এখানে আকাশটা ভালোবাসার পর্ব ১৬

#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ১৬
রাহাত দরজা ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে…
“সানজানা বাবু দরজা খোল প্লিজ, বল তোর কি হয়েছে?”
কোনো উত্তর দিচ্ছে না সানজানা।
“মা কি হয়েছে বল?”
তানিয়া এবারে কেঁদেই ফেললেন মেয়ের জন্য।
“সানজানা বাবু… তোর কি চাই বল আমাকে! তাই দিব তোকে… দরজা খোল”
এভাবে দরজার লক খুলে সানজানা আবার নতমুখে বসে পড়ে খাটের উপর।
তার মুখ দেখে কেমন যেন বিভ্রান্ত লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে নিজের সাথে যুদ্ধ করছে সে।
রাহাতের খুব ভয় হচ্ছে বোনের দিকে তাকিয়ে। কি হলো তার আদরের বোনটার! আবার প্রশ্ন করে সে,
“সানজানা তুই কিছু বলছিস না কেন?”
সানজানা তার মায়ের দিকে তাকাল একবার।
এটা দেখে রাহাত তার মাকে যেতে বলল সেখান থেকে। সানজানার মা তানিয়া চলে গেলে রাহাত আবার প্রশ্ন করে,
“কি রে সানজানা কি হয়েছে?”
“ভাইয়া….!”
ওর উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি দেখে ভয় হয় রাহাতের।
“কি হয়েছে রে তোর?”
“ভাইয়া….. ভাইয়া আমি এখন কি করব!”
“কি হয়েছে?”
“আমি……. আমি একটা ছেলেকে ভালবাসি ভাইয়া”
রাহাত সানজানার কথাতে বেশ অবাক হয়। সানজানা কাউকে ভালবাসে!
তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “তাতে কি? তুই যাকেই ভালবাসবি তার সাথেই তোর বিয়ে হবে। তোর পছন্দের উপর আমাদের বিশ্বাস আছে বুড়ি। কিন্তু তুই এটা নিয়ে এমন করছিস কেন?”
“ভাইয়া ও আমাকে ঠকিয়েছে”
“কিহ! তোকে ঠকাবে! কার এত সাহস”
রাহাত ভাবতেই পারে না তার বোনকে কেউ ঠকাবে!
ধীরে ধীরে সানজানা বলে,
“ভাইয়া ও আমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য কি না করেছে এখন আর কথা বলতে চায় না, আমাকে অবজ্ঞা করে, যেটা ওর স্বভাবের একেবারেই বাইরে।আমাকে নাকি ওর এখন ভাল লাগে না, অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলে ও, ভাইয়া আমি রায়ানকে ভালবাসি। জানিনা রায়ান কেন এমন করছে। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
রাগে রাহাতের মাথায় রক্ত উঠে গেল।
“কই নাম্বার দে তো রায়ানের।”
সানজানা নিজের ফোন থেকেই কয়েকবার কল করল রায়ানকে। শেষবার কল ডিস্কানেক্ট করল রায়ান। তারপর মেসেজ আসে,
“কেন জ্বালাচ্ছিস আমাকে! তোকে আমার ভালো লাগে না, বুঝিস না তুই, তোর জ্ঞান নেই?”
রাগে রায়ানের মাথা উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।
বোনকে কি বলবে বুঝতে পারছে না সে।
সানজানা আবার রায়ান কে মেসেজ দেয়,
“কাল প্লিজ দেখা করো, প্লিজ, আর কিছুই চাইনা”
এবার রাজি হয় রায়ান।
কাল রায়ানের সাথে দেখা করতে যাবে রাহাত আর সানজানা।
.
রিদিমা আর সায়ান আজ অফিসে যাবে। রিদিমার বেশ ভালো লাগছে নতুন একটা জীবন। তার চেয়ে ভাল লাগছে আজ অফিসে যাবে তাই। নিজের ক্যারিয়ারের সাথে কোনো কিছুতেই আপস করতে চায় না সে।
একসাথে অফিস যেতে যেতে সায়ান বলে
“রিদিমা?”
“বলো….”
“অনিক আসলো না কেন? ওকে নিতে পাঠাতেও দিলে না, ওর তো তোমাকে প্রয়োজন। আজ মা ফেরার পথে ওকে নিয়ে যেতে বলেছে। একসাথে গিয়েই নিয়ে আসব ”
রিদিমার ছেলের জন্য এদের মাথা ব্যথা দেখলে গা জ্বলে যায় রিদিমার। প্রকাশ করে না সে। ভাবছে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবে নাকি উত্তর দেবে।
শুনলে সায়ান কি রিএক্ট করবে! বুঝতে পারছে না রিদিমা।
রিদিমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে সায়ান বলে,
“তুমি কি বিব্রত হচ্ছ?”
“না সায়ান আসলে একটা কথা বলব… কিছু মনে করবে না তো???”
“আরে না না… বলো না…”
“সায়ান অনিককে অনিকের বাবা নিয়ে গেছে”
“মানে!!!” প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল সায়ান
.
বিকালে সানজানাকে নিয়ে বের হলো রাহাত।
সানজানার দিকে তাকাতে পারছে না সে, খুব খারাপ লাগছে। কাল সারাটা রাত তার ঘুম হয়নি ভালভাবে। বোনকে খুব ভালবাসে রাহাত।
কাছাকাছি এসে সানজানা বলল,
“ভাইয়া আমার এক বান্ধবী ফোন করেছে, তুমি যাও আমি আসছি”
“আচ্ছা, তোর দেরি হবে?”
“না ভাইয়া, দুই মিনিট”
“ওকে আয়”
সানজানা ফোনে কথা বলতে থাকে।
“ইতু তুমি এখানে?”
“রাহাত আমি তোমাকে ভালবাসি প্লিজ এমন করোনা, কি দোষ আমার?”
“তুই থামবি! তোর প্যানপ্যানানি শুনতে আমি আসিনি”
ইতুর চোখের অশ্রু আর বাঁধা মানে না।
“কি ভাইয়া? কে মেয়েটা? আর কাঁদছে কেন?”
সানজানার প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় রাহাত।
প্রচন্ড রাগ হয় ইতুর উপর৷ সানজানার সামনে কেন আসলো। আর ইতু কি করে জানে তারা এখানে!
উফ!!! মনে মনে বিরক্ত হয় ইতুর উপর।
“আরে না কিছু না সানজানা, আমার পরিচিত একজন, রায়ান কোথায়?”
“ও আচ্ছা। রায়ান মনে হয় একটু পরে আসবে, আচ্ছা ভাইয়া রায়ান কে তুমি কি বলবে?”
“বুঝাবো যে ও যেটা করছে সেটা ভুল”
“যদি না শুনে?”
“মার খাবে আমার কাছে! আমার বোনকে ঠকানো!” হাত মুঠো করে বলে সায়ান।
“আচ্ছা ভাইয়া বসি আমরা?”
একপ্রকার বাধ্য হয়ে ইতুকে যেতে বলতে পারে না রাহাত।
কিছুক্ষণ পর রায়ান আসে সেখানে।
রায়ানকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে রাহাতের, কোথায় যেন দেখেছে। এই মূহুর্তে মনে করতে পারছে না।
রায়ানকে অনেক বুঝানোর পরেও রায়ান কোনো পজেটিভ উত্তর দেয় না।
রায়ান বলে,
“ভাইয়া সানজানা কে আমার ভাল লাগে না। বাদ দেন তো!”
নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে না রাহাত,
“কি বললি তুই?”
“যেমনটা তুমি ইতুকে বলেছ ভাইয়া” পাশ থেকে বলে সানজানা।
রাহাত থ হয়ে যায় বোনের কথায়। তার বোন এমন করে বলবে সেটা তার কল্পনাতীত।
“রায়ান তুমি বাসায় যাও পরে তোমার সাথে ভাইয়ার পরিচয় করিয়ে দিবো, আর ইতু তুমিও”
“আচ্ছা” বলে রায়ান উঠলে, হঠাৎ মনে পড়ায় সানজানা বলে,
“রায়ান ইতুকে একটু পৌঁছে দিও, মেয়েটা অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। পথে কোনো সমস্যা না হয়… তুমি একটু যাও”
“চল ইতু” ইতুকে নিয়ে চলে যায় রায়ান।ইচ্ছে করেই দুজনকে পাঠিয়ে দেয় সানজানা। কারোর সামনে নিজের ভাইকে অপদস্থ করতে চায় না সে। হয়ত ভাই ভুল করছে, সে বুঝালে অবশ্যই ঠিক হবে। সে বিশ্বাস আছে সানজানার।
ভাইয়ের দিকে কিছু বলার উদ্দেশ্য তাকায় সে।
“ভাইয়া?”
“বল সানজানা”, রাহাত কিছুটা অসহায় ধরা পড়ে যাওয়া চাহনিতে তাকায় বোনের দিকে।
“ভাইয়া এই সময়ে এসে মানুষ ভালবাসা চেয়েও পায় না, আর তুমি পেয়েও পায়ে ঠেলছ! এই দুঃসাহস তোমার মনে আসলো কি করে ভাইয়া?”
“কি বলতে চাইছিস?”
“ভাইয়া তুমি জানো আমি কি বলতে চাইছি, আমি তোমার ছোট, তারপরেও বলছি। ভাইয়া যা তোমার পছন্দ নয় সেটা পাওয়ার জন্য আকুল হওয়ার আগে তোমার ভাবা উচিত ছিল যে তুমি সেটা পছন্দ করো না। খাঁটি সোনা পাওয়ার পরেও তুমি নকল সোনা চাইছ!”
একটু থেমে সানজানা আবার বলে,
“ইতুর সাথে তুমি এমন করলে কেন?”
“তোকে ইতু এসব বলেছে?” রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে রাহাতের।
“হ্যাঁ ইতু বলেছে তো? আজ তুমি অন্যের বোনকে ঠকাতে পারছ আর তোমার বোনকে কেউ ঠকানোর কথা ভাবলেও তোমার মাথায় রক্ত উঠে যায়।
তোমার বোন, তোমার আদরের বোন হয়, আর কারোর বোন আদরের বোন না??????”
সানজানা তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ভাইয়ের দিকে।
রাহাতের মুখে এই প্রশ্নের উত্তর যোগাচ্ছে না। এইতো কিছুক্ষণ আগেই তার রায়ানের উপর কত্ত রাগ ছিল, কিন্তু অপরাধ তো সেও কম করেনি।
“ভাইয়া দেখো, আমাদের সমাজটা আমাদের, আমরা কেন এই সমাজকে কলুষিত করব, তুমি শুধু কেন কারোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে! ইতু তো খারাপ না ভাইয়া।”
সানজানা বলে যেতে থাকে,
“একসময় তুমি বাবা হবে, ভাবো তো তোমার মেয়ের সাথে কেউ এমন করলে তোমার কেমন লাগবে?”
“থাম সানজানা থাম!”
“ভাইয়া তোমার খারাপ লাগছে তাই না? বুঝো তো ইতু কতটা কষ্ট সহ্য করেছে? ও আমার কাছে মানসম্মানের কথা না ভেবে এসেছে, তোমাকে নিয়ে খারাপ কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে ও ঠিক হয়ে যাবে। ভাইয়া আমি তোমার সম্পর্কে জানিনা তা কিন্তু নয়। আমি ভেবেছিলাম বলব কিন্তু বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠেনি।”
বোনের কথাগুলো চুপচাপ শুনে যায় রাহাত। আসলেই তো তার কি মন বলতে কিছু আছে! থাকলে কি আর সে এমন করতে পারে! ইতু তো ভাল মেয়ে তবে!!!
প্রচন্ডরকম অনুশোচনা জাগে রাহাতের মনে।
হঠাৎ রাহাতের ফোনে মেসেজ আসে,
“রাহাত ভালবাসি তোমাকে” মেসেজটা ইতুর।
“ভাইয়া, এখনো সময় আছে, এমনটা করো না, দেখো আমি তোমাকে এগুলো বাবা মা, ইতু বা রায়ানের সামনে বলতে পারতাম কিন্তু আমি বলিনি। আমার বিশ্বাস তুমি বুঝবে”
“সানজানা বাসায় চল”
সানজানা আর দ্বিরুক্তি করে না।
“চলো”
.
“মানে কি রিদিমা, তুমি যে বললে অনিকের বাবা অনিকের খোঁজ নেয়না। তাহলে অনিক কিভাবে…কি…”
রিদিমা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে বলল,
“আসলে সায়ান আমার বিয়ের কথা শুনে অনিকের বাবা জোর করে অনিককে নিয়ে গেছে”
“জোর করে মানে!!” সায়ান অবাক হয়ে যায় রিদিমার কথাতে।
“সায়ান ছাড়ো তো এসব কথা”
জাহরার প্রশ্নেও এই উত্তর গুলো দিয়েই কথা এড়িয়ে যায় রিদিমা।
জাহরা অবাক হয়ে যান যে ছেলের কথা রিদিমা বলতেই চাইছে না। তিনিও আর কিছু বললেন না।
.
বাসায় এসে রাহাতের প্রচন্ডরকম অপরাধবোধ জাগছে। সে এসব কেন করল! সারাটা রাত সে ঘুমাতে পারেনি। ইতুকে ভালোবেসে ফেলেছে এই অনুশোচনা থেকে।
তার মনে হয়েছে ইতুই খাঁটি, আর ইতুকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। তার ইতুকে চাই। আর কিছু না।
সকাল হতেই ইতুকে ফোন দেয় রাহাত।
ইতু ফোন তুলছে না। এমনটা কখনো হয়নি।
দশবারের বার ইতু রিসিভ করলো,
“বলো রাহাত” ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলল ইতু।
ইতুর কন্ঠ শুনে ভয় লাগছে রাহাতের। নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত সে। কিন্তু যখন থেকে ইতুর প্রতি ভালবাসা কাজ করছে তখন থেকেই ভালবাসার সাথে হারানোর ভয়টাও কাজ করছে।
“ইতু আমাকে ক্ষমা করো”
“কিসের ক্ষমা রাহাত?”
“মানে?”
“মানে তুমি জানোনা? আমার ভালবাসাকে পায়ে ঠেলেছ তুমি! কি চাও তুমি!”
“ইতু! আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, প্লিজ, ইতু আই লাভ ইউ, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো”
“রাহাত কখনো ফোন দেবে না আমাকে। ভালো লাগে না আমার তোমাকে! প্লিজ!!!!”
“ইতু!!!”
“আল্লাহ হাফেজ”…
ফোন কেটে দেয় ইতু।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না রাহাত!
মূহুর্তের মাঝে কেঁদে ফেলে সে। ভালবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনা রাহাত জানেনা। বোঝেনি কখনো।
টলতে টলতে সানজানার ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে…!
.

.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here