#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৮
মেঘে ঢাকা শহরে সন্ধ্যা নেমেছে সবে। চারিদিকে কৃত্তিম আলোর আনাগোনা শুরু হয়েছে। নাবিলাদের বাড়িতে সবাই ছোটাছুটিতে ব্যাস্ত। একটু পরই অয়নের পরিবার চলে আসবে। এতোকিছুর মাঝে নির্জীব নাবিলা। তানজিলা এবং মাহি অনেক কিছু করেও ওর মন ভালো করতে পারেনি। নাবিলা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও আদতে সেই হাসির প্রান নেই।
প্রয়াসের চিন্তা মাথা থেকে ঝাড়তে সেই বিকেলের পর নাবিলা তার সামনেও যায়নি একবার। এমনকি প্রয়াসও নাবিলার খোঁজ নেয়নি, যেটা নাবিলাকে আরো বেশি ভুগিয়েছে। বিকেলে হালকা মিষ্টি রঙের বেনারসি শাড়িতে সেজেছে নাবিলা। মাহি এবং তানজিলা সাহায্য করেছে সাজতে।
গোমড়া, ছন্নছাড়া মুখটা মেকাপের ছোয়া পেতেই যেন সতেজ হয়ে উঠেছে। নাবিলা আয়নায় তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো, মুখের মেকাপের মতো যদি অন্তরেও মেকাপ দিয়ে সব দুঃখ ঢেকে দেওয়া যেত তাহলে খুব ভালো হতো। পরক্ষনেই ভাবলো, অন্তরের মেকাপ আছে তো! হ্যা আছে। অভিনয়। অন্তরের দহন ঢেকে দিয়ে একজন মানুষকে বাহিরে একদম উৎফুল্ল দেখাতে সাহায্য করে অভিনয়।
রাতে আকদের অনুষ্ঠান হবে বিধায় সন্ধ্যায় অয়নের পরিবার হাজির হয়। অয়ন তখনো আসেনি। একটু পর এসে পড়বে বলে ফোনে জানায়। এর মাঝেই প্রয়াস দুইজন বিদেশি নারী এবং বাচ্চা নিয়ে হাজির হয়। সবাই কৌতুহলী চোখে তাকালে প্রয়াস পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের।
‘মনি তোমার সাথে তো জেসির আগেই পরিচয় করিয়েছি। বাকিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ও হচ্ছে জেসি। আমার বান্ধবী। কানাডায় আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি।’
নাবিলা মুখ তুলে একবার দেখে নিলো। লম্বা মুখ, বাদামি এবং কালো মিশেল চুলের একজন সুন্দরী মেয়ে। দেখতে বিদেশি হলেও স্পষ্ট বাংলা বলতে পারে। নাবিলা মনে মনে ভাবলো,
‘সেদিন সকালের সেই মেয়েটা প্রয়াস ভাইয়ার বান্ধবী! অবশ্য পরিবারের সামনে বান্ধবী বলে পরিচয় দেবে এটাইতো স্বাভাবিক।’
প্রয়াস এবার অপর মহিলার কোল থেকে বাচ্চাটা নিজের কোলে নিয়ে হেসে ইংরেজিতে বললো,
‘তোমার পরিচয় নাহয় তুমি নিজে দাও।’
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো। অতঃপর স্পষ্ট ব্রিটিশ ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিলো,
‘আমি এমিলি। অয়নের বাচ্চার মা।’
নাবিলার দাদি নয়নতারা বেগম ছাড়া বাকি সবার মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটেছে কথাটায়। নয়নতারা বেগম ইংরেজি না জানায় এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না।
অয়নের মা এগিয়ে এসে বললো,
‘কিসব আজেবাজে কথা বলছো তুমি!’
তারপর নাবিলার বাবা তারেক হোসেন এর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনাদের আত্মীয় আমার ছেলের নামে এসব মিথ্যা কেনো বলছে? আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কি?’
তারেক হোসেন প্রয়াসের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। প্রয়াস যথেষ্ট দায়িত্ববান একজন ছেলে। সে কখনোই মজা করে না। তাই তারেক হোসেন কি বলবে বুঝতে পারলো না।
এমিলি অয়নের মায়ের কথা কিছুই বুঝলো না। সে প্রয়াসের দিকে তাকাতেই প্রয়াস মাথা নেড়ে আস্বস্ত করলো।
এমিলি আবার বলতে লাগলো,
‘অয়ন আর আমি একই ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলাম। তবে পরিচয় ছিলো না। পাঁচ বছর আগে এক কমন ফ্রেন্ডের জন্মদিনে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। সেখান থেকেই ভালোবাসা। এবং প্রায় তিন বছর আমরা লিভ ইন রিলেশনশিপে ছিলাম। পারফেক্ট কাপল যাকে বলে আমরা ঠিক তেমনই ছিলাম। এরপর অয়ন আমাকে বললো তার পক্ষে এই সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব নয়।
ওর পরিবার একজন খ্রিস্টান মেয়েকে পুত্রবধূ রুপে মেনে নেবে না উল্টো ওকেও ত্যাজ্যপুত্র করবে। ততদিনে আমাদের ছেলের একবছর হয়েছে। ওর নাম অলিভার। অয়ন বলেছে সে অলিভারের সব দায়িত্ব নেবে, যাবতীয় ব্যয় বহন করবে। কিন্তু আমাদের সাথে থাকবে না এবং আমার সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে সে জড়াতে পারবে না।
এমনিতেও ছেলে হওয়ার পর অয়ন বদলাচ্ছিলো। ওর সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিলো না। তাই অয়ন আমাকে ছেড়ে দেশে চলে আসার পর আমিও মুভ অন করি। নিজের ক্যারিয়ার এবং ছেলেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। অলিভারকে প্রতি মাসেই একটা মোটা অংক পাঠায় অয়ন। কয়েকদিন পর পর ভিডিও কল দিয়ে দুইটা-তিনটা কথা বলে। দ্যাটস ইট।’
এমিলির প্রতিটা কথা বাংলায় বললো প্রয়াস। এতক্ষণে নয়নতারা বেগম সবটা বুঝতে পেরেছে। তিনি ধপ করে সোফায় বসে গেলো। বাকি সবাই এখনো বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। অয়নের পরিবার তখনও দমে যায়নি। নিজের ছেলেকে নির্দোষ প্রমান করতে গলায় জোর এনে অয়নের বাবা জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমার কাছে কি প্রমান আছে?’
প্রয়াস উত্তর দিলো,
‘আছে।’
প্রয়াস এমিলিকে ইশারা করলো হাতের মোবাইলটা অয়নের বাবাকে দিতে। এমিলিও তাই করলো। দিশা আগে ফোনটা নিয়ে ঘেটে দেখলো। অয়নের সাথে এমিলির কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি, বিশেষ করে এমিলি যখন প্রেগন্যান্ট তখনকার দুজনের বেশ কিছু ছবি আছে। তাতে বোঝাই যাচ্ছে অয়ন বাচ্চাটা নিয়ে এক্সাইটেড। অলিভারকে কোলে নিয়ে আদর করারও বেশ কিছু ভিডিও রয়েছে। এছাড়া ভিডিও চ্যাট, মাসে মাসে টাকা পাঠনো, দেশ বিদেশে ঘুরতে যাওয়াসহ সব প্রমানই মোবাইলে করে রয়েছে।
দিশাকে হতাশ হতে দেখে অয়নের বাবা-মা যা বোঝার বুঝে গেলো। নাবিলা ফোনটা নিয়ে সব ঘেটে দেখলো। ওর খুশি হওয়া উচিৎ নাকি কষ্ট পাওয়া উচিৎ বুঝতে পারলো না। তবে এই মুহূর্তে অয়নকে সামনে পেলে কয়েকটা চড় নিশ্চয়ই বসিয়ে দিতো। প্রমানগুলো দেখলো বসার ঘরে উপস্থিত দুই পরিবারের সবাই। তারেক হোসেন প্রয়াসকে জিজ্ঞেস করলো,
‘এতোসব তুই জানলি কি করে?’
প্রয়াস একটু হেসে অলিভারকে কোল থেকে নামালো। এতো অপরিচিত মুখ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে সে। গুটিগুটি পায়ে এমিলির কাছে গিয়ে দাড়ালো অলিভার।
প্রয়াস জেসিকে দেখিয়ে বললো,
‘ওর মাধ্যমে জেনেছি কাকাই।’
‘কিভাবে? তোমরাতো কানাডায় থাকতে আর এমিলি লন্ডনে। তাহলে?’
‘কানাডা থেকে তিনমাস আগে বন্ধুদের সাথে লন্ডন গিয়েছিলাম ছুটি কাটাতে। সেখানে জেসির বড় বোন জিমি থাকে। আমরা লন্ডনে এক দুপুরে তার বাড়িতে দাওয়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে জিমি আপুর লিভিং স্পেসের দেওয়ালে বেশ কিছু ফটোফ্রেম ছিলো। যার মধ্যে একটাতে আমার নজর আটকে যায়। এমিলি, জিমি এবং অয়নের একটা ফটো। সম্ভবত এমিলির বেবি শাওয়ারে তোলা ছিলো ওটা। এমিলিকে না চিনলেও অয়নের ছবি মনির থেকে আগেই দেখেছিলাম।
জিমি আপুকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি সব বলে দিলেন। জিমি আপুর সাথে এমিলির বেশ ভালো সম্পর্ক হওয়ায় জিমি আপু ওদের ব্যাপারে সব জানতো। অয়নের ব্যাপারে খোজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হলাম যে এমিলির সাথে ওটা অয়নই ছিলো। তারপরই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এলাম হাটে হাড়ি ভাঙতে। আরো আগেই সব ফাস করতে পারতাম। কিন্তু আমি এমিলিকে সামনে রেখেই প্রমানসহ সব জানাতে চেয়েছি। জেসি পরশু দেশে এসেছে আর এমিলি আজ দুপুরের পর ল্যান্ড করেছে। তাই দেরি হয়ে গেলো।’
অয়নের বাবাও ভীষণ ক্ষেপে গেছেন ছেলের প্রতি। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে ছেলে যে এতোটা নিচে নামবে তা তিনি ভাবতেই পারছেন না। রেগেই ঘড়ি দেখে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,
‘তোমার ছেলে এখনো আসছে না কেনো? আজ এর বিহিত করেই ফিরবো।’
উত্তরটা প্রয়াস দিলো,
‘আপনার ছেলে আসবে না আঙ্কেল। সে কোনোভাবে জেনে গেছে এমিলি এখানে এসেছে। এবং তাকে আমি এনেছি সেটাও। কিছুক্ষণ আগেই আমার ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। সেখানে অয়ন স্পষ্টই বলেছে, কাজটা ভালো করলে না।’
ছেলের এহেন অধঃপতনে, অপমানে, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে অয়নের পরিবারের। দিশা অলিভারের দিকে তাকালো। একদম অয়নের মতোই চোখমুখ। পিটপিট করে সবাইকে দেখছে।
দিশা এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরতে চাইলে অলিভার মায়ের পেছনে চলে গেলো। সে প্রয়াস এবং মাকে ছাড়া সবাইকে ভয় পাচ্ছে।
ঘটনার আকস্মিকতা মেনে নিতে পারেননি নয়নতারা বেগম। আদরের নাতনিকে সর্বোচ্চ সুখী করতে গিয়ে তার বিপদই ডেকে এনেছিলেন।
নাবিলার জন্য তিনি সারাদিন চিন্তা করে। নাবিলা হালকা শ্যাম বর্ণের হওয়াতে নয়নতারা বেগমের মনে হালকা সংশয় আছে। তার ওপর চশমা পড়তে হয়। কোনোদিন যেনো এইসকল দিক নিয়ে কেউ নাবিলাকে হেয় করতে না পারে তাই তিনি ভাবতেন অয়নের মতো একজন পেলে এবং তার কথায় চললে নাতনি সামাজিক, সাংসারিক সব দিকে এগিয়ে থাকবে। মানুষ খোটা দেওয়ার সুযোগ পাবে না।
কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি নাবিলার মন বুঝতেই ভূলে গিয়েছেন। মেয়েটার ওপর সব চাপিয়ে দিয়েছেন। অথচ ছোটবেলায় দাদিই ছিলো নাবিলার সবথেকে ভালোবাসার মানুষ। তার মতো করে নাতনিকে কেউ বুঝতে পারতো না। স্বামীর শেষ ইচ্ছা লালন করে, সমাজ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কবে যে নাতনির সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে বুঝতেই পারলেন না।
তারেক হোসেনেরও অপরাধবোধ হচ্ছে। ব্যাবসায়ীক বন্ধু বলে তার ছেলে সম্পর্কে খোজ খবর নিতে গাফিলতি করেছেন তিনি। যার ফল এখন হারে হারে টের পাচ্ছেন। বাবার ইচ্ছা এবং নিজেদের বন্ধুত্ব আত্মীয়তায় রূপ দিতে মেয়েটার মতামতকেও অগ্রাহ্য করেছেন। মেয়ের চোখের দিকে তাকাবে কিভাবে সেই মরমে মরে যাচ্ছেন তিনি।
‘দাদি!’
হঠাৎ করেই নাবিলা চিৎকার করে উঠলো। ছুটে দাদির কাছে বসলো। নয়নতারা বেগম বুকের বা দিকে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে পরছেন। একের পর এক ঘটনার আকস্মিকতায় নাবিলার পরিবারের সবাই দিশেহারা হয়ে পড়লো। নাবিলা ভয়ে কেদে ফেলেছে। প্রয়াস ছুটে এসে নয়নতারা বেগমকে কোলে তুলে নিতে নিতে নাবিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘কান্নার সময় নয় এখন। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। অ্যাম্বুল্যান্সে ফোন দিয়ে আনতে অনেক সময় চলে যাবে। তার থেকে আমার গাড়িতে নিয়ে যাই। চল আমার সাথে।’
নাবিলাসহ ওর পুরো পরিবার প্রয়াসের পেছনে ছুটলো। উদ্দেশ্য হাসপাতাল।
চলবে…