এক_রক্তিম_ভোর পর্ব ৭

#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৭

নাবিলার অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। আকদের আর দুই দিন বাকি। কিন্তু নাবিলা নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। এই অস্থিরতার নাম প্রয়াস। প্রতিদিন কফি করে দেওয়া, বিকেলটা একসাথে ছাদে সময় কাটানোর মাঝে নাবিলা কখন যে আবার প্রয়াসকে পছন্দ করে ফেলেছে নিজেও বুঝতে পারেনি। এই পছন্দের নাম ভালোবাসা কিনা সেটা নিশ্চিত হতে পারছে না নাবিলা।

কাল বিকেলে প্রয়াস যখন ওর কান্নায় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে তখন থেকেই নাবিলার মনে হচ্ছে ও আকাশে উড়ছে। প্রয়াস ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, নাবিলাপাখি ডেকেছে তা ওর কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। এতো খুশি বোধহয় বিগত কয়েকমাসেও হয়নি। কিন্তু পরক্ষনেই অয়নের কথা মাথায় আসতে চুপসে যেতে হচ্ছে। এই দোটানা থেকে মুক্তি পেতে মাহি এবং তানজিলা কে কনফারেন্স কল দিলো নাবিলা।

মাহি রিসিভ করেই বললো,
‘কি ব্যাপার এই রাতের বেলা অয়ন বিলাতিকে ফোন না দিয়ে আমাদের ফোন দিচ্ছিস কেনো? নাকি ভুলে টুলে চলে এলো?’

‘প্লিজ মাহি! ফাজলামো না করে আমার কথাটা শোন তোরা। খুব বিপদে পড়েছি।’

তানজিলা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো,
‘কি হয়েছে বলতো? মি. অয়ন কি আবার কিছু করতে বলেছে তোকে?’

‘উফফ! না।’

‘তাহলে?’ তানজিলার কন্ঠ।

‘আই থিংক আই অ্যাম ইন লাভ।’

বলেই নাবিলা চোখ বন্ধ করে নিলো। ফোনের ওপাশে বিকট শব্দে চিৎকার দিলো মাহি এবং তানজিলা।

‘হোয়াট? সিরিয়াসলি নাবিলা! তুই বিলাতির প্রেমে পড়েছিস?’

মাহির কথায় নাবিলা এবার বিরক্ত হলো।
‘আমি কি একবারও বলেছি যে আমি বিলাতির প্রেমে পড়েছি। ওনার প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে।’

তানজিলা বললো,
‘ খোলাসা করে বল প্লিজ কে সেই হতভাগা যাকে আকদের আগে মনে ধরলো।’

নাবিলা প্রয়াসের প্রতি ওর সকল অনুভূতির কথা নিঃসংকোচে বললো ওদের কাছে। সব শুনে মাহি কিছুটা আর্তনাদেএ সুরে বললো,

‘না! এটা হতে পারে না। আমি ভেবেছি তোর সাথে যখন প্রয়াস ভাইয়ার কিছু হলোই না তখন আমিই ট্রাই করি। কিন্তু তুইতো আমার উঠতি স্বপ্নটায় ফাটল ধরালি।’

তানজিলা ধমকে বললো,
‘আহ এখন মজা করার সময় নয় মাহি। পরশু আকদ আর তুই এখন নিজের মনের কথা বুঝলি! তোর কথা ঠিক হলে প্রয়াস ভাইয়াও তোকে পছন্দ করে। ‘

নাবিলা কেদে ফেললো।
‘আমি এবার কি করবো। ভাইয়াকে ভালোবেসে মি.অয়নকে বিয়ে করা যে সম্ভব নয়রে।’

‘আচ্ছা শোন। একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে তো অসুবিধা নেই। তুই প্রয়াস ভাইয়াকে নিজের মনের কথা বলে দে। হয়তো তোর পরিবারকে ভালোবাসে বলেই ওরা তোর বিয়ে ঠিক করায় নিজের মনের কথা চেপে গেছেন উনি। তুই যদি মনের কথাটা বলিস ভাইয়া নিশ্চয়ই কোনো উপায় বের করতে পারবে।’
তানজিলা বলতেই মাহিও সহমত পোষণ করলো।

‘কিন্তু ভাইয়ার যদি সত্যি সত্যিই গার্লফ্রেন্ড থেকে থাকে তখন? উনি তো বললো পাত্রী ঠিক করা আছে।’

‘তুই যা যা বলছিস তাতে আমার মনে হচ্ছে ভাইয়া তোকে জেলাস ফিল করানোর জন্যই ছাদে পাত্রী ঠিক করা আছে বলেছে। নাহলে তুই কেদে ফেললে ওভাবে ছুটে আসতো না। ভাইয়া হয়তো তোর পরিবারের কথা ভেবেই নিজের মনের কথা বলতে পারছে না। মনের কথাটা বলে দিলে দেখবি কোনো না কোনো উপায় বের হবেই। আমি আর মাহি কখনোই চাই না তুই মি.অয়নের হাতের পুতুল হয়ে থাকিস।’

________

সারারাত ভেবে নাবিলা ঠিক করে নিলো আজ প্রয়াস ভাইয়াকে সে মনের কথা জানাবেই। সারারাত না ঘুমিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার প্র‍্যাক্টিস ও করে নিয়েছে। নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছে। আজ লেন্স নয় চশমা পড়েছে। মুখে একটু ফেইস পাউডার দিয়েছে। প্রয়াস ন্যাচারাল বিউটি পছন্দ করে তাই আর কোনো প্রসাধনী দিলো না মুখে।

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সবার চোখ ফাকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো নাবিলা। বাহিরে ঝলমলে রোদ উঠেছে। এখনো তা প্রখর হয়নি। রাস্তায় মানুষের কোলাহল এখনো কম। নাবিলার আজ সব কিছুই রঙিন লাগছে। কাকের কা কা ডাকও যেনো বিরক্ত লাগছে না শুনতে।

প্রয়াসের বাড়ির সদর দরজা খোলা। হয়তো শাহেদ আংকেল বেড়িয়ে যাবার পর আর লাগানো হয়নি। প্রয়াস ভাইয়ার বাবা খুব ভোরে অফিসে যান আবার বেশ রাত করে ফেরেন। উনি একজন যান্ত্রিক মানুষ বলা চলে।
ভেতরে ঢুকতেই উচ্ছ্বসিত একটা নারী কন্ঠ এবং একটা পুরুষ কন্ঠ কানে এলো। পুরুষ কন্ঠটা পরিচিত। প্রয়াস ভাইয়ার কন্ঠ। কিন্তু নারী কন্ঠ?

দোতলার সিড়ি পেরোতেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো নাবিলা। প্রয়াসকে জড়িয়ে ধরে আছে একটি মেয়ে। তার কথায় অজস্র খুশি ঝরে পড়ছে। খুশি প্রয়াসও।

‘তোমারতো বিকেলে আসার কথা। আমায় ফোন দিলে না কেনো? আমি রিসিভ করতে যেতাম তোমায়।’ প্রয়াস মেয়েটাকে ছেড়ে বললো।

‘তাহলে কি তোমায় এতো সারপ্রাইজড করতে পারতাম বলো। খুশি হওনি?’

‘খুব খুশি হয়েছি আমি। তোমার অপেক্ষায় ছিলাম এতোদিন।’

‘আমিও। তোমায় খুব মিস করেছি এই কয়দিন। এসেতো একদম ভুলেই বসে আছো। দরকার ছাড়া কথাই বলো না।’

‘মোটেও না। তোমায় ভুলে যাওয়া কি সম্ভব বলো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির কারন তুমি।’

‘এই জন্যই তো তোমায় এতো…’

এর পরের কথাটুকু নাবিলার কর্নগোচর হয়নি। তার আগেই দ্রুত পায়ে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে গেছে। চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রুপাত হচ্ছে ওর। দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো নাবিলা। সায়মা বেগম পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও শুনলো না। মেয়ের এমন অদ্ভুত ব্যবহারে চিন্তিত হয়ে ছুটে এলেন সায়মা বেগম। কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর পর নাবিলা কর্কশ সুরে মাকে চলে যেতে বললো। সায়মা বেগম কিছুটা আহত হলেও মেয়েকে একা থাকতে দিয়ে চলে গেলো।

নাবিলা চশমাটা খুলে ছুড়ে ফেললো। ওর স্বপ্নে দেখা প্রয়াস ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে ফর্সা মেয়েটাই তাহলে সে! তারমানে সত্যিই প্রয়াস ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে। নাবিলার প্রতি তাহলে কোনো অনুভূতি নেই প্রয়াস ভাইয়ার? এইসব ভেবে আরো বিমর্ষতা গ্রাস করলো নাবিলাকে। চোখ বন্ধ করতেই দোতলায় প্রয়াসের রুমের সামনে একটা সুন্দর মেয়েকে জড়িয়ে ধরা প্রয়াসের চেহারা ভেসে উঠছে বারবার।
একজন ভুল মানুষের জন্য অনুভূতি কেনো সৃষ্টি হলো ওর?

সারাদিন দরজা বন্ধ করে ছিলো নাবিলা। শুধু মায়ের ডাকাডাকিতে একবার দরজা খুলে খাবার নিয়েছে। কিন্তু খেতে পারেনি। সায়মা বেগমকে চিন্তিত দেখে নয়নতারা বেগম বললেন হয়তো কাল আকদ হয়ে যাবে বলে মন খারাপ। ওকে একা থাকতে দাও। সায়মা বেগমও তাই আর ঘাটালেন না। পারিবারিক ভাবেই আয়োজন হচ্ছে কালকের জন্য। নয়নতারা বেগম আত্মীয়দের ডাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অয়ন বা নাবিলা কেউ চায়না বিয়েতে পরিবার ছাড়া অন্যকেউ থাকুক।

সারাদিন দেখতে না পেয়ে বিকেলে প্রয়াস এসেছিলো নাবিলার খোঁজে। কিন্তু নাবিলা তবুও দরজা খোলেনি। তাই সায়মা বেগমের কাছে যায় প্রয়াস।

‘মনি নাবিলা দরজা খুলছেনা কেনো? শরীর খারাপ?’

‘সকাল থেকেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। দরকার ছাড়া খোলেনি। আমার সাথেও রাগারাগি করেছে। একটু দেখতো কেনো এমন করছে। যদি তোকে বলে। আমি কয়দিক সামলাবো বল।’

‘আচ্ছা মনি তুমি যাও আমি দেখছি।’

প্রয়াস চিন্তিত মুখে নাবিলার রুমের দরজায় কয়েকবার টোকা দেয়। নাবিলার কোনো প্রতি উত্তর না পেয়ে প্রয়াসের রাগ হয়। এসে থেকে একদিনও নাবিলাকে বিকেলে ঘুমাতে দেখেনি। আর আজতো একবারের জন্যও ওর দেখা পাওয়া যায়নি। সকাল থেকে দরজা বন্ধ মানে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। প্রয়াস এবার কিছুটা রাগ নিয়ে বললো,

‘তুই যদি ভেবে থাকিস দরজা না খুললে আমি চলে যাবো তাহলে ভুল ভাবছিস। হয় দরজা খোল নয়তো ভাঙবো।’

নাবিলা শোয়া থেকে উঠে আস্তে করে উত্তর দিলো,
‘তুমি চলে যাও। আমার কারো সাথে দেখা করতে ভালো লাগছে না।’

‘তুই দরজা খুলবি কি না?’

অগত্যা নাবিলাকে দরজা খুলতেই হলো। প্রয়াস ঘরে ঢুকতেই নাবিলা মাথা নিচু করে নিলো। সকাল থেকে কান্নার ফলে চোখের অবস্থা কেমন তা ও নিজেও জানেনা। প্রয়াস তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নাবিলাকে পর্যবেক্ষণ করে বললো,

‘মুখ তোল।’
নাবিলা একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘মুখ তুলতে বলেছি আমি।’

প্রয়াসের এমন শক্ত কন্ঠে নাবিলাকে মুখ তুলতেই হলো। প্রয়াস অবাক হয়ে দেখলো ওকে। ফোলা চোখ, বিধ্বস্ত মুখে এক শ্যামাঙ্গিনী দাঁড়িয়ে আছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় লাল চোখগুলো যেন ফুটে উঠেছে।

প্রয়াস এক পা ওর দিকে আগোতেই নাবিলা কয়েক পা পেছনে চলে যায়। তা দেখে প্রয়াসের কপালের ভাজ আরো একটু গাঢ় হয়।

‘ কি হয়েছে তোর? এমন অদ্ভুত আচরন করছিস কেনো আজ? আয়নায় একবার দেখ কি অবস্থা করেছিস নিজের।’

‘আমায় নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। কি জন্য এসেছো সেটা বলো।’

‘এমন ব্যবহার করছিস কেনো? কান্না করে চোখ ফুলিয়েছিস কেনো? শরীর খারাপ…’

প্রয়াস নাবিলার কপালে হাত দিতে গেলে নাবিলা আবার পিছিয়ে যায়।
‘ আমি একদম ঠিক আছি। বেশি ঘুমিয়েছি তাই চোখ ফোলা।’

প্রয়াস বুকে হাত গুজে বললো
‘আচ্ছা! হঠাৎ আজ এতো ঘুমের কদর কেনো করছেন আপনি?’

নাবিলা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘কাল আমার বিয়ে তাই আজ একটু বেশি বেশি ঘুমিয়ে নিচ্ছি। এবার বলো কেনো এসেছো?’

‘প্রয়াস কিছুক্ষণ নিরব চাহনিতে দেখে বললো,
‘ বিয়ের জন্য এত তাড়া! আচ্ছা যাইহোক, আমার মেহমান এসেছে কানাডা থেকে তোর সাথে পরিচয় করতে চায়। কিন্তু তুইতো একবারও এলি না আজ।’

‘মেহমান!’

‘হ্যা স্পেশাল মেহমান।’
কথাটা শুনে নাবিলা চোখ বন্ধ করে নিলো।

‘আমার এই মুহূর্তে কারো সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে না। কাল নিয়ে আসবে দেখা করে নিবো। এখন আমায় একটু একা থাকতে দাও প্লিজ!’

প্রয়াস আহত চোখে তাকিয়ে নাবিলার হাত ধরে টেনে খাটে বসালো। নাবিলা হাত পা ছোড়াছুড়ি করলেও ছাড়াতে পারলো না ওকে।

‘চুপ করে বসে থাক এখানে। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি, কথা থাকে। কোনো কারনে খুব কেদেছিস বোঝাই যাচ্ছে। আমাকে না বলতে চাইলে বলিস না। জোর করবো না। তবে ঝোকের বসে কিছু করিস না। কান্না, মন খারাপ করে বসে থাকা কোনো সমাধান হয় না। হয় যে জিনিসটা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিস তা ভুলে যা অথবা তার শেষ দেখে ছাড়।’

নাবিলার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে প্রয়াস আবারও বললো,

‘মনির সাথে নাকি রাগারাগি করেছিস? নিজের একমাত্র মেয়েকে তার অনিচ্ছায় বিয়ে দিতে হচ্ছে বলে তিনি কষ্ট পাচ্ছে। মনির সাথে রাগারাগি করে তার মনের দহন আর বৃদ্ধি করিস না।’

প্রয়াস বেরিয়ে যেতেই নাবিলা শব্দ করে দরজা লাগিয়ে খাটে বসে ফোপাঁতে লাগলো।

‘ মানুষটা এতো কিছু বোঝে অথচ এটা কেনো বোঝে না যে আমি তার জন্যই কষ্ট পাচ্ছি? অন্যের বেলায় জ্ঞানের জাহাজ অথচ নিজে অন্যের মন বোঝে না। বুঝবে কি করে সেতো আরেকজনকে মন দিয়ে বসে আছে। তোমার কথাই নাহয় আরেকবার শুনলাম ভুলে যাবো সবকিছু…সবকিছু।’

কথাগুলো একা একা বিড়বিড় করে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো নাবিলা।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। কারো জন্য কষ্ট পাবে না। প্রয়াস থাকুক তার ভালোবাসা নিয়ে। নাবিলাও অয়নকে বিয়ে করে নেবে। তবে অয়নের পুতুল হয়ে বাচবে না, পাল্লা দিয়ে চলবে অয়নের সাথে।

প্রয়াসের যত্ন, অধিকারবোধকে ভালোবাসা ভেবে শুধুই এক মরিচীকার পেছনে ছুটেছে নাবিলা।ভালোবাসাটা নাহয় অপ্রকাশিতভাবে আবার চাপা পড়ে যাক কিশোরী বয়সের ভালোলাগার মতো। মনের মাঝে আর দ্বিধা দ্বন্দ্ব না থাকুক তাকে নিয়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here