এখানে আকাশটা ভালোবাসার পর্ব ১৫

#এখানে_আকাশটা_ভালোবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ১৫
.
মত-অমতের বাঁধা ঠেলে আজ বিয়ের পিঁড়িতে সায়ান রিদিমা।
খুব সুন্দর লাগছে আজ রিদিমাকে। সায়ান চোখ ফেরাতেই পারছে না। বিয়েতে অনিক আসেনি। না আসাটাই ভালো। তবে পরে অনিককে নিয়ে আসবে রিদিমার বাবা। রিদিমার কাছে কিছুদিন থাকবে অনিক। আপাতত এমনটাই কথা হয়েছে।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাড়ির বড় বৌমাকে নিজের হাতে ঘরে তোলার জন্য বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছেন জাহরা।
রিদিমা সায়ান গাড়ি থেকে নামতেই নিজের হাত থেকে একটা মোটা বালা পরিয়ে দিয়ে বললেন,
“মা শাশুড়ি এই জোড়া আমাকে দিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়িতে যেদিন প্রথম পা দিয়েছিলাম, তারই একটা তোমাকে দিলাম, আর একটা রায়ানের বউ এর জন্য রইল”
“জ্বি মা, নতমুখে রইল রিদিমা”
রিদিমাকে হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“দেখ মা, আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে এই বাড়ির বউ, বড় বউ। বাড়ির সবাই তোমার আপনজন। তোমার ভাইবোনদের যত্নের ভার তোমার রইল মা”
“জ্বি মা” মৃদুস্বরে জবাব দিল রিদিমা।
“নিশিকা, নওশি, রুশু যা তোদের ভাবিকে ঘরে নিয়ে যা” জাহরা মেয়েদের ডাক দিলেন।
“বড়মা!”
সাহরাফ সাহেব এগিয়ে এলেন ছেলে বউয়ের দিকে।
“তোমাদের বউ শ্বাশুড়িতে ভাগ বসায়নি বলে কি আমার জন্য একটু সময়ও দেবে না নাকি? আগেই যে মেয়েদের ডাকছ!”
সকৌতুকে স্ত্রীকে বললেন সাহরাফ।
“বেশ আমি ভাগ বসাব না তোমাদের বউ শ্বশুর মাঝে”
হাসি হাসি মুখে কপট রাগ দেখালেন জাহরা।
কান্ড দেখে সবাই মিটিমিটি হাসতে লাগল।
“আজ থেকে তুমি আমার বড়মা, জানো তো আমার বাবা তোমার শাশুড়িকে বড় মা বলেই ডাকতেন, আমিও তোমাকে ডাকব, তাতে আমার বড়মার রাগ হবে না তো?”
“না বাবা, আমি বরং খুশিই হবো”
“আচ্ছা বড়মা তুমি যাও রেস্ট নাও, অনেক ক্লান্ত…. নিশিকা যা তো মা তোদের ভাবিকে নিয়ে যা”
নিশিকা নওশি আর রোশনি নিয়ে গেল রিদিমাকে।
বাসরঘরে ভাবিকে বসে আছে রিদিমা।
বড্ড ক্লান্ত সে। সায়ানের অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে গহনা খুলে শাড়ি চেঞ্জ করে এসে খাটে বসে।
হঠাৎ লাইট অফ হয়ে যায়!
রিদিমা একটু শব্দ করে ভয়ে। কিন্তু পরপরই মিউজিক লাইট জ্বলে উঠে, ঝিকিমিকি আলোতে সায়ানকে দেখতে পায় রিদিমা।
সায়ান রিদিমাকে বউসাজে দেখবে আশা করেছিল কিন্তু রিদিমার সাধারণ সাজ দেখে একটু মনক্ষুণ্ণ হয়।
“তুমি বউ সাজে নেই যে!”
“তুমিই তো আসতে দেরি করছিলে!”
“এসবের ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা দেখতে দেরি হলো… তাই বলে…”
রিদিমা তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বলে,
“আরে তোমার জন্য আমি হাজারবার বউ সাজতে রাজি”
তারপর রিদিমা এগিয়ে আসে…
সায়ানের একদম কাছে এসে হাত ধরে।
তারপর চোখে চোখ রেখে বলে,
“অনেক ভালবাসি সায়ান”
রিদিমা সায়ানকে কতটা ভালোবাসে তার পরিমাপকাঠি সায়ানের কাছে ছিল না। কিন্তু সায়ান সত্যসত্যই রিদিমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো, নইলে হয়তো নওশির সাথে রিদিমাকে নিয়ে খারাপ ব্যবহার সায়ান কখনোই আসতো না।
আজ এই চোখের চাহনি এড়িয়ে রাগ বা অভিমান করার ক্ষমতা সায়ানের ছিল না।
“রিদিমা আমিও অনেক ভালবাসি তোমাকে। রিদিমা আজ এই দিনটা অক্ষয় হয়ে থাকুক আমাদের জীবনে”
“হুম সায়ান”
পরম ভালবাসায় রিদিমাকে বুকে টেনে নেয় সায়ান।
রিদিমা আসলেই ভাগ্যবতী।
সায়ানের ভালবাসাতে কোনো কার্পণ্য ছিল না, না ছিল কোনো স্বার্থ। ছিল শুধুই নিখাদ ভালবাসা।
যেটা চেয়েও অনেকে পায় না।
“এই সায়ান…” ঘোর লাগা কণ্ঠে ডাকে রিদিমা
“অনেক ভালোবাসি তোমাকে রিদিমা”
“আমিও”
ভালোবাসার পৃথিবীতে ডুবে যায় সায়ান আর রিদিমা।
.
“কি ভাবছ জাহরা?”
“জানিনা কি ভাবছি, ছেলের বিয়ে দিয়েই চিন্তা হচ্ছে, আমাদের কাল তো গিয়েছেই”
“ভেবো না শুধু শুধু, যা হওয়ার তা হবেই”
“হুম সেটাই, অনিককে আমাদের সাথে থাকতে দিলেই ভালো হত”
“আমিও তো তাই ভাবছি কিন্তু রিদিমার বাবা মা রাজি হলো না যে”
“হুম সেটাই”
জাহরা খাতুনের মনে আজ হাজারো ভাবনার উদয় হচ্ছে। কি হবে ভবিষ্যতে। নিজের মনকে শান্ত করতে না পেরে উঠে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন তিনি।
.
“দেখো রাহাত আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, তুমি এমন করতে পারো না”
“আরে ধূর! ভালবাসা! ন্যাকা কান্না কাঁদবে না”
“তুমি তো এমন ছিলে না রাহাত, আমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য পাগল ছিলে তুমি! আর আজ কি কারণে তুমি এমন বলছ!!”
“ইতু আমার এখন ভাল লাগে না তোমাকে!”
“রাহাত! এসব কি বলছ তুমি? ভালবাস না আমাকে তুমি!”
“না না না, বাসি না ভাল তোমাকে!”
“কিহ!”
“শুনতেই তো পেলে ইতু আমি কি বলেছি”
“এমন টা হতে পারে না রাহাত”
“আরে ধূর, তুই থামবি, দূরে গিয়ে মর, কখন থেকে বলছি প্যানপ্যানানি থামা! যাহ!”
ইতু নির্বাক হয়ে যায় রাহাতের ভাষা দেখে। এই রাহাতই তার ভালবাসা পাওয়ার জন্য পাগল ছিল! আর আজ…!
সত্যিকারের ভালবাসার কোনো মূল্য নেই? শেষ পর্যন্ত এটাই হবে তার সাথে?
সে যে রাহাতকে সত্যিই ভালোবাসে।
দুচোখে অশ্রুর বন্যা বয়ে যায় ইতুর।
রাহাত ফোন কেটে দিয়েছে অনেক আগেই। নিজেকে কিছুটা সামলে রাহাত কে কল করতেই ওয়েটিং পায় ইতু। সব পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে।
কিন্তু সে রাহাতকে ছাড়া থাকতে পারবে না, কিছুতেই না, রাহাত শুধুই তার। শুধুমাত্র তার।
আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে ইতু!
.
আজ রিসিপশনের আনুষ্ঠানিকতা বেশ ভালোভাবেই শেষ হয়েছে গতকাল।
বিয়ের পাঁচ দিন হতে চলল কিন্তু অনেক বার অনিকের খোঁজ করা হলেও একবারের জন্যও অনিককে নিয়ে আসা হয়ন, বেশ অবাক হয়েছে নওশি৷ কিন্তু জানতে চাওয়ার সাহস পায়নি। পরে মায়ের থেকে জেনেছে এমনিই নাকি অনিক আসেনি।
বিষয়টা কেমন লাগলে চুপ করে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করল নওশি।
রায়ান এটা নিয়ে একবার প্রশ্ন করেছিল নওশিকে। কিন্তু নওশি জানেনা বলে দিয়েছে।
আসলে নওশির সাথে সায়ানের সেদিনের ব্যবহারের পর থেকে রিদিমা বিষয়ক কোনো কথাতে নওশি আর রায়ান আগ্রহ কম দেখায়।
“আমাদের অফিস কবে থেকে সায়ান?”
“বাব্বাহ আমার বউ অফিস অফিস করে পাগল হয়ে গেল তো!”
“আরে না এমনি”
“তুমি আর কষ্ট করে অফিস করতে যাবে কেন? তোমার যা প্রয়োজন তাইই পাবে, তাহলে…”
“না সায়ান এমন কোনো কথা নয়। আমি আমার ক্যারিয়ার গড়তে চাই, প্লিজ!”
“আরে ওকে ওকে, আমি এমনিই বলছিলাম, তুমি যেহেতু চাইছ সমস্যা নেই, তোমার ইচ্ছেতেই সব হবে”
“সত্যি বলছ?”
“হুম আমার বউটা…”
“ভালবাসি সায়ান অনেক অনেক অনেক”
“আমিও অনেএএএএএএক ভালবাসি রিদিমা”
.
“আপু…”
একটা মেয়ের ডাক শুনে পিছনে তাকায় সানজানা।
মেয়েটাকে সে চিনে মনে হচ্ছে, হুম,,,,,,তার ভাইয়ের মোবাইলে মেয়েটার ছবি দেখেছে। নাম অবশ্য জানেনা। কিন্তু মেয়েটার বিধ্বস্ত অবস্থা… কেমন যেন টলেটলে হাঁটছে। উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ।
“জ্বি, আমাকে বলছ?”
“জ্বি আপু, আপু আমি ইতু, ইভানা ইতু। আপু আপনার সাথে একটু কথা ছিল।”
“বলো..”
“আপু এখানে না প্লিজ, কোথাও গিয়ে বসি?”
“আচ্ছা চলো”
ইতুর মুখে নিজের ভাইয়ের সম্পর্কে শুনতে থাকে সানজানা।
সানজানা নিজের ভাইয়ের সম্পর্কে জানেনা তা নয়। অনেক বার ভাইকে বুঝাতে গিয়েছে৷ পরিস্থিতি পাইনি। তার উপর বড় ভাই। কিন্তু আর চুপ করে থাকা যায় না!
“আপু আমি রাহাত কে ছাড়া থাকতে পারব না আপু” বলেই আবার কেঁদে ফেলে ইতু।
“কান্না থামাও ইতু… শক্ত হও, আচ্ছা ইতু তুমি আমার ভাইকে বিয়ে করতে পারবে? তোমাকে এভাবে ধোঁকা দিচ্ছে তাও?”
“আপু ভালবাসি আমি ওকে, জানি ও আজ ভুল করছে কিন্তু ও বুঝবে আপু”
ইতুর ভালবাসার গভীরতা বুঝতে পারে সানজানা।
“বেশ আমি দেখছি কি করা যায়”
“প্লিজ আপু”
“আমার ভাবি হচ্ছো তবে?”
লজ্জায় মাথা নিচু করে ইতু।
“মাথা নিচু করলে হবে না, কথা দাও”
“ঠিক আছে আপু, আল্লাহ চাইলে”
“ভাবি কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে, আর বাড়ির ভার আমার উপর ছেড়ে দাও, আর ভাইয়াকেও আমি দেখছি.. টেনশন করো না, ঠিক আছে?”
“হুম আপু ঠিক আছে”
“গুড গার্ল। যাও এবারে বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করো, রেস্ট নাও ঘুমাও। চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। যাও ভালো মেয়ের মতো কথা শুনো, নইলে কিন্তু… আর তোমার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যাও”
“ঠিক আছে আপু”
“আর তোমার সম্পর্কে আমি তো এক প্রকার কিছুই জানিনা, রাতে ফোন দিয়ে সব জেনে নেব, কেমন?”
“ঠিক আছে”
“হুম এবার সোজা বাসায়…”
“আচ্ছা আপু”
উঠে দাঁড়ায় ইতু।
সানজানার কথায় ভরসা পেয়েছে সে, মোবাইল নাম্বার দিয়ে চলে যায় ইতু। তার কেন জানি মনে হচ্ছে রাহাত ফিরবে।
সানজানা ফেরাতে পারবে।
রাহাতকে খুব খুব ভালবাসে ইতু, খুব, নইলে আজ তার বোনের কাছে গিয়ে অনুরোধ করত না।
“রায়ান তোর সাথে কিছু ইমপর্ট্যান্ট কথা আছে, সময় আছে তোর এখন?”
ইতু চলে যাওয়ার পর রায়ানকে কল করে সানজানা।
“হুম সানজু তোর জন্য আমার সময়ের অভাব হবে না, নে বল কি হয়েছে?”
রায়ানের সাথে কথা বলার পর চোখমুখ ছলছল করে বাসায় ফেরে সানজানা…
বাসায় ফিরে সোজা নিজের রুমের দরজা খুব জোরে বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে…!
ছুটে আসে সবাই…!
কিন্তু সানজানা কিছুতেই দরজা খুলছে না…!
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here