এক_রক্তিম_ভোর পর্ব ৪

#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৪

নাবিলা যা ভেবেছিলো ঠিক তাই হয়েছে। অয়ন দাদির কাছে ফোন দিয়েছে। কিন্তু এমন কিছু বলবে তা ভাবতেও পারেনি নাবিলা। অয়ন খুব জলদি বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চায়। হয়তো এই মাসের মধ্যেই। কথাটা শোনার পর থেকে নাবিলা থম মেরে আছে। বিয়ে করা মানেই অয়ন নামের কারাগারে বন্দী হওয়া। কিন্তু নাবিলা দেরি করে ফেলেছে। সিদ্ধান্তটা আরো আগে নিলে হয়তো কিছু করা যেতো।

বিকেলে প্রয়াস ভাইয়ার থেকে কথাগুলো শুনে নাবিলা অনেক ভেবেছে। সত্যিই তো! নাবিলার প্রান খুলে কথা বলার, নিজের ইচ্ছে জানানোর অধিকার আছে। অয়নের অন্যায় কথা কেনো মেনেছে? কেনো মুখের ওপর নিজের ইচ্ছেটাও জানালো না? কিন্তু পরক্ষনেই আবার চুপসে গিয়ে ভাবছে এতে পরিবারের মান সম্মানও জড়িত।

এখন কোনো ভুল পদক্ষেপ নিলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে দাদি। দাদুর শেষ ইচ্ছা নিয়েই তার দাদি বেচে আছে। তিনি নাবিলার ভালো চাইতে গিয়ে যে তার ওপর, তার মনের ওপর জোর করছেন তা নয়নতারা বেগম বুঝতেই পারছেন না।

এক তপ্ত শ্বাস বেড়িয়ে এলো নাবিলার বুক চিরে। দিশেহারা চোখে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। নিকষ কালো আধারে বিল্ডিংগুলোর বারান্দা, জানালা দিয়ে বিচ্ছুরিত হওয়া আলো খেলা করছে। আধারে নিজেদের ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও সেই আলোর বিস্তৃত বেশি দূর যেতে পারছে না। শেষে আধারই জয়ী। ঠিক তেমনই নাবিলার ভাবনাগুলো আধারের মাঝে বিস্তৃত হতে পারছে না বা বিস্তৃত করার উপায় নেই। পরমুহূর্তেই আবার ভাবছে আধারের পরতো আলোও আসে। যা সেই কৃত্তিম আলোক ছটাকে ছাপিয়ে দেয় সাথে আধারকেও দূর করে ঝলমল করে ওঠে। নাবিলার জীবনে কি সেই আলো আসবে। যা ওর ভাবনাকে ছাপিয়ে চারপাশ আলোকিত করে দেবে? হয়তো আসবে। হয়তো না।

নাবিলার বিয়ের খবরে সবথেকে বেশি খুশি হয়েছে দুজন মানুষ। এক দাদি নয়নতারা বেগম এবং আরেক প্রয়াস। প্রয়াসের এই খুশি নাবিলার কোনো এক অজানা কারনে অসহ্য মনে হচ্ছে। দাত যেনো ঠোঁটের আড়াল হতেই চাইছে না প্রয়াসের। হেসে হেসে দাদির সাথে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। বিয়েতে কি করবে তা নিয়ে।

সায়মা বেগমের অবশ্য মন খারাপ। তিনি এখনি বিয়ে দিতে চান না মেয়েকে। কথাও ছিলো না। হুট করেই অয়নের এহেন সিদ্ধান্ত তিনি পছন্দ করছেন না। অয়ন অবশ্য বলেছে এখন ছোট করে আকদ হবে। পরে নাহয় বড় করে আয়োজন হবে। কিন্তু তাও মায়ের মন মানতে চায় না। নাবিলার বাবা তারেক হোসেনও বিশেষ আপত্তি দেখালেন না বিয়ে নিয়ে। বাবার মন যে মায়ের মতো নরম হয় না।

দুই পরিবার আলোচনা করে আগামী সপ্তাহেই আকদের দিন ঠিক করা হলো। এটা শুনে নাবিলার আরো মন খারাপ হয়ে গেলো।

বিয়ের কথা বলতে অয়নের পরিবার নাবিলার বাড়ি এসেছে। দিশাও এসেছে। তবে তার মনোযোগ আলোচনায় নেই। সেই কখন প্রয়াসকে দেখেছিলো এরপর কোথায় যে গায়েব হলো আর দেখতেই পেলো না। প্রয়াসের চলাফেরা কথা বলা সবই দিশাকে আকৃষ্ট করছে। দিশা বয়সে নাবিলার একটু বড় হবে। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পরছে। তবুও নাবিলাকে ভাবী ডাকে সে।

ধারালো সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ায় ছেলেদের চোখ একবার হলেও দিশার ওপর পড়বে। সেখানে প্রয়াস ঘুরেও তাকাচ্ছে না। এই ব্যাপারটা দিশার আরো বেশি আগ্রহের কারন।
দিশা বড়দের আলোচনা থেকে উঠে নাবিলার কাছে গেলো। নাবিলা মুখ ভার করে বসে আছে। দিশা ওকে টেনে নিয়ে দোতলার খোলা বারান্দায় গেলো। নাবিলার রুমের এই বারান্দাটা প্রয়াসের বারান্দার মুখোমুখি। এখানে যে প্রয়াস থাকে দিশা তা জানতো না। প্রয়াস বারান্দায় বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কোনো কাজ করছে বোধহয়। ওর কপালে সুক্ষ্ম ভাজ এবং মুখে গাম্ভীর্য। ওকে দেখেই দিশা কিছুটা খুশি হয়ে গেলো।

দিশার মুখের হঠাৎ পরিবর্তন নাবিলার চোখ এড়ালো না। প্রয়াসকে দেখে নাবিলার রাগ হলো। সকালে এসে প্রয়াস নাবিলাকে বলেছে,

‘দেখলি আমি কতো লাকি তোর জন্য। তোদের সাথে লাঞ্চ করতে গেলাম আর বিয়ে ফাইনাল।’

নাবিলা ফুসে উঠতে গিয়েও চুপসে গিয়েছিলো। কি বলবে সে! প্রয়াস গেছে বলে অয়ন ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি বা নাবিলাকে ছেলেদের সংস্পর্শে আসতে দিতে পছন্দ করে না?
তাকে বলতে হবেও না। প্রয়াস ভাইয়া যে এইটুকু বুঝেছে তা তার তাচ্ছিল্য ভরা কথাতেই বুঝতে পারছে নাবিলা।
নাবিলার ফাটা বেলুনের মতো মুখ দেখে প্রয়াস শব্দ করে হেসে নাবিলার মাথায় হালকা চাপড় মারে।

দিশার ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো নাবিলা। ততক্ষনে প্রয়াস বারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে গিয়েছে।

‘তোমার এই ভাইটা কি সবসময় সিরিয়াস মুডে থাকে?’

দিশার প্রশ্নে নাবিলা মনে মনে বললো,

‘সিরিয়াস না ছাই। ওইসব লোক দেখানো। ওইসব সিরিয়াসনেস সারাজীবন আমাকে দেখিয়েছে। ভাইয়া যে কতটা মিচকা তা আমার থেকে ভালো কে জানে।’

কিন্তু মুখে হেসে বললো,
‘ না না আপু। সিরিয়াস মুডে থাকে না। তুমি যতবার দেখেছো হয়তো সেই সময় সিরিয়াস মুডে ছিলো। এমনিতে আমাদের বাড়িতে সারাক্ষণ হাসি মজায় মেতে থাকে।’

দিশা কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,
‘উনি তো তোমার থেকে ভালোই বড়। তাহলে ভাইয়ের বিয়ের কথা ভাবোনি। না মানে.. শুনেছি তোমরা আলাদা বাড়িতে থাকলেও একই পরিবারের মতো। নাকি ওনার পছন্দ করা আছে কাউকে?’

‘ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে।’

কথাটা নাবিলা কেনো বললো জানে না। তিনবছর আগে শুনেছিলো ভাইয়া কাউকে ভালোবাসে। এখনও তার সাথে সম্পর্ক আছে কি না নাবিলার জানা নেই। দিশা যে ইনিয়েবিনিয়ে প্রয়াস সিঙ্গেল নাকি মিঙ্গেল সেটা জানতে চাইছে নাবিলা তা বেশ বুঝেছে। ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা নিশ্চিত না হলেও উত্তরটা হুট করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো।
দিশার মুখের উজ্জ্বলতায় ভাটা পড়েছে। হয়তো এই উত্তরটা আশা করেনি বেচারি।

________

অয়নের পরিবার চলে যেতেই নাবিলা বিষন্ন মনে ছাদে উঠলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশের নীলের রঙটা ফিকে হতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশের একটুকরো মেঘ থেকে বেড়িয়ে এসে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

নাবিলা কিছুক্ষণ স্থির চোখে সেই সন্ধ্যাতারায় ডুবে রইলো। মস্তিষ্ক দখল করে আছে বিয়ে নামক শব্দটা। ওর বিবাহিত জীবন যে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো হবে না সেই সম্পর্কে নিশ্চিত নাবিলা। অয়নের পারফেক্ট জীবনের নিয়ম মেনেই দিন চলে যাবে। নিজের শখ আহ্লাদ বলে কিছুই থাকবে না।বাবা-মাকে বলেও ফায়দা নেই। অয়ন তাদের খুব ভালো হ্যান্ডেল করতে পারে। দাদির ওপর রাগ হচ্ছে নাবিলার। এই মানুষটার মুখ চেয়ে সহ্য করতে হচ্ছে সব।

হঠাৎ করে কাধে কেউ হাত রাখতেই চমকে উঠলো নাবিলা। পেছনে প্রয়াসকে দেখে আবার পশ্চিমের তারাটার দিকে নজর দিলো। কেউ কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষন পর নাবিলা বলে উঠলো,

‘ আমার মনের কথা কেউ কেনো বুঝছে না ভাইয়া।আমিতো এই বিয়েতে খুশি নই তা কেনো কারো নজরে পরছে না? দাদু আমাকে কেনো এভাবে জড়িয়ে গেলো বলতে পারো? দাদুর ইচ্ছে পূরন করতে বাবা আর দাদি বদ্ধ পরিকর। অথচ আমার খুশি…’

নাবিলা মাথা নিচু করে নিলো।
প্রয়াস নাবিলার বরাবর এসে দাড়ালো। নাবিলার থুতনিটা তর্জনী আঙুল দিয়ে উচু করে ধরলো। চোখে জলরাশি চিকচিক করছে।

‘আকাশে কালো মেঘের চাদর চিরস্থায়ী হয় না। কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে গিয়ে ঝলমলে সূর্য বিরাজ করে। আমাদের জীবনেও খারাপ সময় চিরস্থায়ী হয় না। ধৈর্য ধরতে হবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই উত্তম কিছু রেখেছে বান্দার জন্য। বাবা, দাদিকে দোষারোপ করে কষ্ট পাস না। বিয়ে তো হয়ে যায়নি। কখন কার জীবন কোনদিকে মোড় নেয় তা কে বলতে পারে।’

নাবিলা নির্বিকার। প্রয়াস হালকা হাসলো।

‘ঘুরতে যাবি কালকে? সারাদিন যেদিকে ইচ্ছা ঘুরবি, যা ইচ্ছা খাবি। যাবি?’

নাবিলা কিছুটা অবাক হলো। প্রয়াস কখনো ওকে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যায়নি উল্টে, ঘুরতে গেলেই বকেছে। আজ হঠাৎ..!
কিন্তু নাবিলার মানা করতে ইচ্ছা করলো না। দুইবছরে জীবনের অনেক বদল এসেছে। তাই নাবিলারও একটু মুক্ত বিহঙ্গ হতে ইচ্ছে করলো।

‘কিন্তু দাদি?’

‘সেটা আমি দেখে নেবো। মনিকে বলে সব মেনেজ করে নেবো। তুই নয়টার মধ্যে তৈরি থাকবি কেমন! এখন নিচে যা। আধারে তোর কোকড়া চুল দেখে যে কেউ পেত্নী ভেবে হার্ট অ্যাটাক করবে।’

নাবিলা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো।

_______

তারেক হোসেন এবং সায়মা বেগম প্রতিদিন সন্ধ্যায় একসাথে বসে চা খায় আর গল্প করে। বাবা মায়ের এই অভ্যাসটা নাবিলা ছোট থেকে দেখে আসছে। এবং তার ভালোও লাগে বাবা মাকে একসাথে দেখতে। নাবিলা কিছুক্ষন সেইদিকে তাকিয়ে নিজেকে এবং অয়নকে ভাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ওর মস্তিষ্ক অয়নকে তার পাশে ভাবতেই পারলো না। যেই অয়ন বিয়ের আগেও দরকার ছাড়া কথা বলে না সে বিয়ের পরও তেমন থাকবে কিনা ভাবছে নাবিলা।

যখন প্রথম প্রথম এঙ্গেজমেন্ট হয়, নাবিলার আশা ছিলো আর পাঁচটা সম্পর্কের মতোই অয়ন ওকে ফোন করবে, ওর ভালো বন্ধু হয়ে উঠবে এবং দুজনের প্রেমও হয়ে যাবে। কিন্তু সময় যত গড়ালো ঘটলো তার উল্টো। অয়ন শুধু নাবিলাকে আধুনিক গড়নে গড়তে চেয়েছে। কিন্তু অয়নের মনটা কি সত্যিই আধুনিক? নাকি শুধু বাহ্যিক দিকটাই আধুনিকতায় ডুবিয়ে রাখতে চায়? উত্তরটা নাবিলার জানা।

‘কিরে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আয় এসে বোস এখানে।’

মায়ের কথায় নাবিলা কিঞ্চিৎ হেসে বাবার পাশে বসে পড়লো। দাদি এইসময় সিরিয়াল দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তারেক হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,

‘ মুখটা এতো শুকনো কেনো লাগছে মা? বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে? ওসব নিয়ে ভেবো না। অয়নের পরিবার বিয়ের পর তোমায় আগলে রাখবে।’

‘আর অয়ন?’
প্রশ্নটা মনে আসলেও মুখে কিছু বললো না নাবিলা।

‘ তাছাড়া আকদের পর তুমি এখানেই থাকবে। অনার্স শেষ হলেই অয়নের বাড়ি যাবে তুমি।’

এই কথাটা শুনে নাবিলা খুশি হয়ে গেলো। যাক আরো প্রায় দুই বছর আছে তাহলে। তবে নাবিলা ঠিক করে ফেলেছে। এখন থেকে একদম নিজের মতো করে বাচবে। দাদির জন্য অয়নের সব কথা মানবে না আর। নিজেকে অন্যের পুতুল হতে দেবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here