিরাজমান। কমলা রঙের আভার ছড়াছড়ি চারিদিকে। আজকের আকাশটা যেনো একটু বেশিই স্বচ্ছ মনে হচ্ছে প্রয়াসের কাছে। মৃদু সমীরণে নাবিলার কোকড়ানো চুল দোল খেয়ে চলেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। নাবিলার দৃষ্টি দূরে সাইকেল চালানো একটা বাচ্চা মেয়ের ওপর নিবদ্ধ। কিন্তু মন অন্য কোথাও ঘুরপাক খাচ্ছে তা বেশ বুঝলো প্রয়াস। কফি নিয়ে ছাদে উঠেছে ওরা। আজকে ঘোরাঘুরি করার পর দুজনের বন্ডিংটা আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। কথা বলায়ও কোনো জড়তা কাজ করছে না নাবিলার মাঝে। প্রয়াস কফিতে চুমুক দিয়ে নিরবতা ভাঙলো।
‘ কফিটা শরবত হওয়ার জন্য ওয়েট করছিস?’
‘ হু! কিছু বললে?’ নাবিলার ধ্যান ভাঙলো।
‘বলছি কফিটা শরবত বানিয়ে ফেলছিস।’
‘ওহহ খাচ্ছি।’
নাবিলা এক চুমুক মুখে নিলো।
‘এতো চিন্তার কিছুই নেই। অয়ন কিছুই করবে না।’
‘তুমি এতো শিওর কি করে? উনি পান থেকে চুল খসলেই আমার নামে দাদির কাছে কথা শোনায়। যদিও দাদির ফোন থেকে ওনাকে ব্লক করে দিয়েছি আমি।’
নাবিলার এমন বাচ্চামিতে হেসে উঠলো প্রয়াস।
‘অয়ন বলতে চাইলে ব্লক দিয়েও ঠেকাতে পারবি না ওকে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি অয়ন কিচ্ছুটি বলবে না।’
‘কেনো বলবেনা? উনার তো চুপ থাকার কোনো কারনই দেখছি না।’
‘সেটা নাহয় আমার ওপর ছেড়ে দে। হ্যাভ অ্যা রিলাক্স।’
_______
রাতে আবার সেই পারফিউমের গন্ধটা নাবিলার নাকে এসে লাগলো। প্রয়াস ভাইয়ার গায়েও রিক্সায় বসে গন্ধটা পেয়েছিলো। স্বপ্নে এর আগে কখনোই সে গন্ধ পায়নি। তবে সেই স্বপ্নটা দেখেনি আজ। একই সময় আবার ঘুম ভেঙে যেতেই দেখলো আজও প্রয়াসের ঘরের আলো জ্বলছে।
আজকে বারান্দায় চাদের আলো গলে পড়ছে। যার ফলে আধার কিছুটা মলিন হয়ে আছে। বারান্দায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে নাবিলার মনে হলো সে প্রয়াসের কাছাকাছি থাকছে বলেই হয়তো স্বপ্ন এতো জীবন্ত লাগছে। নাবিলা না চাইতেও বারবার প্রয়াসকে নিয়েই ভেবে ফেলছে। নিজের মনকে আটকানোর চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। নাবিলা আরেকবার নিজেকে শাসিয়ে ঘুমাতে গেলো।
_______
পর পর তিন রাত একই ঘটনা ঘটেছে নাবিলার সাথে। গতকাল রাতে আবার স্বপ্ন দেখেছে সে। প্রয়াস একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে। তবে মেয়েটা সে নিজে নাকি অন্য কেউ তা বুঝে উঠতে পারেনি নাবিলা। তার আগেই ঘুম ছুটে গেছে। সেদিন স্বপ্নে প্রয়াসের সাথে নিজেকে দেখে এতো খারাপ লাগেনি যতটা এখন লাগছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা অন্যকেউ ছিলো। ফর্সা গায়ের রঙের কেউ।
‘ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড?’
কথাটা মাথায় আসতেই অস্থিরতা বেড়ে গেলো নাবিলার। সে শিকার না করলেও মনে মনে এখন সারাক্ষণ প্রয়াসের কথাই ভাবে। কিন্তু প্রয়াস ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড এখনো আছে কি না তা জানে না নাবিলা। আর জানলেই বা কি। সে নিজেই তো এখন অন্যের হতে চলেছে। কিশোরী বয়সের সেই ভালোলাগাটা কি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে?
মাথা চেপে ধরে এই সকল চিন্তা ভুলতে চাইলো।
সারাটাদিন বারান্দায় কিংবা বাড়ির বাইরে গেলো না নাবিলা। মনটা প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর। প্রয়াসের সামনে পড়ে তা আর ঘাটাতে চাইলো না। ছোটবেলা থেকে সবসময়ই নাবিলা নিজের সিদ্ধান্ত একা নিতে হিমশিম খেয়েছে। এর জন্য প্রয়াসের অনেক বকাও খেতে হয়েছে তাকে। মনের কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে না। এখনো নাবিলার মনে হচ্ছে বিয়েটা কোনোভাবে আটকানো গেলে খুব ভালো হতো। কিন্তু ওর কাছে কোনো উপায় নেই। সেদিনের রাস্তার ঘটনার পর অবিশ্বাস্য ভাবে অয়ন আর ফোন দেয়নি। কেনো দেয়নি তার উত্তর নাবিলার কাছে নেই।
বিকেলে মাহি এবং তানজিলা এলো নাবিলার কাছে। মাহি এবং তানজিলা নাবিলার বান্ধবী। তিনজন একসাথে নাবিলার খাটে বসে গল্প করছিলো। একপর্যায়ে মাহি আফসোসের সুরে বললো,
‘ওই হাদাটাকেই শেষে বিয়ে করবি? এর থেকে তো পাশের বাড়ির জন হাজারগুন ভালো।’
তানজিলাও সহমত পোষণ করে বললো,
‘ঠিক, তোর দাদু আশেপাশে একটু তাকাতে পারলো না? বিলাতিই কেনো নজরে পড়লো।’
নাবিলাও আক্ষেপের সুরে বললো,
‘আসলেই।’
ওর উত্তর শুনে তানজিলা এবং মাহি দুষ্টুমির চোখে তাকালো। সেটা দেখে নাবিলা মেকি হেসে উঠলো।
‘হে..হে..আমিতো কথার কথা বলছিলাম আর কি।’
‘সত্যি করে বলতো! তোর কি প্রয়াস ভাইয়ার জন্য একটুও অনুভূতি নেই? ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে শুনেই ভালোলাগা চেপে গেলি কিন্তু গার্লফ্রেন্ড এর কিছুই তো জানতে পারলি না। এমনওতো হতে পারে ভাইয়ার ব্রেকাপ হয়ে গেছে।’ মাহি বললো।
‘তুই যা যা বলছিস তাহলে এখনতো তোদের সম্পর্ক সহজ হয়ে গেছে। ভাইয়াও তোর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করছে। একজন মেয়ে একজন ছেলের চোখের ভাষা খুব ভালো বুঝতে পারে। তুই কি কখনো খেয়াল করেছিস ভাইয়া তোর দিকে বোনের নজরে তাকায় নাকি অন্য কিছু?’
তানজিলা বলতেই নাবিলা কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর ডানে বামে মাথা দোলালো।
‘তেমন কিছু তো খেয়ালই করিনি।’
মাহি এবং তানজিলা হতাশ নিশ্বাস ফেললো। মাহি নাবিলার মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
‘ তা খেয়াল করবে কেনো? তুমি শুধু কফি বানিয়ে দিয়ে নিজের সমস্যার সমাধান নিয়ে আসবা। তুই আসলেই বুদ্ধু।’
____________
শেষ বিকেলে রোজকার মতো ছাদে উঠতেই চোখ গেলো পাশের ছাদে প্রয়াস দুইহাত বুকে গুজে এদিকেই তাকিয়ে আছে যেনো সে নাবিলার অপেক্ষাই করছিলো।
‘এদিকে আয়।’
প্রয়াসের গম্ভীর কন্ঠে নাবিলা ধীর পায়ে এগিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাড়ালো।
‘আমার কফি করার কথা তোকে মনে করিয়ে দিতে হবে কেনো?’
নাবিলা প্রয়াসের চোখের দিকে তাকালো। খোজার চেষ্টা করলো সেই চোখে কোনো মুগ্ধতা আছে কিনা। কিংবা ভালোবাসার ছোয়া। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না।
‘ বিয়ে করে ফেলো। বউ প্রতিদিন কফি করে দেবে।’
‘সেতো করবোই। তোর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর ধুমধাম করে বউ তুলবো ঘরে। ততদিন নাহয় কফিটা তুই করে দিলি।’
‘ পাত্রী ঠিক করে রেখেছো বুঝি।’
প্রয়াস হালকা হেসে বললো,
‘হ্যা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি। মাঝখানে একটু মান-অভিমান ছিলো। তবে এখন ঠিকঠাক এগোচ্ছে। তুই কি এখন কফিটা করে দিবি? আমি কিন্তু এখনো খাইনি। আর কফি না খেলে অফিসের কাজগুলোও করতে পারবো না। এখনো অফিসে যাওয়া শুরু করিনি। তোর বিয়ে পর্যন্ত বাড়িতে বসেই সব কাজ করবো ঠিক করেছি তাই বাবাও আপত্তি করেনি।’
‘পারবোনা।’
বলেই ঝরঝর করে কেদে ফেললো নাবিলা। প্রয়াসের মুখে পাত্রী ঠিক কথাটা শুনে নাবিলা খুবই কষ্ট পেয়েছে। সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তারই সামান্য বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চোখের অবাধ্য জ্বল বেরিয়ে পড়েছে।
নাবিলা কান্না শুরু করতেই প্রয়াস কিছুটা ভরকে যায়। তখনই ওর মোবাইলে কল আসে এবং প্রয়াস ছাদ থেকে চলে যায়।
নাক টানতে টানতে মুখ উঁচিয়ে প্রয়াসকে চলে যেতে দেখে কান্নার বেগ বেড়ে গেলো নাবিলা। নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড কল দিয়েছে। তাই ওর চোখের পানিকে উপেক্ষা করলো।
নাবিলাকে অবাক করে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নাবিলাদের ছাদে আসলো প্রয়াস।এসেই আলতো হাতে নাবিলার মাথা বুকে চেপে ধরলো। কিছুটা আহ্লাদ পেয়ে নাবিলা এবার শব্দ করে কেদে ফেললো।
‘এই কান্না থামা বলছি। এইসব চোখের জল আমার একদম সহ্য হয় না।’
নাবিলা কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ।
‘কাদছিস কেনো? আমি কি এমন বললাম যে কাদতে হবে। নাকি অন্য কেউ বকেছে? আহা! নাবিলাপাখি কান্না থামা প্লিজ!’
নাবিলা পাখি! কথাটা বিষ্ময়ে নাবিলার হৃদয়ে প্রবেশ করেছে। সাথে সাথেই কান্না থেমে গিয়েছে। মুখ তুলতেই প্রয়াসের উদ্বিগ্ন চোখ দৃষ্টিগোচর হলো নাবিলার। এই চোখে কি শুধুই বোনের স্নেহ? নাকি ভালোবাসাও?
প্রয়াস চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কাদলি কেনো?’
‘আপনার না ফোন এসেছে?’ ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো নাবিলা।
‘রাখ তোর ফোন। এদিকে আমি চিন্তায় মরছি উনি ফোন নিয়ে পড়েছে।’
ধমকে উঠলো প্রয়াস। আবার গলার স্বর নরম করে বললো,
‘ আগে বল অয়ন কি ফোন দিয়ে কিছু বলেছে তোকে? নাকি কেউ কিছু বলেছে?’
নাবিলা হকচকিয়ে গেলো। সত্যি কথা জানলে ভাইয়া কি ভাববে! তাই কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,
‘না আসলে… কয়দিন পরই তো মি.অয়নের অধীনে যেতে হবে তাই…’
‘পরেরটা পরে দেখা যাবে। তুই কাদবি নাকি তোর মি.অয়ন সেটা সময়ই বলবে।’
বলে নাবিলার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো।
চলবে….